প্রতিভা, সূর্যের আলোর মতো। ধনী-দরিদ্র, জাত-ধর্ম, দেশ-কাল দেখে কোনো মানুষের মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ হয় না— এই চিরসত্য কথাটি স্বতঃসিদ্ধ। আর তাই এই পৃথিবীর আলোয় এমন অনেক প্রতিভার উদাহরণ আছে, যেখানে এমন সব প্রতিভাধর মানুষের সন্ধান মেলে, যাঁদের না আছে কোনো বংশকৌলিন্য, না আছে হয়তো পারিবারিক কোনো ঐতিহ্য। আর এমনই এক অসাধারণ প্রতিভার ছোঁয়ায় আজ থেকে দেড়শো বছর আগে বিভোর হয়ে গিয়েছিল কলকাতা তথা গোটা ভারতবর্ষের সংগীত পিপাসু রসিকজন।
কলকাতা পত্তনের পর তিনশতকেরও বেশি সময় পার করে আজ সে কল্লোলিনী তকমায় সুশোভিত। পুরনো কলকাতার প্রথম পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছিল ১৮৩৯ সালে। তাঁর আগেও এখানে রাস্তা থাকলেও সেটি ছিল কাছ রাস্তা। আধুনিক প্রযুক্তিতে যেভাবে একটি নির্দিষ্ট মাপে মাটি খুঁড়ে কোনো পাকা রাস্তা তৈরি হয়, চিৎপুর রোড কিন্তু সেভাবে তৈরি হয়নি। সেই রাস্তার ওপরেই একটি চারতলা বাড়ির অলিন্দ বেয়ে ভেসে আসত নানা রাগের সুরের ঝংকার আর বাদ্যের লহরী। বাড়ির অন্দরে সেই সুরের ঝরনা ঝরে পড়ত বহুমূল্য আভরণে সুসজ্জিতা এক সুন্দরী নারীর কণ্ঠ থেকে। তিনি কলকাতার প্রথম পেশাদার মহিলা গায়িকা মলকাজান। তাঁর অসাধারণত্ব ছিল যেমন সংগীতে, তেমনই তিনি ছিলেন একাধারে কবি ও নৃত্যশিল্পী। এই মলকাজানেরই কিশোরী মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনা বা গহরজান একদিন হয়ে উঠলেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি। শুধু তাই নয়, গহর তাঁর মাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল ঠুংরি, গজল, দাদরা ধামারের ধ্রুপদ শৈলী আর রবিঠাকুরের সংগীতসুধার সাগরে। তখনকার তাবড় তাবড় বাঙালি-অবাঙালি সঙ্গীতপ্রেমী পুরুষের তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রাণভোমরা।
তাঁর প্রতিভার আকাশচুম্বী প্রতিস্পর্ধী ঔদ্ধত্যের গরিমায় কম্পমান ছিল কী দেশি, কী বিদেশি পুরুষ! কত যে পৌরুষ বিগলিত হয়েছে তাঁর অঞ্চলে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু এক সময় তাঁদের সেই কাঙালপনার দিকে ফিরেও তাকাননি তিনি। নাকি তাঁরই মনের প্রকৃত তালাশ নেননি কেউ? অথবা তাঁদের তালাশ ছিল বিত্ত-বৈভবে পূর্ণ আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই রূপসীর অন্য কোনো পার্থিব সম্পদের দিকে! আর তাই কি জীবনের সব রকম পার্থিব সম্পদে সম্পদশালী হয়েও তিনি ছিলেন বড় একাকী! জীবনের একটা সময় যখন সেই একাকিত্ব কাটাতে আঁকড়ে ধরতে চাইলেন প্রকৃত কোনো হৃদয়ের আশ্বাসিত বুকের ঠিকানা, তখনই একের পর এক হলেন প্রতারিত? উন্নাসিক আর উদ্ধত জীবনের এটাই বোধহয় ট্রাজিক! কিন্তু কী সেই গল্প? সেদিকে নজর দেবার আগে ফিরে যাওয়া যাক অতীতের কিছু বিবর্ণ ইতিহাসের পাতায়।
