ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু মানুষের জীবনযন্ত্রণার গীতিআলেখ্য বিবৃত হয়েছে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসে। অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কাহিনি দেশভাগের ফলে তাদের কী অবস্থা হয়েছিল তাই হল উপন্যাসটির মূল উপজীব্য বিষয়; তবে উপন্যাসটির কয়েকটি উপকাহিনির মধ্য দিয়ে দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের অস্তিত্ব সংকটের কথা ব্যক্ত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিকের প্রবহমান জীবনধারার সাথে সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের কথা উঠে এসেছে। এছাড়া অজস্র অপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের আনাগোনায় উপন্যাসটি একটি সার্থক দেশভাগের মানুষের জীবনযন্ত্রণার জ্বলন্ত দলিল হয়ে উঠেছে। বর্তমান গবেষণাপত্রে গবেষক ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসে দেশভাগের ফলে মানুষ কীভাবে আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এবং তাদের যন্ত্রণার মূল উৎস কোথায় নিহিত রয়েছে তা অন্বেষণ করার প্রয়াস দেখিয়েছেন।
মূলশব্দ: আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা, দেশভাগের শিকার ও যন্ত্রণা, চরিত্র বিশ্লেষণ, অস্তিত্ব সংকট।
বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্দশার অন্ত নেই। একদা যাদের ছিল গোলাভর্তি ধান, পোষ্যপ্রাণী, পুকুর ভর্তি মাছ আর পর্যাপ্ত পরিমাণে জমি, মালিক ছিল অনেক কিছুরই কিন্তু এক নিমেষেই রাজনৈতিক বিভাজনসূত্রে তারা সর্বসান্ত হয়ে, সর্বস্ব হারিয়ে, সর্বহারা হয়ে, হয়ে পড়ল নিঃস্ব, রিক্ত। এরাই পরিচিত হল শরণার্থী, উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল এবং ‘রিফুউজি’ নামে। যে-সমস্ত মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল ছিল তারাই রাতারাতি রিক্ত, নিঃস্ব ও সর্বহারাতে পরিণত হয়ে ভূমিবর্জিত নিরন্নের দলে নাম লেখাল। যাদের সব ছিল তারা সব হারাল, অবশিষ্ট কিছুই থাকল না, দেশান্তরিত হতে হল— নতুন স্থানে নতুন করে বসতি গড়ে তুলতে গিয়ে অনেক কঠিন কাজ ও সংস্কারের বাইরে গিয়ে নতুন সমাজ ব্যবস্থাকে মেনে নিতে বাধ্য হল। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে অনেকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা পাবার আকাঙ্ক্ষায় নানা ধরনের জীবিকার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে বাধ্য হল। দেশান্তরিত মানুষের জীবনযন্ত্রণার শেষ নেই। তাদের জীবন যেন বিভীষিকাময় হয়ে উঠল। এই ছিন্নমূল মানুষদের মধ্যে বিষেশত হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হল। তবে পিছিয়ে পড়া নিম্নবর্গের মানুষদের সাথে সাথে মুসলিম সম্প্রদায়েরও একাংশ দেশভাগের শিকারে বলি হয়েছে একথা মানতেই হয়। এর ফলে একটি সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। যারা কিনা দুর্বল তারা সবচাইতে বেশি নিপীড়িত, অত্যাচারিত, শোষিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও আক্রান্ত হল বেশি করে অন্য সম্প্রদায় দ্বারা। দেখা দিল অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভয়-ভীতি, সন্দেহ, কলহ নিজেদের মধ্যে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ব্যাহত হল। হিন্দু-মুসলিম যারা দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসবাস করছিল সমবেতভাবে, আজ তারা বিভাজিত নরখাদকের দৌলতে, কিছু সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী আখের গোছানো মানুষের অসাধু কৃতকর্মের ফলে। শাসক ইংরেজ সরকারের প্রদেয় স্বাধীনতাতে এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শে হিন্দুরা এবং দরিদ্র সাধারণ মুসলিমরা সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হল। তারই জীবন্ত দলিল দস্তাবেজ হল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসটি।
দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সমসাময়িক অবস্থা কেমন ছিল তা জানা যায় INDIA WINS FREEDOM গ্রন্থ থেকে। সেখানে মৌলনা আবুল কালাম আজাদ জানাচ্ছেন, On 14 August 1947 Lord Mountbatten went to Karachi to inaugurate the Dominion of Pakistan. He returned the next day and at 12 midnight on 15 August 1947, the Indian Dominion was born.
