২০১৪ সালে বরিশালের শূন্য দশকের কবি অভিজিৎ দাস ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন। এ বছর তার অন্তর্ধানের ১০ বছর হল। এখনও জানা গেল না তার ভাগ্যে কি হয়েছিল। তার জন্ম ৬ এপ্রিল ১৯৮২ জাগুয়া ইউনিয়ন, বরিশালে। তিনি বরিশাল ও ঢাকা থেকে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন ছোটকাগজ, যেমন: ‘ধ্রুবতারা’, ‘দ্রোহপত্র’, ‘শূন্যমাতাল’, ‘বুকটান’। এক সময়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বরিশাল শাখার বিদ্যালয়ভিত্তিক বই পড়া কর্মসূচীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বরিশালের দৈনিক আজকের বার্তা ও ঢাকার দৈনিক বাংলাদেশ সময়, শিল্পকলা বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘শিল্পরূপ’-এ কাজ করেছেন।
নিখোঁজ হবার পূর্বে পাঁচটি স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার মাধ্যমে তরুণ কবি হিসেবে যথেষ্ট কাব্যশক্তির পরিচয় দিয়েছেন ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন সমালোচক ও পাঠকদের মাঝে। কবিতাগ্রন্থগুলো হলো: ‘নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ’ (২০০৮), ‘মাটির চামচ মুখে’ (২০১০), ‘ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ’ (২০১১), ‘জন্মান্ধের স্বর ও লিপি’ (২০১২), ‘করপল্লবসঙ্গিনী’ (২০১৩)। এছাড়া তিনি নিখোঁজ হওয়ার পরে পরিবারের অনুমতি নিয়ে ‘আরক প্রকাশনা’ থেকে ২০১৫ সালে ‘সারাটা আঁধার বেড়াবো মাতাল কুসুম বনে বনে’ শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
বরিশাল থেকে প্রকাশিত ছোটকাগজ ‘আরক’ পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। সে পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন ভায়লেট হালদার আর যৌথ সম্পাদক: তুহিন দাস ও সৈয়দ মেহেদী হাসান। সে সংখ্যায় অভিজিৎ দাসের মোট ১৬ টি গল্প ও গদ্য যেগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলো নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ক্রোড়পত্রের জন্য অভিজিৎ দাসের স্কেচ করেছিলেন চিত্রশিল্পী কাঠুরিয়া কামরুল। ‘সময়ের শব্দ’ আরক প্রকাশনার একটি অঙ্গসংস্থা। সে ক্রোড়পত্র থেকে একটি ছোটগল্প ‘সময়ের শব্দ’ পত্রিকার পাঠকদের জন্য পুনর্মুদ্রিত হলো।
![](https://somoyershabdo.com/wp-content/uploads/2024/06/Design-uten-navn-13-2-300x200.png)
শুধু বাঁশি
অভিজিৎ দাস
দূর থেকে ভেসে আসা বাতাসের সাথে একটি করুণ সুরের আবহ মোহাবিষ্ট করে তোলে সবাইকে। অন্ততঃ এই মুহূর্তটুকুর জন্য সকলে একযোগে কান পেতে রাখে বাতাসের গতি প্রবাহের প্রতি ঠিকঠাক মনযোগ দিয়ে। স্বর শুনে অনুমান করা যেতে পারে এটি এ অঞ্চলের মানুষের বেদনাগীতি। ঘুমন্তদের মধ্যে কেউ এই সুর যাতে তার ঘুমে বিঘ্ন না ঘটায়, তাই মাথার বালিশ টেনে নিয়ে কান চেপে রাখে। আর যারা এখনও পুরোপুরি ঘুমোয়নি, চোখ বন্ধ রেখে চুপচাপ ঘুমোনোর চেষ্টায় মত্ত, তারা একবারের জন্য হলেও পাশ ফিরে শোয়। এদের মধ্যে কেউ আবার স্বপ্নের ঘোরে প্রলাপ বকে চলে অনর্গল। কিন্তু দেয়াল ঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দে যাদের ঘুমের মধ্যে মাথার ভেতর এক অনিঃশেষ সময়প্রবাহের কাটা ঘুরে চলে একই আবর্তে, তারা যেন এই বেদনার্ত সুরের বিহ্বলতা, যা কিনা দূর কোনো উৎস হতে ভেসে আসা তা থেকে নিজেদের আড়াল করে মশারির গোপনে এক অখণডমণ্ডলের ব্যাপ্তি রচনা করে চলে। তখনও