টেবিলে ব্যাগটা রাখবার কিছু সময় পরেই নিজের বোতলটা বের করে আধ বোতল জল শেষ করে দিলেন অলোকাম্যাডাম। এমনটা যে রোজ করেন তা নয়, তবে আজকে লিফ্টের কি একটা অসুবিধা হয়েছে, দু’তলা থেকে এই চার’ তলা পর্যন্ত সিড়ি দিয়ে উঠে আসতে হল। বয়স হচ্ছে, এবার একটু বেশিই হাঁপ লাগছে।কয়েকদিনের মধ্যে একবার ডাক্তার বোসের কাছে যেতে হবে। মেয়ের কথা ভেবে সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই অলোকাম্যাডাম নিজের চেয়ারে বসে চারদিকটা একবার দেখে নিলেন। অনেক টেবিলই এখন ফাঁকা। চেয়ার থেকে উঠে গোবিন্দ এসেছে কিনা খোঁজ করলেন। না, ঐ মহাশয়েরও পাত্তা নেই, অন্য কোথাও ফাইফরমাশ খাটতেও যেতে পারে। ম্যাডাম আস্তে আস্তে নিজেই বোতলে জল ভরতে গেলেন। চেয়ারের কাছে আসতে যাবেন এমন সময় অন্য প্রান্ত থেকে কাবেরি হাত নাড়ার সাথে বেশ জোরেই চিৎকার করে উঠল, ‘অলোকাদি, আসছি, দারুন খবর আছে।’
মেয়েটা কয়েক বছর হল এখানে জয়েন করেছে, আগে অন্য কোন এক ডিপার্টমেন্টে ছিল। বেশ চনমনে, এর মধ্যে দুটো ডাইভোর্স হয়ে গেছে, এখন একটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথে তৃতীয় বিয়ের জন্যে তৈরী হচ্ছে। কারোর খাতির করে না, এক্কেবারে মুখের সামনে বলে দেয়, এই জন্যেই অফিসের আর কেউ তাকে ঘাঁটায় না। তবে অলোকাম্যাডামের সাথে বেশ ভালোই সম্পর্ক, কয়েকবার তার বাড়িতেও গেছে। ঘটনাটার পরে…
-তোমার পাশে বসে বলতে হবে, দারুন খবর।
কথাগুলো শেষ করবার আগেই অলোকাদির টেবিলের পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে যায়। তারপর চারদিকটা দেখে বলে, ‘কিছু কি শুনেছো?’
–কি ব্যাপারে বলতো?
–এই সুমনার ব্যাপারে?
অলোকাম্যাডাম বেশ অবাক হন, ‘সুমনা মানে নিচের তলায় ডেসপ্যাচে বসে, গড়িয়ার দিক থেকে আসে?’
-হ্যাঁ গো।
–ওরও তো স্বামীর চাকরি, বেচারি, খুব অল্পদিনই বিয়ে হয়েছিল।
– হ্যাঁ।এখন এক্কেবারে ফেমাস হয়ে গেছে, কাল একটা টিভিতে ওর ইন্টারভিউ দেখিয়েছে।
-ইন্টারভিউ! কেন?
