গারো পাহাড়ের চিঠি: পাহাড় সরে যাচ্ছে ক্রমশ…

গারো পাহাড় সরে গেছে অনেক দূর। জঙ্গল সরে গেছে অনেক দূর। পাহাড়ি যে সকল ঝোরা ছিল, সেগুলো শুকিয়ে চিকচিক করে বালি কোথাও নাই কাদা। যে সকল জনজাতি ছিল তারাও সরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। ভিন্ন ভাষা ভিন্ন সংস্কৃতি ভিন্ন যাপনশৈলী নিয়ে এই তল্লাট একদিন ফুলের বাগান ছিল– নানা ফুলের বাগান– সে বাগানে এখন কেবলই একফুল ধরছে। একোনায় ওকোনায় একমুঠো ফ্যাকাশে বিবর্ণের ছবি মুখে নিয়ে শরীরে নিয়ে বাস করছে গারো কোচ হদি বানাই আর ডালু। এক সময়ের ফুলেল বাগান এখন একটেরে।

জল জলা জঙ্গলে আমরা মঙ্গল দেখেনি। দেখার ল্যান্স শুধু পাহাড় কাটো রাস্তা বানাও। আবাদী জমি জিরাত করো। পাহাড় ন্যাড়া করে করে টুপ করে একাশি ভোরে লাগিয়ে এসো— আগামীকাল বিকেলে খালি পকেট ভরে টাকা কামাও– এমন তল্লাটই এখন গারো পাহাড়।

আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: কোচবাড়িতে নিমন্ত্রণ 

তাই তোমাকে বলছিলাম গারো পাহাড় কেবলই সরে সরে যাচ্ছে। হারাচ্ছে বৈচিত্র্য। হারাচ্ছে পশুপাখি। গত পঞ্চাশ বছরে পাহাড়ে জায়গা করে নিচ্ছে দখলসত্ত্বে নদী ভাঙন এলাকার মানুষ জন। বসছে সরকারি আশ্রয় প্রকল্পের গুচ্ছ গ্রাম। আর আশ্রিতজনেরাই পাহাড়ে বাকিটুকু অল্প অল্প করে চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে বন ও বন্যপ্রাণীর সকল চিহ্ন। সংকোচিত হয়ে পড়েছে গারো পাহাড়ের হাতির বিস্তৃণ চরাচর। ‘গারো পাহাড়ের হাতি নিজগৃহে পরবাসী’ শিরোনামে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম– তোমার মনে নেই? ভুলে গেলও ক্ষতি নেই। লিংক পাঠিয়ে দেবো- পড়ে নিও।

বনেরা বনে সুন্দর কথাটা বলতে বেশ মিষ্টি মিষ্টি লাগে। হরহামেশাই বলি।আর এমন কথা বলতে বলতেই আমরা বনের পশুপাখি বেঁচে থাকার মৌলিক শর্তগুলোই নষ্ট করে ফেলি। মানুষের আরো আরো চাইয়ের যে লোভ চোখে মুখে পেটে আকাঙ্ক্ষা থাকে তার দাপটে বন বিপন্ন বন্য প্রাণী বিপন্ন; বনের আবাসিক পাখি অতিথি পাখি বিপন্ন। অন্যের বিপন্নতা সুনিশ্চিত করেই মানুষের খাই মেটাতে গিয়েই জল জলা আঁড়ার ঝোপ কিংবা জঙ্গলে আমাদের আর মঙ্গল দেখার চোখটি ছানি পড়ে গেছে।

সকালে হাঁটতে গিয়েই মন খুবই চুপসে আছে। একদল বালক হৈহৈ রৈরৈ করে দৌড়াতে দৌড়াতে সকালের নীরবতাকে সরব করে তুলছে দেখে একটু দাঁড়ালাম। কয়েকজনের হাতে বাঁশের কঞ্চি আর হাতে ইটের ঢেলা নিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল তারা। কয়েকজন বড় বড় ছোকরাও আছে।