ভোর হতে অনেক বাকি। কিন্তু মসজিদের ইমাম কি যেন এক খেয়ালে পূর্বের আকাশের দিকে একবারও না তাকিয়ে পাক-পবিত্র হতে পুকুর ঘাটে যায়। দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে পায়ের গোড়ালি যেই না ভিজিয়েছে জলে, কেমন যেন একটা আলোর দলার মত থক্থকে বস্তু সে দেখতে পেল, জলের ভেতর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। তখন দূর থেকে ভেসে আসা সেই করুণ সুর যেন আরও জোরালো স্বরে বেজে ওঠে তার কানে মুহূর্তের মধ্যেই অমন দ্যুতিময় অসংখ্য বস্তুকে সে দেখতে পায় পুকুরের অপর পাড়ের মাটি ভেঙ্গে গড়িয়ে জলের ভেতর নামতে। এইবার যেন আরও স্পষ্টভাবে তার চোখে ধরা দেয় কয়েনের আকৃতির সেই আলোকিত বস্তুগুলো। যার মধ্যে খচিত রয়েছে প্রস্তরযুগের শিকারের দৃশ্য আর অচেনা ভাষার সব বর্ণমালা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে সে দেখে এই আলোময় ভেঙ্গে পড়া। ক্রমশঃই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে সেই দ্যুতিময় বস্তুর অবয়ব লুপ্ত হয়। ফযরের নামাযের ওয়াক্ত শেষে অবাক হয়ে মুসুল্লীরা এসে জড়ো হয় এই পুকুর ঘাটে। সেখানে এসে তারা দেখতে পায় এই জনপদের সবচেয়ে প্রাচীন পুকুরটির পাড় ভেঙে পড়ার দৃশ্য।
এ অঞ্চলে যা কখনো ঘটেনি আগে, তেমন ঘটনাই ঘটে চলছে আজ। প্রথমতঃ গ্রামবাসী অবাক হয়ে ভেবে পায় না, যে ইমাম সাহেবকে তারা এতকাল যাবৎ দেখে আসছে, তাদের অতি পরিচিত সেই ব্যক্তির পক্ষে কিভাবে এমন একটি আশ্চর্যজনক ভুল করা সম্ভব! ফযরের আযান না দিয়ে তিনি কেনইবা বসে থাকবেন, নিথর হয়ে পুকুর ঘাটে। যার আযানের ধ্বনি শুনে প্রতি ভোররাতে গ্রামের মুসুল্লীদের ঘুম ভাঙে, মোরগেরা সমস্বরে ডাকতে শুরু করে, সেই ইমাম সাহেব আযান দিতে ভুলে গেলেন আজ, এ বিষয়টি যেন কেউ সহজে মেনে নিতে পারে না। তাছাড়া তিনি তো আর এ অঞ্চলে নতুন নন। প্রায় এক যুগ ধরে ইমামতি করে অসছেন এই মসজিদের। গ্রামের আবালবৃদ্ধবণিতা সকলের কাছে একজন নিপাট ভাল মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত। কিন্তু আজ ভোরের ঘটনায় সারা গ্রামে গুঞ্জন ওঠে। ঘটনাটি অস্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে গ্রামবাসীর কাছে। মসজিদে ফযরের আযান না দেয়া, উপরন্তু পুকুর ঘাটে ইমাম সাহেবের নিথর স্থির জড় পদার্থের মত বসে থাকা ও পাড় ভাঙার দৃশ্যের বিষয়ে মুসুল্লীরা যে যার ঘরে ফিরে গিয়ে তাদের নিজ নিজ স্ত্রী-সন্তান-পরিজনদের কাছে সবিস্তারে আলোচনা করল, সবাই একমত হল যে, এ নিশ্চয়ই আল্লাহর কুদরতি। মসজিদে আযানও দেয়া হল না, আর পুকুর ঘাটেও শুরু হল ভাঙন, যা এ অঞ্চলের ইতিহাসে ঘটে নাই আর কোনোদিন। তখন সেই ভোরবেলা গ্রামের লোকজন সব এসে জড়ো হতে শুরু করে পুকুর ঘাটে। তারা পুকুর পাড়ের মাটি ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখে, পুকুর ঘাটে ঠায় বসে থাকা নিঃশ্চুপ ইমাম সাহেবকেও এক ঝলক দেখে নেয়। আর নিজেদের মধ্যে নানান কথা বলাবলি করে। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়লে, এ গ্রাম সে গ্রাম থেকে দলে দলে লোক এসে ভিড় জমায়। ততক্ষণে পুকুরপাড় লোকে লোকারণ্য। এতক্ষণে জনস্রোতে রূপ নিয়েছে। গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান, যিনি কিনা মসজিদ কমিটির সভাপতি, তিনি এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যস্ত হলেন। তারই উদ্যোগে গ্রামের তাগড়া জোয়ানদের নিয়ে দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হল, মানুষের ঢল সামলাতে ও সকল অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য। কর্তৃপক্ষের নেয়া নানারকম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও পুকুর ঘাটের বিপরীত দিকে পুকুরের ফাটল ও ভেঙ্গে পড়া মাটির আস্তর দেখতে গিয়ে খাদে পড়ে আহত হলেন কয়েকজন। আবার মসজিদের ইমাম সাহেবের এই বিমূঢ় নিঃশব্দভাবে বসে থাকা একবারের জন্য দেখতে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি আর পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা গেল একটি শিশু। দলে দলে লোকজন পুকুরের মধ্যে নেমে আসতে শুরু করল। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়েও জনতাকে নিরস্ত করা গেল না। এতে করে, এ ঘটনার খবর দ্রুতগতিতে শহরে পৌঁছোলে, শহর থেকে পুলিশ আসে, সাংবাদিক আসে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে ইমাম সাহেবকে ধরে নিয়ে যায় কোতয়ালী থানায়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করে আর সাংবাদিকেরা ব্যস্ত হন নানা রকম তথ্য ও আলামত সংগ্রহে। যেহেতু, এ হুলস্থুল ঘটনা ও লঙ্কাকাণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ইমাম সাহেবের অবস্থান, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাই তার মুখেই পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত বিবরণ তথা স্বীকারোক্তি ধারণ করতে চাইলেন কথা ধরে রাখা সম্ভব এমন এক ধরনের যন্ত্রে, যাকে রেকর্ডার বলা হয়। যা হোক, ইমাম সাহেব তো বরাবরের মতোই নির্বাক থাকলেন। কোনো অবস্থাতেই জিজ্ঞাসাবাদে নানা ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেও তার মুখ থেকে একটি বাক্যও উচ্চারণ করানো গেল না, স্বীকারোক্তি তো ছাড়! ততক্ষণে গ্রামবাসী এসে দলে দলে থানা ঘেরাও করে তাদের প্রাণপ্রিয় ইমাম সাহেবের মুক্তির দাবীতে শ্লোগানে প্রকম্পিত করে তোলে চারিধার। বেলা যত বাড়ে, থানা অভিমুখে জনতার ঢল সামলাতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশকে। এতে করে থানা ভবনে হামলার আশংকায় ও উপর মহলের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে পুলিশ সুপার স্বয়ং ইমাম সাহেবকে আশু মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংঘবদ্ধ জনতাকে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়। পুলিশ এও জানায়, ইমাম সাহেব এখানে সসম্মানে রয়েছেন। পুলিশের গাড়িতে করেই রাতে তাকে গ্রামে পৌঁছে দেয়া হবে। গ্রামবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এলে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামের লোকজন বিভিন্ন বাড়ির বৈঠকখানায় সকাল থেকে ঘটে চলা ঘটনার আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে চলে আর গেরস্থ বাড়ির মেয়েমানুষ ও ছেলেপুলেরা ঘরের মেঝেতে বসে কণ্ঠ টেনে টেনে এ অলৌকিক ঘটনার মাহাত্ম্য নিয়ে আলোচনা করে। রাত বাড়লে গ্রামের ভেতর একটি গাড়ির শব্দ শোনা যায়।
আরও পড়ুন: মৃত্যুদণ্ড
গাড়িটি মোল্লা বাড়ির সামনে হেরিং মাছের কাটার আকৃতিতে সদ্য বিছানো ইটের রাস্তা ধরে মসজিদের মাঠে এসে থামে। গ্রামবাসী এসে জড়ো হয় মসজিদের মাঠে। অধিকাংশ বাড়ির পুরুষ পোলারা গাড়ির শব্দ শুনতে পেয়ে তাদের বাড়ির মেয়েমানুষ ও ছানাপোনাদের ঘরের ভেতর ভালোভাবে দরজা জানালা আটকে দিয়ে সাবধান থাকতে বলে। এতে করে এ জাতীয় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে উৎসাহী হয় ছেলেপুলেরা এবং বাপ-চাচার নিষেধ অমান্য করে কিছুসংখ্যক ডানপিটে ছেলে ছোকরা গোপনে মসজিদের পেছনে গাছের আড়ালে আবডালে এসে জড়ো হয়। মসজিদ কমিটির সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলেও রয়েছে এদের দলে।
