সিটং

দার্জিলিং-এর খ্যাতি নানা বিষয়ে। যার মধ্যে একটি কমলালেবু। মজার কথা হল, দার্জিলিং-এর বিখ্যাত কমলালেবুর সিংহভাগই উৎপন্ন হয় সিটং- এ। তাই সিটংকে বলা হয় কমলালেবুর গ্রাম। সিটং বা সিতং গ্রামটি দার্জিলিং জেলার কার্শিয়ং মহাকুমা এ অবস্থিত একটি লেপচা গ্রাম, এই সিটং এর উচ্চতা হল ৪০০০ ফিট। কিন্তু এই গ্রামটি বাঙালিদের কাছে পরিচিত কমলালেবুর গ্রাম হিসেবে। সিটংকে দার্জিলিং এর কমলালেবুর হৃদয়ও বলা হয়। এই জায়গাটি পর্যটকদের কাছে এক নতুন ভ্রমণের জায়গা হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এখানকার কমলালেবুর বাগানের জন্য। এছাড়াও রৌদ্রজ্জ্বল দিনে এখানে থেকে পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায়। নিরিবিলিতে প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য ও চিন্তা মুক্ত সময় কাটানোর জন্য সিটং একটি উপযুক্ত জায়গা। সিটং মূলত একটি ছোট পাহাড়ি গ্রাম যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরুপ, এখানকার সৌন্দর্য যে কোনও প্রকৃতিপ্রেমিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে তুলবে।

সিটং আদতে খাসমহল, অনেকগুলি ছোট ছোট গ্রাম মিলে গড়ে উঠেছে অঞ্চলটি। বসবাসের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক গুম্ফা বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরি। গুম্ফাটি আপার সিটং-এ। ট্রেক করে উঠতে হয়। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ ভিউ পাওয়া যায়। একটি অতি প্রাচীন গির্জাও রয়েছে। গির্জাটি একেবারে হোম স্টে লাগোয়া। এটি বাঁশ আর মাটির তৈরি ছিল আগে, সম্প্রতি সংস্কার হয়ে পাকা দালান। তবে, স্থাপত্যে পুরোনো আঙ্গিক ব্যবহার হওয়ায়, গির্জার প্রাচীন রূপটি রক্ষিত হয়েছে।

যাই হোক শিলিগুড়ি বা এন জে পি স্টেশন থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথমে সেবক হয়ে মংপু। সেবকে পৌঁছতেই করোনেশন সেতু। বয়ে চলেছে লাস্যময়ী তিস্তা। মংপু থেকে সিটং সাড়ে আট কিলোমিটার। কিছু দূর যেতেই দেখা যাবে রিয়াং নদীর সঙ্গে। স্থানীয়দের খুব প্রিয় পিকনিক স্পট। প্রতি শীতেই দলবেধে এখানে আসি। খুবই ভিড় জমে এই সময় রিয়াং-এর কোলে। ছোট বড় সকলের উচ্ছ্বাস মিশে যায় নদীর কলকল ধ্বনিতে, উত্তুরে বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে। ঝর্ণা কাছেই। রিয়াং-এর ওপর দিয়েই যায় গাড়ি। ব্রিজের নাম যোগীঘাট। নদীর ওপর দিয়ে গাড়ি চড়ে যাওয়াটা দারুণ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা।

এরপর আরও অনেকটা পথ পেরিয়ে, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সিটং পৌঁছতে মাঝ দুপুরে। রাস্তা মাঝে মাঝেই বেশ চড়াই উৎরাই। পথে পড়ে ছোট ছোট গ্রাম, কাছে-দূরে পাহাড়, গাছপালা আর কমলার বাগান। সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। গাছে ঝুলন্ত কমলালেবু। নানা আকার, আর কমলা রঙের নানান শেড। কমলালেবু প্যাকিং হয়ে বাজারে যায়। বাজার মানে বৃহৎ তার পরিধি, দেশ ও দেশের বাইরে। যারা বাগানে বা প্যাকিংয়ের কাজ করেন, তারা সকলেই এ অঞ্চলের মানুষ।

সিটং-এর উচ্চতা মোটামুটি চার হাজার ফুট। কিন্তু ঠান্ডা সে তুলনায় কিছু বেশি। কারণ এটা একটা বৃহৎ ও ছড়ানো উপত্যকা। চারপাশ খোলা, উত্তরের হাওয়া পাগলের মতো। দূর দূর পর্যন্ত যতটুকু চোখ যায় শুধুই পাহাড়। ধাপে ধাপে ঘরবাড়ি।