আর পড়ুন: প্রাচীন ভারতে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি
সেটা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের কথা। উত্তরপ্রদেশের এক জনপদ আজমগড়। ইংরেজ রাজত্বের তখন মধ্যগগন। সেই আজমগড়ে চাকরি সূত্রে এসেছিলেন ইংরেজ কর্মচারী হার্ডি হেমিংস। এই আজিমগরেরই এক সুন্দরী যুবতী রুক্মিণী। সৌন্দর্য্য আর সঙ্গীতের সুপ্ত গুণের সমাহারে সে মন জয় করে নিল হার্ডির। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল ধর্ম। হার্ডির রক্ষনশীল পরিবারের বক্তব্য— ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে রুক্মিণীকে। হলও তাই। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে রুক্মিণী হলেন এলিজা। হার্ডি-এলিজা যেন রাজজোটক— এক অন্যের পরিপূরক দু-জনের উছলে-পড়া সুখের সংসারে তাঁরা দুই কন্যা সন্তানের জনক-জননীও হলেন। কিন্তু রুক্মিণী ওরফে এলিজার কপালে সেই সুখ বেশি দিন সইল না। হঠাৎ অকাল মৃত্যু হল হার্ডির। আচমকা এই ধাক্কায় অথৈ জলে পড়লেন এলিজা। মেয়েদের মানুষ করতে আর সংসার চালাতে তিনি কাজ নিলেন একটি কারখানায়।
এলিজার বড় মেয়ে সুকণ্ঠী ভিক্টোরিয়া তখন কৈশোর ছড়িয়ে যৌবনের উদ্ধত প্রকৃতির ডাকে উচ্ছল। ওই কারখানারই তরুণ সুপারভাইজার রবার্ট উইলিয়াম ইয়োওয়ার্ডকে দেখে তাঁরই প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া বিয়ে করল রবার্টকে। প্রথাগত শিক্ষায় গান না শিখলেও গানটা ভিক্টোরিয়ার গলায় বেশ ভালোই আসতো। সেই সঙ্গে কবিতাও লিখতেন তিনি। তাঁর এই সুপ্ত প্রতিভার কারণেও অনেকটা মুগ্ধ হয়েছিলেন রবার্ট। ফলে দুই হাতের মিলন হতে দেরি হয়নি। বিয়ের ঠিক পরের বছরই ১৮৭৩ সালের ৩ জুন তাঁদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হল। নাম রাখা হল এলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োওয়ার্ড।
কিন্তু এই প্রতিভা-ই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভিক্টোরিয়ার জীবনে। স্বামী ব্যস্ত থাকতেন তাঁর কর্মজীবনে। ছোট্ট মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনাকে নিয়েও যেন সময় কাটতে চাইত না। সংগীতের ওপর সহজাত দখল থাকা সত্ত্বেও সেই প্রতিভাকে কাজে লাগাচ্ছে না দেখে এক প্রতিবেশিনীর কথায় অবশেষে প্রথাগতভাবে গান শিখতে শুরু করলেন ভিক্টোরিয়া পূর্বপরিচিত এক সংগীত বিশেষজ্ঞ ও নামী শিক্ষক যোগেশ্বর ভারতীর কাছে। নিজের ভেতরের ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে তৈরি করে নিলেন তিনি। সংগীত শিল্পী হিসাবে একটু-আধটু নামও ছড়ালো এদিক-ওদিক। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এর পর থেকেই রবার্ট ও ভিক্টোরিয়ার সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। অবশেষে বিবাহ বিচ্ছেদ। সম্পর্কের অনীহা মূলত রবার্টের দিক থেকেই ছিল। সংগীত জগতে ভিক্টোরিয়ার ক্রমজনপ্রিয়তা নাকি পূর্বপরিচিত যোগেশ্বর ভারতী— কোন বিষয়টি তাঁর মনে এই বিচ্ছেদের বীজ বপন করেছিল, সেটা জানা যায় না।