যে ছেলে এই বছর নিয়ে মোট তিনবার মেট্রিক ফেল করেছে। দিনভর বন্দরের গার্লস স্কুলের সামনে ভিডিও গেমস্ এর দোকানে তার আড্ডা। এ বয়সেই হাতে থোক থোক টাকা, বন্ধুবান্ধবও বেশ জুটিয়েছে, যাদের সংখ্যা হাতে গুনে বলা দায়। সে এসে মসজিদের পেছনে জড়ো হওয়া ছেলেছোকরাদের মধ্যে দুই জনকে চোখের ইশারায় পাশে ডেকে নিয়ে যায়। ওদের দু’জনের মাথা কাছাকাছি এনে চাপা স্বরে কি যেন বলে ছেলেটি, কোলাহলের কারণে যা শোনা যায় না স্পষ্ট। ওরা তিনজন তরুণ একই সাথে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে মোল্লা বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে নেমে যাওয়া মেঠোপথে। পথের দু’ধারে ধানক্ষেত। চৈত্রের জ্যোৎস্নায় এসে বাতাস এসে নৃত্যের ঝড় তোলে ক্ষেতে। কিছুদূর এগোলে একটি বাঁশের সাঁকো পেরোতে হয়। সাঁকো পেরিয়ে ওদের তিনজনের মধ্যে অপর দুই যুবক কাছেই একটি বাঁশঝাড়ের দিকে হেঁটে যায় সন্তর্পণে আর যে যুবকটির পিতা ছিলেন এই গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে মসজিদ কমিটির সভাপতি হওয়ার কারণে যিনি আজ সারাদিন ছিলেন অতিব্যস্ত, আর এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে যিনি মসজিদের সামনের মাঠে বন্দর হতে হ্যালোজেন বাতি ভাড়া করে এনে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করলেন, সেই ছেলেটিকে দেখা যায় কাছেই একটি ছোট্ট দোচালা মাটির ঘরে মাথা নীচু করে ঢুকতে। ঘরের মেঝেতে রাখা কোরোসিনের একটি কুপি জ্বলছিল, দূর থেকে ঝাপসা আলোয় দেখা যায় এক তরুণী সমেত যুবকটিকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। কয়েক মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে নিয়ে তারা দু’জন বাঁশবাগানের দিকে যেতে শুরু করলে, হঠাৎ জ্যোৎস্নার আলোয় বাঁশবনে দুটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়ে আঁতকে ওঠে মেয়েটি যেন কিছু বলতে চায়। ততক্ষণে বাঁশবন থেকে বেরিয়ে আসা দুইজন যুবকের চেহারা আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় মেয়েটির চোখে। এবার মেয়েটির মুখ চেপে ধরায় অস্পষ্ট গোঙানীর আওয়াজ শোনা যায়। তিনজন যুবক মিলে মেয়েটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এগিয়ে যায় বাঁশবনের দিকে। এরপর চৈত্রের জ্যোৎস্না পল্লবিত রাতে আবার সেই করুণ সুর বেজে উঠতে শোনা যায়, যা বাতাসে ছড়িয়ে পড়া আর্তনাদের সাথে একই লয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে।
রাত যত বাড়ে, সমবেত জনতা উদগ্রীব হয়। ইমাম সাহেবের মুখ পানে তাকিয়ে থেকে তাদের চোখে ব্যথা অনুভব করে। আর একদৃষ্টে কতক্ষণই বা একটি লোকের দিকে চেয়ে থাকা যায়। হ্যালোজেনের আলোয় আলোকিত মসজিদের মাঠে বসে থেকে অপেক্ষা করে তারা ইমাম সাহেবের মুখনিসৃতঃ বাণী শুনবে বলে। আর গ্রামের বাড়িগুলোতে দরজা কপাট আটকে ঘরে বসে থাকা মেয়েমানুষেরা যারা সতর্কবাণী মেনে গভীর উৎকণ্ঠার সাথে অপেক্ষা করছিল তাদের পুরুষ লোকদের বাড়ি ফিরে আসবার জন্য, আর সারাদিন ধরে ঘটে চলা অলীক এই ঘটনা সম্পর্কিত ইমাম সাহেবের বয়ান শোনার জন্য, তাদের