সাঁওতালি সংস্কৃতি

ভারতবর্ষের প্রকৃত অধিবাসী হল আদিম উপজাতি। নিষাদ, কিরাত, বোড়ো, খাসি, রাভা, রিয়াং, সাঁওতাল, মুন্ডা, বীরহোর, গারো, মেচ, টোটো, লেপচা প্রভৃতি হল ভারতের আদিম অধিবাসী। বর্তমান প্রবন্ধে সাঁওতালদের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করা হবে।

বলাগড় একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এই বলাগড়ে সাঁওতালদের বসতি লক্ষ করার মতো। সুপ্রাচীন কালের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে বলাগড়। আর বলাগড়ের মানুষ। এ অঞ্চলের মানুষজন বিভিন্ন সময়ে তাদের আত্মিক জাগরণ ঘটানোর জন্য বিচিত্র কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছে। শরিক হয়েছে অজস্র ঘটনার। যা আজও গ্রাম গঞ্জে বাড়িতে বাড়িতে বয়স্কা মহিলার রসকথা পরিবেশনের উপজীব্য বিষয়। সূর্য যখন অস্ত যায়, সন্ধ্যা গাঢ় অন্ধকার নিয়ে নেমে আসে বাঁশ বাগানের ভিতর থেকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সামনে পিছনে দুলতে দুলতে স্কুলের পড়া মুখস্থ করার আওয়াজকেও ঘনীভূত রহস্যের ইমেজ এনে দেয় গুটি গুটি হয়ে বসে থাকা জড়ঠাকুমা। তিনি খুক্ খুক্ করে কাশতে থাকেন, আর চোখ পিটপিট করে তাকান, চোখ তাঁর জ্বলতে থাকে—শেষ মুহূর্তের তলানিতে ঠেকে যাওয়া কুপির সলতের মতো। ফোকলা দাঁতে ফিক ফিক করে অল্প আওয়াজ তুলে হাসে। কিছুটা বা মনে হয় সাপের বিকৃত শিসের মতন। এই ঠাকুমা হলেন গল্পের ঠিলে। তাঁর তোবড়ানো গালের ভিতর জিভ নড়াতে নড়াতে গল্পের ঠিলে কাত করে ঢেলে দেন রসের গল্প, রূপকথা, ছড়া হেঁয়ালি— আরও কত কী! শুনে শুনে শেষ করা যায় না। রাত ফুরিয়ে যায়। ভোর হয়। তবু ঠাকুমার গল্পকথা শেষ হয় না। আকাশের তারা যেমন দু’চোখে দেখে শেষ করা যায় না।তার রূপকে প্রত্যক্ষ করার জন্য হাজার হাজার চোখ দরকার। তেমনি ঠাকুমার গল্প কথা শোনার জন্য দুই কানকে অপ্রতুল মনে হয়। বলাগড়ে ক্ষেত্র গবেষণা করার সুবাদে বলাগড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভিতর প্রবেশ করে গেছি। তাতে গবেষণার কাজ যতটা সহজ হয়েছে তার চাইতে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছি আমি নিজে। পারিবারিক সূত্রে তারা আমার আত্মীয়। এবং এই মানসিক সম্পর্ক তাদের সাথে মিশে যেতে প্রচণ্ড সাহায্য করেছে। তারা যে আমার গবেষণার আলোচ্য বিষয়— একথা কখনও মনে হয়নি কারণ কাজ করতে করতে একথা মনে হয়েছে যে আমি তাদেরই একজন। একথা শুধু মনে হওয়া নয় আলাপ সূত্রে জেনেছি আমাদের পরিবার ও তাদের পরিবারের সঙ্গে রয়েছে রক্তের সম্পর্ক। এই বাস্তব সত্য জানার পর স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রহ বাড়ে গেছে এবং তাদের ভিতর গিয়ে কাজ করার সময় একটা বাড়তি সুবিধা ও সহযোগিতা পেয়েছি তাও স্বীকার করে নিতে কোনো দ্বিধা নেই। বরং তা আনন্দেরএবং গর্বেরও বটে।

আমার গবেষণার কাজে বলাগড় অঞ্চলের সমস্ত মানুষের সংস্কৃতি স্থান পেয়েছে। তবে বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে নৌশিল্পী সমাজ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়। বলাগড়ের বিস্তৃর্ণ ভূখণ্ডে বহু বিচিত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রদায় বসবাস করে। তাদের মধ্যে রয়েছে হিন্দু অহিন্দু জাতি। এখানে আদিবাসী সম্প্রদায় মানুষের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করা হল।

