নাটক এবং অভিনয় নাট্যশিল্পীর কাছে নিঃসন্দেহে একটি অস্ত্র বিশেষ। কিন্তু হাতের সেই অস্ত্র কীভাবে চালানো হবে তা নির্ভর করে নাট্যশিল্পীর মানসিক গঠন, মননশীলতা এবং প্রকাশভঙ্গির উপর। উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, অমল রায় প্রমূখ নাট্যকাররা তাঁদের নাটকের ভাষ্য যেভাবে উপস্থাপন করেছেন শম্ভু মিত্র,মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র প্রমূখ নাট্যকাররা কিন্তু তাঁদের নাটকে ভাষ্য সেভাবে উপস্থাপন করেননি, করতে চানওনি। বাদল সরকারের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলা চলে। এঁরা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে মননে, সৃজনে এবং অভিব্যক্তিতে জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্পর্শ করেছেন। কিন্তু শহর থেকে শহরতলী এবং গ্রাম বাংলায় পেশাদার, অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রাজ্ঞ নাট্যবোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ নাট্যপিপাসু গ্রামীণ মানুষজন যাঁকে সবচেয়ে বেশি সহজ, অনাবিল ও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন, কাছের মানুষ হিসেবে হৃদয়ে স্থান করে দিয়েছেন তিনি অবশ্যই নাট্যকার ও অভিনেতা মনোজ মিত্র। তাঁর লেখা নাটক শহর, শহরতলী তো বটেই গ্রাম বাংলাতেও সমান জনপ্রিয়। সেই সঙ্গে তাঁর অভিনয় শৈলীও। একমাত্র অভিনেতা উৎপল দত্তকে তাঁর সমতুল বলা যেতে পারে। আর গ্রামাঞ্চলে একাঙ্ক নাটকের ক্ষেত্রে অমল রায়ের নাটকগুলি একসময় কিছুটা তাঁর নাটকগুলির জনপ্রিয়তায় ভাগ বসিয়েছিল। কিন্তু বাংলা নাটকের দুই ভুবন জুড়ে তাঁর লেখা নাটক ও অভিনয়ের জনপ্রিয়তা এখনো অমলিন।সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কী সেই রসায়ন যার মোহিনীতে তিনি মঞ্চনাটকের এবং অভিনয়ের এই দুই বলয়েই সমানভাবে আদৃত হলেন? এই অবসরে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের প্রয়াস করতে পারি।
উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, অমল রায় প্রমূখ নাট্যকার তাঁদের অধিকাংশ নাটকের অত্যন্ত তীব্রতা সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্য বিরোধী, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া নানান দমনমূলক নীতির প্রতিবাদ ও প্রতিরোধী কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরেছেন। এঁদের নাটক প্রগতিপন্থী, বিশেষত বাম রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে আত্মবিশ্বাসের মন্ত্র তথা সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এঁদের অভিনয় শৈলীও নাটকানুগ উচ্চকিত ও প্রত্যক্ষ ধর্মী। অন্যদিকে শম্ভু মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র প্রমূখ, সেইসঙ্গে বাদল সরকারও তাঁদের নাটকে মানবিক কাহিনির আধারে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যাসমূহকে উপস্থাপন করেছেন। নাট্যকার মনোজ মিত্র আবার এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী। নাট্যকার হিসেবে তিনি পৌঁছতে চান সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভেদ, বৈষম্য, দমনমূলক নীতির সমস্যার শিকড়ে। সেই শিকড় সন্ধানের প্রবণতা তাঁর নাটকগুলিকে একটি মৌলিক সুরে বেঁধে দিয়েছে। সেই সুরের সাম্পান বেয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন গহন মনের নাট্যকার। তা বলে কি তাঁর নাটকে প্রত্যক্ষতা নেই? নেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সুর? তা নয়। তাঁর