প্রীতির সাথে অনুসুয়া এবং তার পরিবারের সম্পর্কটা যদি কেউ ওদের পারস্পরিক সম্বোধন শুনে বুঝতে চেষ্টা করেন, তাহলে সেটা তার পক্ষে বেশ কস্টসাধ্য হবে। যেমন প্রীতি অনুসুয়াকে বলে সোনা মেয়ে, আর অনুসুয়া প্রীতিকে বলে সোম্মা। অনুসুয়ার বাবাকে প্রীতি ডাকেন স্টেপ ফাদার বলে, অনুসুয়ার বাবা প্রীতিকে ডাকেন অনুসুয়ার ছোটমা বলে। অনুসুয়ার মাকে প্রীতি ডাকেন আন্টি বলে কিন্তু তিনি প্রীতিকে ডাকেন বুনু বলে। এই পারস্পরিক সম্বোধন গত দশ/বারো বছরে কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তিন/চার বছরে এই সম্বোধনের পাশাপাশি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এক মনোজাগতিক সংকট। করোনাকালে অনুসুয়ার বাসাতে প্রীতিই এসেছে দু’একবার। অনুসুয়ার মা ওকে বাসা থেকে বের হতে দেন নাই একদিনের জন্যও। এমনকি অনুসুয়ার সেলফোনটা নষ্ট হয়ে যাবার পরও সেটা সার্ভিসিং করানো কিংবা নতুন ফোন কেনার জন্যও না। মায়ের বক্তব্য হল, ফোন করার জন্য তো আছেই তোমার একজন। ও তোমার বাবা কিংবা আমার ফোনে ফোন করলেই হবে। আমরা তোমাকে ওর সাথে কানেক্ট করিয়ে দেব। তুমিও আমাদের ফোন থেকেই প্রীতিকে ফোন করতে পারবে। অফিসের কাজে মাসে কমপক্ষে দুই-বার মাকে ঢাকার বাইরে যেতে হয়। ঢাকায় থাকলেও আজ রেসিডেন্সিয়াল ট্রেনিং, কাল ওয়ার্কশপ, পরশু ডে-লং-মিটিং… এগুলির মাঝেই মায়ের দিন কাটে। তাই উইকেন্ড ছাড়া মায়ের সাথে অনুসুয়ার সময় কাটে কম। সেই তুলনায় বাবা রিলাক্সড থাকেন অনেক বেশি, কিন্তু বাবার সাথে অনুসুয়ার ঘনিষ্ঠতা তুলনামুলক কম। প্রীতি হল অনুসুয়ার ছোটবেলার বন্ধু, ও মজা করে অনুসুয়ার বাবাকে বলে, ‘তুমি আসলে অনুসুয়ার আসল বাবা না, তুমি একেবারের খুব কেয়ারিং না। আমরা দুইটা মেয়ে তোমার কিন্তু তুমি আমাদের যত্ন নিতে জানো না। তুমি আসলে আমাদের স্টেপ ফাদার।’ এই কথা শুনে অনুসুয়ার বাবা কেবল হাসেন। অনুসুয়ার মা বলেন, ‘ঠিকই বলেছ, যাদের মধ্যে সত্যিকারের পিতৃত্ব থাকে তাদের বউরা সেটা বুঝতে পারেন।’ এই কথা শুনে অবশ্য অনুসুয়ার বাবার অভিব্যক্তিতে বোঝা যায় না, যে তিনি এই বক্তব্য স্বীকার করেন নাকি করেন না। অনুসুয়ার কিন্তু বাবার প্রতি কোনো অনুযোগ নেই। বরং মায়ের প্রতি আছে, কারণ ও মায়ের কাছ থেকে আরো বেশি সময় প্রত্যাশা করে। করোনাকালে মায়ের হোম অফিস হওযাতে এবং ফিল্ড অফিস বন্ধ থাকাতে ওয়ার্কলোড কম ছিল। তাই এই সময়টাতে সে মায়ের সান্নিধ্য পেয়েছে বেশ একান্তভাবেই। এমনকি মায়ের সাথে থাকা অবস্থায় প্রীতি ফোন করলেও অনুসুয়া বলেছে, সোম্মা আমি তোমাকে কল ব্যাক করব, এখন মায়ের সাথে আছি। অনুসুয়া যে তার মাকে অনেক বেশি প্রত্যাশা করে, সেটা ওর মা জানেন। মায়ের অনুপস্থিতিতে অনুসুয়ার মন ভাল করার টনিক হল প্রীতি। তাই অনুসুয়ার মা প্রীতিকে বলেন, ‘তোমার মধ্যে এই বয়সেই একটা মা মা ভাব আছে। আমার মেয়ে তো ওর মায়ের পরে তোমার উপরেই সবচেয়ে বেশি ভরসা করে। তুমি ওর বন্ধুর চেয়ে মা বেশি। সত্যি বলতে তুমি আমার মেয়ের ছোটমা।’ অনুসুয়াও মজা করে প্রীতিকে ছোটমা ডাকতে ডাকতে সেটাকে সোম্মাতে দাঁড় করিয়েছে। প্রীতিও কিন্ত এই ডাক বেশ উপভোগ করে। একদিন অনুসুয়ার মা অনুসুয়া এবং তার বাবার অনুপস্থিতিতেই একটু আবেগের বশে বলে ফেলেন, ‘আমি জানি আমার মেয়ে আমাকে অনেক মিস করে। আমি বড় হয়েছি আমার খালার কাছে। আমি খুব ছোটবেলায় আমার মাকে হারিয়েছি। আমার মেয়ের দুর্ভাগ্য ওর কোনো খালা নেই। অবশ্য তুমি যেটা করছ, সেটা আমার একটা ছোটবোনের অভাব ভুলিয়ে দেয়।’ প্রীতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে, আন্টি তুমি আমাকে বুনু বলেই ডেকো। সেই থেকে শুরু। তবে প্রথম প্রথম অনুসুয়ার মায়ের একটু বাধো বাধো লাগত। কিন্তু প্রীতির আবদারে এই সম্বোধনই এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই হল বৃত্তান্ত। অনুসুয়ার মা একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, করোনার মধ্যে প্রীতি অনুসুয়ার সাথে কথা বলার জন্য বেশিরভাগ দিনই ওর বাবার নাম্বারে ফোন করে। প্রীতি জানে যে অনুসুয়া ওর মায়ের সাথেই সময় কাটায় বেশি, তারপরও কেন যে মেয়েটা ওর বাবাকে ফোন করে অনুসুয়াকে চায় এইটা একটা প্রশ্ন বটে। তবে অনুসুয়াকে নিয়ে প্রীতির মায়ের অন্য ভাবনা নাই। কিন্তু অনুসুয়ার বাবাকে নিয়ে কিছু এই মুহুর্তে না ভাবলেও প্রীতির বেলাতে যেমন অন্য ভাবনা মাথায় আসে না, এতটা নিশ্চিত তিনি অনুসুয়ার বাবার বেলাতে নন। প্রীতির ফোন এলে অনুসুয়ার বাবা ফোনটা ওকে দিয়ে নিজের রুমে চলে যান। একদিন মায়ের প্রশ্নটায় অনুসুয়া প্রীতিকে করে বসে,
‘আচ্ছা সোম্মা আমি তো এখন মায়ের সাথেই থাকি বেশিরভাগ সময়। তাহলে তুমি বাবার নাম্বারে কেন ফোন করে আমাকে চাও?’
