পঁচিশে মার্চের কালরাত্রি ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’: পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যাশা

লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এবং জেনোসাইড ওয়াচ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে পাকিস্তান সামরিক জান্তার অভিযানের নৃশংস অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে পাকদের পরিকল্পিত বৃহৎ হত্যাযজ্ঞ বিশ্বের ইতিহাসে বিরল বলে সংস্থা দুটির পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটি জাতিসংঘে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। লক্ষ্য করা যায়, আন্তর্জাতিক পরিসরে দিবসটি পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নানা উদ্যোগ বিগত সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে।

ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকসামরিক সরকারের বৈষম্য ও অত্যাচারের নির্মমতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারই প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে বাংলার জনগণ ২ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালন করে। জয়বাংলা’র ধ্বনি’তে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিক্ষোভ মিছিল, সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে রাজপথে, অলিতে গলিতে প্রান্তিকে, নগরে। জনগণের আন্দোলন বৃহৎরূপ সংঘটিত হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করলে ৩ জন নিহত হন এবং বহু মানুষ আহত হয়। নিরীহ জনতার উপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কঠোর হুশিয়ারি দিয়ে বিবৃতি দেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ একইসাথে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমাবেশের কর্মসূচি সফল করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান।

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল মহাসমাবেশে ঐতিহাসিক বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ভাষণের ফলে বাঙালিরা স্বাধীন হবার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে থাকে। পশ্চিম পাক-সেনা সরকার আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলার জনগণ পশ্চিম পাক সেনাদের বিরূদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সফল করার সর্বাত্নক প্রস্তুতি, পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। পাক-সেনা জান্তারা জনগণকে নিবৃত্ত করার জন্য নৃশংস হয়ে ওঠে এবং মার্চের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক নিরীহ জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে হত্যার নারকীয় যজ্ঞে মেতে ওঠে।

১৯শে মার্চ জয়দেবপুরে পাক-সেনার গুলিতে ২০ জন নিরস্ত্র মানুষ নিহত এবং বহু জনতা আহত হন। বাংলার জনগণ প্রতিরোধ প্রতিবাদের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন অব্যাহত রাখে।

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধ দিবসের ডাক দেন।

ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের প্রতিরোধ বাহিনীর সমাবেশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ সংগীতের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বিভিন্ন দূতাবাস সহ প্রায় সকল স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ছাত্র প্রতিরোধ বাহিনী পল্টন থেকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ির সামনে আসে এবং সেখানে বঙ্গবন্ধু প্রতিরোধ বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন, সেখানে পুনরায় বলেন,’ এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের ভুট্টোসহ তার দলের নেতৃবর্গ ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিনব্যাপি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের গুলিবর্ষণে ১১০ জন নিহত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দেন। একের পর এক পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকলে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু বিবৃতি দেন, সেখানে উল্লেখ করেন, ‘আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে আমি আমাদের বীর জনগণকে আহবান জানাই।’

২৫ মার্চ বিকাল ৫টার দিকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা প্রসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সন্ধ্যার পর ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী পাকিস্তানের জান্তারা সামরিক অভিযান শুরু করে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে চলে যাবার পরামর্শ দেন। রাত ১০ টার দিকে পাক-সেনারা ঢাকার শহরে ঢুকতে থাকে এবং ১১ টার দিকে নৃশংস অভিযান চালাতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্য চট্রগ্রামে একটি বার্তা পাঠান। তা-হলো–

‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবেলা করার জন্যে আমি আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই বার্তাই স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র বলে বিবেচিত হয়েছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত দেড়টার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। সারারাত বর্বর পাকসেনারা ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা চালায়। তাদের নৃশংসতার লক্ষ্য ছিল, ১. বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ২. রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ৩. পিলখানা ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি)। ঢাকার বিভিন্ন স্থান ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট, সৈয়দপুর, চট্রগ্রামে নৃশংস গণহত্যা চালায়।

অস্ট্রেলিয়ার ‘হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকার মতে ২৫মার্চ রাতে ১ লাখের অধিক লোক নিহত হন। বিশ্বের উনিশ শতকের পাঁচটি বর্বর হত্যাকাণ্ডের ভেতর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা অন্যতম। বাংলাদেশের সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা, নীলনকশাসহ নির্দেশপত্র পাকিস্তান সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তৈরি করে।

২০১২ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার ‘ এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ গ্রন্থে অপারেশন সার্চ লাইটের কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এই গণহত্যার নির্দেশের কোনো লিখিত নথি এখনও পাওয়া যায়নি। সামরিক কমান্ডাররা মৌখিক নির্দেশে নৃশংসতার জঘন্যতম ইতিহাস সৃষ্টি করে।

পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চলাকালিন সময়ে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫মার্চ পর্যন্ত ১লাখের অধিক মানুষ নিহত হয়।

মার্কিন সাংবাদিক এই ভয়াবহতার কথা লিখতে গিয়ে বলেন, ‘সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশানভূমি।’

ইতিহাসের নির্মম গণহত্যাকে বিশ্বদিবস হিসেবে স্বীকৃতির যে উদ্যোগ তৎপরতা সরকার গ্রহণ করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের সংঘটিত পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বীভৎস রাতকে ‘কালরাত্রি’ হিসেবে ইতিহাসের লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

২০১৭ সালের ১১মার্চ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিবছর জাতীয়ভাবে পালিত হয়ে থাকে। বিগত সরকারের সময়ে জাতীয় গণহত্যা দিবসকে বিশ্ব গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন ও জাতিসংঘে দিবসটির স্বীকৃতি আদায়ের দেশে বিদেশে তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে।

১. ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবসকে বিশ্ব গণহত্যা দিবস ঘোষণার যে পদক্ষেপ গৃহিত হয়েছে, তা ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করা যায়‌। এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে দেশ বিদেশে কবি লেখক শিল্পী সংস্কৃতিজন, প্রাজ্ঞবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচার, কর্মসূচি, পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে।

২. বিশ্বে গণহত্যা মানবতার প্রতি চরম বর্বরোচিত আঘাত, তা চিরতরে বন্ধ করার জন্য বিশ্ব গণহত্যা দিবস ঐতিহাসিক মানবিক দিবস হিসেবে পালিত হোক। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল কার্যকর দিবস হিসেবে ‘বিশ্ব মানুষ’-র ঐক্য স্থাপিত হবে।

৩. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে বর্বর গণহত্যা, Genocide হয়েছে, সেই গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট পাক-সেনাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের দাবীকে জোর দিতে হবে। চিহ্নিত ১৯৫ জন পাক-সেনাকর্মকর্তার বিচার, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওনা হাজার হাজার কোটি টাকা সুদ-আসলে আদায়, যুদ্ধশিশুদের দায়ভার ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার আহবান জানাই।

বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৯৭৭, ১৯৮০, ১৯৮৯, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৫, ২০১০ এবং ২০১২ সালে দ্বিপক্ষীয় সভা হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি।

পাকিস্তানের নিকট প্রাপ্য সম্পদ, ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে বর্তমান সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। বিগত সময়ে আদায় না হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে পাকিস্তানের সখ্যতার সুবাদে এই ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায় হলে, তা হবে এই সরকারের একটি কূটনৈতিক সাফল্য।

৪. আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ‘সমঅধিকার ও সমআচার’ প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে নিশ্চয়তা প্রদান ও বাস্তবায়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস রাখতে হবে।

৫. মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন, স্থাপনা সংরক্ষণ করা আবশ্যক। পাঠ্যবইয়ে দিবসটির ইতিহাস ঐতিহ্য ও তাৎপর্য সংযোজন করা অপরিহার্য।

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে হবে। কি নির্মম নৃশংস ছিলো সেই রাত!

বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে জাতীয় গণহত্যা দিবস থেকে সকলের পাঠ নিতে হবে। মহান‌ স্বাধীনতা, সংবিধানের মূলনীতি ও ধারাসমূহের সাথে একটি বৈপ্লবিক ইতিহাস সন্নিবেশিত হয়ে আছে । মুক্তিযুদ্ধের বিশাল বিরল ইতিহাসকে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করেন, অপব্যাখ্যা দেন, তারা পাক-দোসর। তাদের কোন দেশপ্রেম নেই, তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ।

বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কারের যেসব তথ্যাদি প্রতিনিয়ত পত্র পত্রিকায় দেখি, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয় । ৭২-এর সংবিধান একটি ঐতিহাসিক দলিল । এই দলিলে যুগোপযোগী কিছু অধ্যাদেশ সংযোজিত পারে, তবে মূল সংবিধানকে ব্যবচ্ছেদ‌ করে হতে পারে না। যারা সংস্কার প্রক্রিয়ায় জড়িত, তাদের স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। একটি নির্বাচিত সরকার নতুন কিছু সংযোজনে উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, যা একটি চলমান কার্যক্রম বলে বিবেচনা করা হয়।

জাতীয় গণহত্যা দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, পাকসেনাদের নির্মমতায় যাঁরা শহীদ হয়েছেন। প্রতিবছর দিবসটি যথাযোগ্য পালিত হবে প্রত্যাশা রইলো।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!