শিয়ালদা স্টেশনের ন-নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে সবে মাত্র আটটা কুড়ির বনগাঁ লোকালটা ছেড়ে চলতে শুরু করেছে। সুজয় প্ল্যাটফর্মের দিকের দরজার কোনায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে দেখতে পেল নয় ও দশ নম্বরের মাঝে একটা মোটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ঝুমা। পাশে রাখা একটা ঢাউস ট্রলি ব্যাগ। এতদিন পর আচমকা ঝুমাকে দেখে সুজয় ঠিক কী করবে ভেবে না পেয়ে চকিতে লাফিয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মের উপর। ট্রেনটাও তার গতি মৃদু বাড়িয়ে বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গেছে। চলন্ত ট্রেন থেকে নামার মোশানটা কোনো রকমে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। তারপরই হনহন করে সেই দিকে হাঁটতে শুরু করল, যেখানে ঝুমাকে দেখেছিল।
মিনিট-খানেকের মধ্যেই সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে গেল সুজয়। একি! কোথায় গেল! এখানেই তো ও দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এক মিনিটের মধ্যে গেল কোথায়! চারদিকটা খুব ভালো করে দেখল ও। যদি জায়গা পরিবর্তনও করে থাকে, কাছাকাছি ছাড়া আর কোথায় যাবে!
আরও মিনিট-তিনেক সে একই জায়গায় বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, তাহলে কি ভুল দেখলাম? পরক্ষণেই ফের ভাবে, অসম্ভব! আমি মোটেই মাল খেয়ে নেই যে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে ভুল দেখব!
কিন্তু গেল কোথায় মেয়েটা এক মুহূর্তের মধ্যে! আরও একবার সে ভালো করে এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখল। নাহ্, কোথাও নেই। ঠিক সেই মুহূর্তেই লাউড স্পিকারে ঘোষণা হল, পরের বনগাঁ লোকাল দশ নম্বরে। খানিকটা হতাশ হয়েই সুজয় পাশের দশ নম্বরের দিকে পা বাড়িয়ে সেই মোটা থামটা পেরিয়ে দু-পা এগোতেই দেখে ঠিক ওই থামটার পেছনেই একটা থ্রি সিটেড প্ল্যাটফর্ম চেয়ারে বসে আছে ঝুমা। উদাস চোখে চেয়ে আছে সামনের দিকে। কোনো দিকেই যেন কোনো খেয়াল নেই। ওর পাশের ফাঁকা জায়গাটায় আলতো করে বসল সুজয়। তবুও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। সুজয় কোনো কথা না বলে ওর পাশে বসেই থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পর পাশে এসে বসা মানুষটার দিকে আলগোছে তাকিয়ে চোখটা সরিয়ে নেয় ঝুমা। মুহূর্তের মধ্যেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষের মতো ফের ঘুরে তাকায় সুজয়ের দিকে। বিস্মিত চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে ওঠে, “একী! তুমি এখানে? কোথা থেকে?”
“কোথা থেকে আর? কলেজ স্ট্রিট থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। ট্রেনের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ট্রেনটা চলতেও শুরু করেছিল। হঠাৎই তোমাকে দেখলাম এই থামটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছো। চলন্ত ট্রেন থেকেই তাই লাফিয়ে নেমে পড়লাম।”
সুজয়কে থামিয়ে দিয়ে ঝুমা বলে, “চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নামলে! কিন্তু কেন?”
“কী আশ্চর্য! টানা এগারো মাস পর তোমাকে আচমকা এভাবে খুঁজে পাবো, আর আমি ট্রেনে করে বাড়ি চলে যাব?”
“খুঁজে পাবো মানে! আমাকে তোমার খোঁজার প্রয়োজনটাই বা কী?”
“সেই কথা বলার জন্যই তো এতটা ঝুঁকি নিয়েও নেমে পড়লাম। কিন্তু পেছন দিকে পিছিয়ে এসে তোমাকে না দেখতে পেয়ে তো আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজির মতো যেন হওয়া হয়ে গেলে। আমি তো ভাবতেই পারিনি, তুমি এখানে বসে আছো! ভাগ্যিস পরের ট্রেনটা দশে দিল। তাই এদিকে ঢুকতেই তোমাকে দেখতে পেলাম।” এতগুলো কথা বলার পর একটু থামল সুজয়। ঝুমা ওর দিকেই চেয়ে আছে সরু দৃষ্টিতে। সুজয় ফের শুরু করে, “তুমি এখানে বসে আছো কেন? কোথাও যাবে, না কি কোনো জায়গা থেকে এলে?”