–আরে সেটাই তো বলছি।
।।দুই।।
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।বাবা মা আর তাদের একমাত্র মেয়ে শর্মিষ্ঠা, আদরের ঘুড়ি, এই তিনজনের সুখের সংসার ছিল। বাবা সরকারি চাকরি করতেন, টাকার প্রাচুর্য না থাকলেও বেশ ভালো ভাবেই চলে যাচ্ছিল। মেয়ে ইংরাজি মিডিয়ামে না পড়লেও শহরের নামি সরকারি স্কুলেই পড়ত। একদিন রাতে খেয়ে উঠে বাবার বুকে ব্যথা, হাসপাতালে নিয়ে যাবার রাস্তাতেই শেষ।তারপরেই মায়ের আরম্ভ হল আরেক যুদ্ধ, সেটা এখনো চলছে, মাঝখানে এখন আরেকটা লড়াইও এসে জুটেছে।
বাস থেকে নেমে টোটোতে সুমনার বাড়ি আসার রাস্তায় এই সব কথাগুলো অলোকাম্যাডামের মাথার মধ্যে কিড়মিড় করতে আরম্ভ করেছিল। ‘মেয়েদের ভেতর একটা আলাদা শক্তি থাকে, যে কোন স্থানে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে, যারা পারে না তাদের কপালে চরম দুঃখ নেমে আসে।’ কথাগুলো বারান্দায় বসে বসে ঠাকুমা প্রায় বলত।এখন এই সব কথা কাউকে বললে উল্টোপাল্টা কথা শোনাবে। ঘুড়ির এই রকম অবস্থা ছিল, এই সব কথা বললে রেগে উঠত।
টোটোতেই ফোনটা রিঙ্গ হয়।অলোকাম্যাডাম ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতেই দ্যাখে ‘সুমনা কলিং’।ফোনটা রিসিভ করতেই লোকেশন বলে দেয়।
।।তিন।।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই অলোকা খুব অবাক হয়ে যান। দরজাটা সুমনাই খুলেছে। ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার সাথে আর কেউ থাকে না?’
–আর কে থাকবে ? অশোক মারা যাবার পরে মা কয়েক মাস ছিল, তারপর থেকে আমি একা।শোকটা নিতে পারল না, প্রথমে বাবা তারপর মা, ঐ ছয় মাসের গ্যাপ।
–কিছু অসুবিধা হলে ?
–এই কমপ্লেক্সে একটা প্রাইমারি হেল্থ সার্ভিস আছে, যে ডাক্তারবাবুর আণ্ডারে আছি, তাঁর ফোন নম্বরও নিয়ে রেখেছি।
-কিন্তু আর কয়েকদিন পরে তো..
-তখন একটা আয়াকে রেখে দেবো। কথাবার্তা বলা আছে।
–তোমার তো এখন বেড রেস্ট দরকার ?
–ওভুল্যেশনের পরে পজিটিভ হল, দু’সপ্তাহ একটু সাবধানে থাকতে বলেছিল, আমি তিন’সপ্তাহ বেডরেস্ট নিয়েছি। আমার আবার একটা প্রোজেস্টেরণ হরমোন ট্রিটমেন্ট হল, অশোক বেঁচে থাকতে একটা মিসকারেজ হয়েছিল। তাই ডাক্তারবাবু আর রিক্স নেন নি এখন তো মাঝে মাঝেই ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে। সিক্স উইকে একটা ইউ.এস.জি আছে, এইট উইকে একটা ইউ.এস.জি আছে, তারপর আস্তে আস্তে এন.টি স্ক্যান, ডবল মার্কার, এই সব চলতেই থাকবে।
-বাবা! এতো কিছু, আমাদের সময় এতকিছু ছিল না।
-এখন ডাক্তাররা যেভাবে ভাবছেন।
-আমি কাবেরির কাছে তোমার কথা পরশুই জানতে পারি। এই রকম একটা ঘটনা যে এই দেশে হতে পারে এটাই তো ভাবতে পারছি না।
অলোকাম্যাডামের কথাগুলো শুনে সুমনা একটু হেসে ওঠে।
