পড়ন্ত বিকেলে গাছতলায় বসে বিষ্ণুর কত কথা মনে পড়ে। সুখ, দৈহিক তৃপ্তি আর সব পাওয়ার অলিগলি বেয়ে শূণ্য মনে স্মৃতি, পেয়ে হারানোর বিরহের মিষ্টি ব্যথা বিষ্ণুকে বারবার নাড়া দেয়। অতীতে ভ্রমণ করিয়ে আনে। বিশেষ করে শেষ দেখার সেই মুহূর্তগুলো- এখনও মনের পর্দায় ছবির মতো ভেসে ওঠে। না পাওয়া প্রেমের ব্যথার সুখ স্মৃতি মেদুর করে তোলে। এতো পাওয়াকে ছাপিয়ে সেই একটা না পাওয়া উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সালমার সাথে যখন বিষ্ণুর শেষ দেখা তখন সে কি কান্না।
‘বিষ্ণু তুমি কিছু একটা কারো। চলো কোথাও আমরা পালিয়ে যাই, যেখানে কেউ আমাদেরকে চিনবেনা। শুধু তুমি আর আমি একটা নিজস্ব জগতে নিজেদের প্রেম ভালোবাসা নিয়ে সুখে বাঁচবো।’
‘না সালমা তা হয়না। আমি কিছুতেই এখন এ কাজ করতে পারব না। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আর পারলে আমাকে ভুলে যাও।’
কথাগুলোও বিষ্ণু বুকে পাথর বেঁধে নাটকের ডায়ালগের মত আউড়ে গেছিল।
বিষ্ণুর পা দুটো জড়িয়ে ধরেছিল সালমা। চোখের জলে বিষ্ণুর পা ভিজে গেছিল। বিষ্ণু দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।মুখে একটা কথাও ফুটছিল না আর। রাতের অন্ধকারে ওর দু’গাল বেয়ে নামছিল চোখের জল। বুকের ভিতরে একটা তুমুল ঝড় ওকে ভেঙে চুরে শেষ করে দিচ্ছে। তবু ও নিজেকে কঠিন করে বেঁধে রেখেছিল এক চরম দৃঢ়তায়। নিজের সঙ্গে লড়াইয়ে ও যেন ভেঙে চুরে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
অমাবস্যার রাতের নিঝুম রাত l কিছু দূরে ঝোপ থেকে আর্তনাদের মতো ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর ডাক। দূরে শেয়ালের দল একসুরে হুক্কা হুয়া ডেকে ওঠে। কিছু দূরে কেউ একজন আলো জ্বেলে হেঁটে যাচ্ছে। তাতে ওদের কারোরই খেয়াল নেই। বিষ্ণুর মুখের কথার মধ্যে একটা মিথ্যা কাঠিন্যের ভান ফুটিয়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সালমাকে সত্যি ভালোবাসে ও। মনের গভীর থেকে ওকে নিজের বলে এঁকে নিয়েছিল একদিন। স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে একজন নারীকে যেমন একজন পুরুষ ভালোবাসে তেমন। একটু ও খামতি ছিলনা কোথাও। বাহ্যিক সাজ পোষাক, আচার ব্যবহারের ভিন্ন ভিন্ন। তাতে সেঁটে বিভিন্ন ধর্মের বেড়াজালে বেঁধে ফেলেছে। মনের মধ্যে সংস্কার বেড়া হয়ে স্বাভাবিক ভালোলাগাকে কলুষিত করে। অন্তরাত্মার আকুতি, স্বাভাবিক প্রবৃত্তির দৌড় কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে চলতে চায় সরল রেখায়। ভালোলাগার সেই স্বাভাবিক নিয়মে কাছে এসেছিল দুজনে। নতুন ফোটা যৌবনের দুর্দাম প্রেমের স্রোতে ভেসে গেছিল দুজনে। যুক্তি আর পরিনামদর্শিতা এসে পথের মধ্যে বাধা দেওয়ার অবকাশ পায়নি কখনও।
