ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৮)

বাড়ি ছেড়ে পথে নামলেই যে এভাবে পদে পদে নতুন নতুন বাধার সম্মুখীন হতে হবে, আগে কোনোদিন সেভাবে ভাবতে পারেন নি। তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির মধ্যে নতুন করে তাঁকে সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হচ্ছে। জীবনে যে এত বেশি বেহিসেবের খেলা থাকতে পারে, সেটাও তাঁর জীবনে এক অভিনব অভিজ্ঞতা। কলার খোসা ছাড়িয়ে ফেললে মানুষের কাছে তার এক পয়সাও মূল্য থাকে না। ডুরানি সাময়িক অবস্থানের মধ্যে নিজেকে মূল্যহীন খোসা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছেন না। বার বার মনে হতে থাকল, জীবনে মিথ্যার লড়াইটা চারদিকে এত বড়ো হয়ে উঠেছে যে সেসবের মুখোমুখি হয়ে জিতে যাওয়ার যেন কোনো রাস্তা নেই। যেন সকলে তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার লোভে অন্যায় আপসের সঙ্গে মিশে যেতে চাচ্ছে। ডুরানির কেবল মনে হচ্ছে, এভাবে চললে তো স্বাধীনতা হারিয়ে মানুষ আর কোনোদিন সমুদ্র হতে পারবে না, সারা জীবন স্রোতস্বিনী হয়ে থেকে যাবে। এভাবে জীবন চলে নাকি? একটা প্রশ্ন থমকে থমকে পর্বত প্রমাণ হয়ে উঠতে চাচ্ছে তার মধ্যে। জীবনের যে পথ সাগর হয়ে উঠলে মানুষ সদর্পে এগিয়ে চলতে পারে, নতুন করে নিজের সমাজকে গড়ে তুলতে পারে, সাময়িক সুবিধার লোভে সেই পথকে মানুষ কেন সংকুচিত করে তুলতে চাচ্ছে, তা মাথায় আসছে না ডুরানির। চারদিকে এক অচেনা ইস্পাত কঠিন পরিস্থিতি সুবিধাবাদী মানুষকে গিলে খাবার জন্যে যেন হাঙর হয়ে উঠেছে, অথচ কেন যে প্রকৃত বোধোদয় তাদেরকে ধাক্কা মারছে না, সেই প্রশ্ন জাগছে ডুরানির মধ্যে। তাঁর কেবল মনে হচ্ছে, সমবেতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দিন ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত থাকলে সমগ্র সমাজ নিয়ে ভাববে কারা? এ চিন্তা বড়ো হয়ে না উঠলে তো অনাগত দিনে সমাজ বাঁচবে না। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য ইতিহাস ডুরানির দুচোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ ভারতের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে পেরেছিল, বাকিরা ছিল আড়ালে, মারো হাঁস ভাগে আছি মনোভাব নিয়ে। এখন তো তাঁরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, তাহলে কেন সেই পাঁচ শতাংশ অনেকগুণ বেড়ে যাবে না? এভাবে তো মাথা উঁচু করে বাঁচা সম্ভব নয়।
হেমনগরের পথে ঘুরতে ঘুরতে ডুরানির তিক্ত অভিজ্ঞাতা সেভাবেই প্রকাশ পাচ্ছিল। সবই যেন না-সূচক চিত্রবিচিত্র অভিজ্ঞতা অথচ সেসব মুখ বুঁজে সহে নিতে হচ্ছে। যেন পিছন ফিরে তাকানোর কোনো রাস্তা নেই। পুত্রবধু হেনা চলতে চলতে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝল যে তার শ্বশুর মরে গেলেও কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করবেন না। পাপানের মনের অবস্থাও ভালো নয়। ক’দিন