এই প্রশ্নের মধ্যে অন্য কোনো ভাবনা ছিল না। অনুসুয়াও সরল্ভাবেই উত্তর দেয়।
স্টেপ ফাদার তো লকডাউনের পর থেকেই প্রতিদিন সকালে আমাকে মেসেজে গুড মর্নিং জানান। আমি ঘুম থেকে উঠি দেরী করে, তাই আর মেসেজে রিপ্লাই না করে উনাকে কল করেই একটু কথা বলি, তারপর তোমাকে চাই।
অনুসুয়ার মা কিন্তু অনুসুয়ার প্রশ্নটা শুনেছেন, কিন্তু উত্তরটা তো জানার উপায় নাই। উনি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারী। কারো ব্যক্তিগত ফোনালাপের ভিত্তিতে কোনো প্রশ্ন করা, কৌতুহল দেখানো যে শোভন নয়, সেটা তিনি ভাল করেই জানেন। তিনি এটাও জানেন তার মেয়ের এই প্রশ্ন যৌক্তিক কিন্ত সরল প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর শুনতে তিনি মনে মনে একটু উদ্গ্রীব হলেও মুখে কিছু বলেন না। করোনাকাল শেষে মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরতে শুরু করার পর, প্রীতিরও অনুসুয়ার বাসায় যাতায়াত আগের মতই শুরু হয়েছে। অনুসুয়ার মা একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, প্রীতি আর অনুসুয়ার বাবাকে সেই আগের মত স্টেপ ফাদার বলে ডাকে না, বরং তুমি তুমি করেই আলাপ চালিয়ে যায়। অনুসুয়ার বাবা ওকে আগের মতই অনুসুয়ার ছোটমা সম্বোধন করলেও কেন জানি আগের মত সেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধটা উনার মধ্যে নাই। তবে প্রীতি-অনুসুয়া সম্পর্কের মধ্যে বিন্দুমাত্র ছন্দপতন নেই। একদিন অনুসুয়ার ফোন- ‘এখনই একবার আনোয়ার খান মডার্ণ হসপিটালে আয়। মা খুব অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি করিয়েছি।’ প্রীতি একটু অবাক হয়, আন্টিকে এতদিন ধরে দেখছি, হঠাৎ হসপিটালাইজড হওয়ার মত কোনো কমপ্লিকেসি উনার মধ্যে ছিল বলে তো মনে হয় নাই। প্রীতি দ্রুত রেডি হয়ে হসপিটালে গিয়ে হাজির হয়। রিসেপশনেই অনুসুয়ার সাথে দেখা। ও প্রীতিকে নিয়ে দ্রুত মায়ের কেবিনে যাবার সময়টুকুতেই যেটুকু বলে, তাতে অনুসুয়া বোঝে যে এই মুহুর্তে আন্টির প্রেসার খুবই এবনরমাল অবস্থায় আছে। ওর আরো অবাক লাগে আন্টি তো কোনোদিন হাই ব্লাডপ্রেসারের কথা বলেননি। এত ফিট একজন মানুষ। কেবিনে পৌঁছে আন্টির কপালে হাত রাখে প্রীতি। গালে গাল ছোঁয়ায়। যদিও অসুস্থ কিন্তু তারপরও প্রীতির মনে হয়, এই প্রথমবার প্রীতির উপস্থিতিতে আন্টি খুব নিঃস্পৃহ। পেশেন্টের এটেন্ড্যান্ট হিসাবে হাসপাতালে ডিউটি করার অভিজ্ঞতা প্রীতির এসএসসি’র পর থেকেই। ও আন্টির ফাইল উল্টে-পাল্টে দেখে, অনেকগুলি ইনভেস্টিগেশন। প্রীতি জানে একসাথে এতগুলি ইনভেস্টিগেশনের অর্থ হল, ডাক্তার বড় কোনো সমস্যার শংকা করছেন, না হলে তিনি পেশেন্ট দেখে এবং তার মেডিক্যাল হিস্ট্রি শুনে কিছুই ধারণা করতে পারেন নাই। প্রীতি এটাও বুঝে ফেলেন এই পেশেন্টকে এরা এক সপ্তাহের আগে রিলিজ দেবে না। ও ডিউটিরত ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারে, সবগুলি টেস্ট সম্পন্ন হতে কাল দুপুর পর্যন্ত সময় লাগবে। একটা রিপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে পরশু সন্ধ্যা পর্যন্ত। এই সময় পর্যন্ত পেশেন্ট অবজারভেশনে থাকবেন।
আরও পড়ুন: রথযাত্রার সাংস্কৃতিক উৎস
মাস্টার্স পরীক্ষার আর মাত্র মাস তিনেক বাকি। প্রীতি নিয়ম করেই ক্লাসে যায়, অনুসুয়ার জন্য নোট টুকে আনে। বিকালে হসপিটালে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত আন্টির কাছে থাকে। সন্ধ্যায় অনুসুয়াকে সাথে নিয়ে ধানমন্ডি লেকের ধার, রবীন্দ্রসরোবরে একটু ঘোরাঘুরি করে। উদ্দেশ্য, অনুসুয়ার একটু মন ভাল করা আর কি। হসপিটালাইজেশনের চতুর্থ দিন বিকালে হসপিটালে এসে প্রীতি জানতে পারে আন্টির আসলে সেই অর্থে কোনো মেজর কমপ্লিকেসি নাই। প্রচন্ড রকমের দুঃশ্চিন্তা এবং এক ধরনের মানসিক ভীতি থেকেই তিনি অসুস্থ হয়েছেন। উনাকে নাকি এখন থেকে নিয়মিত কাউন্সেলিং নিতে হবে। এইটা জানার পর অনুসুয়ার খুব মন খারাপ হয় এবং প্রীতি খুব অবাক হয়, কি এমন মানসিক চাপ আন্টির? পরদিন মায়ের রিলিজ, কিন্তু অনুসুয়া কেন জানি স্বস্তি বোধ করে না। সেইদিনই সন্ধ্যায় দু’জন বেরিয়ে রবীন্দ্রসরোবরে মাটির কাপে চা নিয়ে জলের ধারে মঞ্চের পেছনে জলের ধারে দাঁড়ায়। বেশ খানিক্ষণ দু’জনেই নীরব। প্রীতি চায়ে কয়েক চুমুক দিলেও অনুসুয়া চায়ের কাপ হাতে অপলক জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রীতি বলে কি হল সোনা মেয়ে?
না কিছু না…
কি এমন ভাবছ?
তোমার কাছে লুকানোর কিছু নেই সোম্মা… তুমি একটা বিষয়ে খেয়াল করেছ, মা’র অসুস্থতার দিন থেকে আজ পর্যন্ত বাবা শুধু কর্তব্য করে যাচ্ছে। কিন্তু বাবাকে খুব টেন্সড কিন্তু আমার একবারও মনে হয়নি। বাবার মাকে দেখে খুব মন খারাপ সেটাও আমার মনে হয়নি।
প্রীতি এই কথায় কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কথা বলতে গিয়ে খেয় হারিয়ে ফেলে। নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হয়। প্রীতি তো জানে, অনুসুয়ার মায়ের প্রতি ওর বাবার কোনো ভালবাসার ফিলিং নাই। কিন্তু নারী হিসাবে, পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে সর্বপরি লাইফ পার্টনার হিসাবে রেসপেক্টটুকু বজায় রেখে চলেন আর কি। এসব কথা আসলে প্রীতি শুনতে চায়নি, ফোনে অনুসুয়ার বাবাই বলেছেন, করোনাকালে দিনের পর দিন নানা কথার অছিলায়।
সব কথা শেষে উনি একটা কথা প্রায় নিয়ম করেই বলতেন, সব কথা তো তোমাকে বলতে পারি না… কিন্তু তোমাকে বলতেও বাকি রাখি নাই কিছু। যেটুকু বলতে পারি না, আমার মনে হয়, সেটুকু তুমি বোঝ।
এই যে সেটুকু তুমি বোঝ, আসলে কি প্রীতি বোঝে? কি বুঝাতে চান অনুসুয়ার বাবা? প্রীতি এবং অনুসুয়া দু’জনের প্রকৃতি আলাদা, কিন্তু কিছু বিষয়ে ওদের মধ্যে মিল আছে। যেমন, ওরা কোনো কিছু না বুঝলে ঠিকই তাৎক্ষণিকভাবে বলে ফেলে না, বুঝি নাই। কিন্তু কেন যে অনুসুয়ার বাবাকে প্রীতি বলতে পারে নাই, না বুঝি না। লেকের ধারে দাঁড়িয়ে প্রীতি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, না এভাবে আর চলতে দেওয়া যাবে না। ভালোয় ভালোয় আন্টি বাসায় ফিরে আসুক। অনুসুয়ার বাবার সাথে কথা বলতে হবে। প্রথমেই পরিস্কার করতে হবে- না, আমি বুঝি না, জিজ্ঞেস করতে হবে এসব কথা কেন তুমি আমাকে শেয়ার কর? নিজেই নিজের ভাবনায় রাশ টানে প্রীতি, কি বলতে হবে, কি জিজ্ঞেস করতে হবে- সেগুলি না হয় পরে ঠিক করে নেওয়া যাবে। আপাতত, অনুসুয়াকে সামলানো যাক।
প্রীতি অনুসুয়াকে বলে, শোনো সোনা মেয়ে, তোমার বাবার এক্সপ্রেশন কম, দেখ না, আমি যে এতদিন উনাকে স্টেপ ফাদার বলে ডাকতাম, আমাদের প্রতি কেয়ারিং না বলে অভিযোগ করতাম, তাতে কি উনার আমাদের প্রতি, বিশেষ করে তোমার প্রতি তার ভালবাসার অভিব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে। যিনি নিজের মেয়ের প্রতি ভালবাসায় প্রকাশ করতে পারেন না, তিনি বউয়ের প্রতি আর কতটা এক্সপ্রেসিভ হবেন বল? মন খারাপ কোরো না। তোমার চা-টা ঠান্ডা হয়ে গেছে, চল আর এককাপ চা খেয়ে আন্টির কাছে যাই।
ওরা কেবিনে আসার পর অনুসুয়ার মা ওর বাবাকে বলেন চয়ন তুমি অনুকে নিয়ে বাসায় যাও। ডিনার সেরে ওকে পৌঁছে দিও। ও থাকবে আজ রাতে আমার সাথে। প্রীতি তুমি একবার ফোন করে বাসায় জানিয়ে দাও, তোমার ফিরতে একটু দেরী হবে। অনুর বাবাই তোমাকে পৌঁছে দেবে। ওরা ডিনার করে ফিরুক, তারপর তুমি যেয়ো। অনুসুয়ার মা গত কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম তাকে নাম ধরে ডাকলেন এবং অনুসুয়ার বাবার কথা বলতে গিয়ে তোমার স্টেপ ফাদারের পরিবর্তে অনুর বাবা বললেন। প্রীতি এবং অনুসুয়া দু’জনেই মেধাবী। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য হল, প্রীতি যেমন বই পড়ে অর্থ ভাল বোঝে, মানুষকে, মানুষের কথাকে, সম্পর্ককে ও ভাল বুঝতে পারে এবং সেটা তাৎক্ষনিকই। আর অনুসুয়া প্রথমটা ভাল বোঝে, দ্বিতীয়টার জন্য ও নির্ভরশীল প্রীতির উপর।