“কাবেরি দিও জানতে পারত না, নেহাৎ সে দিন টিভিতে আমার সাক্ষাৎকারটা দেখতে পেয়ে গেছিল, তারপরেই ফোন করে। না হলে আমি অফিসেও কিছু বলিনি। সবাই জানে শরীর খারাপ।”
–তোমার সাহস আছে, আগে তোমার সাথে সেরকম কথা হয় নি। কাবেরি তোমার কথা বলতেই প্রথমে খুব অবাক লাগছিল, আমার পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলা আই. ভি. এফ এ ট্রাই করলেন। কিন্তু সাকসেশ হল না।
-সাকশেস রেট তো খুব কম, সারা দেশে তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ, বয়েস কম হলে মেরে কেটে চল্লিশ। তাও তো এখন অনেকটা বেড়েছে। প্রসেসটাও তো খুব জটিল, সম্ভবত চারটে স্টেপ আছে। (কিছু সময় থেমে) আচ্ছা তুমি তো আবার বিয়ে করলেই পারতে।
সুমনা কথাগুলো শুনে কোন উত্তর না দিয়ে কিছু সময় চুপ করে বসে থাকে। এই সময় অলোকা ম্যাডাম সুমনার ফ্ল্যাটের চারদিকটা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নেয়। টু’বিএইচকে, তবে বসবার জায়গাটা এক্কেবারেই ছোট নয়, একটা সোফা আর টি’টেবিলের পর আরো কিছুটা জায়গা থাকছে। একদিকের দেওয়ালে একটা বাচ্চার ছবি টাঙানো আছে।
-কফি করি? এই প্রথম আমার ফ্ল্যাটে এলে। আমার বিয়েতেও তুমি আসতে পারো নি।
–না, কার একটা বিয়ে ছিল। তুমি বরং একটু বোস, আমাকে দেখিয়ে দাও, আমি করে নিচ্ছি।
আবার হেসে উঠল সুমনা। ‘আজ এখন করবে, তারপর কাল, পরশু? ছাড়ো এই সব টুকটাক কাজ আমি করে নিতে পারবো। সব কিছু ঠিক থাকলে ডাক্তারবাবুর সাথে কথা বলে সামনের সপ্তাহ থেকেই অফিস জয়েন করব।
–অফিস! তোমাকে দেখেই তো সবাই অবাক হয়ে যাবে।
-হত, কিন্তু টিভিতে দেখানোর সবাই জেনে গেছে। কয়েকটা ম্যাগাজিনেও ফিচার বেরোবে। অফিসের অনেকেই ফোন করে জিজ্ঞেস করল। তমালবাবুকে চেনো? অ্যাকাউন্টসে বসেন, উনি নিজে ফোন করেছিলেন, পরে বৌদিও ফোন করেছিলেন।
–ওনাদেরও মনে হয় কোন ইস্যু নেই না?
-না। অনেক টাকা খরচ করেছেন। কিছু টাকা লোনও হয়েছে।
–আমিও তো ঐ জন্যেই এসেছি।
-তোমার তো মেয়ে আছে।
-মেয়ের তো কেউ নেই।
শেষের এই কথাগুলোর পরে ফ্ল্যাটের ভেতরটা একটা চাপা শূন্যতা গ্রাস করে নিল। কিছু সময় দুটো মানুষ শুধু দুজনের শ্বাসের শব্দ শুনেই কাটিয়ে দিল।
–তুমি নিজে তো আবার বিয়ে করতে পারতে।
কিছু সময় চুপ থেকে অলোকদি জিজ্ঞেস করলেন।
-আর সম্ভব নয় দিদি। একটা মানুষকে ভালোবেসে বিয়ে করলাম। প্রথমে তো আমার বাড়ি থেকে মেনে নেয় নি, আমি কিন্তু বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। মানুষটা তো কোন কষ্ট দেয় নি, আমার ভাগ্যে সুখ নেই, কি আর করা যাবে, এখন বিয়ে করলে শরীর আর মন মেশাতে পারবো না, তাতে একজনের সাথে বেইমানী করা হবে। এটা অবশ্য আমার নিজের বিশ্বাস। অনেকেই এখন এই সব ছেঁদো সেন্টিমেন্টেকে বিশেষ পাত্তা দেয় না।
-তুমি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সব কিছু করলে না কেন?