“যাব।” কিছুটা দাঁত চেপে বলে ঝুমা।
“কোথায়?”
“জলপাইগুড়ি। কিন্তু আজ আর যাওয়া হবে না। জ্যামে আটকে পাঁচ মিনিটের জন্য উত্তরবঙ্গটা ফেল করলাম।” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝুমা।
“উত্তরবঙ্গ? সেখানে কী?”
“সেখানে আমি থাকি। অফিসের একটা জরুরি কাজে দুদিনের জন্য আসতে হয়েছিল। তাছাড়া অনেকদিন মাকেও দেখি না। তাই এসেছিলাম। কিন্তু এমন বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়ে গেল!”
“তাহলে এখন কী করবে?”
“দেখি, এখানেই কোনো একটা গেস্ট হাউসে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে শিলিগুড়ির কোনো একটা বাস ধরতে হবে। এ নিয়ে তো তোমার ভাবার কথা নয়। আমার সমস্যা আমিই মিটিয়ে নেবো। এখন তুমি আমাকে বলো, আমাকে তোমার এত খোঁজার কী হয়েছে? আমার কাছে তো তোমার কোনো প্রয়োজন থাকার কথা নয়। অবশ্য কোনো দিনই সেটা ছিল না। বলো এবার কী এমন তোমার জরুরি প্রয়োজন যে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়তে হল?”
আরও পড়ুন: স্তনকর
কিছুটা সময় নিয়ে সুজয় বলে, “বলছি। তার আগে আমাকে একটা কথা বলবে? অবশ্য তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে?”
“একটা বিষয় ছাড়া অন্য যে-কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে পারো। সেটা হল আমি ঠিক কোথায় আছি।” বেশ দৃঢ়তা নিয়ে কথাগুলো বলে ঝুমা।
“আসলে আমি এই কথাটাই জানতে চাইছিলাম। ঠিক আছে, তোমার যখন আপত্তি আছে, বলতে হবে না।” মৃদু স্বরে বলে সুজয়।
“শুধু এটা জানার জন্যই তোমার এই আকুলতা?”
“নানা, তা নয়। তোমাকে আমি যে কারণে এতদিন ধরে খুঁজেছি সেটা তা নয়। কেউ তোমার কোনো সঠিক খবর দিতে পারেনি। নানা ভাবে জানবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনো ভাবেই জানতে পারিনি!”
সুজয়ের কথার মাঝেই রীতিমত দৃপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠে ঝুমা, “তাই নাকি, তা কীসের জন্য এবার একটু খুলে বলা যাবে? হাতে বেশি সময় নেই। প্রায় নটা বাজতে চলল। আমাকে একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।”
“ঝুমা, সমীর ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও। তুমি চলে যাবার পর থেকেই ও একেবারে ভেঙে পড়েছে। তুমি তো জানো না, ও এখন কোনো রকমে চাকরিটাই শুধু করে। অফিস থেকে এসে সেই যে ঘরে ঢুকে যায়, আর বেরোয় না। আমার কাছে আসাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। তুমি বিশ্বাস করো, ও প্রকৃতই ওর ভুলটা বুঝতে পেরেছে।” এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে সুজয়।
শিয়ালদা প্ল্যাটফর্মের লাউড স্পিকারে ঘোষিকা একের পর এক বিভিন্ন দিকের ট্রেনের ঘোষণা করে চলেছে। সময় পেরিয়ে চলেছে পলে পলে। যত সময় যাচ্ছে, ট্রেন ধরার যাত্রী সংখ্যাও কম আসছে। একটা হতশ্রী বৃদ্ধা ভিখারি ঝুমার সামনে এসে হাত পাততে ঝুমা পার্স থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিলে টাকাটা মাথায় ঠেকিয়ে চলে গেল সে।
এবার মুখ খুলল ঝুমা, “তোমার আর কি কোনো কথা আছে? না থাকলে আমি তোমাকে কয়েকটা কথা বলে উঠব।”
“না, আমার তেমন আর কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি যেটা বললাম, সেটা কি তুমি বিশ্বাস করেছ? বুঝেছ?” বলে সুজয়।
“সুজয়দা, এটা কোনো বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়। আমার কাছে এর কোনো কানাকড়িও দাম নেই। কেন না তোমার সমীর এবং তুমি এখনো পর্যন্ত যে বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছো, আমি কোনো দিনই সেখানে নিজেকে নিয়ে যাইনি। যেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম, যার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম সে শুধু অন্ধ হয়েই ছিল না, বধিরও হয়ে ছিল। আজও আছে।” কেটে কেটে কথাগুলো বলে ঝুমা।
আজ এতদিন পর কী শুনছে সে! ভাবে সুজয়। ঝুমার দিকে বিস্ময় নিয়ে বলে সে, “আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না।”
“কিভাবে আর বুঝবে? একই সঙ্গে অন্ধ এবং বধির হয়ে থাকলে বোঝার কথাও নয়।”
ঝুমার কথায় তালগোল পাকিয়ে যায় সুজয়ের সব ভাবনা-চিন্তা। অসহায়ের মতো বলে ওঠে সে, “কিন্তু সমীর যে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে ঝুমা!”
