প্রকৃতি যদি কারো প্রেমিক হয় তাহলে তার চেয়ে সুখী আর কে হতে পারে? সেই প্রেম যদি আবার হয় ডেলোকে ঘিরে, আর প্রেমিক যদি দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে, তাহলে তাকে কি উপেক্ষা করা যায়? সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সেই ভালোবাসার ডেলো পাহাড়টি কালিম্পংয়ের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। এখান থেকে কালিম্পং শহরটির শোভা সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। ভালোবাসার এই ডেলোতে আসলে মনটা একদম ভাল হয়ে যায়। বারবার হাতছানি দেয়, কিসের যে মোহ! নইলে বারবার কেন ছুটে আসা!
বেড়াতে কে না ভালোবাসে। সেই আদিম যুগ থেকে আমরা দেখে এসেছি মানুষ বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে পর্বতে, নদীর ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতির সান্নিধ্য মানুষকে বরাবরই আকর্ষণ করে। কারো কাছে সুউচ্চ সবুজ পাহাড়,আবার কারো কাছে নীল সমুদ্র এক আনন্দময় মুহূর্ত হিসেবে দেখা দেয়। জীবনের ব্যস্ত সময় থেকে কিছুটা অবসর নিয়ে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে ফেলার এ যেন এক সুবর্ণ সুযোগ। তাই মানুষ সেই আদিকাল থেকেই প্রকৃতির নিবিড় ভালবাসার টানে ছুটে আসে বারবার।
প্রকৃতির সাথে আনন্দময় মুহূর্ত কাটানোর জন্যেই এক একজন এক একভাবে নিজেকে মেলে ধরে। কেউ ছুটে যান তাই পাহাড়ের কাছে, কেউ নদী বা সাগরের কাছে, কেউবা অরণ্যে। প্রতিটি জায়গার নিজস্ব একটি ছন্দ আছে , বর্ণ আছে, গন্ধ আছে। যে যার মতো করে সুন্দর। প্রতিটি সৌন্দর্য-ই আলাদা আলাদা রকমের।
অবহেলার পাহাড় কিন্তু আপন মনে স্বমহিমায় অবস্থান করছে, কি সুন্দর হাসি! শহরের লোকের ভিড়ে সেই প্রাণের হাসি কোথায়? কত অল্পতেই সেখানকার মানুষের প্রতিদিনের যাপন, জীবনকে ভালবেসেই জীবনের দাম। বিশাল উপত্যকায় ছোট ছোট ঘরবাড়ি, ছোট ছোট ক্ষেতখামার, নীচে পাহাড়ি নদী, খাদের শেষাশেষি দিনের অফুরান্ত রোদ।
আরও পড়ুন: কালিম্পং-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং উপেক্ষিত গৌরীপুর হাউজ
কখনো আবার মেঘের পরে জমে থাকা মেঘ। কখনো বা আকাশ জুড়ে রোদের লুকোচুরি। কালিম্পঙের অমোঘ আকর্ষণে বছরভর ভিড় করেন পর্যটকরা। প্রতি বছর গরমের ছুটির মরশুম শেষে ভিড় থাকে তাই কালিম্পঙে। পর্যটক মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থাও রয়েছে ডেলোয়। প্যারাগ্লাইডিং থেকে মাউন্টেন রেস্তোরাঁ। সাজানো আয়োজন।
দশ কিলোমিটার দূরে ডেলো এখন পর্যটকদের হট ফেভারিট। প্যারাগ্লাইডিং-সহ নানা বিনোদনের আয়োজন ডেলোয়। সমুদ্রের সৌন্দর্য অনন্য হলেও বাঙালিকে সবসময়ই পাহাড় একটু বেশিই টানে। আর সেই টানেই প্রতিবছর উত্তরবঙ্গের নানা জায়গায় লক্ষ লক্ষ পর্যটক ভিড় জমান। তবে শুধু বাঙালিরা বললে ভুল হবে, সারা দেশ তথা বিশ্বের কাছেই হিমালয়ের কাছাকাছি পাহাড়ি অঞ্চলগুলির আকর্ষণ অনেক বেশি। এর মধ্যেই পর্যটকদের কাছে অন্যতম সেরা আকর্ষণ তিস্তা নদীর ধারে অবস্থিত শৈলশহর কালিম্পং।
ফুল, ফল, পাহাড়, মেঘ, এই মনোরম পরিবেশের কালিম্পংয়ে কয়েকদিন কাটালেই মন ভালো হতে বাধ্য। ফলে একটু অবসর মিললেই হাতে দিন পাঁচদিন ছুটি পেলেই নিম্ন হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই শৈল শহর হয়ে উঠতেই পারে আপনার সেরা গন্তব্যস্থল।