আর পড়ুন: ভালবাসার মানুষ টনি মরিসন ২
ভিক্টোরিয়ার অবস্থাও হল তাঁর মায়ের মতো। মা এলিজারও কারখানার কাজ তখন আর নেই। অন্য দিকে তখন মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনাও অসুস্থ। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে ক্রমশ। ফলে, নিজের অর্জিত প্রতিভাকে সম্বল করেই নেমে পড়লেন তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখাতে। কিন্তু এই কাজের পারিশ্রমিকে আর কতটা সচ্ছলতা আসে সংসারে! ফলে দারিদ্র্য আর দূর হয় না! আর ঠিক এই সময়েই যোগাযোগ হয় এসরাজ শিল্পী খুরশিদের সঙ্গে। অনেক দিন ধরেই খুরশিদ দেখছেন ভিক্টোরিয়াকে। কিন্তু সেভাবে আলাপ হয়নি কখনো। আলাপ না হলেও মনের মধ্যে ভিক্টোরিয়ার প্রতি একটা গোপন টান ছিল। কিন্তু পরস্ত্রী-কে তো আর প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়ার চরম দারিদ্র্যের সুযোগটা তাই নষ্ট করেননি খুরশিদ। না! ক্ষণিকের তৃপ্তির জন্য নয়। খুরশিদ প্রস্তাব দিয়েছিলেন বরাবরের জন্যেই তাঁর সঙ্গী হবার। মেয়ের অসুস্থতার কথা চিন্তা করেই রাজি হয়ে যান ভিক্টোরিয়া। কিন্তু তথাকথিত সমাজ তাঁদের এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। ভিক্টোরিয়ার কপালে জুটলো ‘ভ্রষ্ট নারী’র অভিধা। আজমগড়ের এই দুর্নাম থেকে আড়াল করতে খুরশিদ তাঁদের সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন বারাণসী শহরে। ধর্মান্তরিত হয়ে এবার ভিক্টোরিয়া হলেন মলকা। আর ছ-সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটি অ্যাঞ্জেলিনা থেকে হল গহর। পরবর্তীতে এই মলকা হয়ে উঠলেন কলকাতার সংগীত জগতের অন্যতম শিল্পী ‘বড়ে মলকাজান’ আর গহর হয়ে উঠলেন দেশ কাঁপানো সুন্দরী গায়িকা ‘গহরজান’।
মলকাজানের ‘বড়ে মলকাজান’ নামের পিছনে রয়েছে সেই সময়ে দেশের বাইজি মহলের আরও তিন মলকাজানের স্বমহিমায় উপস্থিতি। তাঁদের সকলের নামের আগেই একটি করে বিশেষণের যোগ ছিল। এবং প্রত্যেকেই ছিলেন সংগীত ও নৃত্যে শাস্ত্রীয়ভাবে পারদর্শিনী। মলকাজানও ছিলেন সেই জ্ঞানের অধিকারিণী শিল্পী। তাই বারাণসীর বাইজি হলেন ‘বড়ে মলকাজান’। আসলে মলকাজান জীবিকার তাড়নায় নাচটাও খুব ভালো করে শিখে নিয়েছিলেন। আর তখনকার সময়ে জীবিকার কারণে একজন নর্তকী-গায়িকার নামের সঙ্গে ‘বাইজি’ শব্দটাই জুড়ে যেত। যার আর একটি প্রকট সমার্থ দেহোপজীবিনী শিল্পী।