প্রীতি বুঝতে পারে, আন্টি ওর সাথে আলাদা কথা বলতে চাইছেন। একটু আগে অনুসুয়ার প্রশ্নে প্রীতি যেমন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। এই মুহুর্তে সে আবার খুব অস্বস্তি বোধ করছে। প্রীতি জানে না, আন্টি কি বলতে চান, কিংবা আদৌ কিছু বলতে চান কিনা কিন্তু কেন যে ওর অস্বস্তি হচ্ছে? অনুসুয়ার বাবার সাথে ওর ফোনালাপই কি একমাত্র কারণ? কিন্তু অনুসুয়া তো ভদ্রতা করে কথাগুলি শুনে গেছে মাত্র ওর তরফ থেকে তো কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেনি বরঙ কখনো কখনো বিব্রতবোধ করেছে। একটাই ব্যতিক্রম সেটা হল, প্রীতির যা স্বভাব, তাতে ওর বলার কথা ছিল স্টেপ ফাদার তুমি এসব কথা আমাকে কেন বলছ? আন্টিকে নিয়ে তোমার কোনো খারাপ লাগা থাকলে, বিশেষ করে আন্টির জীবনাচরণ কিংবা মানসিকতা নিয়ে সেগুলি তো তোমরা নিজেরাই আলাপ করতে পারো। চেহারার প্রসঙ্গ প্রীতি কোনোদিন তুলবে না, কারণ বয়সে ছোট হলেও ও মানুষকে মানুষ হিসাবেই জানতে এবং বুঝতে শিখেছে। তাছাড়া আন্টি বাহ্যিকভাবেও যথেষ্ট সুন্দর এবং স্মার্ট লেডি তো বটেই। কেন যে প্রীতি পারে নাই, সেটা ওর নিজের কাছেও খুব আশ্চর্যের বিষয়। আসলে অনুসুয়াব বাবা তো হঠাৎ করেই এই আলাপ পাড়েন নাই। উনি নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে এইসব কথা বলেছেন। প্রীতি কিছু ক্ষেত্রে বিব্রতবোধ করলেও ঘরবন্দী জীবনে অনুসুয়ার বাবার সাথে নিয়ম করে কথা বলাটাও ওর একটা অভ্যাসের মত হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন: আমরা মানুষ হবো কবে?
অনুসুয়া এবং ওর বাবা বিদায় নিতেই, অনুসুয়ার মা প্রীতিকে কাছে ডেকে বসান। প্রীতির একবার মনে হয়, প্রীতিই কথা শুরু করবে, যাতে আন্টি যা বলতে চান, সেটা আজ না বলতে পারেন। তখনই প্রীতির মনে হয় এই ছোট্র জীবনে কখনও চালাকির আশ্রয় নেয়নি। তাহলে আজ কেন চালাকি করে আন্টির মুখ বন্ধ করতে চাইছে? আসলে আজ প্রীতির মাথা একটু বেশিই কাজ করছে। একটা ঘটনার সাথে আরেকটার সম্পর্ক খুঁজতে চাইছে। হসপিটালে সেদিন আন্টির নিঃস্পৃহতা, আন্টির প্রচন্ড মানসিক চাপ এবং ভীতি, অনুসুয়ার আজকের প্রশ্ন এবং করোনার মধ্যকার সেই প্রশ্ন আচ্ছা সোম্মা আমি তো মায়ের সাথেই থাকি, তুমি কেন বাবাকে ফোন করে আমাকে চাও সবকিছুর মধ্যে প্রীতি একটা যোগসূত্র খুঁজে পান। প্রীতি যেটা মনে ঠাই দিতে চায় না, কিন্তু সেই কথায় তার মনে উঁকি দিচ্ছে বারবার। আন্টি কি অনুসুয়ার বাবার সাথে প্রীতির সম্পর্ক নিয়ে কোনো কিছু ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন? ভেতরে ভেতরে কি উনি ইনসিকিউরিটি ফিলিং এ ভূগছিলেন, সেটা অবশ্য আন্টির ক্ষেত্রে হবার কথা নয়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, আন্টি আমাদের চারজনের এমন সম্পর্ক যদি সত্যি অন্য কোনো দিকে টার্ন নেয়, সেটা কি ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিংবা হতে পারে মেয়ের বন্ধুর সাথে লাইফপার্টনারের সম্পর্ক এটা বউ হিসাবে কতটা অবমাননাকর। প্রীতির ভাবনা আরো ডালপালা বিস্তারের আগেই আন্টি বলেন, দেখেছ, আমাদের যে বয়স বাড়ছে, তার প্রথম ধাক্কাটা বোধহয় টের পাওয়া গেল। তোমরা আর কতদিন দুই বন্ধু মিলে জীবন পার করবে? লাইফে কাউকে জোটাও। লেখাপড়া তো শেষ হতে চলল। যদিও আমি চাই, তোমরা আগে ক্যারিয়ার গুছিয়ে বিয়ে-থা করবে। তাই বলে এ যুগের মেয়ে তোমাদের ছেলে বন্ধু থাকবে না! একসাথে চলতে চলতে সিদ্ধান্ত নিলে ভাল হয়। নইলে আমার মত দশা হবে।
প্রীতি, কি ভাবছ তখন থেকে বলত?