সুন্দরবনের কোলে লালিত একটা ছোট্ট গ্রাম আম জাম কাঁঠাল, বটের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েক ঘর পোদ আর কিছু মুসলিম পরিবারের বাস। হোব্গা খালের জল বয়ে চলে শান্ত ধারায়। পাশে এই পাড়া গ্রামের জীবন যাত্রা বয়ে চলে প্রায় সরল রৈখিক ধারায় একটা গড়পড়তা ধারা বজায় রেখে। দুটো আলাদা সম্প্রদায়ের মানুষ। মোকরিবের আজানের আওয়াজ আর সন্ধ্যা আরতির শাঁক ঘন্টা পাশা পাশি প্রতিদিন আসে যায়। একে অপরের সঙ্গে কখনও ঠোকর লাগেনি। সালমা আর বিষ্ণুর বাড়ির মাঝের দূরত্ব সাকুল্যে দুশো ফুট। বিষ্ণুর বয়স যখন ন’বছর সালমা তখন হামাগুড়ি আর দুস্টুমির ভাঙচুরের বয়স। তখন কে জানতো দুজনের মধ্যে মন দেওয়া নেওয়ার এমন একটা দিন আসবে? খেলনা ভাঙার মত একটা গোটা সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে হবে!
ছোটবেলা থেকে পড়াশুনায় বেশ ভালো বিষ্ণু। গ্রামের সকলের ওর প্রতি একটা ভালোবাসা ছিল। ছোট গ্রামটার বাচ্ছাদের মধ্যে আইডল সে। ছোট সালমা যখন বাল্যের বৃতি থেকে কৈশরে পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে তখন তার নতুন মেলা পাপড়িতে বিষ্ণুর শান্ত মিষ্টি মুখ, কালো পাথরের মতো বলিষ্ট শরীর আর ভালো ছাত্রের ইমেজ একটু একটু করে রঙ ধরাতে শুরু করেছে। অন্যদিকে তেইশের তপ্ত বসন্ত তখন বিষ্ণুর মনে নতুন রঙের সন্ধানে কি হয় কি হয় শ্বাস। সালমা তার প্রথম ভালোলাগার ভাষা ইঙ্গিতে বোঝাতে চেষ্টা করে। হালকা ঠাট্টা, একটু খুনসুটি নানা অছিলায় একটু ছোঁয়া, অকারণে সাহায্যের হাত বাড়ানো… বসন্তে দোদুল্যমান হৃদয় বিষ্ণুর কাছে সালমার কার্য কলাপ ইশারায় ডাক। ধরা দেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত। সত্যি ধরা পড়েও গেছিল একদিন। সেই শুরু। মাঝ থেকে বয়ে গেছে পাঁচ পাঁচটা বছর। এখন সালমা আঠারোর পূর্ণ যুবতী। তার চলনে মুখে চোখে যৌবন রূপের পসরা সাজিয়ে দিয়েছে। আর সালমার সে উত্তপ্ত যৌবনের নেশা জুড়ে শুধু বিষ্ণু।
এই পাঁচ বছর পথ চলার দুপাশ জুড়ে কত কথা, কত স্মৃতি, ভালোলাগা কাহিনী জুড়ে গেঁথে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সালমা এখন ধ্যান জ্ঞান সব বেঁধে নিয়েছে বিষ্ণুর সুরে। তার সে প্রেমের মাঝে কোনোদিন ভাবেনি ধৰ্ম সমাজ লোকলজ্জা বাধা হয়ে দাঁড়াবে একদিন। এমন চিন্তা আসার অবকাশই পায়নি কোনোদিন। প্রেমের ধ্যানে সব চিন্তার পথ আটকে বসেছিল। এই পাঁচ বছরে দেহের কাছে এসেছে। তার থেকে বেশি কাছে এসেছে মনের। তবুও ওরা মানুষ। কল্পকাহিনীর