অন্ধকারে জলপাই পাতার রঙ ও নয়নতারা

এক

বাহ্! ভারী মিষ্টি কণ্ঠ তো।
কে গাইছে এমন মায়াবী গান?

দরজা খুলে দেখি লোকটি সাদাছড়ির
উপর ভর দিয়ে ঈষৎ হেলান দিয়ে গাইছে
ছায়া মেলানো আদুরী গান।

কাছে যেতেই মুচকি হাসলেন।সুরের ঠোঁটেই
স্বরের উপর সুর বসাতে বসাতে বললেন
‘দূরে কোথাও বুঝি গেছিলেন?

দুই

আজকাল এমনও বৃষ্টি হয়?
বাতাসের তোড়ে বৃষ্টি তেছরা হয়ে পড়তে পড়তে
এক্কেবারে সবকিছু ধুয়ে মুছে ফকফকা করে দিয়েছে।

এমন ধোয়ামোছা দিন কার না ভালো লাগে?
ফুল তোলার মতো গুণগুণ করো, তাও ভালো লাগে।
কড়া লিকারের চা হাতে বই ভেজা খোলা বারান্দা
সবই এমন ফকফকা দিনের অনুষঙ্গ।

এমন কি খাঁজকাটা শিউল পাতা থেকে টিপটপ করে
যে জল গড়িয়ে পড়ছে তা অনেকটা
স্নান সেরে তোমার খোপায় জড়ানো ভেজা গামছার থেকে
জল পড়ার মতো ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে…
তাও ভালো লাগে,বড্ড ভালো লাগে।

তিন

রেলিঙে একটি মুখ একটি ভেজা ফুলতোলা শাড়ি
আর একটি ছোট্ট হাতের ফ্রক দুলছিল ঝুলছিল।

রাস্তা পেরিয়ে অন্য একটি গলির মুখে পড়তেই
চোখে পড়ল একটা বিষন্ন বিকাল উঁকি দিয়ে
আমাকে ডাকছে।

রোদে পুড়ে যাওয়া মুখ শাড়ি ও রঙিন ফ্রক
একটু ফুসরত চাচ্ছে।একটু চা ঢালবার বিকাল চাচ্ছে।

আমার সময় কই?

চার

দুই ফিতার স্যাণ্ডেল পায়ে গলিয়ে কতদূর এসে গেছি।

আরেকটু পথ পেরুলে তোমাদের শটিবনের বাগান।
তার আগেই ছাতার মতো মেলানো ছাতিম গাছ।
এখনও কি তলায় ফুল ছড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে?
এইখানে এই ছাতিমের কাছে একদিন একবর্ষা মাথায়
নিয়ে আমি রেখে এসেছিলাম আমার প্রতিশ্রুতি।

সেই বছরই তুমি গাঢ় নীল রঙের রেইনকোট পাঠালে।
সাথে একজোড়া গামবুটও।
পরের বছর আর বৃষ্টি দেখা নাই।
তারপরের বছরও খরা।

দুই ফিতার স্যাণ্ডেল গলিয়ে কতদূর কতদূর যাই
অথচ আর কখনো ছাতিমের কাছে যাইনি।
আর কখনো তোমাদের শটিবনের বাগানো যাওয়া হয়নি।

পাঁচ

সন্ধ্যা হয় হয় যদি এসো তুমি এই জলপাই তলায়।
যদি সন্ধ্যা পাড় হয়ে জোনাক জ্বলা রাত হয়, তবুও এসো।

অন্ধকারে জলপাই পাতার রঙ আরো সবুজ হয়ে জ্বলে।
আমার জন্য না হলেও তবুও এসো জলপাই তলায়।

অন্ধকারে সবুজ আলো দিনের চেয়ে আলোকিত হয়
এই অন্ধকার এই ঝিঝি ডাকা জলপাই তলায়।

ছয়

এমন পেলব গোল পাথর সহজে পাওয়া যায় না।
চলতি পথে কত পাথরই তো পায়ের কাছে
পায়ের নীচে পড়ে থাকে এখানে সেখানে।

কে আর ব্যস্ততাকে থামিয়ে ভীড়ের মাঝে উবু হয়ে
পাথর কুড়ায়? উজ্জ্বল ছাই রঙের পাথর হাতে তুলে
নিতেই কেমন যেন কোমল তুলতুলে মনে হলো।

পাথর তো পাথর—ভারী পাথর—ভারে আঙুল গলিয়ে
ফস্কে মাটিতে পড়ে যাওয়ার নামই তো পাথর। তাই না?
এ আবার কেমন পাথর!পেলব গোল ছাইরঙের পাথর।

যেন পশমের তোয়ালে আলতো করে গালে ছুঁই
যেন নীল জলে ভাসমান সমুদ্রের ফোলানো ফেনা।
যেন শূন্যে থাকা পেঁজা তুলার উড়ন্ত মেঘদল।

সাত

চারটি সবুজ পাতার ডাল বাতাসে একটু একটু করে দুলছে।
স্নাত ভেজা পাতা একবর্ষা ধরে রেখেও রোদের হল্কায়

একটু ভারিক্কি পোয়াতি শরীর আমাকে দেখে আমার হাতে
রাখল নির্ভার হাত।তৃষিত ফ্যাকাশে ঠোঁট এখনো ভারি—

কথা জড়িয়ে আসছে দেখে আমি আলতো করে হাত রাখলাম
পাতায় পাতায়।শিহরিত পাতা আমার স্পর্শে পুলকিত হলো

প্রিয়জনের কাঁধে যেমন মাথা রাখে নিকটতম প্রিয়জন
ঠিক তেমনে করে নয়নতারা সমস্ত স্নাত পাতার ভারিক্কি শরীর

আমার কাঁধে আমার কোলে ঢেলে দিলো দীর্ঘ অনুপস্থিতর
শরীর।শরীরে শরীর জড়ালে কিংবা আছড়ে পড়লেই বুঝি

শরীর এক উপস্থিতির শ্রেণিকক্ষের নাম।এইখানে এখন এটি
সরবতা আর নিরবতার ক্রসরোড—আড়াআড়ি যাপনের ঘর।

ছোট্ট গোলাপি রঙের থোকা থোকা নয়তনরা ফুটে রয়েছে
বাঁকা চারটি ডালে আকাশের দিকে পাঁচটি পাপড়ি মেলে।

আরেকটি ডাল কে যেন ব্যক্তিগত ঈর্ষায় গতরাতে মুচড়ে দিয়েছে।
সেও ভাঙা হাতের মতো কাৎ হয়ে ঝুলে আছে মাটির দিকে চেয়ে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!