মানুষের কান্না আমাদের চোখে পড়ে, আচ্ছা পাহাড়ের কান্না আমাদের চোখে পড়ে কি? পাহাড়ের দুঃখে কাঁদার কেউ নেই, কিন্তু পাহাড় কাঁদে, সে কাঁদে নিঃশব্দে। সেই কান্নার আওয়াজ কারো কানে যায়, কারো কানে যায় না। আসলে পাহাড়ও সাথি চায় আর তাই তো আমি বারবার ছুটে যাই পাহাড়ের কাছে, মনের কতো কথা হয়, নিজেদের সুখ দুঃখকে ভাগ করে নিতে পারি নিজেদের মতো করে।
আর কেন জানি কালিম্পংই আমাকে টানে বারবার। কবিগুরুও অনেকবার এসেছেন এখানে, হ্যাঁ মংপু আর কালিম্পং এর কথা বলছি। এই কালিম্পঙে এমন কি আছে যার জন্যে এতোবার আসতে ইচ্ছে করে? এই কালিম্পং এর অর্থ-ই বা কি? মনের মধ্যে প্রশ্ন উঁকি দিতেই শুরু হলো খোঁজার পালা।
কালিংপং নামের সঠিক উৎস অনেকেরই জানা নেই। সর্বজনগ্রাহ্য মত হল, তিব্বতি ভাষায় কালিম্পং মানে রাজার মন্ত্রিদের সভা বা বেড়া। কথাটি এসেছে কালোন অর্থাৎ রাজার মন্ত্রী ও পং অর্থাৎ বেড়া শব্দ দুটো থেকে। অন্য মতে, লেপচা ভাষায় কালিম্পং শব্দটির অর্থ, যে শৈলশিরায় আমরা খেলা করি। অতীতে এখানে স্থানীয় আদিবাসীদের গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়ানুষ্ঠানের আসর বসত। পাহাড়ের অধিবাসীরা এই অঞ্চলকে কালিবং ও (মানে কালো নাল) বলে থাকেন।
‘দি আননোন এন্ড আনটোল্ড রিয়ালিটি অ্যাবাউট দ্য লেপচাস’ (The Unknown and Untold Reality about the Lepchas) গ্রন্থের রচয়িতা কে পি তামসাং- এর মতে, কালিম্পং কথাটি এসেছে কালেনপং শব্দ থেকে, লেপচা ভাষায় যার অর্থ গোষ্ঠীর ছোটো পাহাড়। শব্দটি প্রথমে কালীবাং। পরে আরও বিকৃত হয়ে হয় কালিম্পং। অন্য মতে, এই অঞ্চলের বহুল প্রাপ্ত তান্তব উদ্ভিদ কাউলিম- এর নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয়েছে কালিম্পং।
নামের মানে তো উদ্ধার করা গেল, কিন্তু এখানে কি এমন আছে যার টানে রবিঠাকুর বারবার যেতেন? পর্যটকরাই বা কেন আসেন এখানে? শুরু হল তারও পর্যবেক্ষণ। আর রওনা দিলাম শিলিগুড়ি থেকে খুব সকালে। এবারের ভ্রমণের প্রথম লক্ষ্য ছিল আবার কবিগুরুকে ফিরে পাওয়া।
আরও পড়ুন: সোশ্যাল মিডিয়ায় বাচ্চারাও নেশাগ্রস্থ, কিন্তু কেন?