কোনো অলৌকিক কোনো কুশীলব নয়। গালগল্পে ভরা অলীক কাহিনী নয়। রক্ত মাংসের মানুষের মতোই ভালো লাগা ছিল। ভালোবাসা ছিল। শরীরের প্রতি শরীরের পিপাসা ছিল। বেসামাল হওয়ার ইচ্ছা ও ভেতরে ঝড় তুলতো। ওদের গোপন সাক্ষাতে দৈনিক বিবেক আর প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে প্রবৃত্তিকে দুহাতে আগলে রাখতো দীর্ঘ সাক্ষাৎ, ছোঁয়ার মধ্যে ও। ক্রম বর্ধমান ভরসা সালমার মনে জমছিল। সমানুপাতিকভাবে বিষ্ণুর কাছে সালমার পাপড়ি খোলার মত করে সংযমের বাঁধ একটু একটু খুলে পড়ছিল।
সরস্বতী পুজোর রাত। ফাগুনের বাতাসে কি পাগলকরা নেশা। মাঠের একটা খোলা জায়গায় দেখা হয়েছিল। সালমার কাঁধে বিষ্ণুর হাত। সালমার লতার মতো দুটো হাত জড়িয়ে আছে বিষ্ণুর কোমর। একটা নেশা সালমাকে পেয়ে বসেছে যেন। ওর নারীসুলভ সংযম হারিয়ে ফেলেছে তখন। পাগলের মতো জড়িয়ে ধরেছে বিষ্ণুকে।
‘বিষ্ণু তুমি কিছু একটা করো। আমি আর থাকতে পারছিনা।’ তখন ওর চোখে রঙিন ঘোর।
বিষ্ণুর সামনে যেন স্বর্গের সব সুখের সদর দরজা খুলে সাদর আহ্বান। নিজেকে বেঁধে রাখা কঠিন হয়ে উঠছে সংযমের কাছে। কিন্তু যে অসীম মূল্যবোধ ওকে এতদিন পর্যন্ত বেঁধে রেখেছে তারই জয় হয় শেষমেশ।
গভীর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে lফিস ফিসিয়ে বলেছিল,
‘আমিও আর থাকতে পারছিনা।’
‘তাহলে…?’
সালমার কথার ইঙ্গিতে ভেসে যাওয়ার ডাক। বিষ্ণুর ভিতরটা বেসামাল আনন্দে বাঁধ ভাঙতে চাইছে। তবু কিভাবে যেন সামলে নিয়েছিল নিজেকে।
”আজ নয়। অন্য একদিন যখন তুমি আমার হবে। প্লিজ লক্ষ্মীটি একটু ধৈর্য্য ধরো।’
সালমা ক্ষণিকের দুর্বলতা সামলে নিয়েছিল l ঝড় সামলে মন জুড়ে নেমে আসছিল পরিণাম ও বিচারবোধ। বুঝতে পারছিল বিষ্ণুর কথার গুরুত্ব। আর তাতে বিষ্ণুর প্রতি বাড়ছিল ওর সম্ভ্রমবোধ। এরকম পরিস্থিতিতে বিষ্ণু তার দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নেইনি। ব্যপারটা যেন বিষ্ণুর ভালোবাসা আর মহত্বের ছোঁয়ায় আরো বাঁধনে জড়িয়ে ফেলছিল সালমাকে। প্রবল আবেগে জড়িয়ে বলেছিল,
‘সত্যি বিষ্ণু তোমার মতো মানুষ হয়নাl তোমাকে পেলে আমার জীবনের সব পাওয়া হবে গো।’
সেদিন অমাবস্যার রাত। মাঠের মাঝে অন্ধকারের মধ্যে ডুবে দু’জনে। আকাশে একটাও তারার চিহ্ন নেই। মেঘের গভীরে কোথায় হারিয়ে গেছে সব। সালমা এসে গুম হয়ে বসেছিল ঢিপিটার উপর। বিষ্ণু আসে প্রতিদিনের মতো। কেমন কেমন লাগে ওর। অদ্ভুতভাবে আছে সালমা। এতক্ষনে এসে সাপ্টে জড়িয়ে ধরে ওকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ও একটু হালকা চালে বলে,
‘কি হল আজ আমার সালমা রানীর? মুড্ খারাপ নাকি?’