এদিকে কিশোরী গহরের মধ্যেও প্রকট হতে থাকে মায়ের গুণ। মলকা আর দেরি করলেন না। শুরু হল তখনকার বারাণসীর বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক বেচু মিশ্রর কাছে মার্গসংগীতের একনিষ্ঠ তালিম। মায়ের মেহফিলেও বসতে শুরু করলেন গহর। এদিকে বারাণসীতে ব্যবসার অবস্থা খুব একটা আশাব্যাঞ্জক না হওয়ায় খুরশিদ সংগীতকলার অন্যতম পীঠস্থান কলকাতায় চলে এলেন স্ত্রী ও পালিতা কন্যাকে নিয়ে। শুরু হল মলকার নতুন জীবন। যেখানে একমাত্র সম্পদ তাঁর কণ্ঠের গান আর শরীরী বিভঙ্গের নৃত্যমুদ্রা।
প্রথমে ঠিকানা হল কলকাতার কলুটোলা অঞ্চলে। নবাব ওয়াজেদ আলি তখন কলকাতার মেটিয়াবুরুজকে মিনি লক্ষ্ণৌ বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দৌলতে তখন মুঘলখানার আস্বাদন করছে সাধারণ বাঙালিরাও। সেখানেই নিমন্ত্রণ পেলেন মলকা। কত্থক নৃত্যের প্রবাদপ্রতিম গুরু বিন্দাদীন মহারাজ সেই আসরে মলকার মেয়েকে দেখে অনুভব করেন তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা। শুরু হয় নাচের এবং গানের তালিম। এরপর শুধু প্রতিভার বিচ্ছুরণ। গহর যেমন খুব অল্পদিনেই আপন করে নিয়েছিলেন কলকাতাকে, কলকাতাও অল্পদিনের মধ্যেই হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল গহরজানের প্রতিভার কী মূল্য!
আর পড়ুন: মধ্যযুগের বাংলা কাব্য ২
ঠুমরি, গজল, দাদরার আলাপে-মূর্চ্ছনায় প্লাবিত হয়েছিল আঠারো শতকের শেষভাগের কলকাতা। গজল ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথের গানও অনেক গেয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত বাংলা গান ছিল— ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল ‘। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই নভেম্বর দাদরা অঙ্গের একটি হিন্দি গান গেয়ে প্রথম রেকর্ড করেন গ্রামোফোন ও টাইপ রাইটার লিমিটেডের গেইসবার্গের হাত ধরে দেশের প্রথম বাণিজ্যসফল সাত ইঞ্চির এক পিঠের রেকর্ড। গানের শেষে নিজের কোকিল কণ্ঠের স্বাক্ষর ‘মাই নেম ইজ গহরজান’ ইতিহাস হয়ে রইল দেশের রাগ সঙ্গীতের স্বর্ণোজ্জ্বল পাতায়। এরপর শুধু সাফল্য আর খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের পর্ব। তখন তিনি থাকেন কলকাতার প্রথম পাকা রাস্তা চিৎপুর রোডের ওপর বিখ্যাত নাখোদা মসজিদের পাশে একটি চারতলা বাড়িতে। তাঁর নাম অনুসারেই এক সময় বাড়িটির নাম হয়ে যায় ‘গহর বিল্ডিং’।
কলুটোলা অঞ্চল ছেড়ে গহরের মা মলকাজান ওই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিলেন। বাড়িটি ছিল দমদমের ধূলি শেঠের বাগানবাড়ি। কলকাতায় পসার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পয়সাও বাড়তে থাকে মলকার। আর তাই এক সময় চল্লিশ হাজার টাকায় চারতলা বাড়িটি তিনি কিনেই নেন।