দার্জিলিং এর ৫০ কিলোমিটার পূর্বে কালিম্পং (Kalimpong) ছোট একটি শহর। এটি ১২৪৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। একসময় এই শহর দিয়েই ভারত-তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য চলত। কালিম্পং শব্দের মধ্যেই এর ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এই শহরে এক সময় ভূটানের রাজ্যপালের কেন্দ্রীয় দফতর ছিল। আরো সুন্দর ভাবে যদি এর অর্থ খুঁজি তাহলে বলতে হয় ‘কালিম’ শব্দের অর্থ ‘রাজার মন্ত্রী’ এবং ‘পং’ শব্দের অর্থ ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’। শৈবালদামের ওপর পা ফেলে সোনালি ওক গাছের ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া কালিম্পং- এর অন্যতম আকর্ষণ। কালিম্পং এর চমৎকার আবহাওয়া এবং এর কাছাকাছি অঞ্চলে আরও বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র থাকায় ভ্রমণপিপাসু মানুষের অন্যতম ঠিকানা হয়ে উঠেছে এই শহর।
এবারের ভ্রমণের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল গৌরিপুর হাউস। কবিগুরু যেখানে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সরাসরি আসা যায় কিম্বা শিলিগুড়ি থেকে বাসে অথবা সেয়ার গাড়িতে কালিম্পং পৌঁছে, তারপর সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে সহজেই চলে আসা যায় এখানে। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং এর দূরত্ব প্রায় ৬৮ কিলোমিটার।
চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে এসে পৌঁছেছি কালিম্পং-এর একদম ওপরে। গাড়ি থামতেই স্থানীয় একজনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে চড়াই উতরাই পথ সামান্য হাঁটতেই থমকে দাঁড়ালাম, কি নিস্তব্ধ নিঃশ্চুপ পরিবেশ, ভাগ্যিস দিনের আলোয় পৌঁছেছি সেখানে, সূর্যাস্তের পরে গেলে গা ছমছম করবে বৈকি। বাড়িটি কালিম্পং শহর থেকে দক্ষিণ দিকে এক কিলোমিটার গিয়ে খানিকটা পশ্চিম দিকে। রাস্তার নাম রিং কিং পং রোড। এই বাড়িতেই কবি অতিথি হয়ে এসেছিলেন। এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রথমে শ্বেতপাথরের একটি ফলক চোখে পড়ল, তাতে লেখা আছে “এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন।”
গৌরীপুর হাউজের সামনে এসে নিজেও কেমন শান্ত হয়ে গেলাম। চারপাশটা কিছুদিন আগেই বোধ হয় পরিস্কার করা হয়েছে, আগাছা ছিল তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আসলে দিনটি ছিল ২৯শৈ বৈশাখ, ঐদিন ছিল আমার জন্মদিন আর কবিরও সদ্য ২৫শে বৈশাখের রেশ কেটেছে। একটু এগিয়ে সামনে যেতেই ভগ্ন বারান্দায় কবিগুরু একাকী দাঁড়িয়ে যেন আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। বড্ড মনটা খারাপ হয়ে গেল। এভাবে একা একা বসে থাকা যায়! ২০১১ সালের ভূমিকম্পে দেওয়ালে বড়ো বড়ো ফাটলের চিহ্ন প্রবল। একটু রঙের প্রলেপও পড়ে নি। সুন্দর প্রকৃতির বুকে অবহেলায় অসুন্দর ভাবে উপেক্ষিত হয়ে পড়ে আছে যেন। ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির আদলে গড়ে ওঠা এই বাড়ির ব্যালকনি থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। ১৯৪০ এর ২৫ শে বৈশাখ এই বাড়ি থেকে জন্মদিন কবিতাটি আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করেছিলেন বলে বাড়ির ফলকে লেখা আছে। কিন্তু এখন সেই সৌন্দর্যের ছিঁটেফোঁটা চিহ্নও নেই, খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে। চারপাশে অযত্নের ছাপ, ধুলো-ময়লা আগাছায় ভরপুর, কোনো জায়গায় খুলে নেওয়া হয়েছে টিন। ওপর থেকে জল পড়ছে, ভেঙ্গে গেছে জানলার কাচ, দরজা ভাঙ্গা, আলোর কোন ব্যবস্থা নেই, সব মিলিয়ে এক হতশ্রী চেহারা।
আরও পড়ুন: ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস ও বিশ্বকবি
