পেশা বদল

।। এক ।।

বাবার এক্সিডেন্টের পর উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডিটা পেরিয়ে তারক নেমে পড়েছিল বনগাঁ-শিয়ালদা ডিভিশনে ট্রেনে হকারির লাইনে। আসলে নামতেই হয়েছিল। দেখতে দেখতে তাও প্রায় কুড়ি বছর পেরিয়ে গেল। তখন এ রাজ্যে যে সরকারের রাজত্ব, সর্বত্র তাদেরই আধিপত্য ছিল। রাস্তার ধারে শাকের ঝুড়ি নিয়ে বসতে গেলেও তাদের অনুমতি ছাড়া সুযোগ মিলত না। আর একটু উন্নত পসরা নিয়ে বসলে তো রীতিমত নজরানা দিতে হতো। সেদিক থেকে তারকের কপাল অনেক ভালো ছিল বলা যায়। ট্রেনে হকারির দলীয় লাইসেন্স জোগাড় করতে তাকে কোনো সেলামি দিতে হয়নি।

সেই সময় চার ফুট পাঁচে ওদের গোটা মুকুন্দপুর এলাকায় সেরা স্ট্রাইকার ছিল তারক। কলকাতা মাঠে খেলার স্বপ্ন দেখত। এই খেলার সূত্রেই বিজয়া ক্লাবের সেক্রেটারি সুজনদার সুনজরে পড়েছিল ও। এই সুজনদা ছিলেন সরকারি দলের ডাকসাইটে যুব নেতা এবং একজন ফুটবল পাগল মানুষ।

কিন্তু সেই স্বপ্ন ওর অধরাই থেকে গেল। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে পরেই ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে বাবার কোমরের হার ভাঙল। আর জোড়া লাগল না। বড় বাজারের পাইকারি কাপড়ের দোকানে কুড়ি বছরের ভালো কাজটাও বাবার চলে গেল। দোকান থেকে সামান্য কিছু টাকা দিয়েছিল। যা বাবার চিকিৎসার পেছনেই শেষ হয়ে গেল।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে ভবানীপুর ক্লাবের এক কর্মকর্তা বেলঘরিয়ায় ওর খেলা দেখে বলেছিলেন আগামী মরশুমে ওকে সই করাবে। আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবার দুর্ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেল।

টানা ছ-মাস বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল আর বাড়ি এই-ই করতে হয়েছে। ডাক্তার বলল, অপারেশন করে বল বসাতে হবে। সব মিলিয়ে আশি-নব্বই হাজার টাকার ব্যাপার। ওর মায়ের যেটুকু যা গয়না ছিল, এক সঙ্গে করেও তিরিশের বেশি দাম হল না। বাবাও বেঁকে বসলেন। এত টাকা খরচ করে অপারেশন করতে কোনো ভাবেই রাজি করানো গেল না তাঁকে। তারককে ডেকে বলেন উনি, “তুই একটা কাজকর্মের চেষ্টা কর। আমিও একটু সুস্থ হয়ে উঠে লেঙছে লেঙছেই কিছু একটা করব। সংসারটা তো চালাতে হবে! ফুটবল পিটিয়ে আর ক-টাকা রোজগার করতে পারবি?”

ওই বয়সে তারক বাবার সিন্ধান্তের বিপক্ষে আর কিই-ই বা বলবে! ফুটবল নিয়ে তার আবেগ বাবা আগেও কোনো দিন বোঝেননি। এখনো বোঝানো যাবে না। তাই প্রথমেই ও সিদ্ধান্ত নিল বাদামের প্যাকেট নিয়ে ট্রেনে হকারি করবে। ট্রেনে যাতায়াতে ও দেখেছে যে-কোনো কামরাতেই মুড়ি- মুড়কির মতো বাদাম বিক্রি হয়। হকারিতে নাম লেখানোর গল্প ওর জানাই ছিল। তাই সবার প্রথমে ও সুজনদাকেই ধরল। তিনি ওর পরিস্থিতি বুঝে ইউনিয়নের কার্ড বের করে দিলেন। সেই সঙ্গে পাখি পড়ার মতো বুঝিয়ে দিলেন, বিরোধী দলের ছায়াও যেন কখনো না মাড়ায়। পার্টির সব মিটিং-মিছিলে নিয়মিত হাজিরা দিতে হবে। তা না হলে হকারি-কার্ড ক্যানসেল হয়ে যাবে। সেই শুরু তারকের।

