আমরা মানুষ হবো কবে?

আমার এলাকাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। এক স্থানীয়- যারা বাপ-দাদার আমল থেকেই এই এলাকার বাসিন্দা। আর দুই হল- যারা ১৯৪৭ সালের পর বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের পর বিনিময় করে এদেশে এসেছেন। এই দুই ভাগের দ্বিতীয় ভাগকে এলাকাতে বলে রিপুজি (রিফিউজি), কখনও কখনও ইচ্ছাকৃতভাবেই বলেই নিপুজি। রিফিউজি শব্দের মানে বুঝবার আগে পর্যন্ত আমরা এটাকে এক ধরনের গালি হিসাবে মনে করতাম এবং শুনতে শুনতে এতটাই অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম, এটাকে খুব বেশি দোষাবহ মনে করতাম না। অন্যদিকে এই দ্বিতীয়ভাগের মানুষেরা প্রথম দলকে বলতেন বসেন্দা (বাসিন্দা)। এই দুই দলের মধ্যে যে একটা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব ছিল, সেটা বেশ পরিস্কার বোঝা যেত। দ্বিতীয় দলের একটা বিষয় খেয়াল করেছি, এরা সাধারণত এলাকার অন্য মানুষদের সাথে কোনো রকম বিবাদে জড়াতেন না। জাতীয় কিংবা স্থানীয় রাজনীতির সাথেও তুলনামুলকভাবে এদের সম্পৃক্ততা কম। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অংশের কেউ কেউ নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া এদের কোনো ব্যাপারে অতি উৎসাহ দেখি নাই। যাকে বলে সাতে নাই, পাঁচে নাই ধরনের জীবন যাপন। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম, যখন আমাদের গ্রামে মামাবাড়িতে থেকে পড়াশুনা করা একটা ছেলে, বলা যায় মামাদের এবং স্বজনদের একাংশের অবহেলার শিকার হয়ে ধর্মান্তরিত হবার ঘোষণা দেয়, তখন ছেলেটিকে ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে এই সাতে পাঁচে না থাকা মানুষদের একাংশের উৎসাহ দেখে। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটা আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা।

কয়েক দিন খোদ ঢাকা শহরের একজন স্কুল শিক্ষকের সাথে আলাপের সময় জানলাম, তার স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সন্তানের বেতন মওকুফসহ কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, কারণ তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন। বাগড়া বাধিয়েছেন স্কুলের এক কর্মচারী, যিনি প্রধান শিক্ষককে বলছেন, স্যার আপনি যে ওই লোককে এত সুযোগ সুবিধা দ্যান, হ্যায় তো অহনও নিজের নাম পরিবর্তন করে নাই। প্রধান শিক্ষকের কাছে মনে হয়েছে, তাই তো… সমস্যা তো গুরুতর! তিনি ওই লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করছেন, এই আমি আপনার জন্য এত কিছু করি, আর আপনি এখনও নাম পরিবর্তন করেন নাই? লোকটার ব্যাখ্যা হল, তিনি নাম পরিবর্তন করলে তো তার বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন, তাই একটু দেরী করছেন। আমার পরিচিত শিক্ষকের কাছে এই গল্প শুনে আজ থেকে বিশ বছর আগে আমার এলাকার দীর্ঘদিনের পরিচিতদের একাংশের একই বিষয়ে অতি উৎসাহ দেখে যতটা অবাক হয়েছিলাম, এবার সেটা হইনি। কিন্তু কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছি, বিমর্ষ হয়েছি, একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান, একটা প্রতিষ্ঠান প্রধান কিভাবে এই কাজ করতে পারেন, যাদের উপর, যে প্রতিষ্ঠানের উপর আমাদের আগামী প্রজন্মের মনোলোক গঠনের দায়িত্ব অর্পিত। আমার মনে পড়ে বছর দুই-তিন আগে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক অনুজ ধর্ম পরিবর্তন করে ফেসবুকে স্টাটাস দিয়েছিলেন, স্বেচ্ছায় বুঝে শুনে ধর্ম পরিবর্তন করেছি, দয়া করে কেউ কোপাতে আসবেন না। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন-পুরাতন সকল শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে শুরু করেন, সেটা দেখে। মনে হল, আমার সেই অনুজ চন্দ্র জয় করে ফেলেছেন। তাহলে শুধু স্কুল কেন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবর্ত্রই একই অবস্থা।