অবহেলার ধুলো জমছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কালিম্পং- এর গৌরীপুর হাউসে। অথচ এই বাংলোই এক সময় গমগম করত প্রাণপ্রাচুর্যে। সেই গৌরবের ইতিহাসে এখন নকশা বুনছে মাকড়সার জাল। অথচ এই বাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। যা এখন ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির ধুলোয়।
মংপু আর কালিম্পং পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন চার থেকে পাঁচ বার। প্রথমবার এসেছিলেন ১৯৩৮ সালের ২৬শে এপ্রিল, সঙ্গী ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। তখন তাঁর বয়স ৭৮ বছর। এরপর ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসার খবর জানতে পেরে বাড়িতে আসেন পরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মত মানুষেরা। স্থানীয় মানুষজন তাকে দেখতে ভিড় করতেন, কবি তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেই পুরনো ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। চমক ভাঙলো একজন মহিলার কণ্ঠস্বরে। তিনি জানতে চাইলেন কাউকে খুঁজছি কিনা। খেয়াল করলাম একজন স্থানীয় নেপালি মহিলা। বাড়িটা নিয়ে দু চার কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন “এখন আর কেউ আসেনা, আর যারা আসেন তাদের বেশির ভাগই বাড়িটি দখল করার জন্যে।”
অনেকক্ষণ গল্প হল তার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন তারই পরিচিত একজন মহিলা এই বাড়িতে থাকতেন, এই বাড়ির যিনি মালিক তিনি এই মেয়েটির বাবাকে কেয়ারটেকার হিসেবে বহাল করেছিলেন।
এত বড় মানুষের স্মৃতি এমন অযত্নে পড়ে আছে ভাবতেই চোখে জল চলে এলো। বাড়িটার সংরক্ষণের প্রয়োজন। বাড়িটাকে এভাবে ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না। মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেল। এই বাড়িটিকে কেন্দ্র করে এখানে অনায়াসেই একটা চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। স্মৃতি সংরক্ষণ হওয়ার পাশাপাশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে রবীন্দ্রনাথের এই গৌরিপুর হাউসকে কেন্দ্র করে।
আমার মনে প্রশ্ন আসে, উত্তরের এই পাহাড় খুব বেশি টেনে ছিল কি কবিকে? তিনি দার্জিলিং, কার্শিয়াং, তিনধারিয়া, মংপু, কালিম্পং-এ একাধিকবার আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব সহ থেকেছেন। তাঁর পাহাড় ভ্রমণ প্রসঙ্গে দুই শৈলশহর কালিংপং ও মংপুর নাম উঠে আসে বারবার। দুটি শহরেই তিনি চার বার করে থেকেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমান্তে ছোট পাহাড়ি শহর। এখানে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। যাতায়াতের পথও ছিল সমস্যা সঙ্কুল। তিস্তার পাশ দিয়ে রাস্তা, দুই পাহাড়ের মাঝখানে তিস্তা, জঙ্গল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া সে এক অপূর্ব ভয়চকিত আনন্দ। রঙ্গিত আর তিস্তার মিলন আর হিমালয়ের দীর্ঘ বিস্তার। এই পরিবেশ কবিকে খুব কাছে টেনে ছিল। অমিয় চক্রবর্তীকে কবির লেখা চিঠিতে কবিতাটি ভীষণরকম মনে পড়ছিল, “পাহাড়ের নীলে আর দিগন্তের নীলে, শূন্যে আর ধরাতলে, মন বাঁধে ছন্দে আর মিলে। বনেরে করায় স্নান শরতের সোনালী। মাঝখানে আমি আছি, চৌদিকে আকাশ তাই নিঃশব্দে দিতেছে করতালি। আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ, জানে তাকে এ কালিম্পং।”