লেখা সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক ‘সাজানো বাগান’- এই এর একটা চমৎকার উদাহরণ আছে। নাটকের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম তাকে মেরে ফেলার নানা অপচেষ্টা সত্ত্বেও হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জমিদারের কাছ থেকে ন্যায্য মাসোহারা দাবি করে বলে–” চিরদিন এমনটা চলতে পারে না কত্তা, যে আমরা দেব আর তোমরা নেবা। এবারে তুমি দেবা আর আমি হাত পেতে নেব।” ঝান্ডা নয়, শ্লোগান নয়, ঘোষিত সমবেত প্রতিরোধ নয়, এ হল অন্তর্গত বিশ্বাস আর প্রত্যয়ের কথা– যা একান্তভাবেই মনোজ মিত্রের সিগনেচার বহন করছে।
নাটক লেখা হয় মূলত অভিনয়ের জন্য। নাট্য আঙ্গিকে লেখা হলেই নাটক বলে চিহ্নিত যে কোনো রচনা অভিনয়ের উপযোগী হয়ে উঠবে তা বলা যায় না। এমন অনেক নাটক আছে যা যথার্থ অর্থে অভিনয় উপযোগী নয়। নাটকের আর একটি দিক হল তার লেখ্য রূপের পাঠযোগ্যতা। সৌভাগ্যক্রমে মনোজ মিত্রের নাটকগুলি যথার্থ অর্থে অভিনয় উপযোগী তো বটেই, সেই সঙ্গে সুখপাঠ্যও। তাঁর নাটকগুলি মৌলিক সাহিত্য পাঠের আস্বাদ এনে দেয়। তাঁর নাটকের সংলাপে সংলাপে যেমন অদ্ভুত নাট্যগুণ ছড়িয়ে আছে তেমনই তার পরতে পরতে সাজানো আছে সাহিত্যগুণের আশ্চর্য নিদর্শন। জীবনরসের রসিক তিনি। তাঁর নাটকের অন্তরে আছে সেই রসবোধের পূর্ণ আয়োজন। তাঁর নাটকের আখ্যান, বয়ন কৌশল অনায়াসে ছুঁয়ে যায় জীবনের ওপরিতল থেকে অতল গভীর। সংলাপ হয় তার বাহন, আধার। সহজ কথা সহজ ভাবে বলাই শুধু নয়, গভীর কথাও সহজ করে বলার সিদ্ধি ছিল তাঁর কলমে। তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নাটকের সংলাপের ছত্রে ছত্রে। সত্য ভাষণে তিনি কুন্ঠিত নন। কিন্তু সেই সত্যের সঙ্গে লেগে থাকে যে গ্লানি, পরাজয়, অন্তর্বেদনা সমানুভূতির আলোকে তিনি তাকে উন্মোচিত, উন্মুক্ত করে দেন। এখানেই তাঁর নাটকের সংলাপের অমরতার বীজ। নিটোল গল্প বলার কৌশলে তিনি দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদেরও মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’ থেকে শুরু করে ‘সাজানো বাগান’, ‘মেষ ও রাক্ষস’,’অলকানন্দার পুত্র কন্যা’, ‘গল্প হেকিম সাহেব’ হয়ে ‘দর্পণে শরৎশশী’, ‘নরক গুলজার’, ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘কাক চরিত্র’ পর্যন্ত সেই অভিজ্ঞান ছড়িয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা ‘কাক চরিত্র’ নাটক থেকে কেন্দ্রীয় চরিত্র কাকের নাট্যকার ব্যোমকেশ চরিত্রের প্রতি সংলাপের একটি অংশকে নমুনা হিসেবে পেশ করতে পারি। সেটি হল– “বুকে বল না থাকলে সত্য কথা জেনে কী করবে গা! সত্যি কথা লিখতে সাহস লাগে যে!”
এ প্রসঙ্গে আমরা তাঁর ‘সাজানো বাগান’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বাঞ্ছারামের একটি সংলাপের অংশও উল্লেখ করতে পারি–
“কাঁদে না দাদুভাই… কতো পাখি আছে… দলে দলে ঘুরে বেড়ায়… হ্যাঁ হ্যাঁ… কাল সকালে দেখো… কত আমের বোল ধরেছে … মুক্তোর দানার মতো মাটির চাদর বিছিয়ে থাকে… গুনগুন্… মৌমাছি ঝাঁকে ঝাঁকে গুনগুন্ করে …হ্যাঁ হ্যাঁ দেখো, টুপুস টুপুস করে রাতের শিশির ঝরে পড়েছে… জলপাইয়ের পাতা বেয়ে টুপুস টুপুস করে পড়ছে… হ্যাঁ হ্যাঁ সব তোমারে দিয়ে যাব…তোমার জন্যেই তো সাজিয়ে রেখেছি গো… হ্যাঁ হ্যাঁ… ।”
এই দুটি নমুনা সংলাপের মাধ্যমেই আমরা তাঁর সংলাপ রচনার দুই ধরণকে ছুঁয়ে যাবার প্রয়াস করলাম। কুন্ঠার অবগুন্ঠন থেকে বেদনাদীর্ণ সত্য ভাষণের ও শ্রবণের স্পৃহা যেমন এখানে বর্তমান তেমনই বর্তমান পেলব কুসুম কবিত্বময় সংলাপের মেদুরতা, সেইসঙ্গে অন্তর্লীন ব্যথাও। দুইয়ের হরগৌরী মিলনে তাঁর নাটকের সংলাপ তাই এত প্রাণবান, লক্ষ্যভেদী এবং জন চিত্তজয়ী।