“চুপ, একদম চুপ। ভালোবাসা কী জিনিস সেটা যেমন তোমার বন্ধু জানে না, তেমনি তুমিও জানো না। আর এসব কথা বলার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?”
আচমকা ঝুমার এরকম ঝাঁঝে রীতিমত ঘাবড়ে যায় সুজয়। ঝুমা আবার একই রকম সুরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “বন্ধু প্রীতি? কী জানো তুমি তোমার বন্ধু সম্পর্কে? বছরের পর বছর তোমার বন্ধুত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ও তোমার জন্য কী কী করেছে তুমি জানো?”
“আমি জানি ঝুমা। যেদিন প্রথম সমীর আমাকে তোমার প্রতি ওর দুর্বলতার কথা জানাল, সেদিন থেকেই আমার মনে তোমাকে নিয়ে যেটুকু জায়গা তৈরি হয়েছিল। আমি সেই জায়গা ওর জন্য ছেড়ে দিয়েছি।”
“কেন? সেই বন্ধু প্রীতি?”
“না! শুধু বন্ধু প্রীতি নয়। আমার সেই দুর্বলতা তো ছিল একতরফা। বিপরীত প্রান্ত থেকে তো আমি কোনো ইশারা পাইনি। তাই আমার নিজের জগৎ আমার লেখালেখিকেই আরও বেশি করে আঁকড়ে নিয়েছি। সমীর যে কতখানি সেনসিটিভ, তা আমার থেকে বেশি আর কেউ জানে না।”
“আর তাই তুমি ডুবে যেতে শুরু করলে সুরার সমুদ্রে?” ব্যঙ্গ ফুটে ওঠে ঝুমার ঠোঁটে। “মাঝে মাঝেই সোনাগাছির অলিগলি ঘুরতে শুরু করলে?”
এতক্ষণ অংশত মাথা নামিয়ে রাখা সুজয় এবার স্থির দৃষ্টিতে সরাসরি চোখ রাখে ঝুমার চোখের উপর।
“ছিঃ ঝুমা ছিঃ। আমি মাতাল হতে পারি। একটানা সাত-আটদিন মদ খেয়ে শুয়ে থাকতে পারি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অপবাদ দিও না।” এই বলে উঠে দাঁড়ায় সুজয়।
“আমি না। এই অপবাদ দিয়েছে তোমার অবিচ্ছেদ্য বাল্যবন্ধু সমীর।” একই রকম ঋজুতার সঙ্গে বলে ঝুমা। তারপর সুজয়ের একটা হাত টেনে ধরে বলে, “উঠলে কেন, বসো। আরও অনেক কথা আছে। আমার যাওয়া যখন হলই না, বাকি কথাগুলো বলেই তবে আমি যাব।”
“তুমি যা বললে, সত্যি সত্যি আমার আর কিছু শোনার নেই। যদি সত্যিই সমীর আমার সম্পর্কে এই কথা বলে থাকে, তাহলে আমার আর কিছু বলারও নেই। এখন থেকে আমি এটাই ভেবে নেব, এতদিন যা করেছি তার সবটাই ছিল একটা ভ্রান্তি বিলাস। আমারই ভুল। খামোখা অন্যকে দায়ী করে কী লাভ!”
