গল্প: নাগরদোলা

শীতের সকাল। কনকনে উত্তুরে বাতাস বয়ে চলেছে। গাছের পাতায় হিম জমে রয়েছে। পুব আকাশে মিষ্টি রোদ্দুর সবে উঠেছে। রোদে এখনও তেজ হয়নি। শিউলিরা এসময় ভোর বেলা খেজুরের রস ঠিলে ভর্তি করে বাঁকে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছে। কোনো কোনো শিউলি আবার সাইকেলে করেও রসের ঠিলে বয়ে আনছে। এরা বেশিরভাগ আসে নদিয়া থেকে। শীতের মরশুমে আসে। এরা পাণ্ডুয়াতে এসে পেটের টানে গুড় তৈরি করে। সেই গুড় তারা বিক্রি করে হাটে বসে অথবা ঘুরে ঘুরে। আবার খেজুরের রসও তারা বিক্রি করে। শীত ফুরোলে তারা আবার দল বেঁধে চলে যায়। পরিযায়ী পাখির মতন এদের জীবন। প্রতিবছর আসে খেজুরগাছ কাটার সময়। মরশুম শেষ হলে তারা নিজ নিজ ঘরে ফেরে বউ, মা—বাবা, সন্তান—সন্ততির টানে। পাণ্ডুয়ার গম্বুজের নিচে বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মাঘ মাসের মেলা বসেছে। মেলা চলে একমাস ধরে। পয়লা মাঘ থেকে মেলা শুরু। এ অঞ্চলের মানুষের আন্তরিক মেলবন্ধন ঘটায় ঐতিহ্যবাহী এই মেলা। মেলায় হরেক রকম দোকান বসে। সার্কাস, বুগিবুগি ডান্স, মরণকূপ, নাগরদোলা, জাদু প্রভৃতি সব ধরণের আয়োজনই থাকে।

হাওড়া-বর্ধমান মেইন রেল লাইনের পাণ্ডুয়া স্টেশনে নেমে দশ মিনিটের হাঁটা পথ মেলাপ্রাঙ্গণ। সারাদিন ধরে চলে এই মেলা। মেলায় সব ধরণের মানুষ আসে। যেখানে একটু ভিড় বেশি সেখানে যদি মেয়েমানুষ থাকে—তবে তো কথাই নেই—সেখানে মৌমাছির মতো পুরুষেরা ভিড় আরো বাড়িয়ে তোলে—ঠেলাঠেলি করে, মজা পায় ঠেলা দিয়ে, মজা পায় ঠেলা খেয়ে। মেলা সম্পর্কে সবাই বলে মেলায় যায় ঠেলা খেতে। এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ হল গম্বুজ। গম্বুজের ভিতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে মানুষ গম্বুজের মাথায় ওঠে। সংকীর্ণ সিঁড়িপথ বেয়ে ওঠার সময় মেয়েরা অপরিচিত পুরুষের হাতে অনেক সময় মর্দিত হয়। অসহায় মেয়েরা নীরবে নিশ্চুপে মুখবুজে সব অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে। তারা অশান্তি হবার ভয়ে কাউকে জানাতে চায় না। মেলা কমিটিকেও তারা জানায় না এই কারণে।

আরও পড়ুন: ভালবাসার মানুষ টনি মরিসন ২ 

মেলার একপ্রান্তে কেদার সেখের কাঠের নাগরদোলা বসিয়েছে। ক্যাচকুচ্ ক্যাচকুচ্ করে আওয়াজ তোলে কাঠের নাগরদোলা। নাগরদোলায় সারাদিনই কমবেশি ভিড় থাকে। কেদার সেখ আর তার এক খালাতো ভাই এরশাদ নাগর দোলা ঘোরায়। টাকা রাখে কেদারের বাবা মহম্মদ বশির মিঞা। নাগরদোলায় থাকে চারটে ঘরে আটটা চেয়ার। একটা ঘরের দুটো চেয়ার উপরে উঠলে আর একটা ঘরের দুটো চেয়ার নিচে চলে আসে। যারা উপরে থাকে তারা দোলা ঘুরলেই নিচে চলে আসে মাধ্যাকার্ষণের টানে। প্রকৃতির এই নিয়ম লঙ্ঘিত হয় না কখনোই।