মাস খানেকও পার হয়নি, ঢাকা থেকে দূরবর্তী একটা জেলার একটা প্রত্যন্ত উপজেলা সদরে এসেছি পেশাগত কাজে। সকাল সাড়ে দশটার দিকে গেছি, সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করতে। আগে থেকেই উনার সময় নেওয়া ছিল। গিয়ে দেখি তিনি ভীষণ ব্যস্ত। দরজার বাইরে কর্তব্যরত গার্ডকে আমাদের সময় নেওয়া আছে, সেটা উনাকে বলতে বললাম। গার্ড কিছুক্ষণ আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে, আমাদের ধারণা উনাকে কিছু না বলেই আমাদেরকে এসে বললেন, আপনারা পেছনের দরজা থেকে ঢুকে ভেতরে গিয়ে বসেন। বুঝলাম, তাতে যদি আমরা উনার নজরে পড়ি। আমরা গিয়ে বসলাম, কিন্তু উনি কোনোভাবে আমাদের উপস্থিতিকে আমলে না নিয়ে উনার সামনে বসা লোকদের সাথে নানা আলাপে ব্যস্ত। আমাদের তো ভেতরে বসে উনাদের আলাপ শোনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নাই। যেটুকু বুঝলাম, কাল এখানে জেলা প্রশাসক পরিদর্শনে আসবেন, সেইটার প্রস্তুতি চলছে। স্যারকে কি কি খাওয়ানো হবে। আনারসের সাইজ যেন এমন হয়, যাতে কাটা চামচে একবারে মুখের মধ্যে ঢুকে, পেয়ারা আর আমড়া কুচি কুচি করে কাসুন্দি, এক চিমটি চিনি, একটু তেতুল মিশিয়ে কিভাবে করতে হবে সবই ইউএনও মহোদয় বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এর মধ্যে অফিসের বাইরে আমজনতার মধ্য থেকে যারা দুই-একটা কাজে আসছেন, তাদের সাথে চিরাচরিত কথিত সরকারি কর্মকর্তাসুলভ আচরণের বাইরে খুব আন্তরিকতা কারো প্রতিই দেখলাম না। হঠাৎ একজন ২০/২২ বছরের যুবক এসে উনার পাশে দাঁড়ালেন এবং তার হাত থেকে একটা আবেদন নিয়ে ইউএনও অফিসেরই একজন ইউএনও’র হাতে দিয়ে বললেন, স্যার এইটা হচ্ছে ওই কেইস। আপনারে বলছিলাম না? নও মুসলিম। উনার একটা ঘর দরকার। এবার মনে হল, ইউএনও একটু কোমল দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকালেন। তোমার কি ঘর চাই, নাকি জমি চাই? জমি হলে আমি যাবার আগেই ব্যবস্থা করে যাব, ঘর পেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে এবং এতক্ষণ আমজনতা যারা সেবা নিতে এসেছেন, তাদের মধ্যে শুধুমাত্র এই যুবককেই তিনি বসতে বললেন। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাকে তিনি অনুরোধ জানালেন যেন ছেলেটি একটা ঘর পায়, সেটা দেখার জন্য। গার্ডকে ডেকে আবেদনের একটা কপি দ্রুত সহকারি কমিশনার (ভূমি) অফিসে পাঠাতে বললেন। যুবকটি পৌরসভার মধ্যে জমি কিংবা ঘর চান। সেটা যে হবে না, সেটাও তাকে বুঝিয়ে বললেন ইউএনও। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই দাবী যদি অন্য কোনো ভূমিহীন মানুষ করতেন, তাহলে এই ইউএনও মহোদয়ের প্রতিক্রিয়া কি হতো?