“কিন্তু সুজয়দা, যিশুর মতো বাণী দিয়ে চলে গেলে তো চলবে না স্যার। আমার বাকি কথাগুলোও তোমাকে শুনে যেতে হবে। কারণ, আর হয়তো আমার বলা নাও হতে পারে।”
সুজয় আবারও অবাক চোখে ঝুমার তাকিয়ে বসে পড়ে ওর পাশে, “মানে! বলা নাও হতে পারে মানে?”
“হ্যা, আগামী মাসে আমি একটা প্রজেক্টের কাজে নেপাল চলে যাচ্ছি। দু-বছরের কাজ। তারপর কে কোথায় থাকে….” থেমে যায় ঝুমা।
সুজয় এক বুক হতাশা নিয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকায় এই মাত্র দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাওয়া একটা ট্রেনের গার্ড বগির পেছনে ব্লিপ দেওয়া অস্তমিত লাল আলোটার দিকে। হঠাৎই ওর মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, যেদিন প্রথম ঝুমা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।
‘আজকের কথা’ দৈনিকে ওদের বিচারে বছরের সেরা গল্পকার ও ঔপন্যাসিকের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে পুরস্কার নিয়ে মঞ্চ থেকে কেবলই নেমে এসেছে সুজয়। একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো আটপৌরে একটি মেয়ে।
“এটা আপনার জন্য। আমি আপনার গল্পের একজন মনোযোগী পাঠিকা বলতে পারেন। কাগজে আজকের অনুষ্ঠানের খবর পড়েই এখানে আসা। শুধুমাত্র আপনার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করার প্রত্যাশায়। যদি আমাকে একটু সুযোগ দেন, তাহলে আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি?”
আরও পড়ুন: বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা
অতি সাধারণ চেহারার একটি মেয়ে। বয়সে আন্দাজ সুজয়ের থেকে বছর চার-পাঁচেকের ছোট হবে। মুগ্ধ হয়ে যায় সুজয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের দুনিয়ায় ওর কিছুটা নামডাক হয়েছে। কিন্তু সে এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়। এভাবে এর আগে তার কোনো নিজস্ব পাঠক বা পাঠিকা সামনে এসে দাঁড়ায়নি। কিছুটা আপ্লুত হয়ে পড়ে সুজয়। তারপর বলে, “খুব ভালো লাগছে আপনার এই অভ্যর্থনায়। কিন্তু আজকে যে আমার একদম সময় নেই ভাই। খুব একটা জরুরি কাজে আমাকে এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে। আপনি এক কাজ করুন না, যদি কোনো অসুবিধা না থাকে আগামী পরশু আমার বাড়িতে আসুন না। কথা হবে। বাড়িতে আমি আর আমার মা থাকি। ওই দিন ছুটি আছে তো, তাই বলছিলাম।”
“হ্যা হ্যা, কোনো অসুবিধা নেই। কখন যাব বলুন?” সপ্রতিভ জবাব মেয়েটির।
“এই দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ।”
“বেশ, আমি তখনই যাব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদের কিছু নেই। আপনি আসবেন। আপনার নামটা….”
“হ্যাঁ, আমার নাম ঝুমা। ঝুমা রায়। থাকি, আপনার বাড়ির থেকে খুব একটা দূরে নয়— হৃদয়পুর।”
“ও তাই নাকি? তাহলে তো কাছেই। বেশ, তবে আসি?”
এর মধ্যেই ‘আজকের কথা’-র একজন স্টাফ এসে জানল, “দাদা, আপনার জন্য গাড়ি এসে গেছে। কোথা যাবেন ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বলে দিলেই হবে।”
সুজয় সেদিন সেই মেয়েটির দিকে একটা তৃপ্তির হাসি মেলে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল।
আচমকা চিন্তার ছেদ ঘটে ঝুমার মৃদু ধাক্কায়।
“কি হল, এরকম ব্যম্ হয় গেলে কেন? এই তো যিশু খ্রিস্টের মতো ঔদার্যের কথাবার্তা বলছিলে?”
“ঠিকই বলেছ তুমি, ঔদার্য! আচ্ছা, সমীর তোমাকে বলেছে এসব কথা?”
দৃঢ় প্রত্যয়ে উচ্চারণ করে ঝুমা, “কেন, আমার কথা বিশ্বাস হল না? তাহলে শোনো, শুধু বলেনি, ছবিও দেখিয়েছে।”
“ছবি! কীসের ছবি?”
