কার্তিকের পড়ন্ত বিকেলে‚ ব্যালকনিতে চেয়ারে বসে নিবিষ্টমনে‚ কখনো আকাশে সুর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা‚ কখনো-বা স্বামীর আসার পথের পানে চেয়ে থাকে মালিনী।
তবে প্রকৃতপক্ষে সে চাহনিতে কোনকিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো না, কেবলই চেয়ে থাকা।
লক্ষ্যহীন দৃষ্টি…
মন-তো বহুদূরের গন্তব্যে, ছোট্ট দুটি হাতের স্নেহ-স্পর্শের সুখানুভুতিতে বিভোর। তাই তো নিজের অজান্তে ঠোঁটদুটিতে মায়ালি হাসি…
হঠাৎই একটা দামি শাল পিছন থেকে যেন কেউ জড়িয়ে দিল মালিনীকে, সুখস্বপ্নের আবেশ ছিঁড়ে, নির্মম বাস্তবে প্রত্যাবর্তন।
একি তুমি? কোথা দিয়ে এলে? আমি তো তোমার পথ চেয়েই বসেছিলাম‚ আর দিনান্তের রঙয়ের কারিকুরি দেখছিলাম আকাশের পানে চেয়ে…
শান্তিময় বললেন‚ তুমি ছিলে বিভোর আকাশে। দূর থেকে তোমায় নিরীক্ষণ করে‚ আমি একটু মজা করেই পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম একেবারে নিঃশব্দে!
কার্তিকের এই পড়ন্ত বিকেলের নতুন হিম যে তোমার ধাতে সয় না মালিনী…
ফুরফুরে হাওয়াতে মনও তোমার এতই উতলা যে ‚ দূর থেকে আমি লক্ষ্য করলেও তোমার কিন্তু নজরে পড়েনি।
…তাই বলে‚ এখন আবার এই দামি শালটার কি দরকার ছিল বল তো? অভিযোগের সুর মালিনীর গলায়।
হাঃ হাঃ হাঃ সত্যিই এবার তুমি আমায় হাসালে মালিনী…
এতোদিন আমার ধারণা ছিল‚ এসব দিনগুলো মেয়েরাই মনে রাখে।
কিন্তু তুমি‚ ছেলের বিদেশ যাওয়া আর নাতির মধুমাখা পরশ বিহনে এতোই উতলা যে‚ আজকের দিনটা স্মরণেও আসেনি তোমার!
আরে সবাই তো সামনের দিকেই এগিয়ে যায়। পুলস্ত্যর এতো ভালো একটা অফার‚ সেই সঙ্গে মিত্রারও ওখানেই একটা জব অফার…
ভাবলে কি করে তুমি, ঐ সমস্ত সুযোগ সুবিধা ছেড়ে এই মৃত্যুপথযাত্রী দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধার অবলম্বন হয়ে‚ এখানে থেকে যাবে ওরা?
ভুলে যাও মালিনী ও সব। নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়েছে এবার , সারাজীবন তো ছেলে, স্বামী আর সংসার করতে গিয়ে‚ অকালেই বুড়িয়ে গেলে।
না লাগলো কাজে তোমার বিদ্যে বুদ্ধি ‚ না কিছু।
এখন বাতের ব্যাথায় এতোটাই কাবু যে‚ প্রাতঃভ্রমণ বা সান্ধ্যবিহারে আমাকে সঙ্গ দেওয়ার ক্ষমতাও নেই তোমার।
মনটাকেও একেবারে মেরে ফেলেছো। কোথায় গেল আমার সেই‚ উচ্ছ্বল ‚ প্রাণবন্ত‚ সদাহাস্যময়ী মালিনী?
তাকে নিজে হাতে গলা টিপে মেরে ফেলে‚ এখন শুধু দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছো।
শান্তি কথা বলতে বলতে এবার একটা তরতাজা রজনীগন্ধার মালা মালিনীর গলায় পরিয়ে দিতেই…
ওমা? সত্যি তুমি পারো বটে, ঠিক মনে রেখেছো আজকের দিনটা?