আগে পর্যন্ত যে ছেলেটা এত প্রাণচঞ্চল হয়ে কথা বলত, সেই পাপান নিজের মধ্যেকার শক্তি হারিয়ে কেমন যেন মুসড়ে পড়েছে। পথ চলার ধাক্কায় তার ভিতরের গতি এত শ্লথ হয়ে গেছে যে যেখানে সেখানে বসে পড়ে মনের ইজেলে শুধুমাত্র বাপির বড়ো অট্টালিকাটুকু দেখতে পাচ্ছে। হারানোর বেদনা একজন কিশোরকে কত বেশি অতীতমুখি করে তুলতে পারে, পাপান যেন নিজেই সেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।
ডুরানি আর হাঁটতে পারছেন না। পাঁচটা গ্রাম ইতিমধ্যে খোঁজা হয়ে গেছে, কোথাও ঘরভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। হতাশার গ্লানিতে মনে মনে ভীষণ ক্লান্ত। পথ চলার পরিশ্রমে এতই পরিশ্রান্ত যে আর পা চালিয়ে সামনে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হেনাকে বললেন, আর তো পারছি নে মা, জীবন এত দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে? থাকার মতো একটা ছোটো আস্তানা যে কোনো মূল্যে খুঁজে বের করো হেনা, এভাবে তো দিন চলতে পারে না।
হেনার সান্ত্বনা, এত ভেঙে পড়বেন না বাবা, মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ পালা করেই আসে। জানি না, এসব পূর্বনির্ধারিত কপালের ফল কিনা। চোখের সামনে শুধু এটুকু দেখেছি, রাত ইচ্ছে করলেই দিনের সময় ছিনিয়ে নিতে পারে না। বরং সাধারণ নিয়ম মেনে রাতের শেষে দিন আসে। তাই কেবল মনে হয়, চলতি দুঃখের দিন সামনে পড়ে থাকা সুখের দিনকে খুব বেশি দিন ঢেকে রাখতে পারবে না। তখন আমরা নিশ্চয় নতুন অবস্থান দেখতে পাব।
বেশ বললে বৌমা। জীবনের আঘাত থেকে তুমিও গভীর অভিজ্ঞতা লাভ করতে পেরেছ বলেই এভাবে বলতে পারলে। তবে জানো কী হেনা, জীবনের সুখ দুঃখগুলো ঠিক প্রকৃতির আলো আঁধারের মতো নয়। বাস্তব রূপ দিতে না পারলে সুখের ভাবনা জীবনে অলিক হয়ে থেকে যায়। এখন চোখের সামনে দেখছি, সমস্যাসঙ্কুল জীবনের বিড়ম্বনা রোজ বেড়ে চলেছে। জানি না কবে সমাধানসূত্র খুঁজে পাব। যে টাকা পয়সা নিয়ে বের হয়েছিলাম, তা কমতে কমতে প্রায় শেষ হতে চলল। পরের মাসের পেনশন পেতে এখনও দিন পনেরো বাকি। দাদুভাইয়ের পড়াশোনা যেভাবে নষ্ট হচ্ছে, জানি নে, তা কীভাবে পূরণ হবে। ফেলে আসা জীবনের ক্ষতি তো সহজে পূরণ করা যায় না। সেক্ষেত্রে সময়ের অভাব বড়ো ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে।
রাতে ভালো ঘুম না হওয়ার জন্যে পাপান মনে মনে ভীষণ বিরক্ত। ডুরানিকে উদ্দেশ্য করে বলল, এত বেলা হল, এখনও তো কিছু খেতে দিলে না দাদু, শুধু মায়ের সঙ্গে গল্প করে সময় নষ্ট করছ।
পাপানকে কোলে বসিয়ে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ডুরানি বললেন, তোমাকে অনেক বড়ো হতে হবে দাদুভাই।
আঁধার কিন্তু বাপির মতো পুলিশ অফিসার হব না।
এভাবে বলতে নেই পাপান।
জানো দাদু, তুমি মায়ের সঙ্গে যেসব নিয়ে আলোচনা করো, আমি সব বুঝতে পারি।
তাহলে কী তোমার মা তোমাকে খারাপ কিছু বলেছে?
আমাকে আবার ভুল বোঝাচ্ছ দাদু?