“তুমি সোনাগাছির একটা ঘরে একটা চটুল সাজের মেয়ের গলা জড়িয়ে বসে আছো। তুমি চাইলে সে ছবি আমি তোমাকে পাঠিয়ে দিতে পারি।”
সেই মুহূর্তে সুজয়ের সামনের সব কিছুই যেন কেমন কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে উঠতে থাকে। অস্ফুটে বলতে থাকে সে, “আমি সোনাগাছিতে! একটা চটুল সাজের মেয়ে! তার ছবি….”
আকুল হয়ে ঝুমার একটা হাত চেপে ধরে সুজয়, “তুমি বিশ্বাস করো ঝুমা, এসব মিথ্যে। সব মিথ্যে, সাজানো। আমি ভাবতেই পারছি না সমীর শুধু তোমাকে পাবার জন্য এত নীচে নামতে পারল? এ যে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না।”
“একটা মানুষকে তুমি বিশ্বাস করতেই পারো। কিন্তু এমন অন্ধ হয়ো না, যেখানে বিশ্বাস এবং আস্থা শুধুমাত্র বন্ধু প্রীতির জন্য ঠুনকো হয়ে পড়ে সুজয়দা। ওটাও কিন্তু মানুষের একটা সম্পদ। সমীরের ওপর তোমার এই বিশ্বাস এতটাই অন্ধ ছিল যে তার কাছে বাকি সব লঘু হয়ে পড়েছিল। এমনকি তোমার মতো একজন গুণী, কৃতী মানুষও সেই লঘুত্বের কাছে হার মেনেছিল।” রীতিমত একজন অধ্যাপকীয় উপদেশের সুরে কথাগুলো বলে ঝুমা। একপ্রকার মাথা নিচু করে শোনে সুজয়।
ঝুমা আবার বলতে শুরু করে, “সমীরের একটা মেন্টাল প্রবলেমের মাসতুতো বোন আছে না, খরদায় থাকে?”
সুজয় মাথা নাড়ে।
“কোনো এক মহূর্তে হয়তো স্নেহবশতই তুমি ওর কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরেছিলে। কোনো কারণ ছিল কি না জানি না, সমীর সেই মুহূর্তের একটা ছবি তুলেছিল। সেই ছবিটাই ও আমাকে দেখিয়ে তোমার বেশ্যা বাড়িতে যাবার গল্প করেছিল নির্লজ্জের মতো। আমি সেদিনও ওর কথা বিশ্বাস করতে পারিনি, আজও করি না। কিন্তু ছবিটার ব্যাপারে আমার মধ্যে একটা খটকা থেকেই গিয়েছিল।”
আরও পড়ুন: অনুসুয়ার মা
সুজয়ের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সন্ধের ছবিটা। সমীরের ভাইপো তুতুনের জন্মদিন ছিল। কলেজ স্ট্রিটে একটা প্রকাশন সংস্থা থেকে ফিরে রাত নটা নাগাদ ওদের বাড়ি গিয়েছিল সুজয়। সেখানেই ছিল ওর মাসতুতো বোন রেখা। জন্ম থেকেই ওর একটা মানসিক সমস্যা আছে। বড় হবার পর যেটা বেশি করে বোঝা যায়। এমনিতে কোনো সমস্যা নেই। নিজের সমস্ত কাজকর্ম নিজেই করে। শরীরও ভালো। সমস্যা শুধু কথাবার্তায় অসংলগ্নতা আর অস্বাভাবিক জেদ। ওর আর একটা বড় ম্যানিয়া সব সময় চড়া সাজগোজ করে পটের বিবি হয়ে থাকা। বাড়ির লোকেরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কারণ এটা ওর ওই জেদি স্বভাবেরই একটা বহিঃপ্রকাশ।
সেদিন সুজয় সমীরদের বাড়িতে ঢুকেই বুঝেছিল রেখার কোনো একটা সমস্যা চলছে। সমীরকে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “আর বলিস না! ওর এক নতুন বায়না হয়েছে তুতুনের জন্মদিনে ও বেনারসি শাড়ি পরবে। কোনো মানে আছে বল। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেউ বেনারসি-টসি পরে নাকি? বাড়ি ভর্তি লোকজন; কী বলবে বল তো? সেই সন্ধে থেকে মুখ গোমড়া করে বসে আছে।”
“দাঁড়া, দেখছি আমি।” বলে সুজয় রেখার দিকে এগিয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই রেখা সুজয়ের খুব ন্যাওটা। যখন খুব ছোট ছিল, মামাবাড়িতে এলে সুজয়কে তো ছাড়তেই চাইত না। এখন বড় হয়ে গেলেও ওর প্রতি সেই একই টান রয়ে গেছে।
সমীরের ঘরেই খাটের এক কোনায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে ছিল রেখা। সুজয় পাশে গিয়ে বসতে ও একবার সুজয়ের দিকে তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল। ভাঁজ করা হাঁটুর ওপর থেকে রেখার একটা হাত টেনে নিয়ে সুজয় বলে, “শুনলাম তুই রাগ করেছিস। তুই তো আমাকে বিশ্বাস করিস। করিস না? তাহলে আমার একটা কথা শোন। শুনবি তো?”