বলাগড়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে জেনেছি যে আদিবাসী, সাঁওতাল সমাজের মানুষেরা নিজেদের ‘হড়’ বলে পরিচয় দেয়। হড় শব্দের অর্থ মানুষ। বলাগড়ে সাঁওতালি ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে যারা তপশিলি উপজাতি হিসেবে পরিচিত। এরা আঠারো শতকের ভারতবর্ষ থেকে আজ পর্যন্ত বিদেশী, স্বদেশীয় শাসক দ্বারা শোষিত এবং অত্যাচারিত। দিকু, মহাজন ও অত্যাচারী শাসক দ্বারা তারা বিতাড়িত হয়েছে তাদের অরণ্যভূমি থেকে। যে কারণে তারা ১৭৭৮ সালে ছোটনাগপুরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত কলহন (বিহার) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরটি প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়। এই পঁচাত্তরটি প্রতিবাদী আন্দোলন একক জাতির আন্দোলন। ভারতবর্ষে এমন আর কোন জাতি একক ভাবে এতগুলি প্রতিবাদী আন্দোলন করতে পারেনি। অথচ তাদের লড়াইয়ের কথা, সংগ্রামের কাহিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে যতটুকু পাই তা অতি সামান্য। যে জাতি কঠোর পরিশ্রমী, লড়াকু এবং সংগ্রামী, তাদের আন্দোলনের কাহিনিও হওয়ার কথা দীর্ঘ। এবং তারা যে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম জাতি একথাও প্রমাণিত। তবু তাদের জীবন সংগ্রাম, লড়াই ও অস্তিত্বের মর্মকথা ভারবর্ষের ইতিহাসে স্থান পায়নি। যা কী না বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের পক্ষে উপমহাদেশের পক্ষে এক চরমতম লজ্জা। এবং আশ্চর্যের বিষয় ভারতের ইতিহাসবিদেরাও এ ব্যাপারে ততটা সচেতন বা আগ্রহী নয়, বরং কিছু বিদেশী গবেষক, ঐতিহাসিক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। গবেষণা ধর্মী কাজেও ব্রতী হয়েছে।

জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষই বলাগড়ে বসবাস করে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আচার আচরম প্রথারীতি নীতি সব কিছু লক্ষ্য করে বলা যায়— বলাগড় হল বিচিত্র সংস্কৃতির সমন্বিত ঐক্যভূমি। আদিবাসী সাঁওতাল গোষ্ঠীতে এই সমন্বিত ঐক্যভূমির শরিক। তাই তারা ও তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে বহন নিয়ে চলে অন্যান্য জাতির মতই। তাদের সংস্কৃতি যে বাঙালি সংস্কৃতির সুতিকাগৃহ তা বোঝা যাবে বাঙালি সংস্কৃতি ও সাঁওতালী সংস্কৃতির ভাষাতাত্ত্বিক তুলনামূলক আলোচনা করলে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন বাংলাদেশজ শব্দ ব্যবহার করি যা মূলত সাঁওতালী শব্দ। একথা অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তবে তা সত্য। যেমন ভাঁওতা শব্দ টি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ব্যবহার করে। বাংলা শব্দভাণ্ডারে শব্দটি গৃহীত হয়েছে। ভাঁওতা শব্দের অর্থ ধোকা দেওয়া মিথ্যা কথা বলা ইত্যাদি। এটি সাঁওতালী ভাষা থেকে বাংলা শব্দভাণ্ডারে এসেছে। নবম দশম শতাব্দীতে রচিত বাংলা ভাষায় চর্যাপদে একটি পদে ‘ভাঅ’ শব্দ পাই। দিবসই বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ। ভাঅ শব্দের সঙ্গে তা অনুসর্গ যোগে শব্দটি গঠিত হয়েছে। ভাঁওতার মতই গাঁওতা, সাঁওতা ইত্যাদিও সাঁওতালি ভাষার শব্দ। প্রাকবৈদিক ভাষার শব্দ বিবর্তিত রূপ পেয়ে প্রাচীন বাংলা ভাষাতে প্রবেশ করে। সেই সময় এই শব্দটি অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের মৌখিক উচ্চারিত শব্দ ছিল।

