আমার দেখায় আমার বাংলাদেশ: পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি

পদ্মা সেতু দেখে বাসে চেপে বসলাম ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে। ফুরফুরে মেজাজে বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি অবারিত সবুজের হাতছানি। মাইলের পর মাই জুড়ে ধান আর সবজির ক্ষেত আর তার মাঝ বরাবর পীচঢালা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে আমাদের বাস। অল্প সময়ের মধ্যেই ফরিদপুর পৌঁছে গেলাম। বাস থেকে নেমে পড়লাম আমরা, এরপরে একটা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলাম সবাই। সেখানে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের ভোজন পর্ব সেরে নিলাম। ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর রেলষ্টেশনের উত্তরে কুমার নদের দক্ষিণ পাশে তাম্বুলখানা গ্রামে পল্লী কবির বাড়ী অবস্থিত। ১৯০৩ সালে এই বাড়িতেই কবি জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে কবি’র বাড়ি মাত্র দুইকিলোমিটার পথ। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা, অটো বা বাইকে চেপে দিব্যি চলে যাওয়া যায়। আমাদের জন্য নির্ধারিত বাস থাকায় আমরা বাসে চেপেই রওনা হলাম পল্লীকবি জসীমউদীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাস এসে থামল কবি’র বাড়ির সামনে। প্রথমেই চোখে পড়ল কবি জসীমঊদ্দীনের ছবি। বাড়ির ফটকে নক্ষত্র ভাস্কর্য ও মৃৎশিল্প প্রতিষ্ঠানের নির্মিত কবি জসীমউদ্দীনের ম্যুরাল। ফটক টপকে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। ফটক পেরিয়ে বামপাশে রয়েছে চা-কফির দোকান। কেউ চাইলে এখানে চা-কফি পান করতে করতে খানিকটা সময় জিরিয়ে নিতে পারে। কবি’র বাড়িতে প্রবেশ করতে হলে এই দোকান থেকে সংগ্রহ করতে হবে জনপ্রতি কুড়িটাকার বিনিময়ে টিকেট। কবির রচিত বই সংগ্রহ করতে চাইলে এখান থেকেও কেনা যেতে পারে। আমরা প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে টিকেট সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। এরপরে চোখে পড়ল চারটি টিনের ঘর, এই ঘরগুলোই আসলে বসত ঘর। কবি পরিবার নিয়ে এই ঘরেই বসবাস করতেন। বর্তমানে কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র আর কবি সহ পরিবারের সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের একের পর এক ছবি টাঙ্গানো রয়েছে। বাড়ির চত্বরে কবির বিভিন্ন লেখা সম্বলিত বোর্ড প্রদর্শন করা রয়েছে। নদীর সামনে দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে। বাড়ীর প্রতিটি ঘরে রয়েছে কবির স্মৃতি। যেদিকে তাকাই কল্পচোখে ভেসে ওঠে কবির জীবন্ত অবয়ব। কবি কথা ভাবতে ভাবতে হারিয়ে গেলাম যে এক ভিন্ন সময়ে অদেখা জগতে।

কবির বাড়ির সামনে মোঃ হুমায়ন কবির খান।

বাংলা সাহিত্যে ষাণ্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত কবর কবিতাটি পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের এক অসামান্য অবদান। বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে কবর একটি অন্যতম স্থান অধিকার করে আছে। ‘ড্রামাটিক মনোলগ’ (dramatic monologue) এই কবিতায় কবি একজন গ্রামীণ বাংলার বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীমউদ্দীন খুবই দক্ষ বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯২৫ সালে (১৩৩২ বঙ্গাব্দ) বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ‘কল্লােল পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপরে ১৯২৭ সালে (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) কবিতাটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’তে অন্তর্ভুক্ত হয়। কথিত আছে, কবি যে ঘরে থাকতেন- সেই ঘরের বহির্গমন সিড়ির পাশে ছিল দুটি লেবুগাছ, আর লেবুগাছ দুটির মাঝখানে একটি ডালিম গাছ ছিল। কবির ‘কবর’ কবিতাখানি লিখেছিলেন এই ডালিম গাছকে কেন্দ্র করেই। বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে অন্যতম। তিনি কবর কবিতাটি রচনা করেছিলেন মাত্র বাইশ বছর বয়সে।