তারা দৌড়াচ্ছে টিনের চাল বানরকে দেখে। আমিও দেখলাম উচু চৌচালা টিনের চালে টুঁইয়ের বসে ভেংচি কাটছে বানরটি। শহরে বানর ঢুকেছে কথাটি গত কদিন ধরেই শহরবাসীর মুখে মুখে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লাইন শেয়ার কমেন্টস নিয়ে ট্রল হচ্ছে কদিন ধরে। আর এই ট্রলের কারণে ছেলে ছোকরার হৈহৈ রৈরৈটা বেড়ে গেছে। হয় ধরবে নয় মারবে– কিংবা নিদেন পক্ষে একটা ঢিল ছোঁড়া তো গেলো– হোক সেটা বানের গায়ে বা টিনের চালে বা পাশের ফ্লাটের রঙিন থাইগ্লাসে। তাতেই ছোকরাদের প্রশান্তি।

জলখাবারের হোটেল থেকে বের হতেই দেখি হোটেলের সামনে গনগনে লাকড়ির চুলায় গোল কালো তেল চটচেটে চাকতিতে ভাঁজতে থাকা দু’খানা গরম রুটি চোখের পলকে নিয়ে উধাও বানর বাবাজী। থাক করা রুটির উপর থাবাটুকু এক পলকে দেখেছি কি দেখিনি এমন ধোঁয়াশায় তিনি এলেন একথাবা নিলেন আর নিমিষে উধাও। গেরিলা যোদ্ধার মতো– কেউ বোঝার আগেই অপারেশন সাকসেস।

হোটেল মালিক বেচারি হায় হায় করার সুযোগও পেলো না। কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠল। হোটেল বয় লাঠি নিয়ে এলো। মালিক বেচারি ক্যাশবাক্স রেখে উঠতেই পারল না।

ঘটনা ঘটে গেলে কিছুক্ষণ যেমন সেই ঘটনার সুলুকসন্ধানের মজমা বসে।আলোচনার খই ফুটে আগুনের আঁচে তপ্ত বালুর ১০নং কড়াই তাপে আর চাপে। তেমনটি হলো বানরের সফল অপারেশনের পর। তখনই জানলাম এই ধুসর রঙের বিচ্ছুটি সাহসী গেরিলা। কোথাও কলার ছরি নিমিষে উধাওয়ের গল্প কোথাও ছাদে রোদে শুকাতে দেয়া আচারের বোয়াম ভেঙেছে গোটা তিনেক।

না। আচারের প্রতি বিচ্ছুটির লোভ ছিল না। একজন জানাল মূলত ছাদের চিলে কোঠায় আশ্রয় নিয়েছিল। মালিক ঠেঙাতে গেলে ধরমর করে পালাতে গিয়েই বোয়ামের সর্বনাশ হয়েছে। আরেকজন বলল, বিয়ের বাড়িতে খেতে বসা একজনের পাত থেকে আধেক খাওয়া মুগরির রান কেউ কিছু বোঝবার আগেই পগাড়পার– শুনেই হা হা হি হি করে হাসিতে ফেটে পড়ল সকালের মজমার লোকজন। ‘নিশ্চয়ই বান্দরে দাওয়াত দেয়নি।’ তবে যে এই রির্পোট করেছে সে জানালো স্বাদ কিংবা ঝালের কারণে গেরিলা আর খায়নি। বিয়ে বাড়ির ছাদের কার্ণিশ থেকে ফেলে দিয়ে একলাফে টঙদোকানের ঝুলে থাকা পাউরুটি নিয়ে উঠেছে গাছের ডালে।

বুঝা গেলো এদিকে টাউন শেরপুরে একজন দলছুট বানর বনছুট বানর এক বছর ধরে টাউন রেকি করে বেড়াচ্ছে। আজকে এপাড়ায় তো অন্যদিন ওপাড়ায়। আর নতুন নতুন খুৃঁজছে আক্রমণের কৌশল।

সাবধান টাউনবাসী।

গারো পাহাড় সরে গেছে। জঙ্গল সরে গেছে। বনে বন কেটে বসতি। বন কেটে চেয়ার টেবিল নাগরিক স্টেটাস আর কাড়ি কাড়ি লাকড়ি। জঙ্গলে বানর উধাও। উড়ক্কু কাঠ বিড়ালি উধাও।

কাজেই বানর সেনার টাউন শেরপুর আক্রমণ করা ছাড়া তার কোন পথ নেই।

সাবধান টাউনবাসী।
সাবধান সুশীল।

সে রেকি করছে আপনার বাড়িও…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!