যদিও এরই মাঝে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তেরোতম জন্মদিনে গহরের জীবনে ঘটে গেছে এক অনভিপ্রেত লাঞ্ছনার ঘটনা। সেটা ছিল বাইজি প্রথার ‘নথভাঙা’ অনুষ্ঠান। অর্থ ও বৈভবের প্রাচুর্যে মলকাজান তখন কলকাতার বাইজি মহলে শীর্ষে বিরাজ করছেন। তাই মেয়ের নথভাঙা অনুষ্ঠানে এলাহি ব্যবস্থা। কলকাতা তো বটেই, কলকাতার বাইরের বহু গণ্যমান্য বাবুরা নিমন্ত্রিত সেখানে। প্রচুর খাওয়াদাওয়া আর সুরার ব্যবস্থা। অন্যান্য সকলের সঙ্গে মলকাও নেশায় চুর। নিয়ম ভাঙতে গহরও তাই একটু পান করে অনভ্যাসের ফোঁটায় বেসামাল হয়ে পড়েন। আর তারই সুযোগ নেয় নিমন্ত্রিত খয়েরাগড়ের রাজা। গহর হলেন অন্তঃসত্ত্বা। প্রসব করলেন একটি মৃত সন্তান। মানসিক ভাবে ওই সময় খুবই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। মা মলকা সে-যাত্রায় অনেক চেষ্টায় মেয়েকে সামলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন।
এরই মধ্যে একদিকে মেটিয়াবুরুজের নবাব ওয়াজেদ আলির মৃত্যুতে মলকার একটা নিশ্চিত আয়ের রাস্তায় যেমন ছেদ পড়ল, অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে মজলিসের জন্য ডাক এলো দ্বারভাঙার রাজা লংকেশ্বর সিংহের কাছ থেকে। সেখানে পেশকারি হিসাবে গহরকেই তুলে ধরার কথা ভাবলেন মলকা। কিন্তু তখনো গহর তাঁর জীবনের বিভীষিকার স্মৃতি পুরোপুরি বিস্মৃত হতে পারেননি, মাঝে মাঝেই উদাসী হয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। তবু সেই চোদ্দ বছরের কিশোরী জয় করলেন দ্বারভাঙার মজিলসের সভা। একই সঙ্গে খেতাব অর্জন করলেন ‘সভাগায়িকা’র এবং পেলেন ‘জান’ পদবির খেতাব— তাঁর নামের সঙ্গে জুড়লো ‘গহরজান’। এরপর একের পর এক গহরজানের জীবনের পটপরিবর্তনের পালা। মায়ের মতোই তাঁর জীবনেও সুখের তরণী এক পথে বইতে পারেনি কখনো। কখনো পাননি একটানা শান্তির ছোঁয়া। বিষাদের আঁধার থেকে যখন কোনো ভাবেই পুরোপুরি মুক্ত হতে পারছেন না তিনি সেই সময়েই কলকাতায় চিৎপুরের বাড়িতে গহরের গান শুনতে এলেন বারাণসীর রাইবংশের ছেলে যুবক ছগনলাল। কন্দর্পকান্তি ছগনের প্রেমে পড়লেন গহর। ছগনও তো মনে মনে এমনই একটা প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি গহরকে বারাণসী নিয়ে গেলেন। ভালোই কাটছিল তাঁদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু বিধি বাম— ছগনের পরিবার তাঁর অন্যত্র বিয়ে ঠিক করল। ছগনও বাড়ির বাধ্য ছেলের মতোই সেই কন্যার পানিগ্রহণ করলেন। কিন্তু গহরকে বিদায় জানালেন না। নতুন বউ যদি অনুমতি করে, তবে তিনি গহরের সঙ্গে অনিয়মিত সম্পর্ক রাখবেন— ছগনের এই মহানুভবতা আত্মসম্মানী অষ্টাদশী গহর মানতে পারলেন না। ফিরে এলেন কলকাতায় মায়ের কাছে।