রেখা ধীরে সুজয়ের দিকে ফিরে অস্ফুটে বলে, “কী বলছ?”
“আজ তুতুনের জন্মদিন। কত লোকজন এসেছে। সবাই আনন্দ করছে। আমি এসেছি। তুই তো এখন বড় হয়েছিস। এখন এমন জেদ করলে কি ভালো দেখায়? আর তুতুনেরও কি ভালো লাগছে? আমি তোকে বলছি, আমার বিয়ের সময় তোর নতুন মামির সঙ্গে সঙ্গে তোকেও আমি একটা বেনারসি কিনে দেবো। তুই সেই বেনারসি পরে আমাদের বাড়িতে ঘুরে বেড়াবি, কেমন। এখন ওঠ চল, ওঘরে সবাই আছে, সেখানে চল।”
রেখা কয়েক মুহূর্ত সুজয়ের দিকে চেয়ে থেকে সুজয়ের গলাটা জড়িয়ে মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে বলে, “চলো, তোমার কথাই শুনলাম।”
সুজয়ের সঙ্গেই ঘরে ঢুকে এই মান ভাঙানোর পালা দেখছিল সমীর। রেখার মুখে হাসি দেখে চেঁচিয়ে ওঠে ও, “এই দাঁড়া দাঁড়া। মান ভঞ্জনের একটা ছবি তুলে রাখি।” বলেই পট পট করে মোবাইলে কয়েকটা ছবি তুলে নিল।
তাহলে সেই ছবিই সমীর ঝুমাকে দেখিয়েছে? এই তার এতদিনের বন্ধুকৃত্যর প্রতিদান! অথচ সরল বিশ্বাসে ঝুমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সমীরের। অনেক সময়েই ওদের তিনজনের একই সঙ্গে আড্ডা বসতো কখনো সুজয়ের বাড়িতে, কখনো সমীরের বাড়িতে।
ঝুমার সঙ্গে প্রথম আলাপের পর বহুবার সুজয়ের বাড়িতে এসেছে ও। সুজয়ের মায়ের সঙ্গেও ওর ভাব জমে উঠেছে ওর নিজের গুণেই। ঝুমার আটপৌরে বেশভূষা আর সারল্যে ক্রমেই সুজয় কেমন যেন মোহিত হয় পড়ে। নিজে নিজেই ভাবে লেখালেখির সূত্রে অনেক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গেই তো আলাপ হয়েছে। কই, কারও জন্য তো কখনো এমন মোহিত হয়ে পড়েনি। এই মোহিত হয়ে পড়ার অর্থ কি দুর্বলতা? একটা সময়ে এসে যখন ও বুঝল একটানা দু-তিনদিন ঝুমাকে না দেখলেই মনের ভেতর কেমন এক শূন্যতা এসে ভর করে, তখন স্পষ্ট বুঝতে পারে সুজয়— আর কিছু করার নেই ওর। ভাবতে শুরু করে, এবার ঝুমার কাছে ওর না-বলা কথার আগলটা ভেঙে দেবে। আবার, ঝুমার দিক থেকে তেমন কোনো ইঙ্গিত বুঝতে না পেরে ভাবে, সেটা ভালো ভাবে নেবে তো ঝুমা! বাহ্যত মেয়েটি এতটাই খোলা মনের এবং সরল প্রকৃতির যে, ওর মনে কী আছে সেটা অনুমান করা খুবই কঠিন। তাই আর নিজেকে ওর সামনে মেলে ধরতে সাহস হয় না। এর মধ্যেই একদিন সন্ধ্যায় অফিস ফেরতা সমীর সুজয়ের বাড়ি এলো। একথা-সেকথা বলার পর সুজয়কে বলল, “সুজয়, কিছুদিন ধরেই তোকে একটা কথা বলব বলে ভাবছি।”
“বল, কী কথা?” স্বাভাবিক প্রশ্ন সুজয়ের।
“ঝুমা যে আমার সবটা অধিকার করে নিয়েছে রে। তুই একটা কিছু কর।”
আচমকা মনে হল সুজয়ের মাথায় বাড়ির গোটা ছাদটা ভেঙে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে ওর মস্তিষ্কটা যেন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। কোনো কিছুতেই কোনো বোধ কাজ করছিল না। বেশ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল সমীরের দিকে। সমীরই ফের বলল, “কীরে, কী বললাম বুঝতে পেরেছিস? তোকে একটা কিছু করতেই হবে। আমি না পারছি ওকে কিছু বলতে, না পারছি নিজের মধ্যে চেপে রাখতে। ওই মেয়েই আমার জীবনে একমাত্র আসতে পারে। আর কেউ নয়।”