The country was free, but before the people could fully enjoy the sense of liberation and victory, they woke up to find that a great tragedy had accompanied freedom. We also realized that we would have to face a long and difficult journey before we could relax and enjoy the fruits of liberty.
ইংরেজ শাসকবর্গ ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করল। এই বিভাজনে গান্ধীর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ও জিন্নার মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সূক্ষ বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষ চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়তো করে না। তবে তারা যে রাজনৈতিক চেতনারহিত একথাও নির্দ্বিধায় বলা যায় না। সমাজের সাধারণ মানুষদের মধ্যেও রাজনৈতিক ভাবনা উপ্ত থাকে তাই দেশে দেশে আন্দোলন, বিদ্রোহ ও বিপ্লব সংঘটিত হয়। সমাজের পটপরিবর্তনে তাই সাধারণ মানুষ তথা দেশের নাগরিকদের অবদান অনস্বীকার্য। এখানে স্মরণীয় যে, Congress leaders had not accepted it out of sheer anger and resentment and others out of a sense of despair. Men when they are swayed by indignation or fear cannot judge objectively. How could the advocates of partition who acted under the stress of passion see the implications of what they were doing? এটা যে একটি রাজনৈতিক চুক্তি তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এবং এই দ্বিখণ্ডীকরনের মধ্যে কিছু অর্থগৃন্ধু মানুষের মধ্যে অভিসন্ধি নিশ্চিতভাবে নিহিত ছিল। ছিল ক্ষমতা দখলের কায়েমী স্বার্থচরিতার্থই একমাত্র কাম্য। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনপাতে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের মুনাফা লাভই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। দেশভাগের ইতিবৃত্তের কথা বিশ্লেষণ করলে আমরা অন্তত তাই দেখতে পাই।
বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে “নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে” একটি মাইলস্টোন। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন দেশ ভাগের আগে একটি শান্তির, সম্প্রীতির পরিমণ্ডল ছিল। কিন্তু দেশ ভাগের পরে সাধারণ মানুষের জীবন যে কীভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল তাও চরিত্র-চিত্রণের মধ্য দিয়ে এবং ঘটনার ঘনঘটায় সুন্দরভাবে পল্লবিত করেছেন। এবং অসাধারণ মুন্সিয়ানার সঙ্গে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ যে কেমন ছিল তা ঔপন্যাসিক বর্তমান উপন্যাসে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসের চরিত্ররা আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়ে কাহিনিটিকে একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। উপন্যাসের শুরুতেই লেখক বলেছেন ‘আগে সুন্দরআলি লন্ঠন হাতে। পিছনে ধনকর্তা। তিনি চারদিন আগে ধনবৌর চিঠি পেয়েছেন। ধনবৌ লিখেছে—শরীরটা আমার ভাল যাচ্ছে না, এ সময় তুমি যদি কাছে থাকতে। ধনবৌর চিঠি পেয়ে চন্দ্রনাথ আর দেরি করেন নি। বড় কাছারি বাড়িতে মেজদা থাকেন, তার কাছে গিয়ে বললেন, দাদা, আমি একবার বাড়ি যামু ভাবছি। আপনের বৌমা চিঠি দিছে। অর শরীর ভাল না—একবার তবে ঘুইরা আসি। ভূপেন্দ্রনাথ তার সঙ্গে সুন্দরআলিকে দিয়েছেন।’ এখানে আমরা অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের দেখা পাই সে হল ঈশম শেখ। ঈশম শেখ চন্দ্রনাথ বাবুদের তরমুজের ক্ষেতে রাতে পাহারা দেয়। চন্দ্রনাথবাবুর ছেলে হয়েছে। এই ছেলেই সোনা। সোনার ভাল নাম অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। বাড়ির বড় দাদা অস্বাভাবিক। তিনি থেকে থেকে গ্যাৎচোরেৎশালা বলে চিৎকার করে ওঠেন। বড় ভাই-এর কল্পনাবিলাসী মানসলোকের চিত্র অঙ্কণ করতে গিয়ে লেখক যে বর্ণনা করেছেন তা অতি মনোরম। তিনি লিখছেন ‘আমাকে তুমি ভর্ৎসনা করছ চন্দ্রনাথ ! এমন এক করুণ মুখ নিয়ে চন্দ্রনাথকে দেখতে থাকলেন।…চাঁদের কাকজ্যোৎস্না এখন আকাশের সর্বত্র। যথার্থই এবার বড়কর্তা দুহাত উপরে তুলে হাতে তালি বাজাতে থাকলেন, যেন আকাশের কোন প্রান্তে তাঁর পোষা হাজার হাজার নীলকন্ঠ পাখি হারিয়ে গেছে।’ এই উপন্যাসে হিন্দু মুসলিম অজস্র চরিত্রের ভিড় রয়েছে। শচীন্দ্রনাথ ছোট ভাই। মহেন্দ্রনাথ বাড়ির প্রধান কর্তা। এখানে দেখা যায় বড়বৌ সোনাকে অতিরিক্ত স্নেহ করে, ভালবাসে। তাঁর বয়ানে আমরা দেখতে পাই বড়বৌ সোনার মুখের আদলটা দেখে ভাল করে। দেখতে দেখতে তার মনে হয় এই মুখ ধনকর্তার মতো নয়, ধনবৌর মতো নয়। এ-মুখ বাড়ির পাগল মানুষটার মতো। বড়বৌ কলকাতায় মানুষ হয়েছে, কিছুকাল কনভেন্টে পড়েছে। পাগল স্বামীকে এখন আর তার পাগল মনে হয় না। তাকে মোজেস বা গ্রিক পুরাণের বীরদের মতো মনে হয়। সোনাও ওইরকম আদল পেয়েছে। আবেদালি, জালালি, জোটন বিবি, ফেলু, সামসুদ্দিন, ঈশম শেখ, ফতিমা প্রমুখ মুসলিম চরিত্র রয়েছে এই উপন্যাসে। হিন্দু মুসলিম মিলেমিশে পাশাপাশি অবস্থান করে পূর্ব পাকিস্তানে তা এই উপন্যাসটির প্রথমাংশে দেখা যায়। পরবর্তী কালে দেশ বিভাগ হবার সময়ে দুটি সম্প্রদায়েরই সম্পর্কের মধ্যে চির ধরে। সন্দেহের বীজ দানা বাঁধে তাদের মধ্যে। অবশ্য মাঝে ফেলু একটা অপকর্ম করে বসে। এছাড়া ফেলু মিঞা জিঘাংসামূলক ঘটনার প্রতিফলন ঘটায়। সে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির যে অটুট সম্পর্ক ছিল তারও অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। ফেলু তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হিন্দুদের উপর যখন তখন অত্যাচার করা শুরু করে। আর এইসব কারণেই ওই অঞ্চলের হিন্দুরা বাস্তুভূমি ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ধীরে ধীরে অবশ্য নানা ঘটনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রিয় চরিত্র সোনা বা অতীশ দীপঙ্করের চরিত্রের এবং মানবিক সত্তার সার্বিক বিকাশ ঘটে। এই উপন্যাসে কয়েকটি টাইপ চরিত্র দেখা যায়। মালতী একটি বলিষ্ঠ নারী চরিত্র। আভারাণী নারী চরিত্র হিসাবে সার্থক। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের রেখা অঙ্কিত হয়েছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে। এই উপন্যাসেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এবং এপার বাংলায় উদ্বাস্তু, শরণার্থী হয়ে আসা কাতারে কাতারে মানুষের জীবন ধারণ কঠিন ও দুঃসহ হয়ে পড়ে। তবু বেঁচে থাকার তাগিদে লড়াই করে টিঁকে থাকার জন্য, অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয় এইসব মানুষেরা। তারা জীবন থেকে হারিয়ে যাবার জন্য কোনোমতেই প্রস্তুত নয়। বরং নিজেরা জীবনের নতুন সূর্যের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে।