আবারও বিমর্ষ, হতাশ, দগ্ধ গহরজান। আর তার কিছুদিন পরই গহরকে জড়িয়ে পড়তে হয় চিৎপুরের বাড়ি নিয়ে মায়ের আশ্রয় দেওয়া মায়েরই বন্ধু আশিয়ার ছেলে ভোগলুর সঙ্গে এক অধিকার প্রমাণের মামলায়। চিৎপুরের বাড়িটি মলকাজান তাঁর নামেই লিখে দিয়েছে, এবং গহর মলকার কোনো পিতৃ পরিচয় নেই— এই ছিল ভোগলুর দাবি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই মামলায় জিততে হয়েছিল গহরজানকে। অবশ্য এই মামলার সূত্রেই গহর খুঁজে বের করেছিলেন শৈশবে তাঁকে এবং তাঁর মাকে ছেড়ে চলে যাওয়া বাবাকে। তিনি মেয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বটে, তবে দু-হাজার টাকার বিনিময়ে। সে এক অন্য কাহিনি। এই মামলার লড়াইয়ে সর্বক্ষণ পাশে থেকে সবথেকে বেশি সাহায্য করেছিল গহরের তখনকার ব্যক্তিগত সচিব গোলাম আব্বাস। আব্বাসের প্রতি এক অমোঘ বিশ্বাসের সূত্র ধরেই দু-জনের মধ্যে বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। সম্পর্কটা সচিবের পর্যায় ছড়িয়ে জীবনের ভরসার জায়গা অধিকার করে নেয় অল্প সময়ের মধ্যেই। কিন্তু সেই আব্বাসের কাছ থেকেই নেমে এলো জীবনের ওপর আর-একটি চরম আঘাত। একাকিত্বের অবসান চেয়ে চুক্তিভিত্তিক বিয়েতে গহর-আব্বাসের নতুন জীবন শুরু হয়েছিল। গহরের দিক থেকে আব্বাসের প্রতি এতটাই বিশ্বাসের ইমারত তৈরি হয়েছিল যে, আবেগের বশবর্তী হয়ে চিৎপুরের বাড়িটি তাঁর নামে দানপত্র করে দেন তিনি। আব্বাস হয়তো এই দিনটির অপেক্ষাতেই ছিলেন। গহরের প্রতি তাঁর আস্থা, সহানুভূতি, নানা দিক থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সর্বোপরি প্রেম নিবেদনের ছলনা— এসবের পেছনে হয়তো উদ্দেশ্য ছিল এই একটি কাজ সিদ্ধ করার। গহরের দিক থেকে প্রেম যতই প্রগাঢ় হোক না কেন, আব্বাসের প্রচ্ছন্ন কপট আকুতি না থাকলে হয়তো গহর বাড়িটি ওভাবে আব্বাসের নামে দানপত্র করে দিতেন না।
বাড়িটি হাতে পেয়েই এতদিন মুখে পরিয়ে রাখা মুখোশটি খুলে ফেললেন আব্বাস। পরিবারের লোকজন তো বটেই, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদেরও নিয়ে এসে তুললেন ওই বাড়িতে তিনি। বস্তিবাড়ির চেহারা নিল সেই সঙ্গিতালয়, সেই শান্তিনীড়। বন্ধ হতে বসলো গহরের সঙ্গীতচর্চা, মজলিস। নিজের ভাগ্যের ওপর অভিমানে আর অদৃষ্টের নীরব বিলাপে কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি চলে গেলেন ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে। ওদিকে আব্বাস তখন আর-এক সুন্দরী বাইজির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। সব জেনেও একটির পর একটি সম্পর্কের ওঠাপড়ায় ক্লান্ত গহর চেষ্টা করেছিলেন যদি আব্বাসের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করে নেওয়া যায়। কিন্তু যখন বুঝলেন সে আর হবার নয়, তখন বাধ্য হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করলেন তিনি। জিতেও গেলেন সেই মামলায়। কিন্তু সেই মামলা চালাতে গিয়ে তাঁকে হারাতে হয়েছিল এতদিনের অর্জিত অর্থ, সম্পত্তির প্রায় সবটাই। আর এই জায়গা থেকেই নেমে এলো সংগীত সম্রাজ্ঞী কিংবদন্তি গহরজানের জীবনের অন্তিম পর্ব।