না তেমন কিছু না…
আমাকে লুকায়ো না…
না, এই যে তুমি বললে, তোমার মত দশা… এই কথার মনে কি?
আরে ওইটা একটা কথার কথা… প্রীতি বুঝতে পারেন এই কথা আসলে আন্টি বলতে চান নাই, মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। এখন সামলে নিতে চেষ্টা করছেন। আর সেটা তো আমি এই মাত্র বললাম, কিন্তু তুমি আজ অনুসুয়ার সাথে ঘুরে আসবার পর থেকে আর এখানে নাই।
তোমার যা কথা, এখান থেকে কোথায় যাব? তোমার মতো লাইভ মানুষের কাছে এসে কি অন্য কোথাও হারিয়ে যাওয়া যায়?
অনুসুয়ার মা হঠাতই চিৎকার করে ওঠেন, এইসব কথা আমাকে আর বলবে না। প্রীতি একটু অবাক হয়, কিন্তু ও জিজ্ঞেস করতে যাবে কেন আন্টি। কিন্তু তার আগেই অনুসুয়ার মা কেঁদে ফেলেন। প্রীতি পরিস্থিতি সামাল দিতে একটু অভিভাবকত্ব নিয়েই বলে, হল কি তোমার? বাচ্চা মেয়ের মত কাঁদছ কেন?
কেন কাঁদছি? তোমরা আমাকে লাইভ বল, স্মার্ট লেইডি বল, সত্যি বলতে কি এই এপ্রিসিয়েশন আমি আমার কাজের জায়গা, বন্ধু এবং পরিচিত সার্কেলেও শুনতে অভ্যস্থ। মুখে খুব বিগলিত না হলেও মনে মনে এটাকে এনজয়ও করি। অথচ আমার লাইফ পার্টনার, আমার মেয়ের বাবা লাইভ নারী খুঁজতে, সুন্দরী নারীর উষ্ণতা পেতেই প্রেম করছে আমারই মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে?
প্রীতির শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে। তাহলে কি, তার শংকা-ই সত্যি? আন্টি কি তাকে জড়িয়েই অনুসুয়ার বাবাকে নিয়ে এই কথাগুলি বলছেন? প্রীতি আর কিছু ভাবতে পারে না, মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। এরই মধ্যে কেবিনের দরজায় ঠকঠক শব্দ। অনুসুয়ার মা নিজেকে সামলে নেয়। প্রীতি গিয়ে দরজা খুলতেই একজন নার্স ভেতরে আসেন, রাতের মেডিসিন নেওয়া হয়েছে কিনা সেটা ফলোআপ করতে। এতক্ষণ, প্রীতির রক্ত হিম হয়ে এলেও এখন প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে, আজকে আর এই পর্ব শেষ হল না বলে, কারণ একটু পরেই অনুসুয়া আর ওর বাবা চলে আসবে। আন্টি যদি ওকে দোসারোপ করত, তাহলে তো অন্তত ও কিছু বলতে পারত। যদিও এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, তাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে এমন কথা প্রীতি ভাবতেই পারে না। কিন্তু এই কদিনের অস্বস্তির পর আজ মনে হচ্ছিল মানসিক চাপ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি মিলতে যাচ্ছে। কিন্ত হল কই?
অনুসুয়া এবং ওর বাবা ফিরে এলে, প্রীতি বিদায় নিতে যাবে এমন সময় অনুসুয়ার মা’ই বলেন, দু-মিনিট অপেক্ষা কর। চয়ন, তুমি ওকে বাসার সামনে নামিয়ে যাও। প্রীতি বলতে যাচ্ছিল, না না আন্টি তার দরকার হবে না। কিন্তু তার আগেই অনুসুয়ার মা বলেন, কি হল চয়ন আজ তো তোমার এখানে কোনো কাজ নাই, ওকে দেরী করাচ্ছ কেন? বেরিয়ে পড়।
অনুসুয়ার বাবা যেন হুকুম তামিলের ভঙ্গিতেই হ্যাঁ, না কিছু না বলেই চোখের ইশারায় প্রীতিকে বের হবার ইঙ্গিত করে নিজেই দরজার দিকে এগোতে থাকেন। প্রীতিও আজ আর কোনো কথা না বলে অনুসুয়াকে একবার জড়িয়ে ধরে অনুসুয়ার বাবাকে অনুসরণ করে। অনুসুয়াদের গাড়ি নেই। অনুসুয়ার মা অফিসের গাড়ি ব্যবহার করেন। অনুসুয়ার বাবা সাধারণত সেই গাড়িতে চড়তে চান না। নিচে নেমে তিনি উবার ডাকার জন্য মোবাইল স্ক্রিনে চোখ দিতেই প্রীতি বলল, ‘এখান থেকে লালমাটিয়া যেতে উবার লাগবে না। রিক্সা নাও আমাকে ৩২ নাম্বার ব্রিজের কাছে নামিয়ে দিলেই হবে।’
আজ অনু’র বাবার কি হয়েছে প্রীতি বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে তিনি দুনিয়ার সকল নারী কুলের হুকুম তামিলের জন্য প্রস্তুত। দু,জনে রিক্সায় ধানমন্ডি ৮ নাম্বার ব্রিজ পার হবার আগেই প্রীতি অনু’র বাবাকে বলেন, আমি একদিন তোমার সাথে বাসার বাইরে কোথাও বসতে চাই একটু সময় হাতে নিয়ে। আমার অনেক কথা আছে তোমার সাথে এবং সেটা আন্টি বাসার ফেরার দু-একদিনের মধ্যেই। এবার তিনি শুধু ঘাড় নেড়ে জানান দেন, তিনি রাজি। প্রীতি একটু আশ্চর্যের ভঙ্গিতে বলল, কি হয়েছে তোমার বলো তো! আজ সব কিছুতেই তোমার মৌন সম্মতি! বলেই প্রীতি নিজেই একটু লজ্জ্বা পান, মনে হয় বন্ধুর বাবাকে নয়; এমন কথা একান্ত বন্ধুকেই বলা যায়। অনুসুয়ার বাবা ম্লান হেসে বলেন, কই কিছু না তো। আসলে ক’দিন যা ধকল গেল। তুমি টাইম এবং লোকেশন জানিও আমিই আসব। কথা বলতে বলতে রিক্সা ৩২ নাম্বার ব্রিজ পেরোলে প্রীতি রিক্সা থেকে নেমে বিদায় নেয়। বিদায় নেবার সময় প্রীতি অনু’র বাবার মুখের অভিব্যক্তিতে এক ধরনের অসহায়ত্ব লক্ষ্য করেন।