আবার বাংলা বারো মাসের নামও যে সাঁওতালি বারো মাসের নাম থেকে গৃহীত। মাসগুলির নামকরণ তাকেই নির্দেশ করে। সংক্রান্তি উৎসব। এবং এই উৎসব অখণ্ড বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র পালিত হয়। বাংলা দেশের অন্ত্যজ শ্রেণীর কাছে সংক্রান্তি হল একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। এই সময়ে নতুন পোশাক, নতুন বাসনকোসন ‘কাড়ানো’ হয়। নতুন চাল দিয়ে বাস্তু পূজা, ভিটে পূজার প্রচলনও দেখতে পাই এবং এই রীতি সাঁওতাল সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এমনকি তারা মাঘ মাসকেই বর্ষ শুরু হিসাবে গণনা করে। মাঘ মাসকে সাঁওতালি ভাষায়ে মাগ, ফাল্গুন-ফাগুন, চৈত্র-চীত, বৈশাখ-বীইশীত, জ্যৈষ্ঠ-ঝেঁট, আষাঢ়-আসার, শ্রাবণ-সাম, ভাদ্র-ভাদর, আশ্বিন-দাশায়, কার্তিক–সহরায়, অঘ্রান-আঁঘাড, পৌষ-পুস। অতএব আমরা এই বাংলা মাসের নাম সাদৃশ্য লক্ষ্য করে এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের বিচারে সাঁওতালি প্রাচীন নাম অনুসারেই যে বাংলা মাসের নাম সৃষ্টি হয়েছে একথা বলতে পারি। তাছাড়া মকর সংক্রান্তি উৎসব ও সন্তান সন্ততি জন্ম নেওয়ার সময় যে প্রচলিত আচার বিচার তা সকলই সাঁওতালি সংস্কৃতি থেকে বাঙালি সংস্কৃতিতে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। এক কথায় বলতে গেলে আজকের বাঙালি সংস্কৃতি হল সাঁওতালি সংস্কৃতির সংস্কৃত রূপ।

তথ্য অনুযায়ী আবার আমরা সবাই জানি যে এই বলাগড় অঞ্চল একসময় ছিল অরণ্যভূমি। পাশ দিয়ে ভগীরথী বয়ে চলেছে। আর দুই তীরে বসবাস করত এইসব আদিম অধিবাসীদের উত্তরসূরী। এরা সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাহাতো, জেলে, শবর (অল্প) ইত্যাদি উপজাতি। ক্রমে অন্যান্য জাতির চাইতে বেশি কষ্ট সহিষ্ণু আদিবাসী সাঁওতালরা এখানে টিকে গেল এবং তারাই স্থায়ীভাবে বসবাস করল। সুদীর্ঘ প্রাচীনকালে এরা এখানে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করত। তারা মাটির বাড়ি তৈরি করে থাকত। রাস্তাঘাটও ছিল অনুন্নত, তাদের তৈরি করা মাটির বাড়িতে পরবর্তীকালে ইংরেজরা ‘গর’ উচ্চারণ করে। ভারতবর্ষে ও ভারতের বাইরে এরা বেশির ভাগ সময়ই মাটির ঘর বাড়ি নির্মাণ করে থাকত। তাই তাদের বসবাসের জায়গার নামের সঙ্গে ‘গড়’ যোগ হয়। জায়গার নামের শেষে যে গড় ব্যবহার করে তার উদাহরণও রয়েছে। অনেক। যেমন— লালগড়, রামগড়, নারায়ণগড়, কর্ণগড়, হুমগড় ইত্যাদি এবং তারা যে বলাগড়ে বসবাস করে আসছে দীর্ঘ কাল ধরে তাই বলাগড় নামটি যে তাদের দেওয়া নয় একথা নিঃসংশয়ে বলতে পারি না। এই বলাগড় নাম হুগলি গেজেটে পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায় সাঁওতাল ও অন্যান্য জনজাতির গড় অনুসর্গ যুক্ত নাম ধরে ডাকার কথা।

গড়’ শব্দটি যে স্থানীয় মানুষজনের কাদামাটির নির্মিত ঘর বাড়ি থেকে এসেছে সে কথা হুগলি গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়।