সালমা ওকে জোরে জড়িয়ে ধরে। কান্না ভেজা কণ্ঠে বলে ওঠে,
‘তুমি কি করবে করোl আমি আর এভাবে পারছিনা।’
‘কেন হঠাৎ কি হল?’ ওর এমন কথা শুনে অবাক হয়ে বিষ্ণু বলে।
‘হঠাৎ নয় বিষ্ণ, বেশ অনেক দিন ধরে কথাবার্তা চলছে পড়াশুনার দোহাই দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু…’
‘কিন্তু কি?’
‘এখন আর এভাবে থাকা যাবেনা। বাড়ির লোক আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ছেলেটার বাড়ি সন্তোষপুর। ধনী ব্যবসায়ী। তুমি একটা কিছু করো।’
‘এই মুহূর্তে আমি কি করবো বলো? কি বা করার আছে আমার?’ অসহায়ের মত বিষ্ণু বলে।
‘চলো, আমরা পালিয়ে যাই। দূরে কোথাও যেখানে কেউ আমাদেরকে জানবেনা। ধর্মের বেড়াজাল তুলে আলাদা করবেনা কেউ।
বিষ্ণু কিছুতেই যেন কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলনা। শুধু একটা বুক ভাঙা দ্বন্দ্বে ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছিল। ভেবেছিল আর দু একটা বছর এর মধ্যে তার কাজগুলো, দায়িত্বগুলো সেরে নিয়ে দুজনে কোথাও দূরে হারিয়ে যাবে। হঠাৎ করে এভাবে সালমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। নিরুপায় বিষ্ণু সালমাকে বলে,
‘কোনোভাবে বিয়েটা পিছিয়ে দেওয়া যায়না? অন্তত একটা বছর সময় না পেলে…’
‘না, তা এখন আর সম্ভব নয়। বাবা আর দাদারা পুরো ঠিক করে ফেলেছে সব কিছু। মনে হয় কোনোভাবে আমাদের সম্পর্কের কথা ওরা জেনে গেছে।’
এতদিন যে স্বপ্নটা দেখেছে বিষ্ণু, যে স্বপ্নটা সালমাকে দেখিয়েছে সেই স্বপ্ন পূরণের দোর গোড়ায় এসে যে এতটা মানসিক সংকটে পড়তে হবে তাকে কিছুতেই কিছু যেন ভেবেই পায়না।
‘কিন্তু এখন কিভাবে…?’ অনেক ভেবে বিষ্ণু বলে।
‘আমি কিছু জানি না। শুধু তুমি কিছু একটা কর।’ সালমা অধীর প্রত্যাশা নিয়ে বিষ্ণুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘বিষ্ণুর মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। কৈশরে আবেগে যে স্বপ্ন দেখেছিল তার গলা টিপে চুপি চুপি সমাজের ভ্রান্ত ধারণার কাছে হেরে গিয়ে এভাবে পালাতে হবে সে আগে ভাবেনি কিন্তু এছাড়া উপায় ও নেই।
‘সালমা এখন তা সম্ভব নয়।’ আবেগ মাখা গলায় অসহায়ের মত বিষ্ণু বলে।
কান্না জড়ানো গলায় অভিযোগের সুরে বাঘিনীর মতো গর্জে ওঠে সালমা,
‘কেন সম্ভব নয়? যদি ভালোবেসে ভালোবাসার মর্যাদা দিতে না পারবে তবে কেন এমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলে? কেন ভালোবেসেছিলে?’
