বিশ্বে বাংলা ভূখণ্ডের গঠন প্রায় দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ বছর পূর্বে প্লাওসিন যুগে বলে গবেষকগণ মতামত দিয়েছেন। এই গঠন ভূতাত্ত্বিক। প্লাওসিন যুগের পরে প্লাইস্টোসিন যুগের উদ্ভব ঘটে। বিশ্বে প্লাওসিন যুগে জীবের বিবর্তনে নরাকারের বিবর্তন, যা প্লাইস্টোসিন যুগে মানুষের আর্বিভাব বলে মনে করা হয়। বাংলায় প্লাইস্টোসিন যুগের নিদর্শন বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। তাঁদের ব্যবহৃত আয়ুধসমূহ যেমন পাথরের হাতিয়ার দিয়ে মানুষেরা আত্মরক্ষা ও পশু শিকার করে জীবপ্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে। প্রত্নপ্রস্তর যুগের শক্তিশালী মানবের উত্তরাধিকার বর্তমান বাংলার জাতি জনগোষ্ঠী। অতি প্রাচীন যুগের আয়ুধ ভারতের বাংলায় বলে বিশ্বে বাঙালি জাতি সভ্যতার প্রধান প্রধান পথিকৃতদের অন্যতম বলা যেতে পারে। প্রত্নপোলীয় যুগের অবসান হয় দশ হাজার বছর পূর্বে, তারপর সূচনা হয় নবপোলীয় বা নবপ্রস্তর যুগের। নবপ্রস্তর যুগের বিবর্তনে তাম্রাশ্ম যুগের উজ্জ্বল নিদর্শন আমরা অবহিত হয়েছি। বর্ধমান, মেদিনীপুর জেলায় সেই যুগের বিস্তৃতি, যার নিদর্শন পাণ্ডুরাজার ঢিবি। এই সময়ে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার আর্বিভাব ঘটে।
বাংলা ভূখন্ডে সভ্যতার যে বিস্তৃতি প্রসারে আকৃষ্ট হয়ে বা জীবিকার অন্বেষণে Proto-Aistraloids প্রাক দ্রাবিড়, দ্রাবিড়রা অনুপ্রবেশ করে। এই দ্রাবিড়দের অনুসরণ করে আলপীয়দের একটা দল পশ্চিম সাগর দিয়ে বাংলা ও উড়িষ্যায় প্রবেশ করে। তাদের বৃহৎ অংশ সিন্ধু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্নাটে অবস্থান নেয়। তখন বাংলায় ‘বয়াংসি’ গোষ্ঠীর বসবাস ছিল বলে ঐতরেয় আরণ্যকে পাই। বৌদ্ধ গ্রন্থের তথ্যে জানা যায়, মহামানব গৌতম বুদ্ধের আর্বিভাবের পূর্বে শিবি রাজ্য, চেত রাজ্য ছিল। যা কলিঙ্গ রাজ্য সীমানা মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মহাভারতে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, সুহ্ম বিবিধ জাতির উদ্ভবের কথা বলা হয়েছে। যার মূল উদ্ভব বঙ্গে, যা বয়াংসি নামে পরিচিত।
আদি জাতির বৈশিষ্ট্য ও উত্তরাধিকার বাঙালি নামক সংকর জাতির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নবপ্রস্তর যুগের আয়ুধ যন্ত্রপাতি ধামা, কুলা, ঝাপি, জাঁতা ইত্যাদি বাংলায় ব্যবহৃত হয় যুগ যুগ ধরে। বোলপুর শান্তিনিকেতনের নিকটস্থ আউসগাঁয়ে ১৯৬২-৬৫ সাল পর্যন্ত উৎখনন কার্য সম্পন্ন হয়। এখানকার নিদর্শন হরপ্পা, মহেঞ্জদারো মতো নগরের প্রতীক পান্ডুরাজার ঢিবি।
বিস্মিত হই, এই নগর সভ্যতায় কাঁকরপেটা গৃহ নির্মাণ করতো, ধানের চাষ, ধূসর মাটির পাত্র ব্যবহার করতো। এমনকি দুর্গ ও ঘর নির্মাণ, পরিকল্পিত যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই অঞ্চলে তাম্রাশ্ম যুগের আর্বিভাব ঘটে। তামার ব্যবহার, শস্য উৎপাদন, তৈজসপত্রের নিদর্শন থেকে বোঝা যায়, বাংলার সভ্যতা শুধুমাত্র আদি ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বে জ্যোতিঃ প্রদান করেছে। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ যেসব নিদর্শন মেলে, তার উদ্ভব বাংলায়।
ভূমধ্যসাগর দিয়ে অনুপ্রবেশ করে দ্রাবিড়, আলপীয় জাতির কৌম গোষ্ঠী। তারা এই সম্পদ ও প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ দেশে অবস্থান করে এবং নানা সংঘর্ষ মিলন বৈপরীত্যে জীবন অতিবাহিত করে। কৌশলে আদি ঐতিহ্য পরাশ্রয়ীরা নিজেদের বলে অভিহিত করে। যা বিচার বিশ্লেষণে করে দেখা যায়, যত বিপরীত অবস্থান হোক না কেন, তা একসময় মিলনের ঐতিহ্যে সংকর জাতিরূপে অগ্রসর হয়।
বাংলা ভূ-ভাগের জনজাতি আদি ভারত শুধুমাত্র নয়, সমগ্র বিশ্বে আদি যুগে অন্যতম প্রধান সভ্য জাতি বাংলায় ছিল। যারা ছিলেন বাঙালি জাতির পূর্বপুরুষ। অর্থাৎ বাংলার জনজাতি আদি বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাতি।#