তোমার মনে এখন কী ভাবনা জাগছে, তাই বলো শুনি।
বড়ো নদীর বুকে খুব কষ্ট কিন্তু কিছুতেই ছোটো নদীর সঙ্গে মিশে যেতে পারছে না।
এসব কথা এখন থাক দাদুভাই। বললে তো খুব খিদে পেয়েছে, একটু পা চালিয়ে গেলে সামনে বড়ো বাজার পাব। সেখানে তোমাকে কিছু খেতে দিতে পারব।
খিদে পূরণের ইচ্ছায় দুলতে দুলতে পাপান জোরে পা চালিয়ে সামনে হেঁটে চলল। মাত্র মিনিট দশেক লাগল বাজারে পৌঁছাতে। পাপান হাত বাড়িয়ে বলল, ওই তো মিষ্টির দোকান দাদু।
ডুরানি হেনাকে বললেন, আর দেরি করো না বৌমা, তিনটে রসগোল্লা আর একটা পাঁউরুটি কিনে এনে দাও।
সঙ্গে এক গ্লাস জল আনতে হবে তো?
একটা জলের পাত্র কিনে আনো না।
তাহলে তাই আনছি।
খেতে খেতে পাপানের দুচোখ ডুরানির দিকে। এমনি করে অনেকবার দাদু তাকে খাবার কিনে দিয়েছে। সে যে ডুরানির কাছে খুব স্নেহ আদর পায়, তাও একবার মনে করতে পারল। দাদুর প্রতি তার বিশ্বাস পাহাড়ের মতো উঁচু। খাওয়া প্রায় শেষ করে পাপান বলল, বাপিকে ঠিক তোমার মতো ভাবতে পারি না কেন বলো তো?
ও প্রসঙ্গ থাক্ পাপান।
বাপির প্রসঙ্গ এলে তুমি শুধু এড়িয়ে যাও।
বড়ো পুলিশ অফিসারকে নিয়ে যেখানে সেখানে আলোচনা করা যায় না।
তাহলে তুমি আর মা বাপির জন্যে বাড়ি ছেড়ে চলে এলে কেন?
হেনার কড়া মন্তব্য, খাওয়া শেষ হয়েছে, এখন চুপ করে বোস্, শুধু পাকা পাকা কথা। ডুরানিকে উদ্দেশ্য করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে?
বলো মা শুনি।
এটা বাজার এলাকা, এখানে ঘর পাওয়া যেতে পারে।
তাহলে ঘুরে দেখতে পারো।
আপনাকে ততক্ষণ পাপানকে নিয়ে কোথাও অপেক্ষা করতে হবে।
তাতে অসুবিধা কোথায়? ডুরানির বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। —তাহলে যাও বৌমা, ভালো করে খুঁজে দ্যাখো।
ততক্ষণে বছর তেইশের গুণধর বারমুন্ডা পরে ডুরানির পাশে এসে দাঁড়ালো। তার কৌতূহলী প্রশ্ন, কী খুঁজে দেখার কথা বলছ দাদু?
এখানে কী ঘরভাড়া পাওয়া যেতে পারে?
গুণধরের ভিতরের ইচ্ছে বেড়ে আকাশের মতো উঁচু হয়ে উঠল। পলক না ফেলে চেয়ে থাকল হেনার দিকে। একবার মাথা নেড়ে বলল, আমাদের বাড়িতে থাকবে দাদু?
বড়ো আশার কথা শোনালে বাবা। কদিন ধরে ঘুরতে ঘুরতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তা বলবে, তুমি কে, তোমার বাড়ি কোথায়?
আমি পুঁটিরামের ছেলে গুণধর। আমাদের অনেক ঘর আছে দাদু। বড়ো বাড়ি করার শখ বাবার ঘাড়ে আজও ভূতের মতো চেপে রয়েছে। একটা ঘরে থাকার কথা বললে রাজি না হয়ে পারবে না।
হেনার প্রশ্ন, এখান থেকে কতদূরে তোমাদের বাড়ি?
