দার্জিলিঙের রায় ভিলা

কিছু কিছু জায়গা বা পরিবেশ বিখ্যাত বা জনপ্রিয় হয় পূজনীয় কিছু মনীষীদের আগমনে। তাঁদের কাটানো কিছু মুহূর্তই সেই পরিবেশের রূপকে একেবারে পালটে দেয়, মানুষের হৃদয়ের অন্তরালে আজীবন জায়গা করে নেয় সেইসব স্থান। সেই আকর্ষণেই পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে মানুষ ছুটে যায় একবার নিজের চোখে সেইসব স্থানকে দেখবে বলে। আর তাঁরা যদি হন সিস্টার নিবেদিতা বা স্বামী বিবেকানন্দ কিম্বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা জগদীশচন্দ্র বসু তাহলে সেই জায়গা সম্পর্কে আলাদা করে কিছু বলার অবকাশই থাকে না। তাঁদের স্পর্শেই সেই পরিবেশ যেন আলাদা রকম সুন্দর হয়ে ওঠে। মানুষের কৌতুহলও বেড়ে যায় একবার সেই জায়গাকে খুব কাছ থেকে দেখবে বলে।

সিস্টার নিবেদিতার প্রিয় শহর ছিল এই দার্জিলিং। তিনি এখানে এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনও এসেছেন কোনো কারণ ছাড়াই নিছক অবসর যাপন করতে। কখনও ছুটে এসেছেন সমতল থেকে বহু দূরে এই দার্জিলিং পাহাড়ে কোনো অজ্ঞাত কারণে। এভাবেই কখন যে ‘কুইন অফ হিলস’-এর কোলটি হয়ে উঠেছিল তাঁর আরোগ্যের আশ্রয়স্থল তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেন নি। ইনিই হলেন বিবেকানন্দের মানসকন্যা নিবেদিতা।

দার্জিলিঙে বসে নিজের ভালোলাগার কথা, নিজের অনুভূতির কথা, পাহাড়ি প্রকৃতির মুগ্ধতার কথা উইলসনকে লিখে জানিয়ে ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “আমি কখনও জানতাম না দার্জিলিং এত সুন্দর! ঠিক এখনই বসন্তের ফুলে ভর্তি।”

দার্জিলিঙের বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি প্রকৃতির মতোই তাঁর নানারকম কাজ ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে, অসামান্য বৈচিত্র্যে ভরপুর সেই কাজ। দার্জিলিঙের প্রতিটি দিনকে তিনি নিজের কর্মব্যস্ততার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতেন। কখনও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে সঙ্গে নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কখনও বা জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণা গ্রন্থের প্রুফ সংশোধন করছেন। কখনও বা ছুটে যাচ্ছেন শৈল শহরে বস্তিবাসী শিশুদের কাছে। আবার কখনও বা আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াতেন আশপাশের পাহাড়ি গ্রামগুলিতে, প্রত্যক্ষ করতেন গ্রামীণ জীবনকে। তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল সেখানকার জনজাতির মানুষ। মিশেছিলেন নেপালি ভুটিয়া স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘এরা সকলেই সাহসী, পরিশ্রমী আর ধর্মপ্রাণ।’

১৮৯৮-র এপ্রিল মাস। বিবেকানন্দ তখন দার্জিলিঙে। মিস মুলারের সঙ্গে দার্জিলিং যাওয়ার কথা নিবেদিতারও। স্বামীজী হঠাৎ তাঁকে টেলিগ্রাম করে আসতে নিষেধ করলেন। প্রথম বার দার্জিলিঙে যাওয়ার সুযোগ এল ১৯০৩ সালের মে মাসে। তাঁর ঠিকানা হল ঘুম স্টেশনের কাছে ‘অ্যাসাইলিন ভিলা’। কিছু দিন আগেই এখানে এসে পৌঁছেছেন সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু। সেইসময় নিবেদিতার কিছু পরিচিত জন, বন্ধুরাও ছিলেন। সকলেই চলে আসতেন তাঁর বাড়িতে। সেবারে এসে ছিলেন ৪৯ দিন। মাঝে এক দিন তাঁর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে। তিনিও তখন দার্জিলিঙে,বড়দিনে স্কুল ছুটি।

জগদীশচন্দ্রের গবেষণাপত্র তৈরির কাজে বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। পাশাপাশি নিবেদিতা নিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতির কাজও করছিলেন। দার্জিলিঙে বসেই শেষ করলেন বইটির ছ’টি অধ্যায়ের কাজ। নানান কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই সময় বের করে চলে যেতেন বস্তিবাসীদের কাছে। সেখানে শিশুদের হাতে হাতে তুলে দিতেন খেলনা। এভাবেই চলছিল জীবন কখনও পাহাড়ে, কখনও সমতলে।