সুজনদার পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। কিন্তু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারপর আর পারেনি। নাম লিখিয়েছে অন্য দলের ইউনিয়নের খাতায়। ততদিনে এ লাইনে ও এক পোক্ত হকার।

আরও পড়ুন: অন্ন জোগায় নারী

।। দুই ।।

হকারি শুরুর প্রথম প্রথম ট্রেনের ভিড় কামরায় অনেক কষ্ট করে কাজ করতে হত। প্রথম দু-মাস তো দিনে কুড়িটা প্যাকেটও বিক্রি হয়নি। মাঝে মাঝেই মনে হতো হাতের প্যাকেটগুলো প্লাটফর্মে আছাড় মেরে ফেলে দেয়।

একদিন মাস্টারমশাইয়ের মতো এসে ওর হাত ধরলেন প্রায় বাবার বয়সি ধরজেঠু। প্যাসেঞ্জার-হকার সকলের ধরদা। এ লাইনে বহু পুরোনো হকার। গত তিরিশ বছর একই প্রোডাক্ট ‘ঢোল গোবিন্দের’ দাদের মলম আর পেটের গ্যাসের অব্যর্থ পাউডার ‘অর্জুন চূর্ণ’ ফিরি করে যাচ্ছেন যাত্রী মহলে। বহু হকারই আজ এটা, কাল সেটা ফিরি করে। কিন্তু ধরজেঠু যা দিয়ে শুরু করেছিলেন তাই নিয়েই আছেন।

কিভাবে সম্ভাব্য বিক্রির কামরা বুঝতে হয়। কোন কামরায় উঠলে মাছি তাড়াতে হবে না। কোন সুলুকে একই প্রোডাক্টের অন্য হকারের আগে কামরা দখল করা যায়। কিভাবে কথা বললে ডেইলি প্যাসেঞ্জারের কাছের মানুষ হওয়া যায়। কী ভাষায় ক্যানভাস করলে ক্যাজুয়াল পাসেঞ্জারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়— এ সমস্ত কায়দাকানুন শিখিয়েছেন ধরজেঠু। মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই সব কিছু রপ্ত করে নিয়েছে তারক। ধরজেঠুও খুশি। তিরিশ বছরের হকারি জীবনে এ রকম অনেকেরই ত্রাতা হয়ে আছেন উনি।

ট্রেইন্ড তারকের দিনকে দিন সেল বাড়তে থাকে। গোড়া থেকেই খেলাধুলোর সাথে সাথে লেখাপড়ায় ওর মনটা থাকায় স্কুলের প্রায় সব মাস্টারই এই কারণে আর ওর ফুটবল প্রতিভার জন্য আলাদা নজর দিত। সেই সুবাদে এবং ওদের একদা একটা বংশ মর্যাদার কৌলিন্যে মার্জিত স্বভাব আর সুন্দর কথা বলার অধিকারী ছিল ও। তাই এই নতুন অল্প-বয়স্ক হকার ছেলেটি অল্প দিনের মধ্যেই সকলের প্রিয় হয়ে ওঠে।

সংসার চালিয়ে মাত্র দু-বছরের মধ্যেই বাবার জন্য একটা হাত রিক্সা কিনে ফেলে ও। বাবা সেটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে লটারির টিকিট বিক্রি করে মোটামুটি একটা রোজগার করতে শুরু করে। একটু পরিণত তারক বাবাকে বলে দেয় সকালে দু-ঘণ্টা, বিকেলে দু-ঘণ্টার বেশি একদম বাইরে থাকা চলবে না।