উনার সাথে আমাদের যে কাজ তাতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগার কথা। আমরা যেহেতু কোনোভাবে উনার নজরে আসছি না, তাই নিজেরাই বললাম, আপনার সাথে কথা হয়েছিল, আজ সকালে সময় দিতে চেয়েছিলেন। উনি বললেন, যা বলার পাঁচ মিনিটেই বলতে হবে এবং আমার কাজের মাঝেই কথা বলতে হবে। আমরা কথা বলে বেরিয়ে আসার পর আমার সঙ্গীদেরকে বললাম, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পাবার ক্ষেত্রে নও মুসলিম কোনো ক্যাটাগরি আছে নাকি? ইউএনও মহোদয় তো লোকটাকে একবার জিজ্ঞেসও করলেন না যে তার জমি আছে কিনা?

আমার সঙ্গীদের একজন বললেন, শুনলেন না, উনার হয়ে ইউএনও অফিসের যিনি ওকালতি করছেন তিনি বললেন, পৌরসভার মধ্যে হলে আবেদনকারীর পক্ষে ভাল হয়। কারণ তার বাড়ি পৌরসভা সংলগ্ন। আমি হয়ত শুনতে ভুল করেছি।

আমার সেই অজ পাড়াগাঁয়ের পরিচিতজনদের একাংশ, ঢাকার একটা প্রাচীন প্রতিষ্ঠান প্রধান, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীবৃন্দএবং একটা উপজেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রধান, এঁদের সকলেরই মনোলোকে এই ধারণা বদ্ধমূল নিজধর্মের একজন অনুসারী বাড়ানো হল পূণ্যের কাজ/ সওয়াবের কাজ। অথচ, এঁরাই বঙ্গবন্ধুর চেতনার কথা বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলেন। এগুলি কেবলই তোতাপাখির বুলি, না বুঝেই বলেন। আমার মনে হয় হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান হওয়া খুব সহজ কাজ। জন্মসূত্রে কিংবা ধর্ম পরিবর্তন করে একটা ধর্মের অনুসারী হলে তার শরীরে সেই ধর্মের সিল পড়ে যায়। কঠিন কাজ হল মানুষ হওয়া। কথিত আছে, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণি, যাকে প্রতিদিন মানুষ হয়ে উঠতে হয়। আমাদের শুধু ডিজিটালে পোষাচ্ছে না, আমরা স্মার্টও হতে চাচ্ছি। কিন্তু মানুষ কি হয়ে উঠতে পারছি? আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে কৃষি জমিতে ঘর উঠিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ছি। অনিকেত মানুষের আশ্রয় নিশ্চিত করার চেয়ে আমার জেলায় কতগুলি ঘর উঠল, আমি সবার আগে ভূমিহীন মুক্ত জেলা কিংবা উপজেলা হিসাবে নিজের কর্ম এলাকাকে ঘোষণা করতে পারব কিনা এগুলিই যখন বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে এই ঘটনা তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু আমি বিষয়টাকে আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ হল সমাজ এবং রাষ্ট্র- এই একটা ইস্যুতে এক কাতারে। নিজধর্মের অনুসারী বাড়াতে হবে। মানুষকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার, মানুষের মত বাঁচতে দেবার জন্য আমাদের কোনো উদ্যোগ নাই। আমরা দারুণ উৎসাহী নিজধর্মের অনুসারী বাড়াতে, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে। এটা শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়; এইটা এখন আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সমস্যা বটেও। নিজের চারপাশ, দেশ, এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে বাইরের বিশ্বের দিকে তাকালে মনে পড়ে গণসঙ্গীত শিল্পী শুভেন্দু মাইতির সেই গানের লাইন “ধর্ম এখন মানুষ খাচ্ছে”। একটু চোখ কান খোলা রেখে মুক্তদৃষ্টিতে পৃথিবীর দিকে তাকালে আমরা দেখব, ধর্মীয় উন্মাদনা যেখানে যত কম, সেখানকার নাগরিকেরাই কিন্তু সবচেয়ে ভাল আছেন। বিপরীত উদহারণ না দিয়ে বরং বলি, আসুন, ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে আমরা বরং মানুষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করি, ধর্ম থাকুক ব্যক্তিগত চর্চার জায়গায়। তাতেই সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণ নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়।♦

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!