ওই তো, ওই মোড়টার ওপারে। আমার সঙ্গে গেলে দেখিয়ে দিতে পারি।
ডুরানির উচ্ছ্বসিত কথা, তাহলে যাও না বৌমা। তুমি তো ঠিক কথা বলেছ। বাজার এলাকায় ঘর ভাড়া দেওয়ার প্রচলন থাকতেই পারে।
গুণধর তখনও হেনার উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারে নি। তার ভিতরের ইচ্ছে জোয়ারের তীব্র স্রোতের মতো হয়ে উঠছে। ছেলেটা ঠিকমতো বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। টেনে টেনে কথা বলার অভ্যেস ছোটোবেলা থেকেই। দু’ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল, জানো দাদু, আমার বাবার এট্টু অন্য দোষ আছে। মা মরে যাবার পর থেকে তা আরও বেড়ে গেছে। প্রতি রাতে একটা করে নতুন মেয়ে মানুষ লাগে। অবশ্য পাওয়া না গেলে পুরনো দিয়ে চালিয়ে নেয়।
ডুরানি আঁৎকে উঠে বললেন, এসব কী বলছ বাবা?
মাইরি বলছি, বাবার ওই রোগ অনেক দিনের। হেনার দিকে চেয়ে বলল, তুমি আমাদের বাড়িতে থাকলে বাবার ওই রোগ সম্পূর্ণ সেরে যাবে। নতুন কোনো মেয়ে-মানুষের কথা ভাবতেই পারবে না।
ডুরানি রাগে কাঁপছেন। গুণধরের গলা টিপে ধরে বললেন, এত বড়ো স্পর্ধা তোর? যা মুখে আসছে, তাই বলে দিচ্ছিস? জানিস, মেয়েটা কার বউ?
হেনা দ্রুত ডুরানিকে সরিয়ে নিয়ে বলল, এভাবে মাথা গরম করবেন না। পুরনো প্রবাদবাক্যটা ভুলে গেলেন? বিপদ কখনো একা আসে না। বেচারা গুণধর সেই সূত্রের একজন।
তাই বলে?
এভাবে আচরণ করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে এভাবে বলবে?
প্লিজ চুপ করুন।
চুপ করে থাকা সম্ভব? এ হয় না হেনা।
গুণধর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোষ দেখাতে শুরু করল। —আমি তোমার কী করেছি? বাবা যেভাবে চলে সেকথাই বলেছি। তুমি আমার গলা টিপে ধরলে কেন? কত মেয়েকে সুকৌশলে আমার বাবা কিডন্যাপ করেছে জানো, বৌদির রূপের কথা শুনলে বাবা কী করতে পারে, তা ভাবতে পারবে না। কারুর ইচ্ছে না থাকলেও বাবা কিডন্যাপ করে নিজের লালসা পূরণ করে নেয়।
হেনা বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেও পারছে না। —আমার শ্বশুরের বয়স হয়েছে ভাই। তোমার কথা শুনে একটু মাথা গরম করে ফেলেছেন। সেজন্যে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। এটুকু মেনে নাও খোকা।
গুণধর আবার গলা চড়াতে শুরু করল। —কেন এভাবে আমার গলা টিপে ধরবে? আমি কী দোষ করেছি? বাবা রোজ যা করে, সেটাই বলেছি তো মাত্র। তোমার মতো সুন্দরীকে দেখলে বাবা লোক লাগিয়েও তুলে নিয়ে যেতে পারে।
হেনা গলার স্বর নামিয়ে বলল, আরে ভাই, এভাবে মাথা গরম করছ কেন? বললাম তো, ভুল হয়ে গেছে। তারপর এসব কী বলছ?
গুণধর বলতে বলতে হন্ হন্ পায়ে এগিয়ে চলল, বাবাকে খুলে বললে কী হয় দ্যাখো না।
ডুরানি ভিতরের প্রক্ষোভ চাপতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, কোথায় এলুম রে মা? কোনো দিকে এতটুকু আলো নেই, শুধু অন্ধকারের ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছি।
এভাবে দুঃখ করবেন না, মন্দ সময়ে কেউ বন্ধু হতে চায় না। কারণ তার মধ্যে অন্যের দুর্দশা মেনে নেওয়ার ইচ্ছে থাকে না। যারা পারে, তারা মহান। এখন দরকার নিজেদেরকে আরও শক্ত করে তোলা।#

চলবে…

এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৭)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!