বিষ্ণুর মুখে কোনো কথা ফোটেনা। সালমার প্রশ্নের জবাব ওর কাছে নেই। কৈশোরে যখন পরিণামদর্শিতা আসেনি তখন কে জানতো এমন পরিস্থিতির সামনা সামনি হতে হবে?এ র জন্য সেই তো দায়ী। এই অপরাধবোধ ওকে কুরে কুরে খায় ।
‘চলো বিষ্ণু আমরা পালিয়ে যাই। আমাদের স্বপ্নকে এভাবে নষ্ট হতে দিও না। তুমি ভালোই উপার্জন করো, স্বাবলম্বী তাহলে অসুবিধেটা কি? নাকি তুমি ভয় পাচ্ছ? মৃত্যুর ভয়?’
সালমার কথার মধ্যে ব্যাঙ্গের সুর।
‘না সালমা মরণের ভয় আমি পাইনা। কিন্তু একটা ভয় আমি পাচ্ছি অবশ্য। মানবিকতা হারানোর ভয় ।
‘মানে…?’
তীব্র বিদ্রোহীর মত বলে ওঠে সালমা।
‘সালমা আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। সারাজীবন তোমাকে ভালোবেসে যাবো। তোমাকে ছাড়া আমার জীবনটা তছনছ হয়ে যাবে। তবুও তোমার সঙ্গে পালতে পারিনা। কিছুতেই না…’
‘কিন্তু কে –নো?’
‘সালমা আমরা পালিয়ে গেলে ধর্মান্ধ উন্মাদগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো আমাদেরকে খুঁজে বেড়াবে। সুখ শান্তিকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।নাগালে পেলে প্রাণে পর্যন্ত মেরে দেবে। তাতে আমি ভয় পাইনা। তোমার ভালোবাসার জন্য জীবন দিতে ভয় পাইনা কিন্তু…’
কিছুটা যেন আশ্বস্ত হয় সালমা। তারপর আস্তে আস্তে বলে,
‘কিছুদিন না হয় দু’জন গা ঢাকা দিয়ে থাকবো। তারপর একসময় যখন ঝড় থামবে। মনে ক্ষোভের আগুন নিভবে তখন নাহয়…’ গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সেই অন্ধকার ফুঁড়ে ওর দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে সালমা ।
‘আমিও তাই ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর সমস্ত রাগ নেমে আসবে পরিবারের উপর। ওদের জীবন ভবিষ্যৎ সব…
কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সালমা। কর্কশ ভাবে বলে ওঠে,
‘ওদের চিন্তা ওরা করে নেবে। ওরা ওদের পথ দেখবে।’ সালমার মাথায় এখন বিষ্ণুকে নিয়ে ঘর বাঁধার চিন্তা ওকে বেপরোয়া কিছুটা স্বার্থপর ভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।
‘না সালমা আমি কিছুতেই এই কাজ করতে পারবোনা। বাবা মরে যাওয়ার পর যে দাদা দিদি তাদের জীবন যৌবন সখ আহ্লাদ সব কিছু বিসর্জন দিয়ে আমাকে মানুষ করলো তাদেরকে এভাবে বিপদে ফেলে রেখে সুখের ঘর বাঁধতে পারবোনা। আমার মৃত্যু হয়ে গেলেও না। তোমাকে ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হবে। যন্ত্রণার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যাব। তবু এতগুলো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারবো না। সালমা তুমি আমাকে ক্ষমা কারো। তোমার বাবার দেখা ছেলের সঙ্গে বিয়ে করে সুখী থাকো।
সালমার কান্না জড়ানো গলায় বিদ্রুপের সুর,
‘সুখ! সুখ আর এজীবনে নয়।’