অভিনেতা মনোজ মিত্র চিরকালই বৈচিত্রের সন্ধানী। উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য প্রমুখ বরেণ্য অভিনেতা। কিন্তু অতি উচ্চমার্গের হলেও তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজস্ব অভিনয় শৈলীর এক একটি খোপের মধ্যে নিজেদের আটকে রেখেছিলেন । উৎপল দত্তের অভিনয় শৈলীর নানা বৈচিত্র্য ছিল। কিন্তু সেগুলিও এক একটি টাইপ। বরং শম্ভু মিত্র এক্ষেত্রে নানাভাবে নিজের অভিনয় শৈলীকে ভেঙেছেন। সেদিক থেকে অভিনেতা মনোজ মিত্রের অভিনয় শৈলী কিন্তু অভূতপূর্ব। তিনি বারবার নিজের অভিনয় শৈলীকে ভেঙেছেন। একেবারে অভিনয় জীবনের শুরুর দিকে মাত্র ২১ বছর বয়সে নিজের লেখা প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’- এর বৃদ্ধ বঙ্কিম, ৩৭ বছর বয়সে ‘পরবাস’- এর বৃদ্ধ গজমাধব, ৩৯ বছর বয়সে ‘সাজানো বাগান’-এর বৃদ্ধ বাঞ্ছরাম কিংবা ১৯৭২ এর নাটক ‘চাক ভাঙ্গা মধু’-র জটা চরিত্রে তিনি শুধু নিজের অভিনয়ের শৈলীকেই নয়, বলা ভালো নিজেকেও ভেঙেছেন। আবার নাটক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁর সমবয়স্ক চরিত্রে অভিনয়ের সংখ্যাও বিপুল। অন্তরঙ্গ দর্শনে এই বয়স্ক ও সমবয়স্ক চরিত্রগুলির জীবন বোধ, সমস্যা এবং প্রকাশভঙ্গিও কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। এই কারণেই তাঁর লেখা নাটকগুলির মতোই তাঁর বহুমাত্রিক অভিনয় শৈলীও শহর ও গ্রামের নাট্যমোদী মানুষজনের কাছে এত জনপ্রিয় ও আদৃত।
প্রসঙ্গক্রমে একটি আপাত অপ্রিয় বিষয় উত্থাপন করা বোধহয় এক্ষেত্রে অসংগত হবে না। সেটি হল শহুরে এলিট মহলের মতে, গুটিকয়েক ক্ষেত্রকে বাদ দিলে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মনোজ মিত্রকে কিছুটা তরুলতাপূর্ণ স্ট্রিরিওটাইপ অভিনয় করতে দেখা গেছে–যা তাঁর অভিনয় ক্ষমতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। কথাটা আংশিক ভাবে সত্য হলেও নিবিড় দর্শনে সেই অভিনয়ের মধ্যেও সূক্ষ্ম অনেক কারু কাজ লক্ষ করা যায়। তাছাড়া বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সিংহভাগ দর্শকই যেহেতু গ্রামীণ তাই তাদের আগ্রহ ও মনোরঞ্জনের বিষয়টি কখনোই অবহেলাযোগ্য হতে পারে না। তিনি অন্তত তা মনে করতেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘শত্রু’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ইত্যাদির মতো বহু চলচ্চিত্রে তিনি অত্যন্ত নৈপুণ্য ও দাপটের সঙ্গেই অভিনয় করে যুগপৎ শহর ও গ্রামের জনচিত্ত জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সামগ্রিক বিচারে তাই এ কথা মেনে নিতেই হয় যে, তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই জীবন বীক্ষণ নিপুণ এক গহন মনের নাট্যকার এবং মরমি অভিনেতা।
সহায়ক গ্রন্থ তালিকা:
১. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত– ড.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মর্ডান বুক এজেন্সি
২. মনোজ মিত্র নাট্য সমগ্র (১–৬) –মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি.
৩. মনোজ মিত্রের শ্রেষ্ঠ একাঙ্ক– কলাভৃৎ
৪. ব্রাত্য বহ্নি বাংলা পথনাটক– ড. পার্থপ্রতিম পাঁজা, নতুন পথ প্রকাশনী
৫. নাট্যপথে পরিব্রাজন– ড. পার্থপ্রতিম পাঁজা, দেশের আয়না
৬. একান্ত সাক্ষাৎকার: মনোজ মিত্র–প্রতিদিন রোববার
৭. আজকাল.ইন
এবং অন্যান্য পত্রপত্রিকা