সিটং এমনিতেও বেশ নয়নাভিরাম। উত্তরবঙ্গের আর সব অঞ্চলের মতোই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানেও উজার করে ঢেলে দিয়েছে ঈশ্বর। তবে, কমলার বাগান দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। আর কমলালেবুর ফলন দেখতে হলে আসতে হবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। এছাড়াও এখানে সিঙ্কোনা চাষ হয়। মংপু এবং সিটং সিঙ্কোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। এর বাইরে হয় বড় এলাচ। আছে সব ধরনের শাকসবজি। ফলের মধ্যে কমলালেবু ছাড়াও হয় কলা, পেঁপে। আর ফুলঝাড়ু যে গাছ থেকে হয়, তারও চাষ হয় সিটং-এ। গ্রামের মানুষ মূলত কৃষিজীবী। নিজেদের খাওয়ার বাইরে উৎপাদিত শাকসবজির পুরোটাই তারা কালিম্পং ও কার্শিয়ং-এর বাজারে বিক্রি করে। এছাড়াও রুটিরুজির জন্য ড্রাইভারিকে পেশা হিসেবে নেয় অনেকেই। স্থানীয় মানুষ পর্যটন ব্যবসায় আসতেও আগ্রহী। কেউ কেউ করছেনও।

সিটং পৌঁছনোর জন্য দুটি রাস্তা আছে। প্রথম রাস্তাটি, শিলিগুড়ি থেকে রওনা দিয়ে সেবক হয়ে কালিঝোরা যেতে হবে। এরপর লাটপাঞ্চার হয়ে সিটংএ পৌঁছতে হবে। এই পথের দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিমি। শিলিগুড়ি থেকে দ্বিতীয় রাস্তা, কার্শিয়াং থেকে বাগোরা হয়ে সিটং। এই পথের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিমি।

শিলিগুড়ি থেকে সিটং পৌছতে গেলে শিলিগুড়ি থেকে বা নিউ জলপাইগুড়ি (NJP Station) থেকে গাড়ি ভাড়া করতে হবে সিটং এর উদ্দেশে। এক্ষেত্রে গাড়ি ভাড়া আনুমানিক ২৫০০-৩০০০ টাকা। এছাড়াও হোম স্টে’তে থাকাকালীন হোম স্টে-র মালিকের সাথে কথা বলেও গাড়ির জোগাড় করা যেতে পারে। সিটং এ থাকতে গেলে এখানে হোম স্টেতে থাকা যেতে পারে। প্রতিটি হোম স্টেতে একই খরচের মধ্যে সকালের জল খাবার থেকে শুরু করে দুপুরের খাবার, সন্ধ্যার টিফিন, রাতের খাবার সবটাই দিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন: কোঠিগাঁওয়ের পথে

এখানকার হোম স্টে’তে পরিবারের সবাই মিলে কাজ করে। রান্না, পরিবেশন, কাপ প্লেট ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যে যেমন রুচিবোধ, তেমনই আন্তরিকতা। মন ভালো হয়ে যায় সহজেই। বেশ কিছু হোম স্টে’র মতো এখানকার হোম স্টে’তেও হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে মিষ্টি চেহারার নেপালি মেয়েরা যাদের চোখদুটো অপার সারল্যে ভরপুর। তারা বাইরে থেকে পড়াশোনা করে। ছুটিতে বাড়িতে এলেই বাবা, মায়ের সঙ্গে কাজে নেমে পড়ে। ভবিষ্যতে বাবার এই হোম স্টে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। এমনই অনেক পরিকল্পনা আছে তাদের ভাবনায়। পড়াশোনা শেষ হলে এই গ্রামেই থাকতে চায় সে। মিষ্টি প্রাণবন্ত মেয়েটির দুচোখে কত স্বপ্ন। পাহাড়ের মেয়েরা ছেলেদের চাইতেও অনেক বেশি পরিশ্রমী। কোনও কাজকেই ছোট চোখে দেখে না। তাদের খিলখিল হাসিতে পাহাড়ও হেসে ওঠে। কথার মধ্যেই ভেসে ওঠে ওদের জীবন কথা, প্রতিদিনের বেঁচে থাকার লড়াই, বহু যুগের ইতিহাস। শিক্ষার জায়গায় এখনও পিছিয়ে তারা। এলাকায় সরকারি প্রাইমারি স্কুল দুটি মাত্র। একটি প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুল আছে, ইংলিশ মিডিয়াম। জুনিয়র হাইস্কুল দুটি। তার একটা কেন্দ্রীয় সরকারের। অন্যটি প্রাইভেট, জিটিএ-র অধীনে চলে। চিকিৎসা ব্যবস্থাও তথৈবচ। একটাই হাসপাতাল, যেখানে বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তার থাকে না। কঠিন রোগে যেতে হয় কালিম্পঙে। এত কিছু না পাওয়ার জন্য অবশ্য থামে না জীবন। বেঁচে থাকার লড়াইটা ওরা শিখে যায় পুরুষানুক্রমে। বিস্তৃত ছড়ানো উপত্যকা জুড়ে প্রকৃতি সাজিয়েছে তার সৌন্দর্যের ডালি। পর্যটন আকর্ষণ বাড়ছে। আরও অনেক অনেক পর্যটক আসুক, এটাই এখানকার অধিবাসীদের প্রার্থনা।

