প্রতুল মুখোপাধ্যায় ও ভাষা চেতনার ২০শে ফেব্রুয়ারি সারারাত

প্রতুল মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন। কিছুদিন আগেও কখনও লাবনির মোড়, কখনও কাঁকুড়গাছি, কখনও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর বাড়ির কাছে দেখতাম তিনি হাঁটছেন। অনেক হাঁটতেন তিনি। এই হাঁটা তাঁর বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের বাইরের ছবি। বাংলার গানের এক কিংবদন্তির সহজ জীবনযাপন।

সৃষ্টির একটা নিজস্ব ক্ষমতা থাকে। শক্তি। ব্যক্তি আর সৃজক দুই ভাইয়ের মত। তাদের একজন এক পথে যেতে পারে, আর একজন অন্যপথে। কিন্তু এক মায়ের পেটেই তাদের জন্ম। ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে সৃজনশীলতা চলতে পারে। বিরোধিতা করতে পারে। দুমড়ে দিতে পারে। বদলের চেষ্টা করতে পারে।

অনেক মেয়ে ‘বাংলার গান’ গেয়েছেন। এই ক্ষণে সৃজক সার্থক। তাঁর একটা গান – আমি বাংলার গান গাই, তার বহুমাত্রিক প্রয়োগ, সুরের কম্পন, উচ্চারণের বদলিয়ানা,,, বেশ বেশ দাগ কেটে যায়, হেঁটে যায়….

তারপর— সেই গান। মিছিলের প্রতিবাদ হয়। একক অ্যালবাম হয়, জনকন্ঠ হয়,,,, আবার প্রবন্ধ যে গান হয়, তাও ছিল তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা। কতশত পড়াশুনা ছিল প্রতুলদার।

একদিন বাড়িতে সে গান শুনিয়েছিলেন বেতের চেয়ারে বসেই। সেদিনই কিছু পরে পুজোর মণ্ডপে নানা মতের নানা পরিধানের মানুষকে শুনিয়েছিলেন গান। নানা মত ওই সৃজনী প্রতিভাকে ছাড়তে চাননি।

ভাষা ও চেতনা সমিতির বিশে ফেব্রুয়ারি সারারাতের অনুষ্ঠানে প্রতুলদার উদ্বোধনী গান কয়েক বছর অঙ্গাঙ্গি ছিল। নিয়ে যেতাম আমরা তাঁর বাসস্থান থেকে। গাড়িতে চলত বক্তা, গায়কের নানান কথার আলপনা। একাডেমির সামনে নামা মাত্র ঘিরে ধরতো তাঁর ভক্তদল। একটু পর মঞ্চে উঠতেন তিনি। তিনি উপস্থিত থাকতেন সবার হৃদয়জুড়ে। একের পর এক বাংলা গান গাইতেন। হয়তো প্রথমে ‘ফেব্রুয়ারির অক্ত’ -কিম্বা নতুন বাধা গান তিনি গেয়েছেন, কিন্তু ‘আমি বাংলার গান গাই’- গাইতেই হবে শ্রোতাদের এই ছিল আবদার। হাসিমুখে আবদার মেটাতেন তিনি।

অঙ্গভঙ্গি করে গান শরীরে নাচ যুক্ত করে কম গায়ককেই দেখেছি। গণসঙ্গীত গান তো অনেক জন। তাঁদের শরীর নাচে না যেমন নাচে তাঁর।

প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান ও কথাতে মিশেছিল যুগের কন্ঠ, বিদ্রোহের সুর। হয়তো কোনো শ্রমিকের কথা, জাতির কথা, কিম্বা স্বপনপুরে স্বপ্নালু দিনযাপনের কথা বলছেন, বিভঙ্গ নিয়েই।

চুঁচুড়া শহরে তার বেড়ে ওঠা। প্রথম জীবনে শিক্ষক পরে ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মী প্রতুল মুখোপাধ্যায় কর্মজীবন সামলেই গান বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।

বাংলা ভাষা নিয়ে যত গান আছে, তার মধ্যে, আমি বাংলার গান গাই ‘- থেকে যাবে, যাঁরা তার স্বকন্ঠে শুনেছেন অনেকেই সহমত হবেন এই বিষয়ে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্বালে বর্তমানের এই অস্থির অবস্থায় প্রতুলদার চলে যাওয়া সত্যিই দুঃখজনক।

আগামীর ভোর বাংলা ভাষাকে সম্মান করুক- এই চাওয়া। তবেই সব যাওয়া তো নয় যাওয়া- দৃপ্ত শপথ নিয়ে বলতে পারা যাবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!