দেশত্যাগের অনেক আগে একটি মেলায় গিয়ে আক্রান্ত হয় মালতী, রঞ্জিত, সোনা, লালটু, পলটু প্রমুখেরা। তারা একদিন মেলাতে গেলে মেলায় আগুন লাগে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। লেখকের বর্ণনায় দেখা যায় ‘রঞ্জিত দেখল নৌকাটা কে আলগা করে দিয়েছে। একটু দূরে ভেসে রয়েছে। সে জলে ঝাঁপ দিল। এবং মাঝ নদী থেকে নৌকা আনার জন্য সাঁতরাতে থাকলে দেখল, জলের ওপর কি সব ভেসে রয়েছে। সে বুঝতে পারল সেই ভীত সন্ত্রস্ত মানুষেরা জলে ভেসে রয়েছে। আগুন থেকে এবং হত্যা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে ডুবে ডুবে নদী পার হচ্ছে। সে দেখল কিছু কিছু নৌকা তীরবেগে ছুটে যাচ্ছে। সে আর দেরি করল না। নৌকায় উঠে গেল। এবং মনে হল তার কিছু আবছা মতো মানুষের আভাস সেই নৌকায়।’
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে” উপন্যাসে মহেন্দ্রনাথের পরিবারকেও দেশত্যাগী হতে হয়। সময়ের অন্তর্লীন প্রবাহে ভেসে যায় নতুন প্রজন্ম। তাদের মধ্যে জন্ম নেয় নতুন এক প্রত্যয়ের, নতুন এক বিশ্বাসের। দেহকামী কয়েকটি চরিত্রের আবহ পেরিয়ে শাশ্বত সত্য পুনরায় প্রতিস্থাপিত হয় আশার আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে। পূর্বপাকিস্তান থেকে অতীশ দীপঙ্করের পরিবার এই বঙ্গে এসে বসবাস শুরু করে। শুরু হয় জীবন সংগ্রাম, টিঁকে থাকার লড়াই। ভারতে এসে এক ভিন্ন পরিবেশে, সম্পূর্ণ আলাদা মানচিত্রে নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কার ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। শেষপর্যন্ত মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হয় সোনার পরিবার এবং তারা আশ্রয় নেয় ভারতবর্ষে।
মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হবার পর সোনা ভারতে আসে। এসে তাঁর মানসিকতার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ নতুন সমাজ সোনার বা অতীশ দীপঙ্করের কাছে বড় বেশি রহস্যময় মনে হল। এখানে এসে সে সমস্ত যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তারই বর্ণনা উপন্যাসের শেষে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দর করে প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত করেছেন। লেখক লিখছেন ‘সোনার মনে হল দাঁত কটা উড়ে গেছে। দাঁতের কষ চিরে যে রক্ত পড়ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। রক্তের নোনতা স্বাদ লালার সঙ্গে জিভ দিয়ে সে চেটে নিল … ক্ষুধার সময় নোনতা রক্ত চুষে খেতে মন্দ লাগছে না। সে নিজের রক্ত চেটে খেতে খেতে ভয়ঙ্কর সেই কঠিন মুখ দেখে ফের শীতল হয়ে গেল। … যখন সে কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না অথচ সেকেণ্ড অফিসার ওর কান টেনে সামনে পিছনে মাথা দোলাচ্ছেন তখন ওর বলতে ইচ্ছা হল স্যার, আমাকে যে নামেই ডাকুন, যে ভাবেই মারুন, আমি জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছি না। আমি আর একটু বাদে ভেড়ার মাংস-ভাত খাবই।’