বলাগড় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সমস্ত মৌখিক অনুষ্ঠান উৎসব এবং প্রচলিত বিশ্বাস সংস্কার আচার রীতিনীতি প্রথা ইত্যাদি সবই সাঁওতালি সংস্কৃতি থেকে ধার করা। একথা গায়ের জোরে বা অনুমানসিদ্ধ নয়। প্রাক বৈদিক যুগের মানুষের সংস্কৃতির দিকে যদি আমরা নজর দিই তবে এমনটি মনে হতে বাধ্য। এবং বর্তমান ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় সেই সাদৃশ্য দেখেছি। আর্যদের আসার আগে অনার্য সংস্কৃতি বর্তমান ছিল। আর্যরা যতসংখ্যক পুরুষ এদেশে এসেছিল নারী ছিল তুলনায় সামান্য। তাই তারা বংশবিস্তার করার জন্য স্থানীয় জনজাতির নারীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এভাবে অনার্য সংস্কৃতি অনার্য নারীর দ্বারা লালিত হয়ে বাহিত হয়েছে এবং মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির। তাই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও আর্য জাত সংস্কৃতি ও যে অনার্য সংস্কৃতিরকাছে নানা বিষয়ে ঋণী সেকথা ড. অতুল সুর তাঁর “বাঙলার সামাজিক ইতিহাস” গ্রন্থে বলেছেন। তিনি বলেছেন, বস্তুত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনেক কিছু পূজা পার্বনের অনুষ্ঠান যেমন দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা ও শারদোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বণ, হোলি, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা কলাগাছ নারিকেল সুপারি পান সিঁদুর ঘট আলপনা শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনি গোময় পঞ্চগন্ধের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের থেকে গৃহীত হয়েছি। তাদের কাছ থেকে আরও গৃহীত হয়েছিল আটকৌড়ে সুবচনী পূজা, শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠীপূজা বিবাহে গাত্রহরিদ্রা পানখিলি গুটিখেলা স্ত্রী আচার লাজ বা খই ছড়ানো দধিমঙ্গল লক্ষ্মীপূজার সময় লক্ষ্মীর ঝাঁপি স্থাপন ইত্যাদির আচার যা বর্তমানকালেও বাঙালী হিন্দুপালন করে থাকে। এসবই তো প্রাক্ আর্য সংস্কৃতির অবদান।

উপরে বর্ণিত ড. অতুল সুর যে সব তথ্য দিয়েছেন তা আজও সাঁওতালি সংস্কৃতির পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিতে দেখা যায়। অতএব বাঙালি সংস্কৃতিকে সাঁওতালি সংস্কৃতিরই অন্য এক রূপ একথা বললে ভুল হয় না।

সাঁওতালি সাহিত্য মূলত মৌখিক সাহিত্য। শ্রুতি তাদের নির্ভর। পণ্ডিত সাধু রামচাঁদ মুর্মু, গ্রীয়ার্সন সাঁওতালি ভাষার লিখিত রূপের নবীনতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তারা সাঁওতালি ভাষার লিখিত নিদর্শনের অপ্রতুলতার কথা জানান। লিখিত ভাষাই যে জাতির শিল্প সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে তা সাঁওতালি ভাষা-ভাষী মানুষ অনেক দেরিতে বুঝেছে। তাদের ভাষার লিখিত রূপের জন্য অলচিকি হরফ মালার জন্ম হয় অনেক দেরিতে। বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানে সাঁওতালি ভাষা স্বীকৃতি লাভ করেছে।

সাহিত্য ও ভাষা নির্ভর করে মৌখিক সাহিত্যের উপর। যে ভাষাতে যত মৌখিক সাহিত্য সে ভাষা ততবেশি সমৃদ্ধ। মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে প্রবাদ, প্রবচন, বাগধারা ছড়া হেঁয়ালি লোকসংগীত লোককথা ধাঁধা এবং লোকভাষা। এগুলি এক নিমেষের সৃষ্টি নয়। দীর্ঘকালের সংসার জীবন-সংগ্রাম ও সমাজ জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল। জীবনের সারস্বত্যবাণী অপূর্বতা লাভ করে প্রবাদ প্রবচন ছড়া ধাঁধার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। আমরা জানি যে, সাহিত্য ভাষা সমৃদ্ধ হয় সেই সমাজের মানুষের মৌখিক সাহিত্যকে আশ্রয় করে। তাই এই সমস্ত মৌখিক সাহিত্য যতবেশি রচিত ও সৃষ্টি হবে মানুষের মুখে মুখে ভাষাও সাহিত্য ততবেশি সমৃদ্ধ হবে। এ প্রসঙ্গে ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতামত স্মরণ করা যেতে পারে। প্রবাদ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন— প্রবাদ গৌষ্ঠীজীবনের অভিজ্ঞতা তার সংক্ষিপ্ততম সরস অভিব্যক্তি। একথা সত্য যে অভিজ্ঞতা সমাজ জীবনের নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে জন্ম নেয়। ঘটনা বেশিদিন বেঁচে থাকে না, হারিয়ে যায় সময়ের চাপে এবং তা চলে যায় স্মৃতির অন্তরালে। এই সব অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় অজস্র প্রবাদ যা কিছু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে পরিস্থিতিতে মানুষ তা স্মরণ করে। এইভাবে প্রবাদ বেঁচে থাকে। সমাজের চরিত্র যখন সাহিত্যে স্থান পায় তখন তার লালিত সংস্কৃতিও সেখানে ঠাঁই পায়। এইভাবে প্রবাদ প্রবচন বাগধারা সহ অন্যান্য মৌখিক সাহিত্যও স্থান করে নেয় সাহিত্যের আসরে।

