গল্প: মা

ক্ষেতের আইলে হেলান দিয়ে পা গুলোকে ছড়িয়ে, কোমড়ে থাকা সিগারেটটা জ্বালায় রফিক। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবিররাঙা আকাশের দিকে তাকায়।
মার্চের ২৬ তারিখের পর দেশের অবস্থা যখন ভয়াবহ, রফিক ফজলুল হক হলের দোতলার ২০১নং রুমটাতে বন্দী। ট্রাংকে রাখা মুড়ি আর পুকুর পাড়ের আমগাছটা সঙ্গী। বন্ধুদের অনেকেই হল ছেড়ে চলে গেছে, কেউবা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে সীমান্তের ওপাড়ে, কেউ হয়তো গ্রামে। বাবা মারা যাওয়ার পর, মা রায়বাবুর বাড়িতে কাজ করে তাকে পড়িয়েছে, তাই রফিকের লক্ষ্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে মায়ের সংগ্রামী জীবনের ইতি টানা। চেষ্টা করেছে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে যতটুকু দূরে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা শেষ করা।
প্রতিরাতেই আশেপাশের কোথাও না কোথাও গোলাগুলি হয়, পাকিস্তানি আর্মিদের কাজই এখন ঢাকা শহর খালি করা, এখানে মানুষ আছে নাকি নিম্নস্তরের কোনো প্রাণি সেটা তারা পরীক্ষা করার প্রয়োজনও মনে করছে না। আজব ব্যাপার যে রফিক একটা সময় আওয়ামীলীগের কার্যক্রমগুলো নৈরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হতো, তার চিন্তায়ও কেনো জানি পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা জন্মাচ্ছে। হলের দক্ষিণপাশের চা দোকানে, চা খেতে গেলে আবুল নামের ছেলেটা প্রতিদিনই প্রায় একই রকম খবর জানায়,
‘ভাই, কাল রাতেও শখানেক টেরাকে ভইরা লাশ লইয়া গেছে মিরপুরের দিকে।ঢাকার শহর সাফ হইয়া গেছে।” এমন প্রতিদিনই নাকি লাখ খানেক লাশ ট্রাকে ট্রাকে ভরে নিয়ে যায় মাটিচাপা দিতে। লাখখানেক- মানুষের মুখে ছড়িয়ে যাওয়া গুজব হলেও, সংখ্যাটা নেহাত কমও না। নিরস্ত্র বাঙালির উপর রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া যে শুধু আওয়ামীলীগ কিংবা ভারতীয় গুপ্তচর নিধন না, তা যেকোনো মানু্‌ষই বুঝবে। ভেবেছিলো, দেশ স্বাভাবিক না হলে বাড়িতে যাবে না। কিন্তু ভোর রাতে দেখা দুঃস্বপ্ন তাকে মায়ের কথা ভাবিয়ে তুলেছে। বাড়িতে যাওয়ার আগে, তার ছাত্রী নীলাদের বাসায় যেতে হবে। গত মাসের বেতনটা নেওয়া হয় নি। কে জানে- বাসায় আছে কি গ্রামে চলে গেছে!
দরজায় টোকা দিতেই, নীলা দরজা খুলেছে।
“স্যার, আমি জানতাম আপনি আজ আসবেন। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। তবে, দেখা হবে কি না সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আপনি তো সবসময় দুপুরের পরে আসেন।” কপালের মাঝের কালো টিপটার জন্যই কি না আজকে নীলা একটু বেশিই ভালো লাগছে। “কোথাও যাচ্ছো নাকি?” “ঢাকা শহর সেইফ না, তাই বাবা আমাদের গ্রামে রেখে আসবেন। দুপুরের পর আসলে আমাদের পেতেন না। একটু পরই বেড়িয়ে যাবো।”
“যাক, তাহলে ভালোই হলো। দেখা হলো, আবার কবে দেখা হয়, দেখা হয় কি না!”