অফিসার আরও জানালেন কথার শেষে স্যার বলে ডাকতে হবে। এটাই জাহাজের নিয়ম, আর খাবার প্রসঙ্গে অফিসারের সঙ্গে কথা বলে সোনা জানতে পারল যে তাকে বিফ অর্থাৎ গরুর মাংস খেতে হবে। তখন সোনা বা অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক জানালেন যে কেন তিনি অযথা গরুর মাংস খেতে যাবে। সোনা বললে, ‘বিফ! আমি বিফ খাব কেন! আমি হিন্দু ছেলে, হিন্দুস্থানে চলে এসেছি। আমি আবার বিফ খাব কেন! যারা পাকিস্তানে আছে তারা বিফ খাবে।’ দেশভাগের পরে ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বতন্ত্র দেশ গঠন হল। আর তার সাথে সাথে একটি ধারণাও তৈরি হল যে ভারত অর্থাৎ হিন্দুস্থানে হিন্দুর বসতি হবে। আর পাকিস্তানে বসতি হবে মুসলমানদের। আর সামাজিক ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্যক্তিমানসের মানসিকতা গঠন হয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় সংস্কৃতি অর্থাৎ পারিবারিক সংস্কার অনুযায়ী হিন্দু পরিবারের বিশেষত ব্রাহ্মণ পরিবারের সদ্য যুবক যে গরুর মাংস খাবার কথা ভাবতে পারে না। এটাই আমাদের সামাজিক-পারিবারিক ঐতিহ্য। এখানে কেন্দ্রিয় চরিত্র সোনার চেতনাস্তরে লালিত হয়েছে পারিবারিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। তাই সে গরুর মাংস খাবার কথা শুনে আৎকে ওঠে। তাঁর লালিত বোধের জগতে আলোড়নের ঝড় ওঠে। কিন্তু বাস্তবে সে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে মেনে নিতে হয় পরিবারের অসহায় মা ছোট ছোট ভাইবোনদের কথা ভেবে। অস্তিত্ব সংকটে প্রতিকূল পরিবেশকে মানিয়ে নিয়ে বিজয়ী হয় শেষ পর্যন্ত অপরাজেয় আদর্শ মানব চরিত্র। আর এই চরিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন সোনা বা অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক। সে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান এবং ছিন্নমূল পরিবারের একজন সদস্য। নিঃস্ব, রিক্ত, উদ্বাস্তু হওয়া সত্ত্বেও গরুর মাংস খাবার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির চাপে পড়ে তবু তাকে গরুর মাংস খাবার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। গরুর মাংস খাবার ভয়ে অতীশ দীপঙ্করের জ্যাঠামশায় গঙ্গার পাড়ে ঝোপজঙ্গলের কাছা বাড়ি করেছে। পারিবারিক সংস্কার ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্রভাব ফেলে এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে এই প্রসঙ্গে লেখক বলেছেন ‘সোনার এত খিদে যে বিফ মটন সব এক হয়ে যাচ্ছে। তবু এক আজন্ম সংস্কার, তীব্র ঘৃণাবোধ সারা শরীরে দগদগে ঘা হয়ে ফুটে উঠল। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে। সে এবার মরে যাবে যেন। চারপাশে ঋষিপুরুষরা দাঁড়িয়ে আছেন।… ওর চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা হল, বলতে ইচ্ছা হল, না না আমি সব পারব। এটা পারব না। আমাকে আমার জন্ম থেকে আমার বাবা মা, আমার পূর্বপুরুষ, মাটি ফুল ফল এক আশ্চর্য পরিমণ্ডলে মানুষ করেছেন, আমি সব পারি স্যার, কিন্তু সেই পরিমণ্ডল ভেঙে দিতে পারি না। ভেঙে দিলে আমার আর কিছু থাকে না। … জাহাজ মে নোকরি করনেসে বিফ তুমকো খানেই হোগা। বোল, সাকোগে কী নেহি?