কবির বাড়িতে ব্যবহৃত ঢেঁকি।

‘পল্লীকবি’ উপাধিতে ভূষিত জসীমউদ্দীন আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ আধুনিক কবি। তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ আখ্যানকাব্যটি কুমার নদের পাড়ে এই বাড়িতে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন। রুপাই ও সাজু নামক দুজন গ্রাম্য যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী। কাব্যে রূপায়িত এই চরিত্র দুটি কাল্পনিক নয় বরং এই দুজনই ছিলেন বাস্তব চরিত্র। কাব্যে বর্ণিত রুপাই ছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামের জনৈক রুপা নামের এক যুব্ক। আর সাজু চরিত্রটি ছিল রুপার পাশের গ্রাম মশাখালির বাসিন্দা ললীতা।রুপা ও ললীতা একে অপরকে ভালবাসতো। কবি যখন ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র সংগ্রাহক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের কথায় ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করতে গফরগাঁও গিয়েছিলেন তখন রুপার সাথে পরিচিত হন। পরে ১৯২৯ সালে সেই রুপা ও ললীতার কাহিনীকে উপজীব্য করে রচনা করেছিলেন নকশী কাঁথার মাঠ।

কবির রচিত বহুলপঠিত এবং বিদেশি ভাষায় অনুদিত বই ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ১৯৩০ সালে কুমার নদের পাশে এই বাড়্রিতে বসে রচনা করেছিলেন। গ্রাম বাংলার অপুর্ব অনবদ্য রূপকল্প ‘সোজন বাদিয়া ঘাট’ শিমুলতলী গ্রামের হিন্দু মেয়ে দুলি আর মুসলমান ছেলে সোজন এর মধ্যকার অসম প্রেমের কাহিনীকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে। ‘নমুদের কালো মেয়ে’, ‘নীড়’, ‘পলায়ন’, ‘পূর্ব্বরাগ’, ‘বেদের বহর’, ‘বেদের বসাতি’ নামে মোট ছয় পর্বে রচিত এই কাব্যগ্রন্থটি বিগত জমিদারি আমলের সামন্ততান্ত্রিক নিষ্ঠুরতার চালচিত্র- যা ১৯৩৩ সালে কবি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে রচনা করেন। ‘সোজন বাদিয়া ঘাট’ সম্পর্কে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘তোমার সোজন বাদিয়ার ঘাট অতীব প্রশংসার যোগ্য। এই বই যে পাঠক সমাজে আদৃত হবে সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নাই।’


কবির স্মৃতি সম্বলিত এই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে প্রথমে চোখে পড়ে ঢেঁকিঘর। এখানেই কবির বাড়ির লোকেরা ঢেঁকিতে ধান ভানতেন্‌চাল কুটতেন। প্রথম ঘরটিতে প্রবেশ করে দেখতে পাই কবির পারিবারিক ছবি। স্ত্রী মমতাজের সঙ্গে কবির ছবি। এরপরে কবির পুত্র হাসু, আমিন, কবি পত্নী মমতাজ জসীম এর সঙ্গে ছোট ছেলে বাবু, কবির নাতি নকশী, আমিন, আরিফ ও নাতনী মধুবালার ছবি টাঙ্গানো রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে দেশী বিদেশি বিখ্যাত সব লোকেদের ছবি। আরও রয়েছে কবি ও তার পরিবারের ব্যবহৃত পোশাক ও গৃহকর্মে ব্যবহৃত আসবাবপত্র। পাশেই রয়েছে কবির ডায়েরী, পুরুস্কার সহ বাচ্চাদের খেলনা দিয়ে সাজিয়ে রাখা আছে ঘরগুলো।

হাসু ও বাঁশুমনির স্মৃতিঘর।

এরপরে আছে কবির পুত্র হাসু ও বাঁশুমনির স্মৃতিঘর। এই ঘরটির বেড়ায় সাথে টাঙ্গানো রয়েছে কবির লিখিত কবিতা- তার মধ্যে ‘আসমানী’, ‘নিমন্ত্রন’, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে। এই ঘরের ভেতরে আছে পালকি, মাটির হাড়ি মাটির কলস, ব্যবহৃত ড্রেসিং টেবিল ও আসবাব সহ কবির আত্মীয়-স্বজনদের ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে।

আনসারউদ্দীন স্মৃতিঘর।

কবির পিতা আনসারউদ্দীন স্মৃতিঘর। এ ঘরটি সাজানো আছে কবির বংশলতিকা ও পূর্ব পুরুষের ব্যবহৃত আসবাবপত্র দিয়ে।

বাড়ির উত্তরে রয়েছে পারিবারিক কবরস্থান। এখানেই ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ থেকে এই ডালিম গাছের তলে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন কবি। এর পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে যাওয়া যায় কুমার নদের তীরে…

কবির বাড়ির কবর।

কবির জাদুঘর ঘুরেফিরে দেখে কুমার নদের আশেপাশে খানিকটা হেঁটে বের হয়ে এলাম গেটের বাইরে। সন্ধ্যা নামতে এখনও অনেক দেরী। ভাবছি বাড়ি ফেরার পথে আর কোথায় থামা যায়!

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!