এরপরের আসাটা একদম অন্যরকম। তাঁর আসার আগের দিন রথীন্দ্রনাথ আর প্রতিমাদেবী এখানে এসেছিলেন। কবি আসবেন, তাঁর সমস্ত আয়োজন পূর্ণ করার জন্য। রবীন্দ্রনাথ আসবেন আর সে খবর ছড়িয়ে পড়বে না তা কি হয়? এমনিতেই ছোট শহরে, তার মধ্যে কবিগুরু বলে কথা! চারদিকে সেই কি উত্তেজনা। স্থানীয় বাসিন্দারা গুরুদেবকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন তাই নিয়ে ব্যস্ত সবাই। তাদের হাতে রাতটুকু সময়, পরের দিন দুপুরে এসে পৌঁছবেন। তারা ঠিক করলেন একটা তরোণ তৈরি করবেন। পাইন, ওকের পাতা আর ফুল দিয়ে তোরণ তৈরি হল থানার সামনে।
২৬শে এপ্রিল কালিম্পং এর ইতিহাসে স্মরণীয় দিন। কবিকে নিয়ে গাড়ি যখন শহরে পৌঁছলো তখন বেলা এগারোটার কিছু বেশি। তোরণের কাছে এসে গাড়ি থেকে নামলেন গুরুদেব। তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হল মালা। কবি আর তাঁর সহযোগীরা এ বিষয়ে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না।
পাহাড়ের সহজ সরল জীবন, নেই কোনো আড়ম্বরের ছিঁটেফোঁটা। তাঁদের কাছ থেকে এমন অভ্যর্থনায় চমকে উঠলেন কবি, এমনটাও হয়! কবি গৌরীপুর ভবনে গিয়ে উঠলেন। এই ভবনটি ছিল ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর। বাড়িটি অনেকখানি জায়গা নিয়ে, পাহাড় কেটে কেটে, কখনো বড় বড় পাথর সাজিয়ে ধাপ বানানো, নিচের দিকে সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে প্রশস্ত জায়গা। অসাধারণ সুন্দর বাড়িটি। ঘরে প্রচুর আলো বাতাস। ঘরের দরজা গুলো বড় মাপের। বাড়িতে জমিদারবাড়ির স্পষ্ট ছাপ। চারদিকে বড় বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় বেশ স্পষ্ট। কবির জন্যে ছিল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ব্যবস্থা।
এর আগেও কবি অনেক পাহাড়ি জায়গায় ঘুরেছেন কিন্তু দার্জিলিং শহরের ব্যস্ততা, মানুষের আনাগোনা তাঁকে মুগ্ধ করে নি।
কালিম্পং শহরের লোকেরা অনেক বেশি সহজ, সরল। তাঁরা কবির শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে তাঁকে কখনো বিরক্ত করেনি। শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং আসার নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই কবি পৌঁছে যান। কালিম্পং- এর ডাক্তার গোপাল দাশগুপ্ত কবির খুব কাছের মানুষ ছিলেন, যতোদিন কবি কালিম্পং ছিলেন, ততোদিন তিনি তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।
আরও পড়ুন: আধুনিক চীনের সবচে বিয়োগাত্মক প্রেমগাঁথা
পাহাড়ে শান্ত পরিবেশে কবির জন্মদিন পালিত হবে। মংপু থেকে মৈত্রেয়ী দেবী এবং তাঁর স্বামী মনোমহন সেন, চিত্রিতা দেবী এলেন। কলকাতা থেকে এলেন প্রবোধ সান্যাল। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, ঝড়ও হয়েছিল। রাস্তার বেশ কিছু জায়গায় উপরে পড়েছিল টেলিফোনের খুঁটি। কয়েকদিন আগে এগুলো পোঁতা হয়েছিল। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে যোগাযোগ হবে, কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে কালিম্পং এর। টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন কবি। জন্মদিন কবিতাটি আবৃত্তি করার কথা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতার শাখার অধ্যক্ষ নিরঞ্জন মজুমদার সেজন্য এখানে এসে পৌঁছেছেন। কবির আবৃত্তি সরাসরি রেডিওতে সম্প্রচার করা হবে। দেশবাসী শুনবে কবির গলায় কবিতা। কবিতা অনুষ্ঠানের সময় এগিয়ে এল। কবি গৌরীপুরে ভবনের একটা ঘরে বসে আছেন। দরজা জানালা বন্ধ, বাইরে থেকে যেন কোন শব্দ ভেতরে ঢুকতে না পারে। কবির কন্ঠ সোজা কলকাতা পৌঁছে বেতারে ছড়িয়ে পড়বে দেশজুড়ে। সকলেই তখন প্রচন্ড কৌতুহল। তখন সাড়ে সাতটা থেকে আটটা, কবির কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হল,
“আজ মম জন্মদিন
সদাই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে মরণের ছাড়পত্র নিয়ে”
(জন্মদিন, সেঁজুতি)
