কাঁচা হলদে বাঘটা

আমাদের স্কুলের এক মেয়ে চলে গেল কদিন আগেই৷ মেয়েটা ডাউন সিনড্রোম ৷ গোটা একরাত শ্বাসকষ্টে জ্বালাপোড়া হয়ে ভোর নাগাদ সে গেল৷ পরদিন আরেকজন অভিভাবক এসে যখন মেয়েটির মৃত্যুর খবর দিলেন এবং কীভাবে সে মরেছে সেটা বললেন, তখন খেয়াল করলাম স্কুলের সব থেকে দুষ্টু ছেলে বাঘু হাঁ করে শুনছে ৷

এমনিতে বাঘু সদা আনন্দিত ছেলে ৷ জীবনের সামান্য সামান্য ঘটনায় আনন্দ পেতে জানে৷ তার আনন্দ পাওয়ার বহর দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ৷ পুলিশ ফাঁড়ির বড় মাঠের পরিবর্তে তাকে যদি বলি স্কুল বাড়ির গলি ধরে ছোট বাঘু হাসতে হাসতে রেস দেবে ৷ জুতো নেই তার৷ পায়ের সস্তা চটিতে মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরের পটি মেখে যায়৷ বাঘুর দৌড় থামে না৷ সিকনি মোছার জন্য বড় রুমাল কিনেছে বাঘু৷ সেটা নিয়েও হাসি৷ কখনো সেটা দিয়ে নাক ঘষে লাল করে ফেলছে৷ কখনো আবার সেটা পাগড়ি করে পরে সূর্য খেদায় বাঘু৷ বলে- এই সূর্য দেখবি মজা! খালি আমার চুলগুলো গরম করা তোর! হ্যাট হ্যাট! এই দ্যাখ পাগড়ি পরেছি! এবার কোথা দিয়ে ঢুকিস দেখি!

তো সেই বাঘু তার মতো এক বাচ্চার মৃত্যুর খবর শুনে চুপ করে রইল৷ সূর্য এদিন খুব ছিলl। স্পোর্টসের প্র্যাকটিস চলছিল৷ দেখি, খেলা বন্ধ বাঘু তার পায়ের বুড়ো আঙুলটা মন দিয়ে দেখছে৷ আমি কাছে গেলেও চোখ আর তোলে না বাঘু৷ অথচ সে সবার কাছে বড় গলা করে বলে বেড়ায়-ময়ূরী ম্যামকে ভয় পাই নাকি আমি! ম্যাম ভয় পায় আমাকে! আমি ম্যামকে তাড়া করি কিনা! তাই ম্যাম ভয় পেয়ে বাঘু বাঘু করে৷ কাছে যাওয়া সত্ত্বেও তাকাল না দেখে আমার বুকটা কেমন হাহাকার করে উঠল৷ কেন, কে জানে! জিজ্ঞেস করলাম-
–বাঘু রান রেস হচ্ছে৷ লাইনে দাঁড়া সবার সঙ্গে৷ ওয়ান টু থ্রি বলব৷ তারপর রুমাল নাড়ব৷
বাঘু বলল, এখন না পরে৷

মুখ নীচু করে উত্তরোত্তর ভ্রু কুঁচকেই যাচ্ছে ছেলেটা৷ চোখের কোলে আঙুল ঠেকালাম৷
বাঘু বলল, ম্যাম আমার নখে কেমন রোদ লাগছে দেখো৷ নখগুলো কাঁচা হলুদ হয়ে গেছে৷ তবে আমার আর সর্দি লাগবে না বল ম্যাম!

বাঘু কাঁদছে না৷ বন্ধু মরে গেছে শুনে একটিবার জিজ্ঞেস করছে না তার কথা৷ শুধু শরীরে রোদ আসায় আশ্বস্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে৷ দুপুরের সূর্য তার সমস্ত প্রসারতা সমস্ত ঔদার্য্য দিয়ে বন্ধুহারা শিশুর চারপাশ ছেঁকে ধরেছে৷

জীবন রাখার আকুতি বাঘুর মুখখানাকে একটি খরাতপ্ত ক্ষেত বানিয়ে দিয়েছে৷

খরার ক্ষেত বড় জেদী হয়৷
শস্য আনার হাসি তারই৷

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!