কথায় আছে—মাঘের শীত বাঘে খায়। এই ভরা মাঘে কনকনে ঠাণ্ডায় আদিবাসী সাঁওতালদের শিশুরা প্রায় আদুল গায়ে মেলায় ভিড় করে। জাতিধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই মেলায় বেড়াতে আসে। একটি ষোড়শী সাঁওতালি আকর্ষক তরুণী ভিড় ঠেলে ছোটো ভাইকে নিয়ে কেদার সেখের নাগরদোলার কাছে আসে। পাঁচ টাকা করে দশ টাকা দিয়ে দুই ভাইবোন নাগরদোলায় চড়ে। নাগরদোলা ঘোরাতে শুরু করে কেদার সেখ। হেই—ও—হেই—ও—হেই—ও—করে মুখে শব্দ করে নাগরদোলার কাঠ ধরে গায়ের জোরে ঘোরাতে থাকে। সোনালি হেমব্রম নাগরদোলায় উঠছে এই প্রথম। তাঁর ভাই অনেক ছোটো। নাম গোপাল হেমব্রম। পরনে নীল জামা কালো প্যান্ট তার উপরে হলুদ সোয়েটার। বয়স মাত্র আট বছর। গোপাল ভয়ে চিৎকার করতে থাকে।

সোনালি পরেছে গোলাপি রঙের চুড়িদার। গলায় ওড়না, পুতির কাজ করা। উদ্ভিন্ন যুবতীর সৌন্দর্যে ম্রিয়মাণ সুনীল আকাশ, মুখরিত মেলাতলা। নাগরদোলা ঘোরানোর সময়ে সোনালির গায়ের ওড়না উড়তে থাকে। ওড়নার একপ্রান্ত সোনালির গলাতে আটকে যায়। অপর প্রান্ত নাগরদোলার গলসির কাছে বাতাসে উড়তে উড়তে চলে যায়। গোলাপি ওড়না সহসা যেন কালো রূপ ধারণ করে। ওড়নায় গলা পেচিয়ে যায়। নাগরদোলার গলসিতে ওড়নার আর এক প্রান্ত পেচাতে থাকে নাগরদোলা ঘোরার সাথে সাথে। এই ঘটনা কেদারের নজরের বাইরে থেকে যায়— সে নাগরদোলা আরো জোরে ঘোরাতে ব্যস্ত। সোনালির গলায় ফাঁস ক্রমশ টাইট হতে থাকে। কষ্টে সোনালি হাঁসফাঁস করে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। নাগরদোলা থামাতে বলবে সেকথাও তার মনে নেই। আর মনে থাকলেও বলার মতো শক্তি তার নেই। নাগরদোলার ক্যাচর—কোচর আওয়াজ, মেলার মাইকের আওয়াজ— সামনেই বসা বুগিবুগি ডান্সের আসর থেকে ভেসে আসছে গানের কলি—টিপিটিপি বরষা পানি—পানি মে আগ লাগি হে—।

নাগরদোলা থামতে থামতে সোনালি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। গোপাল কিছু বুঝতে পারে না। সে শুধু ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে থাকে। নাগরদোলার চারপাশে লোক জড় হয়ে যায়। কেদারকে মারার জন্য একদল মানুষ হন্য কুকুরের মতো তেড়ে আসে। তারা বলতে থাকে– এই ব্যাটা মুসলমান। ইচ্ছা করে আমাদের মেয়েকে মেরে ফেলেছে।

আরও পড়ুন: লোকগণিত পরিচয় (প্রথম পর্ব) 

কেদার অসহায়ভাবে মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকে। থানায় খবর দেয়া হয়েছে। পুলিশ আসবে লাশ নিয়ে যাবে। কেদারকে মেলাকমিটির লোকজন আগলে রেখেছে। এই অকস্মাৎ ঘটনায় সে নিজেকে অসহায়বোধ করে। নিজেকে বিপন্ন মনে হয়। নিজের কাছে আজ কেদার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হয়। তার মনের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়।

পুলিশ আসে। শুটকি মাছের পট্টির পাশ দিয়ে পুলিশের জিপ, শববাহী যান আর লোকাল এমএলএ গাড়ি করে আসে। তেঁতুলগাছের নিচে শোয়ানো লাশ। লাশ শনাক্ত করে তদন্তের জন্য শববাহী ভ্যানে তোলে। শববাহী যানে লাশ ওঠে সব জাতির মানুষেরই। এখানে কোনো বিভেদ নেই। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে খ্রিস্টান তার কোনো বাচবিচার থাকে না। লাশ তো লাশ— তার আবার জাতি কী ধর্ম কী!!! আর কেদারকে পাণ্ডুয়া থানায় নিয়ে যায় পুলিশভ্যানে করে। বেলা তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আজ বশির মিঞা রান্না বসায়নি। মেলাতলাতে আজ রবিবারে লোক গমগম করছে। তারমধ্যে আজকের এই অপ্রীতিকর ঘটনা। রোসনার দিক থেকে—জামগ্রামের দিক থেকে— মহানাদের দিক থেকে আদিবাসীরা খবর পেয়ে তীরধনুক, টাঙ্গি, কুড়ুল, বল্লম নিয়ে পাণ্ডুয়া হাটতলার কাছে জড়ো হচ্ছে। তারা খবর পেয়েছে এক মুসলমান তাদের মেয়েকে মেরে ফেলেছে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!