আশ্চর্যভাবে সোনার সামনে মায়ের মুখ ভেসে উঠল। শীতের রাতে মা কুপি জ্বালিয়ে বাবার প্রত্যাশায় বসে আছেন। উঠোনে সেই আবহমান কালের সাদা জ্যোৎস্না। উনুনে জল সেদ্ধ হচ্ছে। বাবা এলেই দু’মুঠো অন্ন সবার পাতে। কী উদগ্রীব চোখমুখ ছোট ছোট ভাইবোনদের। সে তার স্থৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। মা তার অন্নহীন। ভাইবোনের শুকনো চোখমুখ ভেসে উঠল, সে বলল, আমি পারব স্যার।’ দেশভাগের ফলে সোনা বা অতীশরা উদ্বাস্তু। তাদের অস্তিত্ব সংকটে বিপন্ন মানবতাবোধ, আত্মমর্যাদাটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা সমাজে অন্তেবাসী হয়ে জীবনযাপন করছে। কিন্তু দারিদ্র্যতা এতই ভয়ঙ্কার রূপ নিয়েছে যে সেখানে পারিবারিক সংস্কার, সামাজিক ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন। তাই জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে অতীশ দীপঙ্কর শেষ পর্যন্ত জাহাজের কাজে গিয়ে গরুর মাংস খেতেও রাজি হয়ে যায় পরিস্থিতির শিকার হয়ে। এখানেই চরিত্রের উত্তরণ এবং মূল কেন্দ্রিয় চরিত্র হিসাবে যথাযথ হয়েছে।
দেশভাগের ফলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বৈষম্য দেখা দিলেও এখানে আলোচ্য উপন্যাস ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ তে ঈশম শেখ যেন এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুরকে অনুরণিত করেছেন। তিনি অতীশ দীপঙ্করদের বাড়ির কাজের লোক। কিন্তু সোনারা দেশত্যাগের জন্য এই ভালোবাসার মানুষটিকে, আত্মার আত্মীয়কেও ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ঈশম শেখ পূর্বপাকিস্তানে বা বাংলাদেশে থেকে যায়। সেখানেই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়। উপন্যাসের একেবারে শেষে দেখতে পাই ঈশম যখন মারা যায় তখন সামু ঈশম শেখকে কবর দিল। ‘ঈশমের কবরে সামু এবার নতুন একটা ইস্তাহার রেখে দিল। ইস্তাহারটার নাম বাংলাদেশ। একদিন সোনা দেশত্যাগের সময় অর্জুনগাছে লিখেছিল, ‘জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলে গেছি। যেন জ্যাঠামশাই ছাড়া তার বাংলাদেশে কেউ নেই। … মহাবৃক্ষে সেই ক্ষত আবার মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। অর্জুন গাছটা আরও বড় হচ্ছে। ডালপালা মেলে সজীব হচ্ছে।
সময় চলে যায় নিয়ম মেনে, কালের প্রবাহে রেখে যায় স্মৃতি। সত্তা ব্যক্ত করে বীক্ষ্যমাণ অন্তর্বিশ্বের চালচিত্রকে। আলোচ্য বিষয়ে তাই অবশেষে ব্যক্তিসত্তার উত্তরণের মধ্য দিয়ে জীবনের জয়গান শুনতে পাই। এখানে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনযুদ্ধে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে সাহিত্য কর্মে প্রকাশ করেছেন। বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতাই বর্তমান দেশভাগ কেন্দ্রিক উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। এইদিক দিয়ে ছিন্নমূল মানুষের জীবন-যন্ত্রণার কথা, দেশভাগ হবার ফলে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের কথা প্রাঞ্জলভাবে এই উপন্যাসে ব্যক্ত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১। Maulana Abul Kalam Azad, INDIA WINS FREEDOM, Orient Longmans, Calcutta, 1st pub. January, 1959.pp.206
২। Ibid.pp.207
৩। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, মে ২০১২, পৃ. ১৪।
৪। তদেব. পৃ. ১৫
৫। তদেব. পৃ. ১৩৯
৬। তদেব. পৃ. ৩৯১
৭। তদেব, পৃ. ৩৯১
৮। তদেব, পৃ. ৩৯১
৯। তদেব, পৃ. ৩৯৮
১০। তদেব, পৃ. ৩৯৮