তারকের মা-ও নিশ্চিন্ত হয়ে আরও দু-বছরের মাথায় ছেলের বিয়ে দেন। পাত্রী তারকেরই পছন্দ করা মেয়ে লিপি। সেই কবে খেলার মাঠে আলাপ। নানা ঘাত-প্রতিঘাতেও সেই সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি।

ফুটবলকে আঁকড়ে জীবনটা তৈরি করার আশায় ছেদ পড়লেও শেষ পর্যন্ত রেলের কামরায় হকারের এই ভবিতব্য মেনে নিয়েছিল ও। চলন্ত ট্রেনে অনেক অপরিচিত মানুষই প্রশ্ন করেছে— “তুমি সাব-জুনিয়রে দশটা গোল করেছিলে না?” মুচকি হেসে পাশ কাটিয়েছে ও। কিন্তু অন্তঃস্থলে ক্ষরিত গোপন ব্যথার অশ্রু কিন্তু কখনো কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। মন দিয়ে নিজের কাজ করে সবাইকে নিয়ে সুখেই কাটছিল দিন।

আরও পড়ুন: কবি কৃষ্ণরাম দাস

।। তিন ।।

হঠাৎ সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল কোভিড নামের মারণ রোগের কামড়ে। মাসের পর মাস লকডাউনে দিশাহারা তারকের সামনে সবকিছুই যেন ঘন অন্ধকার। কাজ নেই, কাজের জায়গা নেই। বিয়ের তিন বছরের মাথায় মায়ের তাড়নায় তাঁকে একটি নাতির মুখ দেখাতেই হল। ঘরে পাঁচটা মানুষের পেট চালানোই এখন দায়। বংশ গরিমায় তারকের বাবা লাইন দিয়ে যৎসামান্য সরকারি সাহায্যের চাল-ডাল ব্যাগে নিতেও নারাজ।

চারদিকে শুধু মৃত্যুর খবর, স্বজন বিয়োগের হাহাকার। এদিকে জমানো টাকাও প্রায় সব শেষ। কিছু একটা কাজ পেতেই হবে। মরীয়া তারক ইউনিয়নের নেতার কাছে গিয়ে কোনো আশ্বাসই পায় না। শেষ পর্যন্ত সেই সুজনদার শরণাপন্ন হয় তারক। সুজনদারও বয়স বেড়েছে। রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। তবুও তারকের সব কথা শুনে দু-দিন পরে দেখা করতে বলেন ওকে।

।। চার ।।

তারক এখন ভিআইপি-র ধারে একটা বড় বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে। হাসপাতালটি এখন পুরোটাই কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট। একশো বেডের এই হাসপাতালে রোজই এক-দুজন করে মানুষের ঠাই হচ্ছে হাসপাতালের ঠান্ডা ঘরে। তাদের স্বজনদের চোখের দেখা তো দুরস্ত, আশপাশে যাবারও অনুমতি নেই। পুরসভার গাড়িতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তাদের দেহ। তারপর আর হাসপাতালের দায়িত্ব নেই।