–গেছিলাম দিদি। এই শহরের সব বড় বড় সেন্টারে কথা বলেছি। যে টাকাটা ট্যারিফ বলল সেটা এই মুহূর্তে বিয়ার করতে পারবো না। তুমি মনে হয় জানো না, অ্যাক্সিডেন্টের পরে ও পনেরো দিন কোমাতে ছিল। সেই সময় অনেকটাকা খরচা হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কে প্রায় কিছুই নেই, তার উপর এই ফ্ল্যাটের ই.এম. আই, সব কিছুর মধ্যে খুব চাপে আছি।
কথাগুলো বলবার সময়েই সুমনা কফি তৈরী করছিল।তারপর একটা ছোট প্লেটে কফি আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে ড্রয়িংরুমের টি-টেবিলের উপর রাখল।
কফিতে একটা চুমুক দিয়ে সুমনা একটা শান্তির শ্বাস ছাড়ল। “ভেবেছিলাম বাকি জীবন একাই কাটিয়ে দেবো, একটা অনাথ আশ্রমে যাতায়াত আরম্ভ করেছি, সেই মতই মানসিক প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ফেসবুকের একটা লিঙ্কে খবরটা পাই। যদিও ব্যাপারটা বিদেশের, এবং সেই ভদ্রমহিলার হাসবেণ্ড বেঁচে ছিল, তাও এই কিট কিনে ডোনার নিয়ে আবার প্রেগনেন্ট হয়েছিলেন। আমিও চেষ্টা আরম্ভ করলাম।”
-ঐ সব এখানে পাওয়া যায়?
-ও ইনসেমিনেসন কিটস! হ্যাঁ হ্যাঁ। এখন সব অনলাইনে পাওয়া যায়। এটাকে মোসি কিটও বলে। বাইরে ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় কিনা বলতে পারবো না, আমি তো অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ছিলাম। অলোকাম্যাডাম কিছু সময় আবার চুপ করে গেলেন। এমনকি হাতে থাকা কফির কাপটাও স্থির হয়ে গেছিল।
‘আমার মেয়েটার হবে..?’
এবার সুমনা বেশ চমকে উঠল। ‘হ্যাঁ, না হবার তো কোন কারণ নেই।’
একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন অলোকাম্যাডাম, ‘তুমি ভুলে গেছ, আমার মেয়েটার কিন্তু দুটো পা নেই। হুইল চেয়ারে চেপেই ঘুরে বেড়ায়। এখনো কিছু ব্যবস্থা করতে পারিনি। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি, এই বুঝি কিছু করে দেয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার সুইসাইড করবার চেষ্টা করেছে। এখন দিনের বেলা একজনকে আয়া হিসাবে রাখতে হয়েছে। কাউন্সিলিং করালাম, কুকুর পাখী পোষার কথাও বললেন, তবে বাচ্চা হলে আরেকটু ভালো হয়। ঐ আয়া ভদ্রমহিলারও কেউ নেই, সেই রকম চার্জ নেয় না, তবে দুবেলার খাবারটা দিতে হয়।’
–ও , হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ভুলে গেছিলাম। সত্যি এই রকম দেখা যায় না। ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে কিছু বলেনি তো…
–কেন বলবে? হনিমুন করতে গিয়ে ওদের ছেলে মারা গেল, আমার মেয়ের দুটো পা কেটে গেলেও প্রাণে তো বেঁচে আছে। অতো উঁচু পাহাড় থেকে পড়ল, একই গাড়িতে পাশাপাশি দু’জন ছিল, একজন মারা গেল আরেক জন…। (আবার কিছু সময় চুপ করে) মাঝে মাঝে মনে হয় দু’জন মারা গেলেই ভালো হত।
-এই রকম কেন বলছো ? তোমার মেয়ে তো বেশ ড্যাশিবুশি। আমার মনে আছে, অফিসের সেই পিকনিকটার কথা। সেই কি একটা বাগানে হয়েছিল। তোমার মেয়ে তখন বেশ বড়, হায়ারসেকেন্ডারি দেবে, অশোক তখন বেঁচে ছিল। সেই অরূপবাবুর ছেলের সাথে কি একটা হয়েছিল। ডিসটার্ব করেছিল, তোমার মেয়ে সবার মাঝে ছেলেটাকে চড় মেরে দিয়েছিল। তুমি কত বকলে। অরূপবাবু লাঞ্চ না করেই বেরিয়ে গেছিলেন। ওর ডাক নাম মনে হয় ঘুড়ি।
–এখন দেখলে তোমার কষ্ট হবে। হুইলচেয়ারেই সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। যেদিন মন ভালো থাকে ঐ অবস্থাতেই আমার জন্যে চা করে, টিফিন বানায়, না হলে গুম মেরে বসে থাকে। প্রথম প্রথম দেখে দুজনারই খুব কষ্ট হত। এখন মনে হয় কষ্টটাকেই ও নিজের পোশাক করে নিয়েছে।
শেষের কথাগুলোর সাথে অলোকাদির ফোঁপানির শব্দও অলোকাদির কানে গেল।
-ঘুড়ির হাসবেণ্ডের চাকরির কিছু হয় নি?