ডেলো হিল কালিম্পং শহরে অবস্থিত দুটি পর্বতমালার মধ্যে একটি। ডুরপিন এবং ডেলোপাহাড় দুটিকে সংযুক্তকারী একটি শৈলশিরার উপর কালিম্পং শহরটি অবস্থিত। সমুদ্রসমতল থেকে পাহাড়ের উচ্চতা ১৭০৪ মিটার অর্থাৎ ৫৫৯০ ফুট এবং এটি কালিম্পং শহরের সর্বোচ্চ স্থান। পাহাড়টি শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। শহরে প্রধান পানীয় জলের উৎস হিসাবে কাজ করে তিন জলের জলাধার, যার মধ্যে দুটি এই পাহাড়ের উপরে উপস্থিত। কালিম্পং শহরে রেলি উপত্যকা, তিস্তা নদী এবং এর উপত্যকাগুলির আশেপাশের গ্রামগুলি এই স্থান থেকে দেখা যায়।
কুয়াশা মুক্ত দিনে এই ডেলো পাহাড় থেকে পশ্চিম সিকিমের তুষারাবৃত পাহাড়গুলিও দেখা যায়। এই পাহাড়ের শীর্ষস্থানে বহিরাগত ফুলের সম্ভার যুক্ত বেশ কিছু পার্ক আছে , যা বিনোদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত। পার্কটি পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়দের জন্য একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট। পার্কের কাছাকাছি একটি হিন্দু মন্দিরও এখানকার জনপ্রিয় পরিদর্শন কেন্দ্র। সামগ্রিকভাবে ডেলো পাহাড়টি কালিম্পং শহর এবং এর পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলির ৩৬০ ডিগ্রী দৃশ্যের একটি দৃশ্যমান দৃশ্য সরবরাহ করে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের এটি একটি শৈলশহর। নিম্ন হিমালয়-এ অবস্থিত। গড় উচ্চতা ১,২৫০ মিটার ।কালিম্পং জেলার কালিম্পং মহকুমার সদর শহর। কালিম্পং-এর পরিচিতি রয়েছে শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য। এগুলির অধিকাংশ ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত হয়। চীনের তিব্বত আগ্রাসন ও ভারত-চীন যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই শহর ছিল ভারত-তিব্বত বাণিজ্যদ্বার। ১৯৮০-র দশক থেকে কালিম্পং ও প্রতিবেশী দার্জিলিং পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র।
আরও পড়ুন: পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের বাড়ি
কালিম্পং তিস্তা নদীর ধারে একটি শৈলশিরার উপর অবস্থিত। মনোরম জলবায়ু ও সহজগম্যতা একে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র করেছে। উদ্যানপালনে কালিম্পং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নানাপ্রকার অর্কিড দেখা যায়। এখানকার নার্সারিগুলিতে হিমালয়ের ফুল, রাইজোমের ফলন চলে। কালিম্পং-এর অর্থনীতিতে এই ফুলের বাজার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নেপালি, অন্যান্য আদিবাসী উপজাতি ও ভারতের নানা অংশ থেকে অভিনিবেশকারীরা শহরের প্রধান বাসিন্দা। কালিম্পং বৌদ্ধধর্মের একটি প্রধান কেন্দ্র।
শিলিগুড়ি বিমানবন্দর থেকে কালিম্পংয়ের দুরত্ব ৬৬ কিলোমিটার। এছাড়া জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পংয়ের দুরত্ব ১১২ কিলোমিটার। এরপর কালিম্পংয়ে পৌঁছলে চোখে পড়বে কানাচে কানাচে এমনই কমলালেবু সহ আরও নানা ফুল-ফলের বাগান।
কালিম্পং বৌদ্ধধর্মের একটি কেন্দ্র। মধ্য ঊনবিংশ শতাব্দির আগে পর্যন্ত কালিম্পং ও তার সংলগ্ন অঞ্চলগুলি পর্যায়ক্রমে শাসন করেছে সিকিম ও ভুটান। ১৭০৬ সালে ভুটানের রাজা একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে এই এলাকাটি সিকিমের রাজার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন। তিনিই এই অঞ্চলের নতুন নাম রাখেন কালিম্পং।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মানমন্দির