‘দেখো এখন তুমি আবেগের বশে যেটা ভাবছো দেখবে সেটা একটা ভ্ৰম ছিল। সেটা কেটে গেলে দেখবে স্বামী সংসার নিয়ে তুমি সুখে থাকবে।’ বিষ্ণু সান্ত্বনার সুরে বলে,
‘থাক আমাকে আর সান্ত্বনা দিতে হবেনা। তোমার কাছে খেলনা পুতুল ছিলাম। পুতুল খেলা শেষ হয়েছে এখন তুমি আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলতে চাও। আমার জন্য তোমাকে কষ্ট পেতে হবে না। তোমাকে আজ মুক্তি দিলাম। শুধু উপরওয়ালার কাছে শুধু একটাই অনুরোধ তোমার সাথে যেন আর কখনও আমার দেখা না হয়। ওর কথায় বিষ্ণুর প্রতি প্রজ্জ্বলিত ঘৃনা। চোখের জল মুছতে মুছতে অন্ধকারে মিশে যায় সালমা।’
বিষ্ণুর মাথায় তখন নানা চিন্তা আর যুক্তির আলোছায়া খেলা। মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জীবন থেকে বাঁচার সব মানে যেন মুছে মিশে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। বুকের মধ্যে কি অদ্ভুত একটা ব্যথা। যত মনকে সান্ত্বনা দেয় কিছুতেও যেন যুক্তি মানেনা। ভিতর থেকে একটা কান্না বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সব চিন্তা ছাপিয়ে মনে হচ্ছে বিরাট একটা ভুল হয়ে গেল। মনে হয় এক ছুটে গিয়ে সালমার কাছে চলে যাই। তাকে নিয়ে দূর দেশে পালিয়ে যায়। তাহলে বুকের জ্বালাটা জুড়ায়। চোখ বুঁজে ও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। আবেগের সঙ্গে একটু একটু বিচারবোধ নেমে আসে। ভাবে,
সালমা হয়তো কাঁচা বয়সের আবেগের বশবর্তী হয়ে এখন ধৰ্ম জাতপাত এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করেনি বা ভাববার মতো বিচক্ষণতা আসেনি।কিন্তু বিয়ের পর সব রহস্যের উম্মোচন যখন হয়ে যাবে। চোখে আর রোমান্টিকতার চশমা থাকবেনা। সব পাওয়ার মাঝে যখন কল্প জগতের স্বপ্নের পৃথিবী বাস্তবের মাটিতে এসে গড়াগড়ি খাবে। যখন ওর মাথায় বিচারবোধ ঢুকবে তখন হয়তো তাদের এই বিয়ের জন্য তার অনুশোচনা হবে। প্রেমের দিনগুলোকে দোষারোপ করবে। মনের গভীরে থাকবে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা আকুতি। কিন্তু সমাজ, লোকলজ্জা একুল-অকুল দুকূল হারাবার ভয়ে শুধু শুধু সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাবে। দয়াকরে তার সাথে একঘরে রাত কাটাবে। জৈবিক চাহিদায় ওর সন্তানের মা হবে। হাজার সাদামাটা সম্পর্কের মতো একদিন জোলো হয়ে যাবে।মরে যাবে প্রেম সব পাওয়ার চাপে। তার চেয়ে রাতের গভীরে বেড়ে ওঠা প্রেম রাতের গভীর চাপা থাক- চির অপূর্ণ চির কাঙ্খিত হয়ে। অনন্ত কাছে পাওয়ার তৃষ্ণার্ত চিনচিনে মিষ্টি ব্যথা হয়ে বেঁচে থাক মনের গভীরে। মাথার সমস্ত যুক্তি বোধ একত্রিত করে হৃদয়ের আগুনকে চাপা দিতে চেষ্টা করে ও। চারদিকে দিক দিকভ্রান্তের মত তাকায় আলোর খোঁজে । দূরে একদল শিয়ালের ডাক হুক্কাহুয়া করে ভেংচিয়ে যায়।#