-চেষ্টা করলে হয়ে যেত, কিন্তু এই রকম একজন যার দুটো পা নেই, তার কি করে কাজ হবে বল? তাছাড়া ওকে নিয়ে বারবার অফিসেই বা কিভাবে যাবো? শ্বশুর বাড়ি থেকে টাকা পয়সাও কিছু দেবে বলে মনে হয় না, উল্টে ওর নামে না না রকম অপবাদ দিচ্ছে। আমার আর এই সব ভালো লাগে না। তার থেকে মনে হয় এই ভালো আছে, তবে একটা চিন্তা তো সব সময় থাকে, আমার অবর্তমানে ঘুড়ির কি হবে?
-আবার দেখাশোনা করে বিয়ে দিয়ে দাও।
–একটা খোঁড়া মেয়ের কি অতো সহজে বিয়ে হয়? তোমার ব্যাপারটা শুনে তাই তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এবার যদি একটু গাইড করে দাও। এখানেও ভয়, যদি সাকসেস ফুল হয় তাহলে যে আসবে তারই বা ভবিষ্যত কি?
-তোমরা কোন হাসপাতালে যাচ্ছো না কেন?
–গেছিলাম, কয়েক মাস আগে ঘুড়ি কোন একটা ম্যাগাজিনে আই. ভি. এফ, আই.ইউ. আই, নিয়ে কি সব পড়ছিল। তারপর একদিন ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গেলাম।ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটাও খুব কঠীন। ওকে যে ডাক্তার দেখছিল তাকেও ব্যাপারটা জানালাম। আসলে সাধারণ ভাবে তো ওর কিছু হবে না। দুটো পায়ের থাইয়ের নিচ থেকে বাদ হয়ে গেছে। তার উপর অ্যাক্সিডেন্টের সময় একটা ওভারিতেও একটু সমস্যা হয়।
–তাহলে তুমি কিন্তু ভালো ভাবে ডাক্তারের সাথে কথা বলে এগোবে। আমাকেও ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হয়েছে, একটা সার্টিফিকেট নিতে হয়েছে।
-সে ঠিক আছে, তুমি আমাকে পুরো প্রসেসটা একবার বলে দাও।
-সে রকম কিছু না, ইনসেমিনেসন কিট অর্ডার দিলাম, ওটা পৌঁছানোর পর অনলাইনে স্পার্ম অর্ডার দিলাম।এটা একটু দেখে শুনে দিতে হবে। আই. ইউ. আই, রেডি স্ট স্পার্ম এই হোম ইনসেমিনেশনের জন্যে খুব এফেক্টিভ। আই. সি.আই. এর দু’গুন বা আই. ইউ. আই. মোটো টেন স্ট্র স্পার্মের প্রয়োজন হয়। মোটো টেন মানে প্রতি মিলিলিটারে টেন মিলিয়ন মুভিং স্পার্ম সেল। পিরিয়ডসের দিনটা একটু খেয়াল রাখতে হবে।
-অনলাইনে এটা কি সম্ভব?
-দেখো আমাদের দেশে এখনো স্পার্মের হোম-ডেলিভারি আরম্ভ হয় নি। বিদেশে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। আমি একটা সেন্টারের স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়েছিলাম। ওরা একটা খুব সুন্দর কন্টেনার করে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেছিল। আসলে স্পার্মকে ঠিক রাখতে খুব ঠান্ডা লাগে, লিক্যুইড নাইট্রোজেনের প্রয়োজন হয়, এটাই বেশ ঝামেলার। ওরা আগে আমাকে একটা ডেটা বেশ পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি একজন ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে তবে নিয়েছিলাম। আসলে ডোনারের ফ্যামিলি হিস্ট্রি, রোগ ব্যাধি এমনকি জেনেটিক স্ট্রাকচার, এডুকেশন, আই.কিউ এই সব কিছু এক্ষেত্রে খুব ম্যাটার করে। তার পর অ্যাডভোকেটের সাথেও কথা বলেছি।
–অ্যাডভোকেট!