প্রীতি বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে নিজের রুমে এসে চাণক্য সেন-এর পুত্র-পিতাকে বইটা হাতে নিয়েছে এমন সময় ওর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করার আগে ওর টেবলওয়াচে সময়টা দেখে ১২:১১ মিনিট এবং স্ক্রীনে নামটা দেখে একটু অবাক হয়। স্টেপ ফাদার? প্রীতি একবার ভাবে ফোনটা রিসিভ করবে না। কিন্তু ভদ্রতার জায়গা থেকে মনে হয়, উনি জানেন আমি এখনও ঘুমাইনি। কাজেই ফোন না রিসিভ না করাটাও ঠিক হবে না। বিকাল থেকে উনার মুখ দিয়ে একটি কথাও শুনিনি। কি বলতে চান শুনতে তো দোষ নাই। প্রীতি ফোন রিসিভ করে বলেন, বল…
কি বলি বল তো, তোমাকে?
কেন কি হয়েছে?
প্রীতি, তোমার আন্টি আসলে তোমাকে কি কি বলেছেন?
কেন বলত?
না, এমনি জানতে চাইছিলাম।
প্রীতির কেন জানি মনে হয়, এমনি জানতে চাইছিলাম বললেও অনুসুয়ার বাবা আসলে দারুণভাবে জানতে শুধু আগ্রহীই না বলা যায় উদগ্রীবও- কি আলোচনা তার সাথে হয়েছে অনুসুয়ার মায়ের। প্রীতি স্বাভাবিকভাবে বলে, তোমাকে এমনকি অনুসুয়াকেও আলাদাভাবে শেয়ার করার মত কোনো কথা তো আন্টি বলেন নি।
আমার মনে হচ্ছে, তুমি আমার কাছে লুকাচ্ছ।
তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি লুকাচ্ছি? আর আমি তোমার কাছে লুকাতে যাবই বা কেন? তবে আন্টি যদি আমাকে এমন কিছু বলতেন, যেটা তোমাকে বলা যায় না, সেটা কিন্তু আমি তোমাকে বলতাম না।
তুমি আমার সাথে বাইরে কেন দেখা করতে চাইছ? সত্যি বলতে কি…
কি?
না তেমন কিছু না…
বল…
শুনতে তোমার ভাল লাগবে না
দেখ, ফোনে তুমি আমাকে অনেক কথা-ই বলেছ, যেগুলি শুনতে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি এমন নয়; কিন্তু শুনেছি। কাজেই তুমি বল।
কোনো মেয়ে কিংবা নারী আমার সাথে আলাদাভাবে দেখা করতে চাইলে, খুব ঔৎসুক্য না দেখালেও বরাবরই মনে মনে আমি খুব আগ্রহো থাকি। কিন্তু…
অনুসুয়ার বাবাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রীতি বলে, আমি যে তোমার কাছে, কোনো মেয়ে কিংবা নারী এইটা আমার জানা ছিল না। আমার মধ্যে তো তোমার নতুন করে আবিস্কার করার কিছু নাই। সেই কবে থেকে আমি অনু’র সাথে তোমাদের সংস্পর্শে বড় হয়ে উঠেছি। তুমি যে কথাটা বললে না কোনো মেয়ে কিংবা নারী, কথাটা শুধু আমার কানেই লাগেনি। আমি অনেক বড় একটা ধাক্কা খেলাম।
অনুসুয়ার বাবা কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রীতি তাকে থামিয়ে বলে, তোমার কোনো কথা আমি আজ আর শুনতে চাই না। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলি, আন্টি কিন্তু তোমার নামে আমাকে কিছু বলেন নাই। কাজেই তুমি নিশ্চন্তে ঘুমাতে পার। স্যরি, আমি একটু ওভার রিয়াক্ট করে ফেলেছি বোধ হয়। তুমি অস্বস্তিতে থেকো না। এখন ছাড়ি। আর হ্যাঁ, দেখা কিন্তু আমি করব তোমার সাথে। আমার কথা আছে।
ফোনটা রেখেই প্রীতি জোরে জোরে শ্বাস নেয়। এতক্ষণ কথাগুলি ও একদমে বলে গ্যাছে। একটু স্বাভাবিক হয়ে ও সিদ্ধান্ত নেয়, আর দেরী নয়; কাল মঙ্গলবার। আন্টির রিলিজ। এই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সে অনু’র বাবার সাথে দেখা করবে। কথাটা আর কানে বাজতে থাকে, কোনো মেয়ে কিংবা নারী… প্রীতি এবার একটু লজিক্যালি ভাবার চেষ্টা করে, তার মানে অনু’র বাবা নিয়মিতই কোনো না কোনো মেয়ে কিংবা নারীর সাথে দেখা করেন। অনুসুয়া এবং প্রীতি এই যুগের মেয়ে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সম্পর্কের জটিলতা সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই এমন না। কিন্তু পরিবারে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বন্ধুমহলে ওদের দু’জনের কেউই এখনও পর্যন্ত সরাসরি এ রকম কোনো জটিল অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়নি। তাই প্রীতি একটু