সুজনদা এখানেই তারকের একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তারকের কাজ মৃতদেহগুলি ভালো করে পিপিই কিটে মুড়ে ওয়ার্ডের বেড থেকে ঠান্ডা ঘরে পৌঁছে দেওয়া। প্রয়োজনে পুরসভার লোকেদের সঙ্গে হাত লাগানো। প্রথম প্রথম নিজের জন্য পিপিই কিট পাওয়া যেত। এখন তাও পাওয়া যায় না। ওর আরাধ্যা মা কালীর নাম করে এখন শুধু হেয়ার কভার, হ্যান্ড গ্লাভস আর মুখে মাস্ক সেঁটেই কাজ করে ও। এর আগে দু-জন এই কাজ ছেড়ে দেবার পর গত তিন মাস তারকই টিকে আছে এখনো। টিকে থাকতেও হবে ওকে। দৈনিক চুক্তির কাজ। দিন গেলে করকরে একটা গান্ধী নোট আর দুপুরে লাঞ্চের প্যাকেট। এ বাজারে কে দেবে? আর মরণ? সে তো একদিন হবেই। ঘরের মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দিতে হবে, সুস্থ রাখতে হবে। লিপিকে ও কথা দিয়েছে, ওদের ছেলেকে বড় ফুটবলার করে তুলবেই। যত কষ্টই হোক, এই স্বপ্নটা সফল ও করবেই। যদিও বাড়ির কেউই জানে না সত্যি সত্যি ও কী কাজ করে।

বাড়ি ফিরতে রোজই বেশ রাত হয়ে যায়। রাতের বিছানায় বউ লিপি অনুযোগ করে বলে, “কী এমন কাজ করো যে সেই ছ-টায় বেরিয়ে রাত দশটায় বাড়ি ঢোকো?”

তারক কোনো রকমে ম্যানেজ করে, “কী করি বলো? প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ। এই বাজারে যে এটা পেয়েছি তাই তো তোমাদের নিয়ে চলতে পারছি। আমাদের ফুচুকে সুস্থ সবল রাখতে হবে না? দেখো, তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

লিপি ওকে আরও একটু জড়িয়ে নিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে।

আরও পড়ুন: প্রথম ইঙ্গভারতীয় কবি কাশীপ্রসাদ ঘোষ

।। পাঁচ ।।

হাসপাতালের কাজের চাপ আর ঘরের লোকেদের চিন্তায় সুজনদার কথা মাথা থেকে প্রায় চলেই গিয়েছিল। সুজনদার জন্যই তো এ যাত্রাতেও বেচেঁ যাওয়ায় কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে যায় তারকের। কিন্তু কিভাবে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানো যায়! ভেবে ভেবে একদিন ভোরে কাজে যাওয়ার পথে বড় এক বাক্স মিষ্টি আর কৃতজ্ঞতায় ভরা একটা প্রণামী চিঠি প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে বারান্দার গ্রিল গলিয়ে চুপিচুপি রেখে আসে ও। এখন যে মানুষে মানুষে দেখা করাতেও বিধিনিষেধ। তাছাড়া হাতে হাতে এভাবে টাকা খরচ করে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলে সুজনদা যে ভয়ংকর ক্ষেপে যাবে সেটা তারক খুব ভালো করেই জানে।

নিয়ম মতো ওয়ার্ড মাস্টারের ঘরে টেম্পোরারি স্টাফ খাতায় সই করে করিডোরে আসতেই সুপারভাইজার মণীশবাবু বললেন, “তুমি এসে গেছো? একটু বসে তিন নম্বর কেবিনের দু-নম্বর বেডের বডি প্যাক করে ফেলো। বেশি দেরি করো না। সাত ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।”

মিনিট পাঁচেক বসে মণীশবাবুর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নির্দিষ্ট বেডের কাছে গিয়ে নিথর শুয়ে থাকা মানুষটার মুখ থেকে চাদরের ঢাকাটা সরাতেই চমকে ওঠে তারক। এ কে শুয়ে আছে তার সামনে! কবে, কখন আনা হল সুজনদাকে! সারাক্ষণ এখানে থেকেও কিচ্ছুটি জানল না ও! আজই সকালে যাঁর জন্য…..। আর ভাবতে পারে না। দু-হাতে মুখ ঢেকে সুজনদার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া পায়ে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়ে তারক। কোনো ভাবেই ভেতরের কষ্টটা আটকে রাখতে পারে না। সবার আড়ালে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে ও।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!