তাহলে গত প্রায় ছ-সাত মাস ধরে যে স্বপ্নকে সে লালন করে চলেছে, তার কী হবে? ভাবতে থাকে সুজয়। আবার সমীর সেই মানুষ, যাকে আবাল্য প্রগাঢ় বন্ধুত্বের নিবিড়তায় যেভাবে নিজের অংশ হিসাবে ভেবে এসেছে, তাকেও তো অস্বীকার করা সম্ভব নয়। প্রাণময় বন্ধুকে বলে সে, “আমাকে কটা দিন সময় দে। তারপর তোকে জানাচ্ছি। ওরও তো মতটা জানা প্রয়োজন।”
দুদিন পর সুজয় ঝুমাকে সমীরের কথাটা জানিয়ে বলে, “তোমার কী মত, সেটা জানালে ওকে আমি জানিয়ে দেবো।”
অনেকক্ষণ সুজয়ের দিকে অপলকে কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে ঝুমা বলেছিল, “তুমিও কি এটাই চাও?”
“ঝুমা, সমীর আমার কাছে অনেক কিছুরই ঊর্ধ্বে। ওকে আমার অদেয় কিছু নেই। কিন্তু এই বিষয়ে তো আমার কোনো হাত নেই। এটা তোমার আর ওর সম্পর্কের ব্যাপার। তুমি যা বলবে, তাই হবে।”
“শুধু তাই? তোমার আর কোনো চাওয়া নেই?”
“আমার আর কি চাওয়া থাকবে? সমীর খুশি হলেই আমার তৃপ্তি। একই রকম ভাবে সেটা তোমার ক্ষেত্রেও। তুমি খুশি হলেও আমার তৃপ্তি।”
আরও পড়ুন: পেশা বদল
খুব বেশি সময় নষ্ট করেনি ঝুমা। জানিয়ে দিয়েছিল ওর বক্তব্য, “এ নিয়ে তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না। সমীরদাকে যা বলার আমিই বলব।”
সেই মুহূর্তেই উঠে চলে গিয়েছিল ঝুমা। তারপর থেকে ঝুমা আর সুজয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেনি। চেষ্টা করেও কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি সুজয়। শুনেছি মাঝে মাঝে সমীরের বাড়িতে যায়। কিন্তু ওর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগই করেনি। তবুও এই ভেবেই শান্তিতে থাকতে চেয়েছে যে, সমীর আর ঝুমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক থাকুক, ব্যাস। কিন্তু হঠাৎ একদিন সমীর বলল, “না রে সুজয়, ঝুমা বোধহয় অন্য কাউকে মন দিয়ে বসে আছে।”
ভুল, ভুল ভাবছে সমীর। তেমন কিছু হলে এতদিনে কি সে কোনো আভাসই পেত না? সুজয় ওকে নানা ভাবে ওর এই ভ্রান্ত ধারণা কাটাবার চেষ্টা করলে সমীর বলে, “আমি জানি না বন্ধু— হয়তো তোর দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ও তোকেই মনে মনে ভালোবাসে। হয়তো কোনো কারণে তোকে বলতে পারছে না।”
সমীরের কথার সেভাবে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না সুজয়। আবার ওর ভেতরের কথাটাও বলতে পারে না সমীরকে। ঝুমাও নিশ্চই সমীরের এই মনোভাব বুঝেই নিজেকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে— ও যে বুদ্ধিমতী মেয়ে! আর তাই যেভাবেই হোক ঝুমার সঙ্গেও কথা বলতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবে তারে!