বলাগড় এর সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষরা যে সমস্ত প্রবাদ বলে থাকে তা এখানে উল্লেখ করলাম।
১) একেন ঠিলি দ সাজেগয়া— শূন্য কলসীর আওয়াজ বেশি।
অনুরূপ বাংলা : ফোঁপরা ঢেঁকির শব্দ বেশি।
২) কাঁড়া হাপা দ মিৎ ছিটগেয় আৎতা— অন্ধলাঠি একবারই হারায়।
অনুরূপ : ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।
৩) টাকা খান বীহু দাকা খান কীহু (বঁহু বউ)
অনুরূপ বাংলা : ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।
৪) মিৎ ধারেতে পিঠা দ বাং ই সিনঃ গেয়া।
অনুরূপ বাংলা : এক হাতে তালি বাজে না।

এই প্রবাদগুলিতে মানুষের চরিত্রের দিকগুলিকে নির্দেশ করেছে। এবং সামাজিক অবস্থানকেও সূচিত করে।
সাঁওতালি ভাষাতে প্রবাদের পাশাপাশি রয়েছে অজস্র বাগধারা। গ্রাম্য নিরক্ষর মানুষ কথায় কথায় এ সমস্ত বাগধারা প্রয়োগ করে থাকে। সে সবের থেকে কিছু এখানে তুলে ধরলাম।
১। উদমা ঢিংকি—ভবঘুরে (আক্ষরিক অর্থ অনিয়ন্ত্রিত ঢেঁকি)
২। কাটকল ইতিল-বড়লোক হওয়া (কাঁকড়ার চর্বি)
৩। লাচবাবাত-ক্ষিদে পাওয়া (পেট চুলকানো)
৪। ছাতা দরে-স্বামী (ছাতা রূপ গাছ)
৫। পোণ্ডপুখরি দাঃ-হাঁড়িয়া (শ্বেত পুকুরের জল)

যারা সমাজে ভবঘুরে লোক তাদের কোন চালচুলোর ঠিক থাকে না। জীবন তাদের অনিয়ন্ত্রিত। কাজকর্মও ঠিকঠাক করতে পারে না। ঠিক যেন অনিয়ন্ত্রিত ঢেঁকি যে পাড় দিলেও এলোমেলো ছন্দে তার গর্তে ঢোকে। এমন চরিত্রের মানুষকে নিয়ে বাগধারা তৈরি হয়েছে। আবার স্বামী পরিবার তথা স্ত্রী আশ্রয়দাতা। প্রতিপালক স্বামীকে তাই ছাতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আবার ঈঙ্গিতময়তাও বর্ণিত হয় বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে। যেমন পেট চুলকালে ক্ষিদে পেয়েছে বুঝে নিতে হয়। এ সকল বিষয় নিয়েও অজস্র বাগধারা সাঁওতালি ভাষাতে বর্তমান।

বীরভূম জেলার বল্লভপুরে সাঁওতাল উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। এখানকার সাঁওতালরা সহরায় পরবে নৃত্য করে। এছাড়া বিবাহ ও অন্যান্য মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেও এরা নৃত্য করে থাকে। সাঁওতাল রমণীরা বৃত্তাকারে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে। নাচের মধ্যে থাকে একটি স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। যা শিল্পী ও দর্শক মনে উন্মাদনা জাগায়। আনন্দ প্রদান করে। এবং এই নৃ্ত্য হয়ে ওঠে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক ও মনোগ্রাহী। নাচের সময় শিল্পীরা এক—দুই—তিন ও তিন—দুই—এক পায়ের তালে নাচতে থাকে। এরা কখনও কখনও সরলরেখা বরাবর নাচে আবার কখনও বৃত্তাকারেও নাচে। তাদের জীবনচর্চা ও জীবনচর্যা কঠোর কঠিন তপশ্চর্যাতে সম্পৃক্ত হলেও তারা জীবনের আনন্দ গানে থাকে ভরপুর। তারা জীবন বোধে রসের কাণ্ডারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করে।


