গল্প: জল সইতে

থালা ভরে ফুলফল সাজিয়ে দক্ষিণেশ্বর থেকে নদীপথে বেলুড় মঠ যেতেন আমার ঠাকুরদা অশোক মিত্র৷ ঈশ্বর সম্বন্ধে যদিও আমার নাক কোঁচকানি সেই ছেলেবেলা থেকেই, তবুও কেন যেন ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে আমাকেই বারবার সাথে নিতে চাইতেন ঠাকুরদা অশোক৷ আমিও অবলীলায় বইতাম পুজোর উপকরণ৷ বইতাম আমার অশোকের জন্য৷ ভালোবাসার মানুষটির ভারটুকু বয়ে দিতাম৷ জল কেটে নৌকো এগোত৷
অশোক দেখতেন আকাশ, গঙ্গার ঘোলা রঙ, পাড়ের শ্রমজীবী সব মানুষ৷ মুচকি হেসে একদিন শুধিয়েছিলাম- সোজা তাকালে বেলুড়ের মন্দির দেখা যায়! তা না দেখে কষ্ট করে ঘাড় উঁচিয়ে কি এত খোঁজ আকাশে? সেদিন আমার মহাআস্তিক ঠাকুরদার উত্তর আমাকে অবাক করে দিয়েছিল৷ বলেছিলেন- আকাশে ঈশ্বর – নদীতে ঈশ্বর – নদীর জলে ভেসে আসা গাছের টাটকা সবুজ পাতায়ও ঈশ্বর৷ অনন্ত বিশ্বচরাচরে ব্যাপ্ত মধুরিমাটাই তো ঈশ্বর৷
একবার বেলুড় ঘাটের কাছাকাছি এসে পড়েছি৷ পাড়ের লোকেরা চেঁচাচ্ছে – আরে! আরে! বান আসছে৷ এবার মরবে এ নৌকো৷ মুণ্ডু চেপে ধরেছি ঠাকুরদার বুকে৷ কাঁদছি৷ খুব কাঁদছি৷ বিদ্যুৎবেগে আমার কান্নাঝরা মুখটা তুলে ধরলেন আকাশের দিকে৷ বললেন- ঢেউ যদি বড়ই হোক তা আকাশ স্পর্শ করতে পারবে না৷ নাস্তিক হ- ক্ষতি নেই৷ নির্ভয় হ৷
পরে যখন অনেকটা ধাড়ি হয়ে কলেজ যাতায়াত শুরু করি ঢেউয়ের ব্যাখ্যা আরো প্রাঞ্জল করেছিলেন ঠাকুরদা৷ এক সন্ধেতে রামকৃষ্ণ আরাধনার পর পাকড়াও করেছিলাম তাঁকে৷ সেদিন নিজেকে ফুলের পাপড়ির মতো খুলেছিলেন৷ কথাগুলো তাঁর সুগন্ধী ফুলের মতোই মনে থেকে গেছে আমার:
বাপু হে ঢেউ যদি আসে আগে ভাব জীবনের স্থিতি তুমি কদ্দিন ভোগ করেছ! বিষাদ যদি অতল হয় তো পিছে ফিরে দেখ তোমার আনন্দ কত অনন্ত ছিল!
এইসব বলে বোধহয় বোঝাতে চেয়েছিলেন, আনন্দ বিষাদ সমান না হলে জীবননদী তার বাঁক নেওয়ার সৌন্দর্য হারায়! জানা হয়নি৷ জীবন বিশুদ্ধ সুন্দর বা বিশুদ্ধ পাপের হয় কীনা তাও জানা হয়নি!
তো ছোটবেলার সে বানের দিন শেষমেষ ঘাটে ভিড়েছিল নৌকো৷ ভিজে সালোয়ার আষ্টেপৃষ্টে শরীর সাপটে ধরেছিল৷ সর্ব বিঘ্ন হটিয়ে অশোক পৌঁছে যাচ্ছিলেন তাঁর ঈশ্বরের কাছে৷ আর আমি? ঈশ্বর বিশ্বাস না করে, অনেকটা ক্ষণ হেঁটেছিলাম আমার জীবনের সবথেকে সাহসী পুরুষের সাথে৷ দৃষ্টি যাঁর আসমানে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!