অষ্টাদশ শতাব্দীতে কালিম্পংয়ের জনসংখ্যা খুবই কম ছিল। অধিবাসীরা ছিলেন মূলত আদিবাসী লেপচা সম্প্রদায় ও অনুপ্রবেশকারী ভুটিয়া ও লিম্বু উপজাতির। পরে গোর্খারা কালিম্পং আক্রমণ করে জয় করে নেয়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কালিম্পং দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর কালিম্পং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কালিম্পং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার শৃঙ্গটি খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। ফলে এখান থেকে হিমালয়ের অপরূপ শোভা চেখে দেখারও সুযোগ পাওয়া যাবে। ডেলো পাহাড়টি কালিম্পংয়ের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। এখান থেকে কালিম্পং শহরটির শোভা সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য–
(১) কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টার: কালিম্পংয়ের কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা ঐতিহাসিক সামগ্রী রয়েছে।
(২) তিস্তা বাজার: কালিম্পংয়ে এলে প্রায় সব পর্যটকই এই বাজারে আসেন। সস্তায় নানা সামগ্রী পাওয়া যায় এখানে।
(৩) রোমান ক্যাথলিক চার্চ: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এখানে রোমান ক্যাথলিক চার্চ গড়ে ওঠে।
(৪) জাং ঢোক পালরি ফোডাং: কালিম্পংয়ে অনেক বৌদ্ধ মনাস্ট্রি রয়েছে। এর মধ্যে জাং ঢোক পালরি ফোডাং মনাস্ট্রিটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
(৫) ম্যাক ফারলেন চার্চ: স্কটিশ মিশনারিরা ১৮৯১ সালে এই চার্চটি তৈরি করেন।
(৬) মর্গ্যান হাউস: ব্রিটিশ আমলে তৈরি কালিম্পংয়ের অন্যতম পুরনো বাংলো এটি।
(৭ ) সায়েন্স সিটি: সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত এই সায়েন্স সিটিটি ডেলো থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। পাহাড়ের কোলে এই জায়গাটি বাচ্চাদেরও অন্যতম পছন্দের জায়গা।
এই হলো আমার প্রেমিক, আমার ভালোবাসা, আমার পছন্দের ডেলো, শিলিগুড়ি থেকে মাত্র ৬৮ কিমি দূরে পাহাড়ের কোলে সবুজ গালিচায় মোড়া ডেলো।
“এই শহর থেকে আরও অনেক দূরে
চলো কোথাও চলে যাই
ঐ আকাশটা কে শুধু চোখে রেখে
মনটাকে কোথাও হারাই।
কি চাইনি, কি পাইনি, সবই ভুলে যেতে চাই…”
বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময়: কে কখন বেড়াতে যাবে সেটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছের উপর। তবে পাহাড়ের ভ্রমণ অনেকটাই নির্ভর করে সেই ব্যক্তির মনের উপর। অনেকেই আছেন গরমে পাহাড়ে যেতে চান। অনেকেই আবার
পাহাড়ে শীতের সময় যেতে পছন্দ করেন, কারণ তুষার পাত অনেকেরই খুব পছন্দ। শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে প্রকৃতিকে উপভোগ করার মজাই আলাদা।অনেকে আবার পাহাড়ের বৃষ্টিকে উপভোগ করতে পছন্দ করেন।
পাহাড়ে সেপ্টেম্বরে তাপমাত্রা ভালো দেখায়। এই সময় মাঝে মাঝে বৃষ্টি এবং মেঘলা আবহাওয়ায় মন আবিষ্ট হয়ে আসে। এখানে ২-৩দিন থাকার পাশাপাশি ডেলো হিলস (Deolo hills) এলাকায় রাফটিং বা প্যারাগ্লাইডিং করার পরিকল্পনায় থাকলে একটি পরিষ্কার দিন যেকোনো ভ্রমণ প্রেমীর জন্য উপযুক্ত হবে।
থাকার জায়গা: পাহাড়ের উপরে পর্যটকদের জন্য সরকার দ্বারা পরিচালিত একটি গেস্টহাউস রয়েছে। অসুবিধা এড়াতে আগাম বুকিং করতে হবে কারণ এটি খুব কম খরচ। বেশ বিখ্যাত তাই ঘর না পাওয়ার সুযোগই বেশি। এছাড়াও অনেক হোটেল, গেস্ট হাউস ও হোম স্টে রয়েছে।
কিভাবে পৌছবেন: শিলিগুড়ির কাছাকাছি অবস্থিত বাগডোগরা বিমানবন্দরটি (Bagdogra Airport) কালিম্পং থেকে মাত্র ৭৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিমানবন্দর থেকে যে কোনো গাড়ি নিয়ে কালিম্পং পৌঁছানো যায়। নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) রেলওয়ে স্টেশন দিয়ে কালিম্পংয়ে পৌঁছে সেখানে স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে সহজেই ডেলো পৌঁছাতে পারেন।#