“স্যার, আপনি কি যুদ্ধে যাচ্ছেন? আমার ছোট মামাও গত সপ্তাহে, আগরতলা গেছেন।”
“না, গতরাতে মাকে স্বপ্নে দেখেছি। আর এদিকেও অবস্থা ভালো না। তাই ভাবলাম মাকে দেখে আসি। বাড়িতে যাবো।”
নীলা অনেকটা জোর করেই রফিককে দুপুরের খাবার খেতে বাধ্য করলো। কে জানে, মেয়েটা বুঝেছে কি না- রফিক আজ দু-সপ্তাহ ভাত খায় নি। হলের বাবুর্চি কলু মিয়া কাউকে কিছু না বলেই উধাও হয়ে গেছেন, বাহিরে খাওয়ার মতো সামর্থ্যও তার ছিলো না। এই মেয়েটার ইন্টিমেশান পাওয়ার দারুন। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালে, অপটিক্সের প্রিপারেশান খুবই বাজে ছিলো। রিটেক দিতেই হতো। কিন্তু এই মেয়েটা বললো, “স্যার, আপনি কি এক্সাম নিয়ে চিন্তা করছেন? টেনশান করার দরকার নাই, আপনি ভালো করবেন।” “এক্সাম ভালো করতে প্রিপারেশানও ভালো নিতে হয়, আমার সেটা খুবই বাজে।”
“আহা! বললাম তো আপনি ভালো করবেন।” রফিকের পরীক্ষা আসলেই ভালো হয়। সেবার মাত্র ৪ জন অপটিক্সে ফার্স্ট ক্লাস পায়, সে তাদের একজন।”
সদরঘাটে, লঞ্চ চলাচলের কোনো চিহ্ন নেই। কোলাহল শূন্য সদরঘাট তার জীবনের অন্যতম একটা আশ্চর্য। কতকিছুই তো আশ্চর্যজনক! হকারদের চিরায়ত হাকডাক নেই, কুলিরা দৌড়াচ্ছে না লাগেজ টানার জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর, একটা রেশন বোঝাই ইঞ্জিনের নৌকা পাওয়া গেলো চাঁদপুর যাবে, ডেকে লম্বা বাঁশে টাঙানো পাকিস্তানের বিশাল পতাকা। যেনো দূর থেকে বুঝা যায়, এই নৌকা মুজিবের না, এটা পাকিস্তানের। কতক্ষনে পৌছাবে তার নিশ্চয়তা নাই উপরন্তু নৌকার মাঝি রফিককে উঠাতে চাচ্ছিলো না। এই বয়সের ছেলেপেলেদের নৌকায় উঠানো মানে হানাদার বাহিনীর সরাসরি টার্গেট। ১০ টাকার বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলো।
নদীর সেই চিরচেনা রূপ নাই, বাতাসে নির্মলতা নেই আছে নির্মমতা, চাপা কান্না। শেয়ালের আধ-খাওয়া লাশ ভেসে উঠেছে কিছু জায়গায়। “নাক চাইপা ধরেন ভাইসাব, নদীতে এখন লাশের গন্ধ। জ্বালায়া দিছে আশেপাশের এলাকা। গ্রামকে গ্রাম খালি হয়ে গেছে।”
“সব মেরে ফেলেছে? কেউ বেঁচে নেই?”
“গ্রামের পর গ্রাম জ্বালায় দিছে, যারা মরে নাই তারা সীমান্ত পার হইয়া ঐ পাড়ে গেছে গা।”
আপনি যান নাই?
-বউ আর মাইয়ারে পাঠায় দিছি আমার বড়গিরিরা লগে। মাইয়া মানুষ সেইফ না। ধইরা লইয়া যায় ক্যাম্পে।
মাঝরাতের দিকে রফিক বাড়িতে পৌছায়। গ্রাম আসলেই খালি হয়ে গেছে। চারিদিকে পোঁড়া গন্ধ। তাদের ঘর গ্রামের একপাশে, সেই পথে রায়বাবুদের বাড়ি পরে। বাড়ির অবস্থা দেখে রফিকের বুকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়। সে আল্লাহর নাম জপতে জপতে বাড়িতে পৌছায়।
“কে রফু? তুই আইসিস, বাবা।”
রফিক মা জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়, “রায়বাবুর বাড়ি দেখে তো আমি ভয় পাইছি, মা।”
“আল্লাহ দেখছে সব। রায়বাবুর কাছে কেউ সাহায্য চাইয়া ফেরত যায় নাই। মানুষটারেও মাইরা ফেললো কুত্তার বাচ্চারা। বাড়ির সবাইরে মাইরা, নাতনি ডারেও লইয়া গেলো ক্যাম্পে। তুই যুদ্ধে যাইতেসিস?”
না, মা৷ আমি তোমারে দেখার জন্য আসছি। তুমি সুস্থ আছো কি না!
“বাংলা মা-ই তো সুস্থ নাইরে, বাবা। দেশটাই তো আমাদের মা। মা, ভালো না থাকলে কোনো সন্তানই ভালো থাকে না।”
মফু ভাইয়ের দেওয়া সিগারেটটা শেষ হতে চললো। উনি গেরিলাদের নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। শখানেক আর্মিতো ছিলোই। সবগুলাই মনে হয় শেষ। আকাশে বাতাসে শুধু “জয় বাংলা” স্লোগান শোনা যাচ্ছে।
“স্যার, আপনার পেটের দিকটা তো রক্তে ভেসে গেছে। ব্যাথা পাচ্ছেন?” লাল পাড়ের সুবজ শাড়িতে নীলাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। কপালের লাল গোল টিপটা কিছুটা বামে সরে গেছে, সরুক তবুও মায়াবতী মেয়েটার যত্নটুকু অগ্রাহ্য করার শক্তি রফিকের এখন নেই।
সূর্য ডুবে গেছে, নতুন সূর্য উদিত হবে তাই।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!