অথচ এই গহরজানের বিলাসী জীবনযাপনের বহর তাঁর মা মলকাজানের বেহিসাবি বিলাসিতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। তাঁর বিলাসী জীবনযাপনের কথা সে যুগে খুব প্রচলিত ও মুখোরোচক ছিল। শোনা যায়, পোষা বেড়ালের বিয়েতে ওই সময় খরচ করেছিলেন কুড়ি হাজার টাকা। বহুমূল্য অলংকারে ভূষিতা য়ে তিনি কোনো মজলিস বা আদরে গান গাইতে যেতেন। তাঁর সেই গয়না পাহারা দেবার জন্য ছিল সশস্ত্র রক্ষী। এও শোনা যায়, দূরের কোনো মেহেফিলে যেতে গেলে ভাড়া করতেন গোটা একটি রেলগাড়ি! সেই গহরজান একটা সময়ে একেবারে নিঃস্ব জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন শুধুমাত্র অপরিণামদর্শী, বেহিসাবি আর বিশ্বাসের ভুল জায়গা নির্বাচনের কারণে।
আর পড়ুন: বহু সত্তার বহুমুখী পর্যটনে আত্মশরণের প্রজ্ঞাময় চিত্রকল্প
এই মানুষটি মাত্র ১২-১৩ বছরের মধ্যে বাংলা-হিন্দি থেকে শুরু করে তামিল-গুজরাটি, এমনকি ইংরেজি-ফরাসি ভাষাতেও প্রায় ৬০০ গান রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর গানের টানেই গৃহস্থের ঘরে শোভা পেতে শুরু করে দামি গ্রামোফোন। সেই গহরজান একটা সময়ে অর্থের প্রয়োজনে তাঁর কালজয়ী গানগুলি মাত্র এক টাকা দরে বেচতে শুরু করেছিলেন! গহরের বিলাসী জীবনের বিপরীতেরও একাধিক ছবি পাওয়া যায়, যা সেই সময়ের অন্য ধনী বাইজি শিল্পীদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায়নি। গরিব-দুঃখী-আর্তদের সেবায় অকাতরে অর্থ বিলিয়েছেন তিনি। অর্থের জন্য কারও কোনো ভালো কাজ আটকে গেলে, খবর পাওয়া মাত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যও অর্থ সাহায্য করেছেন তিনি।
অথচ মানুষের প্রতি দরদ এই মানুষটিই বার বার সেই মানুষকে বিশ্বাস করেই ঠকেছেন। শুধু ঠকেনই নি, বহু অর্থের গুনাগার দিয়ে নিঃস্ব জীবন কাটিয়ে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। জীবনের উপান্তে এসে প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে বহু জায়গা ঘুরে অবশেষে ১৯২৮ সালে মহীশূরের সভাগায়িকা হিসাবে মাত্র পাঁচশো টাকা বেতনে কাজ শুরু করলেন; যিনি এক সময় একটা আসরে গান গাইতে নিতেন নিদেনপক্ষে হাজারটি টাকা, একটি গান রেকর্ডের জন্য পারিশ্রমিক নিতেন কমপক্ষে পাঁচশো টাকা। মহীশূর রাজসভার অসম্মানজনক ক্লান্তিকর জীবন অবশ্য বেশিদিন ভোগ করতে হয়নি তাঁকে। মাত্র এক বছরের মাথায় জানুয়ারি মাসে সাতান্ন বছরের একাকিনী গহরের জীবনে চিরশান্তি নেমে আসে সমস্ত নিকটজনের চোখের আড়ালে, নিঃশব্দে।#
তথ্যসূত্র:
১| অচেনা কলকাতা- রমাপদ চৌধুরী
২| জনকণ্ঠ সংবাদপত্র
৩| আঠার ও ঊনিশ শতকে বাজারের ইতিহাস- জ্যোতির্ময় সেন
৪| মনসাজিও কাব্য- বিপ্রদাস পিল্লাই
৫| চন্ডীমঙ্গল- মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
৬| পুরনো কলকাতার পত্রপত্রিকা- সুকুমার সেন, গৌতম ভদ্র
৭| বাঙালির গান- দুর্গাদাস লাহিড়ী