১৯০৫-র মার্চে হঠাৎই ‘ব্রেন ফিভার’-এ আক্রান্ত হলেন নিবেদিতা। দীর্ঘ এক মাসের জ্বরে শরীরের অবস্থা সঙ্গিন। কিছুটা সুস্থ হলে ডাক্তার নীলরতন সরকারের পরামর্শে জগদীশচন্দ্র হাওয়া বদল করতে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিবেদিতাকে নিয়ে পাড়ি দিলেন দার্জিলিং। এ বারে তাঁদের সঙ্গী হলেন নিবেদিতার বোন ক্রিস্টিন। সেখানে বসু-দম্পতি আর ক্রিস্টিনের সেবাযত্নে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলেন। নিবেদিতাকে মানসিক ভাবে প্রফুল্ল রাখার জন্য জগদীশচন্দ্র সব সময় ছিলেন তৎপর। একদিন দার্জিলিঙের বাজারে গিয়ে দেখলেন একজন একটি শেয়ালছানা নিয়ে এসেছে বিক্রির জন্য। জগদীশচন্দ্র চার আনা দিয়ে সেই শেয়ালছানাটিকে কিনে নিলেন। বাড়িতে ফিরে নিবেদিতাকে দিলেন। নিবেদিতার কি আনন্দ এমন উপহার পেয়ে। তার নাম দিলেন ওয়াইল্ড হার্ট। তাকে নিয়েই সময় কাটাতেন, মেতে থাকতেন। শেয়ালছানাকে কেন্দ্র করে এ সব দেখে ঠাট্টার ছলে জগদীশচন্দ্র বললেন, ‘ওটার ওপর অত মনোযোগ দিলে তো মুশকিল। ও-ই দেখছি আমায় ফতুর করবে।’ একদিন সকালে নিবেদিতার গলায় অভিমানের সুর “কাজ করতে পারব এ বার। …আজ বিকেলে শেয়ালছানাটিকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসব।”
এভাবেই কাটছিল দার্জিলিঙের স্মৃতিমধুর সেইসব দিনগুলো।

রায় ভিলা পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের লেবানং কার্ট রোডে অবস্থিত একটি চারতলা ভবন। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর স্বামী বিবেকানন্দের এই পরম প্রিয় শিষ্য নিবেদিতার মৃত্যু স্থান হিসাবেই পরিচিত হয়ে আছে।

এই ইউরোপীয় দুর্গের মতো কাঠামোটি প্রায় ১১৫ বছরের পুরনো এবং এর মূল মালিক বিখ্যাত বাঙালি দ্বারকানাথ রায়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল মিঃ পি কে রায়ের ভাই। গ্রীষ্মের আবহাওয়া এবং পরিবেশের কারণে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস বন্ধু দ্বারকানাথ রায়ের কাছ থেকে এই প্রাঙ্গণটি ভাড়া নিয়েছিলেন। তখন সম্পন্ন বাঙালিরা অনেকেই গরমের ছুটি কাটানোর জন্য শৈলশহরে বাড়ি কিনে রাখতেন। তবে দ্বারকানাথ খুব কমই থেকেছেন এখানে। বাড়িটি দীর্ঘদিন ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর আতিথ্যেই নিবেদিতা ১৯০৩ সাল থেকে ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২৪৬ দিন বসবাস করেছিলেন এখানে।

পরে যখন সিস্টার নিবেদিতার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছিল, তখন তিনি এবং লেডি আবালা বোস সিস্টার নিবেদিতাকে এই বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ার কারণে বোন নিবেদিতা এই জায়গাটি পছন্দ করেছিলেন এবং তাদের সাথে বিচক্ষণতার সাথে জীবনযাপন শুরু করেছিলেন। মিঃ ও মিসেস বোস ছাড়াও বিখ্যাত ডাক্তার নীল রতন সরকার এবং বিজ্ঞানী বাসীশ্বর সেনও ১৯১১ সালে সিস্টার নিবেদিতা মারা যাওয়ার সময়ে রায় ভিলাতে উপস্থিত ছিলেন।

রায় ভিলার পর দার্জিলিংয়ে সিস্টার নিবেদিতার সমাধিক্ষেত্রও ভক্তদের জন্য সাজিয়ে দেয় রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবর নিবেদিতার প্রয়াণ হলে দার্জিলিংয়ের বর্তমান শ্মশানেই তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয়। পরে ১৯২৫ সালে সেখানে নিবেদিতার স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে গত কয়েক বছর ধরে সেই সমাধিক্ষেত্রটি বেহাল হয়ে পড়েছিল। সমাজবিরোধীদের আখড়া বলে পরিচিত এলাকাটি নিবেদিতার ভক্ত এবং পর্যটকদের কাছে বেদনাদায়কও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে বছর দুয়েক আগে সমাধিক্ষেত্রটির সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সেন্টারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওখানকার অবস্থা অনেকটাই বদলে গেছে। নিবেদিতার সমাধিক্ষেত্রের পাশেই রাহুল সংস্কৃতায়ন, অগম সিং গিরি, এইচ ডি লামার সমাধিও রয়েছে। রয়েছে একটি প্রাচীন শিবমন্দির এবং কালী মন্দিরও। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা পূবোর্ত্তর দার্জিলিংয়ের ইতিহাস যেন থমকে রয়েছে এখানে। চকবাজার থেকে শ্মশানে যাওয়ার রাস্তাও জিটিএ’র পক্ষ থেকে পুরোপুরি সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে নিবেদিতা কিংবা দার্জিলিংয়ের পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহীরা এখন দার্জিলিংয়ের শ্মশানে এলে হতাশ হবেন না বলে দাবি সেন্টারের। রায়ভিলার রামকৃষ্ণ মিশন সেন্টারের প্রধান স্বামী নিত্যসত্যানন্দ বলেন, ‘যখন কাজটা আমরা হাতে নিই তখন অর্থের সংস্থান নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু নিবেদিতার ভক্তরাও আমাদের চিন্তা দূর করে দেন। এখন ভক্তরা এখানে এসে হতাশ হবেন না বলে আশা করছি।’ দার্জিলিং মানেই বাংলার নবজারণের এক জাগ্রত ইতিহাস। দেশবন্ধু, নেতাজি, গান্ধী,, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, কার না পদধূলি পড়েছিল এই শৈলশহরে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!