এই উত্তরদেশ, এই জোড়া মহিষের দেশ (তৃতীয় পর্ব)

৭.

দূরের পৃথিবীতে তখন রোদের বিস্তার অনেকটা জায়মান বিস্তারের মতন।সেই রোদে ভেসে যাওয়া চরের ভেতর কি বিপুল এক শূন্যতা খেলা করে!

শুন্যতার মধ্য দিয়ে ছুটে আসে আবহমান কাল ছুঁয়ে থাকা সেই জোড়া মহিষ। মিথ আর উপকথার গন্ধ লেগে থাকে তাদের শরীরময়। মহিষের শান্ত চোখের মায়ায় বুঝি মইশাল বন্ধুর স্মৃতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে সম্পূর্ণ পরিসর জুড়ে। চরের সকল প্রান্ত থেকে ভেসে আসে গানের সুর-

“আজি ছাড়িয়া না যান
ও মোর বাচ্চা মইশাল রে।”

রূপকান্ত উন্মনা হতে হতে পুরোন স্মৃতির শরীরে হাত রাখলে একটা নুতন রূপকথা নির্মাণ বিনির্মাণ অতিক্রম করে ভেঙে ফেলতে শুরু করে আবহমান কালের সকল মিথ।

নদীর জলে তখন উড়ন্ত পাখিদের ডানার ছায়া।

মধ্য নদীর খুব অন্দর থেকে কোন এক একাকী নারী হয়তো গাইতে শুরু করে উত্তরদেশের চিরকালীন বিরহের গানই হয়তো বা-

“আমার কাঙ্খের কলসি
বুঝি গিয়াছে ভাসি
মাঝি রে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়া রে।”

৮.

জন্ম জন্ম জুড়ে এই যে বাঁচা এটাকে কিন্তু তীব্র এক বিভ্রম বলে মনে হয় রূপকান্তর। সে গানের সুরের মধ্যে প্রবিষ্ট হতে হতে একটা আদ্যন্ত জন্মান্তরের কথাই ভাবতে শুরু করে। দীর্ঘ একটা জীবন কি এক খোঁজ

তাকে ডুবিয়েই মারলো পরিত্রাণহীন এক অসহায়তায়!

রূপকান্ত তো তার দীর্ঘ জীবনের আদিঅন্ত নিয়ে নুতন করে বারবার আর আখ্যানের বিষয় হয়ে কেবল থাকতে চায় না! সে কেবল জীবনের গভীরে ঢুকে গিয়ে

পাখির পালকের মতন একটা জীবন,বাঁচা আর বেঁচে থাকবার অন্তহীনতায় অনিবার্যভাবে লীন হয়ে যেতে চায়।

রূপকান্ত তার অন্যমনস্কতার ঘোর থেকে ফিরে আসতে শুরু করে রোদ জল বাতাসের এক চিরচেনা ব্যাপ্ত পৃথিবীতে; যেখানে ঘুরে বেড়াতে থাকে ‘হুদুম পূজার’

গানের সুরের মাদকতা-
“আয় আয় রে কালা ম্যাঘ
আয় পর্বত ধায়য়া
তোক ম্যাঘক বান্ধি থুইম
মাথার ক্যাশ দিয়া”

জন্ম আর জন্মান্তর ডিঙিয়ে এই গানের সুর ঘুরে বেড়াতে থাকে জীবনের খুব গহিনেই।

৯.

নদী পেরিয়ে পেরিয়ে চর পেরিয়ে পেরিয়ে মাঠ ঘাট জনপদ পেরিয়ে পেরিয়ে নাচ গান বাদ্য বাজনার এক পৃথিবী পেরিয়ে পেরিয়ে রূপকান্ত তার শরীরে জড়িয়ে নিতে থাকে অদ্ভুত এক ছন্দ, অদ্ভুত এক গতিসূত্রের বহুমাত্রিকতা! এটা আসলে একধরনের বিষ্ময়!

পরিক্রমণের তীব্রতায় রূপকান্ত তার শরীরে গুঁজে দিতে থাকে গাছপালার ছায়ায় শ্যাওলাঢাকা অজস্র পুকুর দীঘি দহ।আর রূপকান্ত তার অনন্ত যাতায়াতের রাস্তায় কেবল খুঁজতে থাকে, খুঁজতে শুরু করে জন্মান্তর পেরিয়ে আসা সেই সব পাখিদের, যারা কেবল উড়ে যাওয়াই বোঝে এক পৃথিবী থেকে অন্য কোন পৃথিবীর দিকে!

চলবে…

ছবিঋণ: সুবীর সরকার

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!