তখন প্রায় রাত দশটা। বাগনান থেকে শেষ বাসটা ধুকতে ধুকতে নিমতলা স্টপেজে নামিয়ে দিল সুতনুকে। অনেক দিনের পরে কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরছে সে। বলাই বাহুল্য, সঙ্গী কেউ নেই। হি হি কাঁপন লাগানো জমাটি শীতের রাত। রূপোলী চাঁদের আলোয় হালকা কুয়াশা চাদর। মায়াবী প্রতিবেশ। প্রাণের আনন্দে গান গাইতে গাইতে চলতে লাগলো সে মেঠো রাস্তায়। কিছুটা এগিয়ে মোড় ঘুরতেই সে লক্ষ করল চাদর গায়ে দেওয়া একটি মেয়ে চলেছে তার আগে আগে। এত রাতে, গ্রামের রাস্তায়, তাও আবার মেয়ে! খুব অবাক হল সুতনু। আপনা থেকেই গান থেমে যায় তার। মেয়েটিও থামে। সন্দিগ্ধ মনে এগিয়ে যায় সুতনু। মেয়েটির কাছে গেলে হঠাত্ কথা বলে ওঠে সে, “কী হল, গান থামিয়ে দিলে কেন? এখনো কত ভালো গাও তুমি!” অবাক হয়ে সুতনু বলে, “তার মানে, তুমি আমাকে অনেক আগে থেকেই চেনো? কে বলতো তুমি? এত রাতে কোথা থেকেই বা ফিরছো?” মেয়েটি উত্তর দেয়, “আমি তোমার পাড়ারই মেয়ে, আবার এককালের সহপাঠিনীও–কমলিনী।” নামটা চেনা চেনা লাগলেও পুরোপুরি চিনতে পারেনা সে। তবু একটা আন্দাজ করে সে– “আচ্ছা, তুমি মানে তুই কি কমলি?” চাদরের ঘোমটার নীচে একটা অপার্থিব হাসি খেলেযায় মেয়েটার মুখে। তারপর পুরো রাস্তাটা পুরোনো দুই সহপাঠী কথায় -গানে মশগুল হয়ে ওঠে। কমলি বলে, “জানোতো, এলাকায় আমার খুব দুর্নাম। আমি ভালো মেয়ে নই । আমার সঙ্গে কেউ মেশেনা। দেখো, আজ এত রাতে তুমি আমার সঙ্গে ফিরছো –লোকে আমার তো বটেই, তোমারও বদনাম করবে।” সুতনু বলে, “আমি এসব পরোয়া করিনা। তুমি থুড়ি তুই আমার সহপাঠিনী, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাছাড়া, আমরা সবাই কি খুব ভালো, ধোয়া তুলসিপাতা?”
অনেকটা চলার পর ওরা একটা মোড় মতো যায়গায় উপস্থিত হয়। ডানদিকের সরু রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই কমলির বাড়ি। বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে সে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।তার চোখে যেন খুশির সঙ্গে বেদনার অশ্রু। সুতনু এগিয়ে যায় সোজা- শীতলাতলা, কলতলা পেরিয়ে তার বাড়ির দিকে।
বাড়িতে ঢুকেই মায়ের একচোট বকুনি খেতে হল সুতনুকে। সত্যি, গ্রামের দিকে শীতকালের রাত হিসেবে অনেক দেরী করে ফেলেছে সে। কিন্তু মাকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে সে বলে যে সে এক ছিলনা, ওপাড়ার কমলিও সেই নিমতলা থেকে তার সঙ্গেই এসেছে। ছেলের কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় সুতনুর মা, “কী বলছিস! গত সপ্তাহেই তো ওই নিমতলার রাস্তায় কারা যেন কমলির উপর শারিরীক নির্যাতন করে মেরে ফেলে গিয়েছিলো!” নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনা সুতনু। হাড় হিম করা একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় তার শিরদাঁড়া বেয়ে। তবে একটু আগে পর্যন্ত তার সঙ্গে সারাটা রাস্তায় কে ছিল, কে?#