দ্বিধায় পড়ে, তাহলে আন্টি যে বললেন, আমারই মেয়ের বয়সই একটা মেয়ে, সেই তো আমি নাও হতে পারি। আন্টি আমাকে নিয়ে সন্দেহ করছেন না সেটা ভূল প্রমাণিত হলে হয়ত আমার স্বস্তি মিলত কিন্তু আমি ভাবনামুক্ত হতাম না। কারণ আন্টি তো ভাল নেই, উনি ভাল না থাকলে যে আমার সোনা মেয়েটা ভাল থাকবে না। আহা আজ বিকালে যখন অনু ওর বাবার নামে অনুযোগগুলি করছিল, কেমন করুণ দেখাচ্ছিল মেয়েটার মুখটা। কথা তো আমাকে বলতেই হবে অনু’র বাবার সাথে। জানতে হবে, আন্টির এই পরিণতির জন্য দায়ী আসলে কে? কিছুদিন অপেক্ষা করলে প্রীতি আন্টির কাছ থেকেই জানতে পারবে। কিন্ত সে সেটা চায় না। কারণ আন্টির এই অবস্থার জন্য অন্য যে কেউ দায়ী হোক না কেন, তার ভূমিকা পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ দায়ি কে, সেটা তো পরিস্কার। আর প্রতিকারের ব্যবস্থা তো প্রীতিকেই করতে হবে। কাজেই অপেক্ষা করার সময় নাই। এইসব ভাবনার মাঝে প্রীতি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু ঘুমটা ভাল হয় নাই। খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফ্রেশ হয়ে প্রীতি পরপর কয়েকটা প্রার্থনা সঙ্গীত শোনে ইউটিউবে। তারপর অনুসুয়ার বাবাকে একটা মেসেজে শুক্রাবাদের একটা রুফটফ রেস্টুরেন্টের ঠিকানা মেসেজ করে আরেকটা মেসেজে লেখে থার্সডে ১২.০০টা। প্রীতি জানে, অনু’র বাবা কর্মজীবী মানুষ। এই সময়টা উনার জন্য সুইটেবল না। তাছাড়া এক’দিন আন্টির জন্য হসপিটালে অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন। কাজেই উনার জন্য একটু ডিফিকাল্ট হবে বটে। কিন্তু এই সময়টা বলার দুইটা কারণ আছে, যে রেস্টুরেন্টের ঠিকানা দিয়েছে, সেখানে প্রীতি অনেকবার এসেছে। খুবই নিরিবিলি জায়গা। এখানে আড্ডা জমে মূলতঃ অফিস টাইমের পর। তাই কথা বলা যায় স্বাচ্ছন্দ্যে। আর দ্বিতীয় কারণ হল, অনু’র বাবা কোনো ওজড়-আপত্তি করে কিনা, মানে কাল রাতে ফোনে প্রীতির বক্তব্যের পরও উনার প্রীতির সাথে দেখা করার আগ্রহ কতটা আছে সেটা পরীক্ষা করতে। প্রীতি খুব অবাক হয়, তাৎক্ষণিক প্রত্যুত্তর, ওকে।
আরও পড়ুন: বোদল্যার: দুইশো বছর পরে দাঁড়িয়ে পর্ব -১
প্রীতি এর মধ্যে অনুসুয়ার কাছ থেকে আন্টির খবর নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো আলাপে যায় নাই। মনে মনে প্ল্যান করতে থাকে কিভাবে প্রীতির বাবার সাথে আলাপ পাড়বে। প্রীতি খুব লজিক্যাল মানুষ। ও নিজেই ভাবে লোকটাকে কেন জানি ও এই দুই-তিন দিনের মধ্যে বড় বেশি নেতিবাচক মানসিকতায় নিয়ে ফেলেছে। আন্টির সব কথা তো সেদিন শেষ হয় নাই। তাছাড়া সেটা তো শুধু আন্টিরই কথা। প্রীতির বাবারও তো অন্য ব্যাখ্যা থাকতে পারে। যে বক্তব্যে প্রমাণ হতে পারে আন্টির ভাবনা ভূল। তাছাড়া আমি তো জানিও না আন্টির কি শুধুই ভাবনা, নাকি কোনো প্রমাণ আছে। এই ভাবনা এই ক’দিন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই ভাবনার মধ্যেই বুধবার রাতে প্রীতি’র মনে হয় প্রীতির বাবাকে একটা রিমাইন্ডার মেসেজ পাঠাবে কিনা। কিন্ত ফোন হাতে নিয়ে নিয়ে অনুসুয়া দেখে প্রীতির বাবাই তাকে হোয়াটসএপ এ মেসেজ করে রেখেছে আগামীকালের মিটিং এর কথা স্মরণ করিয়ে। প্রীতি আবারও অবাক হয়। লোকটার এত তাগিদ কেন?
প্রীতি ভাবে যাক, কাল দুপুরেই সব ভাবনার অবসান। রাতে এই ভাবনা বেশি ভাবলে রাতের ঘুম মাটি। সে নিজের কাজ শেষ করে। পিতা-পুত্রের সুজান ফোর্ডের পড়াশুনা, জীবনাচরণের অংশটুকু উল্টে-পাল্টে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেরীতে। আজ ক্যাম্পাসে যাবে না। ফ্রেশ হয়ে সে সাড়ে পৌনে বারোটার দিকে সে বাসা থেকে বের হয় সেই নির্ধারিত রেস্টুরেন্টের উদ্দ্যেশে। রিক্সায় ১২টার পরপরই রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখে প্রীতির বাবা আগেই পৌঁছে গিয়ে কর্ণারের দিকে একটা টেবিল দখল করে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
প্রীতি গিয়ে বসতেই অনুসুয়ার বাবা বলেন কি খাবে বল? প্রীতি বলেন, খাবার নিয়ে ব্যস্ত হইও না। আমাদের সময় লাগবে। আমার অনেক কথা আছে। তোমাকেও বলতে হবে। কাজেই আমরা এখানেই লাঞ্চ করব।
আপাতত কফি বলি।
এই সময় কফি?