লোকসংগীত সাঁওতালি সংস্কৃতির অপর এক জীবন্ত শাখা। বিষয় বৈচিত্র্যে সাঁওতালি লোকসঙ্গীত এক অন্য মাত্রা দাবি করে। ভাষা আঙ্গিক বিষয়ে সাঁওতালি লোকসঙ্গীত একটু সচেতন সুর সঙ্গীত রসিক ব্যক্তিকে অনায়াসেই আকৃষ্ট করতে পারে। বলাগড় থেকে বেশ কিছু সাঁওতালি সংগীত সংগৃহীত হয়েছে। এখানে দুটি গান উল্লেখ করা হল—

যাহা করেন পীড়া হিজু আক উড়ঃ
এগো, আমদ সোর আক মেরে লুটাবে দাঃ
যাহা উডং সিসাং আলম কুজোল সাতেঃ
এগো, পাচেৎ সেক হায়োঃ আমাড়েন পীড়াঃ
সন্তাল সমাজ বেদ লুটা দাঃ গো মারাং
এগো আলম লেবেৎ লটম জাতি ধরম।

অতিথি আপ্যায়ণ সাঁওতালি সমাজে বিশেষ ভাবে প্রচলিত এবং তাতে যাতে কখনই ভুল না হয়। আমাদের অতিথি সেজে আমারই পরমাত্মীয় তথা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আসতে পারেন। তাই কখনই অতিথির প্রতি অমনোযোগী না হওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সাঁওতাল সমাজের রীতি অনুযায়ী ঘটি ভর্তি জল দিয়ে অতিথির পদরজ ধুয়ে তাকে বরণ করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপর একটি গানে উন্মত্তরূপে পিসায়ী মনের আকুতি প্রকাশ পেয়েছে।

এ চরকীয়
আমাঃ রূপে ঞেলাতে রৌমতীতে চাপে তাবানা
ওকা সেত হঃ বৌঞচালা দাড়ে আর কানা
এ চরকীয়
এ চরকীয়
আমাঃ হারা যৌওম হরম চিকতে জটত।
ইঞা দঃ চেদ হঃ বালু তিঞা
এ চরকীয় . . . এ চরকীয়।

সংগীত হল হৃদয়ের ভাষা। আর হৃদয়ের ভাষা মানেই একটি হৃদয় থেকে আরেকটি হৃদয়ে ভাবের সঞ্চার। তাই হৃদয়ের ভাষার মাধ্যমে মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করা যায়, কাছে টানা যায়। তাই পৃথিবীর সমস্ত ভাষার সংগীতের সিম্ফনির মধ্যে সমন্বয় দেখা যায়, দেখা যায় অন্তর্নিহিত ঐক্য। তাই সাঁওতালি সংগীতেও নারী মনের বেদনার বাণী প্রকাশ পায় খুব সুন্দরভাবে। এখানে এক প্রেমিকার হৃদয়ের আকুলতা ও বেদনার আর্তি প্রকাশ পেয়েছে উপরের গানটিতে।


বীরভূমের সাঁওতালি দেওয়ালচিত্র আকর্ষক ও মনোগ্রাহী। তারা মাটির বড়িতে দেওয়াল কাদা দিয়ে লেপে তার উপর প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে নানান ধরনের চিত্র ও ভাস্কর্য তৈরি করে। প্রথমে সাঁওতাল রমণী আয়তকার একটি জমি আঁকে। তার চারপাশে বর্ডার দেয় কালো রঙ দিয়ে। কালো রঙ তারা তৈরি করে কাঠ কয়লা দিয়ে। গেরুয়া রঙ তৈরি করে লাল কাঁকর মাটি দিয়ে, এবং বেগুনি রঙ পুঁইশাকের পাকা বীজ দিয়ে তৈরি করে। চুন দিয়ে করে সাদা রঙ। এরা ছবি আঁকে নানা ধরণের মটিফ দিয়ে, এই মোটিফ হয় জ্যামিতিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক, বাস্তবতার কোনো কাহিনি এবং সৌরজগতের নানা চিত্রের। নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত এইসব সাঁওতাল রমণীরা প্রথাগত শিক্ষা না নিয়েও তাদের মনের শিল্পীসত্তার সুন্দর প্রকাশ ঘটায় তাদের কাজের মধ্য দিয়ে।-0-

ছবিঋণ: শাশ্বতী মার্ডি

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!