অধিকাংশই যে যার অবস্থানে বসে থেকেই হাই তুলতে তুলতে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মাঠের মধ্যে অপেক্ষমান জনতা ঘাসের ওপর বিছানো গঞ্জের ডেকরেটর থেকে ভাড়া আনা ফরাশের ওপর হাটু মুড়ে, কেউ আবার দুই পা সামনে মেলে দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বসে ঠায় তাকিয়ে থাকল ইমাম সাহেবের মুখের দিকে। এভাবে রাত গড়াতে গড়াতে ভোরের আলো ফুটতে যখন আরও কিছু বাকি, ইমাম সাহেবকে দেখা গেল মসজিদের বারান্দায় স্থাপিত মঞ্চের ওপর বিছানো লাল রঙের জায়নামায ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর গতিতে পুকুর ঘাটের দিকে হেঁটে যেতে। মাঠের অপেক্ষমান জনতা সোৎসাহে তাকে অনুসরণ করতে চাইলে তিনি চোখ ও হাতের ইশারায় একযোগে সবাইকে যার যার নিজ অবস্থানে বসতে বলে ওযু সেরে ফিরে এলেন। গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ মুসুল্লী ইমাম সাহেবকে পুকুর ঘাটের দিকে যেতে দেখে মহাপ্রস্থানের আশংকায় একযোগে কেঁদে উঠেছিলেন, কিছুক্ষণ বাদে ফের তাকে ফিরে আসতে দেখে আশ্বস্ত হলেন তারা। এবার তিনি মঞ্চাকৃতির সেই চৌকির ওপর স্থাপিত লাল রঙের জায়নামাযে না বসে, মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলেন ভেতর থেকে কয়েক মুহূর্তের শুনশান নীরবতা ভেঙে আবারও জনতার গুঞ্জন শোনা গেল। দূর থেকে এক দমকা হাওয়ার মত সেই বেদনাগীতি আবারও যেন শোনা গেল সুস্পষ্ট স্বরে।
আরও পড়ুন: কবি অভিজিৎ দাস নিখোঁজের দশ বছর
সকলকে মোহাবিষ্ট করে তোলা যে করুণ সুর গত রাতে। যে সুর অনেকেরে নিদ্রাভঙ্গের কারণ হয়ে উঠেছিল, যার বাধ্য হয়েছিল মাথার বালিশ কানে চাপা দিয়ে ঘুমোতে, আর যারা স্বপ্নের ভেতর প্রলাপ বকে চলেছিল, সকলেই সেই বেদনার্ত সুর কান পেতে শুনতে চাইল একযোগে। হঠাৎ দৈববাণীর মত মসজিদের ভেতর থেকে শোনা গেল এক কণ্ঠস্বর। ‘তোমরা অনুসরণ কর সেই করুণার গান, যা আমাদের আত্মার প্রকোষ্ঠে বেজে ওঠে প্রত্যহ। অথচ যা কিনা আমাদের অশ্রুত। যে সুর খরাপ্রবণ চৈত্রকে করতে পারে দ্যুতিময় বসন্ত, আর যার প্রচণ্ড ভাঙনের ছন্দে ধ্বসে যায় আমাদের আত্মার সরোবর।’
তখন ফযর ওয়াক্ত। ভাল করে আলোও ফোটেনি চারদিকে। চাঁদ মধ্য আকাশ হতে হেলে পড়ে পশ্চিম আকাশে ডুবে যাবার প্রাকপ্রস্তুতি নিচ্ছে। জনতার দল সেই মোহনীয় সুর অনুসরণ করে চলল একযোগে। মোল্লা বাড়ির বিপরীত দিকের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে তারা একটি সাঁকোর মুখোমুখি হল সুরের উৎস খুঁজতে গিয়ে সবাই যখন একযোগে পেরোতে চাইল সেই সাঁকো, বাঁশের সেই সাঁকো গেলো ভেঙে। ততক্ষণে বাড়ির মেয়ে মানুষেরাও বাইরে আলো ফোটার পূর্বাভাস টের পেয়ে সেই রহস্যময় সুরের উৎসানুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। এবার জনাকয়েক শক্তিমান পুরুষলোক মিলে খালের মাটি তুলে হাতে হাতে সাঁকো বরাবর একট বাঁধ নির্মাণ করল। সেই বাঁধ ডিঙায়ে জনতার ঢল, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলে একে একে জড়ো হতে লাগল বাঁশবনে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল গ্রামবাসী। কেবল সেই বেদনাগীতি আর শোনা গেল না তখন, দিনের আলোয় থেমে গেছে সেই গান। চাঁদ ডুবে গেছে। পূর্ব আকাশে রক্তরাঙা সূর্য ডানায় ভর রেখে উঠে আসছে ওপরে। একটি তরুণীকে দেখা গেল ঝোপের ভেতর বাঁশঝাড়ে ছিন্নবস্ত্র শরীরে নিথর পড়ে আছে। সম্ভবত মৃত সে। তার যোনিপথে একটি রক্তাক্ত বাঁশি গেঁথে আছে।#