আমার কেমন জানি নার্ভাস লাগছে। একটু কফি হলে ভাল হয়।
ওকে… আমার জন্য লেমন টি।
চা এবং কফি আসা পর্যন্ত কেন জানি দু’জনেই নীরব থাকেন। শুরু করেন অনুসুয়া।
আচ্ছা, আন্টিকে দেখে তো কখনও এতটা অসুস্থ হওয়া তো দূরের কথা অসুস্থতার কোনো লক্ষণ আছে বলেও মনে হয় নি। কেন এমন হল হঠাৎ করে বলো তো?
আমি কিভাবে বলব? আমি তো ডাক্তার না, তাছাড়া তোমার আন্টির মনের খবর জানার সুযোগ তো আমার এতদিনেও হয় নি, এ জীবনে হবে কিনা তা ও জানি না।
জানার সুযোগ হয়নি নাকি জানতে চেষ্টা করনি?
প্রীতি তুমি আমাকে ডেকেছিলে কথা বলার জন্য। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে প্রশ্নোত্তর সেশন চলছে।
ওকে তাহলে একটু অন্যভাবে বলি, আমার মনে হয় আন্টির এই অসুস্থতার জন্য তুমিই দায়ী। তুমি ছাড়া অন্য যিনি বা যারা আছেন তাদের ভূমিকা পরোক্ষ। প্রত্যক্ষভাবে দায়ী তুমিই।
তোমার কেন এমনটা মনে হচ্ছে? তুমি দ্যাখনি, তোমার আন্টির অসুস্থতার সময় আমি আমার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে কিভাবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি?
সংকটটা বোধহয় এখানেই। এই যে তুমি বললে না, দায়িত্ব পালন করেছ। এইটা চোখে দেখা যায়। জীবনসঙ্গী বোধহয় এই দায়িত্ব কর্তব্যের বাইরে আরো কিছু প্রত্যাশা করে যার সবটা হয়ত চোখে দেখা যায় না।
আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ কিংবা ভাললাগা, মন্দলাগা, শেয়ারিং এগুলি তো এক তরফা হয় না। আমি চেয়েছি, কিন্তু তোমার আন্টির সাথে সেই সম্পর্ক আমার কখনই গড়ে উঠে নাই। হয়ত আমারই ব্যর্থতা, আমি পারিনি। তবে এটাও সত্য, এর জন্য তোমার আন্টির দায়ও কম নয়। ও জীবনে কখনও আমার সাথে নমনীয়তা দেখায়নি।
তোমরা শুধুই নমনীয়তা প্রত্যাশা কর, কমনীয়তা পছন্দ কর, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারীকে তোমরা মনে নেওয়া তো দূরের কথা জীবনসঙ্গী হিসেবে মানতেও পার না।
প্রীতি তুমি বলেছিলে, তুমি আমার সাথে বসতে চাও। তোমার আমার সাথে আলাপ আছে, কথা আছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি শুধু আমার কথার কাউন্টারই দিচ্ছ না, বরং আমাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছ। অথচ, আমি আজ এতদিন ধরে তোমাকে আমার একাকীত্বের কথা বলে আসছি, কই তুমি তো…
তুমি কি আমার সমবেদনা প্রত্যাশা করেছিলে?
শুধু সমবেদনা নয়; আমি তোমার নিকট…
কথা শেষ কর। আর আমি সত্যিই স্যরি, তোমার সাথে কথা বলতে ডেকে তোমাকে বোধহয় একটু বেশিই হার্ট করে ফেলেছি।
না না ঠিক আছে… আসলে আমি…
বল…
তোমার কাছে শুধু সমবেদনা নয়; বন্ধুত্ব নয়…
বল… তার চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম।
মানে?
তুমি যখন এতদিনেও বোঝনি… তাই ওই প্রসঙ্গ থাক
না, তোমাকে কথা শেষ করতে হবে।
অনুসুয়ার বাবা একটু ইতস্তত দৃষ্টিতে চারপাশ তাকিয়ে প্রীতির হাত চেপে ধরে বলেন, আমি আসলে তোমার কাছে বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশি আশা করেছিলাম।
প্রীতি হাতটা ছাড়িয়ে নেয়, ওর সারা শরীর কাঁপছে। গলার স্বরটা নিচুতে রেখে খুব ঝাঝালো গলায় বলে, তোমরা পুরুষ জাতটাই না এমন… না হতে পার ভাল পার্টনার, না হতে পার ভাল বাবা, না হতে পার ভাল বন্ধু। কথাগুলি বলেই প্রীতি দ্রুত ওখান থেকে চলে আসে।
আরও পড়ুন: গল্প: বৈশালী পাড়ার প্রতিমারা
অনুসুয়ার বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। নিজেই নিজের সাথে কথা বলেন। মেয়েটার মধ্যে ম্যাচিউরিটি আছে বটে। কিন্তু জীবনের অনেক কিছুই ও জানে না। তাই আমাকে এভাবে বলে গেল। ওর কথার মধ্যে অনুসুয়ার মায়ের কথার ঝাঁঝ পাওয়া যায়। কিন্তু এই স্বগোক্তির মধ্যে, এই ভাবনার মধ্যে নিজের অস্বস্তি নিজের এমন অসহায় আত্মসমর্পণের পরও এভাবে হেরে যাওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি মেলে না। তার একটা যুতসই সিদ্ধান্তে আসা দরকার, যেখানে তিনি জয়ী না হলেও পরাজয়ের গ্লানি থাকবে না, অস্বস্তি থাকবে না। দপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গ্যাছে। ঠাই বসে আছেন অনুসুয়ার বাবা। মাথার মধ্যে একটাই ভাবনা, মুক্তি। পেয়েও যান…আসলে অনুসুয়ার মায়েরা এমনই হয়। বয়স, অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিত্বে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্ত এরা কেউই পুরুষের মন বোঝে না।#