–হ্যাঁ। আমি অ্যানোনিমাস ডোনার নিয়েছি, কিন্তু বলা যায় না, কোথা থেকে কে এসে যদি পেরেন্টহুড দাবি করে? বিদেশে এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে।
।।চার।।
সুমনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে অলোকাদির মনটা সেরকম খুশি হল না। সুমনা কি কিছু লুকিয়ে গেল, কিন্তু আর ঠিক কি লুকাবে? একটা ব্রসিয়্যর দিল। কি যেন নাম বলল মসি কিট, দামও বিরাট। কি আমড়ার জিনিস আছে, ঐ তো ছোট বাটি, তাকেই কন্টেনার বলছে, একটা সিরিঞ্জ আর চামচ। নাইট্রোজেন না কিসের যেন একটা কন্টেনার বলল।
অলোকা ম্যাডাম সব কিছু মনে করতে পারলেন না।
বাসে চেপেও ইউটিউবে ভিডিও দেখছিলেন। মেয়েটা কি একটু অন্য রকম ভাবে থাকতে পারবে? কে জানে প্রতিদিন অফিস এসে ভয়ে ভয়ে থাকে। আয়া মেয়েটাকে প্রতি ঘন্টায় ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। একা রাখতে এক্কেবারে সাহস হয় না। কিন্তু আজকালকার যুগে কেউ কি মানুষকে কোন উপকার করে ? এটা করতে গেলেও তো সাত ঝামেলা।
।।পাঁচ।।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই আয়া ভদ্রমহিলার কালো মুখটা দেখে অলকাম্যাডাম আবার ঘাবড়ে গেলেন। ‘আজ আবার কি হল?’
–কিচ্ছু খায় নি, নামেও নি। বিছানায় বসে শুধু কেঁদে যাচ্ছে। ওর দুই বান্ধবীর একজনের বিয়ে, আরেক জনের বাচ্চা হয়েছে। তোমাদের ঐ ফেসবুক না কিসে দেখে কান্নাকাটি করছে।
অলোকাম্যাডাম একটু থমকে দাঁড়ালেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতরে একটা ব্রসিওর আছে। ফোনে ভিডিওর লিঙ্ক। কিন্তু এখন কি ঘুড়ির কাছে গিয়ে সব কিছু বলা ঠিক হবে? অবশ্য বললেই তো আর…।
কিছু সময়ের জন্যে ড্রয়িং রুমের চেয়ারে বসলেন। চোখ দুটো বন্ধ করলেও রাস্তা পেলেন না। উঠে ঘুড়ির রুমে গিয়ে দেখলেন ও বিছানায় বসে কেঁদেই যাচ্ছে। পাশে আয়া দাঁড়িয়ে আছে। অলোকাদি চোখের ইশারাতে আয়াকে বাড়ি যেতে বললেন তারপর বিছানাতে বসে ঘুড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে সুমনার কথাগুলো বললেন। ঘুড়ি সব কিছু শোনবার পর চোখ দুটো বন্ধ করে কি সব ভাবল। কেঁদে কেঁদে ওর চোখদুটো কেমন যেন হয়ে গেছে। অলোকাম্যাডাম দিকে তাকিয়ে হাল্কা হেসে বলে উঠল, ‘ মা, তুমি আমার এই দুটো পা ঠিক করবার একটা ব্যবস্থা করে দাও। মা হতে গেলে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, একটা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। আজ সারাদিন এই সব ভাবলাম।’
অলোকাম্যাডাম কথাগুলো শুনতে শুনতে ঘুড়ির দুটো কাটা পায়ের মাঝের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, কি দেখছিলেন কে জানে?