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচিহ্নকে ধারণ করে আছে বিখ্যাত গৌরিপুর হাউস। পাহাড়ী টিলায় অবস্থিত এই শান্ত নির্জন পরিবেশে এসে রবীন্দ্রনাথের ‘চির আমি’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে গেল,
“তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই- আমি
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই – আমি।
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে…”
মনে হচ্ছিল কবির কণ্ঠস্বর আমার চারপাশে আমাকে ঘিরে রেখে করুন ভাবে বলে উঠছে,
“না, যেয়ো না, যেয়ো নাকো
মিলনপিয়াসী মোরা
কথা রাখো কথা রাখো”
রবীন্দ্রনাথের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, যেন আরো বলছেন “পথিক ওগো থাকো থাকো…”
অসুস্থ এই বাড়িটিতে পাহাড়ে রবীন্দ্রনাথের থিম নিয়ে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা যেতে পারে। আজ এই গৌরী হাউসের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে সেই সবুজ পাহাড়কে হাতড়ে বেড়াতে হয় কারণ এর উল্টো দিকেই তৈরি হয়েছে বিশাল কংক্রিটের পলিটিকনিক কলেজ।
এই গৌরিপুর হাউসের কাছেই অতিশা রোডে রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত চিত্রভানু-র অবস্থান। কবির খুব ভাল লাগত কালিম্পং। তাই কালিম্পং-এ স্থায়ী একটি বাড়ি হোক তিনি খুব চেয়েছিলেন। এই বাড়িটির জমি কেনা হবে বলে তিনিই স্থান নির্বাচন করে দিয়ে যান। ১৯৪১ স্থানে কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ স্ত্রী প্রতিমা দেবীর নামে লিজে নেওয়া হয় জমি। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রথীন্দ্রনাথ নির্মাণ করিয়েছিলেন, পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসেবে রথীন্দ্রনাথ কাজে ব্যস্ত থাকলে প্রতিমা দেবী দীর্ঘদিন সেই চিত্রভানুতে ছিলেন। আর তিনি থাকার সময় চিত্রভানুর লনে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করেছিলেন বেশ কয়েকবার। ২০১১ সালে ভূমিকম্পে সেই বাড়ির অনেকটাই ক্ষতি হয়। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের নামানুসারে এই বাড়িটির নাম হয় চিত্রভানু ।
চলে আসার সময় প্রতিমা দেবীর কণ্ঠস্বরকে স্পষ্ট অনুভব করলাম আমি, যেন কবির সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বলছেন আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা, আমার হিয়ার চলছে রসের খেলা, মোর জীবনের বিচিত্ররূপ ধরে তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে…
করুন দুটো চোখ আমাকে পেছনে টেনে ধরছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু আমাকে যে আমার নিত্যদিনের কাজের জগতে প্রবেশ করতে হবে। তাই তো সবটুকু অনুভূতি নিয়ে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। একটা মায়াবী পৃথিবী যেন ধীরে ধীরে, অনেক দূরে পিছিয়ে পড়তে লাগল আমাকে ছেড়ে।
রবীন্দ্র অনুরাগীদের মধ্যে একটা অনন্য অনুভূতির জন্ম দেয় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত এই মংপু ও কালিম্পং। উত্তরের পাহাড়ে তিনি ছিলেন এবং থাকবেনও। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি বিলুপ্তির অন্ধকার হতে বেঁচে উঠুক রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত গৌরীপুর হাউস।
কিভাবে যেতে হবে—
(১) নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সোজা কালিম্পং চলে যাওয়া যাবে। ইচ্ছে হলে সোজা এই গৌরিপুর হাউসেও চলে যাওয়া যায়।
অথবা
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি এসে কালিম্পং এর প্রচুর বাস আছে। কালিম্পং এ পৌঁছে অনেক কিছু দেখার আছে। তাই যে যার পছন্দ মতো হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে এক একদিন এক এক জায়গায় বেড়াতে পারেন। ট্যাক্সি ভাড়া করে এই গৌরিপুর হাউসে সহজেই চলে যাওয়া যায়।#