বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি অনেক “নীরব নায়ক” ছিলেন যাঁদের অবদান এখনও যথাযথভাবে আলোচিত হয়নি। চিত্ত হালদার তেমনই এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব- একাধারে শিল্পী, ভাস্কর ও অস্ত্র উদ্ভাবক। তাঁর হাতে গড়া শিল্পকর্ম যেমন বাংলার জীবন ও প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি, তেমনি তাঁর তৈরি দেশীয় অস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সৃজনশীলতা কেবল রঙ ও ক্যানভাসে নয়, বরং ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনে কিভাবে এক অপ্রত্যাশিত রূপ নেয়, তা চিত্ত হালদারের জীবন থেকে বোঝা যায়।
চিত্ত হালদার বরিশালের এক সম্ভ্রান্ত খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই প্রকট। তার হাতে গড়া ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পে বাংলার গ্রামীণ জীবন, শ্রমজীবী মানুষের চিত্রকল্প, নারী ও পুরুষের নানা রূপ বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তার শিল্পকর্মে পুরাকালের শৈল্পিক কৌশল ও আধুনিক রুচির মেলবন্ধন ছিল লক্ষণীয়। প্লাস্টার অব প্যারিস, কাঠ, মাটি ও পাথরের মিশ্রণে তৈরি তার ভাস্কর্যগুলো বাংলার প্রকৃতির নীরব ও গতিময় দুই প্রকৃতির মোহনীয় সংমিশ্রণ। এমন শিল্পীজীবন তাকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুপরিচিত ও সম্মানিত করে তুলেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকা গণহত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই চিত্ত হালদার তাঁর শিল্পকর্মের সরঞ্জাম সরিয়ে রেখে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বরিশালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তৈরির কাজে হাত দেন। এখানে তার ভূমিকা ছিল অন্যরকম। তিনি শুধু সাহায্যকারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নিজস্ব অস্ত্র তৈরির ফর্মুলা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবক। শিল্পীর হাতের দক্ষতা ও যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার জোরে তিনি দেশীয় উপাদান থেকে কার্যকর বোমা, মলোটভ ককটেল, হ্যান্ডগ্রেনেড বানাতে সক্ষম হন।
বরিশালে তার নেতৃত্বে কালিবাড়ি রোডের যুব সংঘের সহযোগীরা প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতেন এবং চিত্ত হালদার নিজেই অস্ত্র তৈরি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। চিত্ত হালদারের তৈরি বোমাগুলো ব্যবহার হয় চাঁদপুর-খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে, যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
চিত্ত হালদারের শিল্পীসত্তা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় এই দ্বৈত পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরে একজন মানুষের বহুমাত্রিকতা- যেখানে সৃজনশীলতা প্রয়োজনে পরিণত হয় অস্ত্র উদ্ভাবনের দক্ষতায়। এটি আরও প্রমাণ করে, সৃজনশীলতা শুধু রঙ ও তুলিতেই নয়, প্রয়োজনে দেশপ্রেমে অস্ত্র তৈরিতেও বিকশিত হতে পারে।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চিত্ত হালদারের জীবন ও কাজ শুধু শিল্পকলা বা যুদ্ধের দিক থেকে নয়, মানবতার এক গভীর অধ্যায়। তার সংগ্রামের মর্ম ছিল স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এক অনন্য অবদান। তার শিল্পকর্ম বাংলার প্রাণ, তার অস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ।
চিত্ত হালদারের যুদ্ধকালীন অবদান প্রায়শই মূলধারার মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে উপেক্ষিত থেকে গেছে। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আলোচনা ও চর্চায় একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়, যেখানে কেবল সামরিক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে আলোকপাত করা হয়। অথচ, মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক সমন্বিত সংগ্রাম, যেখানে পেছনের সারির মানুষগুলোও ছিলেন সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে মুক্তিযুদ্ধের জয়লাভ শুধু রণাঙ্গনের সাহসে হয়নি, বরং এর পেছনে ছিল গোপন প্রস্তুতি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, ও সাংগঠনিক দক্ষতারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
চিত্ত হালদার ছিলেন একাধারে শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা। শিল্পীর রূপে তিনি বাংলার সংস্কৃতির চিত্রায়ন করেছিলেন, যোদ্ধার রূপে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তৈরি করেছিলেন। তার জীবনের এই দ্বৈত পরিচয় আমাদের শেখায়—সৃষ্টিশীলতা ও দেশভক্তি একসঙ্গে থাকতে পারে, যখন দেশপ্রেমের কথা আসে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান স্মরণীয় ও গর্বের। এই অধ্যায় আমাদের শিক্ষা দেয়, সংকটময় সময় মানুষের সম্ভাবনা সীমাহীন, আর শিল্পীও হতে পারে দেশের জন্য বীর যোদ্ধা।
আজকের প্রজন্মের জন্য তাঁর জীবন এক মূল্যবান শিক্ষা: কোনো সংকটে কেবল সাহস নয়, সৃজনশীলতাও পারে মুক্তির পথ দেখাতে। তাই চিত্ত হালদার আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনুল্লেখিত কিন্তু অনন্য নায়ক, যাঁর অবদান নতুন আলোয় দেখা প্রয়োজন।
তথ্যঋণ:
১। ভায়লেট হালদার সম্পাদিত- চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত হালদার স্মারকগ্রন্থ: মারমেইড প্রকাশনী।
২। খ্যাতিহীন বিত্তহীন শিল্পী চিত্ত হালদার: মানবেন্দ্র বটব্যাল
দৈনিক সংবাদ, প্রকাশকাল: ২ আগস্ট ১৯৭৮