ঝুমা আচমকা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে সমীর নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল। আর সেই দৃশ্য দেখে সুজয়ও খাচায় বন্দি পাখির মতো ছোটফট করে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ সে কোন সমীরের রূপের কথা জানল ঝুমার মুখ থেকে? পৃথিবীতে এও হয়?
পরিতাপের আগুনে আটকে থাকা সেই অগ্নিশিখার বাইরে বেরিয়ে আসে সুজয়। সে যে সত্যিই এতদিন ভুলে ভরা বন্ধুকৃত্যের অস্তিত্বের লালন করে এসেছে নিজের মূর্খতার বলিদানে, সেটা স্বীকার করে নিয়ে চেয়ে থাকে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা এই মেয়েটির মুখের দিকে। প্ল্যাটফর্মের উজ্জ্বল আলোয় সেই মুখ যেন এক সময়ে একজনের প্রতি ভ্রান্ত ঔদার্য, আর আর-একজনের প্রতি প্রত্যাখ্যানের পাল্টা প্রত্যাঘাত করতে পারার তৃপ্তিতে চক চক করে জ্বলতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে হতাশার প্রান্তিক সীমায় এসে সুজয় ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে, “আমি খুব ভালো লিখতে পারছি ঝুমা। তোমার খুব আশা ছিল, সানন্দ পাবলিশার্স থেকে আমার একটা গল্প সমগ্র বেরোনোর। এবার বইমেলায় সত্যি সত্যিই ওরা আমার সমগ্র নয়, নির্বাচিত বের করছে। তুমি ভালো থেকো ঝুমা। আমিও ভালো থাকব।”
“তোমাকে বলছিলাম না, ওই ছবির ব্যাপারটায় আমার একটা খটকা থেকেই গিয়েছিল। সেই খটকাটা যেদিন কাটলো, সেদিনই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল তোমার বন্ধু কতটা তোমার জন্য বিপজ্জনক আর তুমি কতটা বোকা! সমীরদার প্রতি যেটুকু অনুকম্পা ছিল ঘটনাটা বোঝামাত্র ওর প্রতি ঘেন্নায় আমার শরীর মন কলুষিত হয়ে গেল।” কথাগুলো বলে একটু থামে ঝুমা। তারপর ফের বলতে শুরু করে, ” ওর ওই মাসতুতো বোন রেখাকে আমি সেই প্রথম দেখলাম। আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, সমীরদার অফিসে তাদের একটা ফাইল ছিল। এটা জানার পর ট্যাকনিকাল কারণেই ওর বাড়িতে যাই ফাইলটা নিয়ে কথা বলতে। সেখানেই রেখাকে দেখে আমার খুব চেনা চেনা মনে হল। কিন্তু কিছুতেই ট্রেস করতে পারছিলাম না। বাড়ি ফিরে হঠাৎ কী মনে হতে মোবাইলটা খুলে দেখি হুবহু এক মেয়ে। পরদিনই আবার ওই ফাইলের ছুঁতো নিয়ে ওর বাড়ি গিয়ে খুব ভালো করে মিলিয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আসল ঘটনা কী ঘটতে পারে। আমি এও নিশ্চিত ছিলাম তখন তোমাকে এই ঘটনার কথা জানালে অবশ্যই তুমি আমাকে ভুল বুঝতে।”
প্ল্যাটফর্মের এক অন্য প্রান্তে দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে বলে সুজয়, “হয়তো বুঝতাম না ঝুমা। কারণ তুমিও আমাদের টানা এক বছরের মেলামেশাতেও বুঝতে পারোনি ধীরে ধীরে তোমার জন্য আমি কতটা ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম। তোমার সারল্যের কাছে আমার অজান্তেই কখন যে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছি আমি নিজেই জানতে পারিনি। আর তাই তোমাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশই ছিল না। তুমিও কখনো আমাকে বুঝতে দাওনি তোমার ভেতরের ভাষা। ভালোই হয়েছে। আমার মতো একজন মূর্খের এটাই যোগ্য প্রাপ্তি।”
কথাগুলো বলে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়ায় সুজয়।
ঝুমা ওর হাতটা টেনে ধরে বলে, “কোথায় যাচ্ছ আমাকে একলা ফেলে? অনেক জ্বালিয়েছ। আর নিয়ে। এবার চলো, আজ আমি মাসিমার কাছেই থাকব।”#