তাদের গল্প শেষ হলেই থেমে যায় সব শব্দ। হিমেল আবেশে ছেয়ে যায় চারপাশ, কেটে যায় সারাদিনের ক্লান্তি। উপত্যকা ততক্ষণে মায়াবী জ্যোৎস্নায় মাখামাখি। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে সেই আলো চুইয়ে পড়ে ঘরে, নিয়ে যায় এক কোমল স্বপ্নের দেশে। সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাক শুনে, অনেক ভোরে। প্রসঙ্গত, সিটং হলো পাখির স্বর্গ। মহানন্দা স্যাংচুয়ারী কাছেই। কাছে লাটপাঞ্চারও। লাটপাঞ্চারও এখানকার এক আকর্ষণীয় টুরিস্ট স্পট। সিঙ্কোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। সিটং-এ পাখির বৈচিত্র্য এইসব কারণেই। সকালের অনেকটা সময় তাদের ওড়াউড়ি চলে, সঙ্গে কলকাকলি। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত সব। লাটপাঞ্চার ছাড়াও কাছাকাছির মধ্যে আছে বাগোড়া, চটকপুর। কার্শিয়ং, মিরিক হয়েও আসা যায় সিটং। অর্থাৎ এই অঞ্চলকে ঘিরেই অনেকগুলি স্পট দেখে নেওয়া সম্ভব। ছোট ছোট ট্রেকিং রুটও আছে সিটং-এ। এখানে প্রায় সব বাড়িতেই কমলালেবুর চাষ হয়। এখানে সকাল, দিন রাতের সৌন্দর্য আলাদা আলাদা। পূর্নিমার সময় আকাশ যেন রুপোর থালা। আহা কি রূপ! চাঁদের মায়াময় আলোক বিচ্ছুরণে চোখ ফেরানো যায় না। ততক্ষণে রাতে ঠান্ডা পড়ে জাঁকিয়ে। উপত্যকার অপার সৌন্দর্য। পাখি আর প্রজাপতিরা বিদায়ের কথা বলে তাদের ভাষায়। বাতাসে বাতাসে কমলালেবুর গন্ধ ছুঁয়ে যায়। মনটা কেমন হয়ে যায়।

বর্ষা এড়িয়ে চলা ভালো। শীতে যথেষ্ট শীতবস্ত্র সঙ্গে রাখা উচিত। এছাড়াও ‘ফার্স্ট এইড বক্স’, সাধারণ জ্বর, পেট খারাপের ওষুধ ইত্যাদিও। ফ্লাস্ক, টি ব্যাগ ও কফি, বিস্কুট ও শুকনো খাবার সঙ্গে রাখা দরকার। একটি টর্চও।

সিটং এ দেখার মধ্যে আছে যোগীঘাট। সিটং থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে রিয়াং নদীর ধারে অবস্থিত এই স্থানটি, এখানে আছে পুরনো দিনের তৈরি কাঠের সেতু যা রিয়াং নদীর ওপর দিয়ে দুটি গ্রামকে জুড়েছে । চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা ও মাঝে প্রবাহিত নদীর দৃশ্য এই স্থানটিকে এক অন্য সৌন্দর্য দিয়েছে।

এছাড়াও আছে সিটং অরেঞ্জ ভ্যালি। কমলালেবু খেতে কার না পছন্দ তবে যদি সেই কমলালেবু সরাসরি গাছ থেকে পেড়ে খাওয়া যায় তার আনন্দই আলাদা । সিটং এর মূল আকর্ষণ হল এখানকার কমলালেবু বাগান। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে এখানকার গাছে কমলালেবুর ফলন দেখতে পাওয়া যায়।

সিটং থেকে একটু দূরে অবস্থিত বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাঠাকুরের বাড়ি। এছাড়াও সিঙ্কোনা প্রজেক্ট এবং এটি থেকে কুইনাইন তৈরির কারখানা ।

সিটং থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত আহলদারা। এই ভিউ পয়েন্টটি থেকে পরিস্কার কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য এবং তার সাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দৃশ্য মনকে ভরিয়ে তোলে। এছাড়াও লাটপাঞ্ছর যেটি বিভিন্ন পাখিদের রাজ্য এই স্থানটিও দেখার মতো। পাখি প্রেমিদের জন্য এটি একটি স্বর্গ রাজ্য এখানে বিরল প্রজাতির বিভিন্ন পাখি দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়াও আছে একটি প্রাচীন জলাশয়, সেল্পু হীল এ অবস্থিত। বর্ষা কাল বাদে এটি বছরের ৬ মাস শুকনো থাকে। এই নাম্থিং পোখরিতে এক ধরনের বিরল প্রজাতির হিমালয়ান সালামান্ডার দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতি দেখা যায়। অহালদারা থেকে এই স্থানটি খুব একটা দুরে নয় হাঁটা পথে এখানে পৌঁছে যাওয়া যায়।#

ছবিঋণ: মণিজিঞ্জির সান্যাল

 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!