কিযে বলো না মালিনী‚ মনে রাখাটাই তো স্বাভাবিক…
আজ থেকে ঠিক পঁয়তাল্লিশ বছর আগের এমনই এক কার্তিকের গোধূলিবেলায় আমার হাতে হাত রেখে এসেছিলে আমার ঘরনি হয়ে।
রেজিষ্ট্রী অফিস থেকে রাঙা বেনারসিতে সেজে‚ প্রবেশ করেছিলে‚ এই বাড়িতে…
।।দুই।।
সত্যি গো‚ এবার আমার একেবারেই খেয়াল ছিল না। আমাদের সেই কার্তিক মাসেই বিয়ে করা…
তোমার তো মাথার ওপর অভিভাবক কেউ ছিলেনই না, একেবারে নিজেই নিজের কত্তা।
কিন্তু আমি? উঃ মা-বাবার সঙ্গে লড়াই করে যখন হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম‚ তুমিই আমায় এমনি দিনেই এক কাপড়ে বেরিয়ে আসার বুদ্ধিটা দিয়েছিলে।
কিন্তু তোমাকে মিট করার এড্রেসটা দেখে আমি তো বুঝতেই পারিনি যে ওটা রেজিষ্ট্রী অফিস। ঢুকেই তাজ্জব! তুমি একেবারে রেজিষ্ট্রী অফিসে‚ পাকাপকি বন্দোবস্তই করে রেখেছিলে।
আমাকে তো দু’হাত বাড়িয়ে সাদরে কাছে টেনে নিলে। তারপর তোমার আয়োজন দেখে তো আমি থ
আমাকে সাজানোর সব ব্যবস্থা মায় বেনারসি‚ গয়নাও… কিছু ত্রুটি রাখনি তুমি।
পার্লারের মেয়েটি সাজিয়ে দিতে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে‚ নিজেই সলজ্জ নববধূ হয়ে‚ তোমার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
তুমিও তখন‚ ধুতি-পাঞ্জাবী পরে দিব্যি বরটি সেজে দাঁড়িয়েছ, স্মৃতি রোমন্থন করলো দামিনী।
সবই ঐ আমার অফিস কলিগ‚ মিঠুনদা আর সৌরমের কারসাজি।
আমাকেও টের পেতে দেয়নি, শুধু দরকার মতো টাকাটা আমার কাছ থেকে নিয়েছে।
দেখলে তো ওরাই সাক্ষী‚ বরপক্ষ‚ কনেপক্ষ স…ব… সত্যি বড় কষ্ট হয়, সেই মানুষ দুটোর একজনও আজ নেই।
জানো মালিনী, যে সিঁদুর কৌটো থেকে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়েছিলাম‚ রুপোর ওপরে সোনার জল করে তোমার নাম লিখা‚ ওটা জীবন-দাই আমাকে দিয়েছিল।
তোমার মনে আছে‚ তোমাকে সিঁদুর পরানোর সঙ্গে সঙ্গে তুমি ঢিপ করে আমাকে প্রণাম করেছিলে?
তাই দেখে‚ আমাদের তিনজনেরই হো হো করে কি হাসি….
ধ্যাৎ‚ ছাড়ো না। সে সেই উনিশ বছরের অপরিণত বুদ্ধির কান্ড …
কেন, ছাড়বো কেন? জানো তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে গেছিলো।
এতদিনে‚ আমি কারো প্রণম্য হলাম। তারপর ওদের পীড়াপীড়িতে‚ দুজনে গলা জড়িয়ে ধরে সেই ছবি তোলা?
সে ছবি আজ মলিন‚ তবু আমাদের ঘরে এখনো সেই ছবিটাই স্মৃতিটাকে ধরে রেখেছে।
খাওয়া দাওয়ার পর ওরাই তো আমাদের সঙ্গে ট্যাক্সিতে এসে‚ আমাদের দরজার ফিতেটা তোমাকে দিয়ে কাটিয়ে, আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েই দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে বলে গেল‚ কাল সকালে অফিস যাওয়ার সময় খুলে দিয়ে যাবো। বলে হা… হা…হা… করে হাসতে-হাসতে চলে গেল।
ওঃ‚ প্রথম থেকে ওরাই আমাদের পাশে ছিল। আর আজ‚ দুজনেই মহাশুন্যের ওপারে।
…আচ্ছা তোমার মাথায় হঠাৎ কার্তিকেই বিয়ে করার প্ল্যানটা, এসেছিল কেনো? মালিনীর হঠাৎ সুপ্ত কৌতুহল জেগে উঠলো।
ভেরি সিম্পল, প্রেমের ফাল্গুন তো সবই। তাতে কার্তিক বা চৈত্রে কি এসে যায়…
।।তিন।।
মালিনী শুরু করলো এবার…
তুমি তো আমায় হাত ধরে নিয়ে এলে আমাদের সেই নতুন ঘরে‚ যেটা আজও আমাদেরই আছে। তারপর সারা..রাত… উঃ আদরে‚ সোহাগে…
ক’দিনেরই বা আলাপ ছিল আমাদের?
মাত্র চার মাস আগে এক গোধুলিবেলায়‚ তুমি ফিরছিলে অফিস থেকে আর আমি কোচিং থেকে…
পেনটা পড়ে যেতেই আমি নীচু হয়ে তুলতে যাচ্ছি, তুমি আমার হাতে ধরিয়ে দিলে স্মিত হেসে।
দুজনে তাকালাম পরস্পরের দিকে‚ ব্যাস মদনবাণে বিদ্ধ হলাম। অলক্ষ্যে তোমার স্টপেজ পেরিয়ে গেল‚ তোমার খেয়ালই নেই…
পরের স্টপেজ নীলরতন… হাঁকতেই‚ আমার পিছনে তোমাকে নামতে দেখে অবাক হয়েছিলাম…
এক্সকিউজের স্বরে বললে‚ আমাকে এক স্টপেজ পিছিয়ে যেতে হবে, খেয়ালই ছিলো না…
আমি মনেমনে হেসে এগোলাম।
তারপর টুকটাক কথা‚ রবিবার হলেই মনটা খারাপ হয়ে যেতো।
তুমি তো এরমধ্যেই বন্ধুদের পরামর্শে রেজিষ্ট্রী অফিসে নোটিস দিয়ে রেখেছো‚ সম্পুর্ণ আমার অজান্তে।
নতুন বাড়ি বানাচ্ছো‚ তাও বলনি…
কেন বলিনি জানো? তোমার তখন শিয়রে শমন‚ বি এ ফাইনাল, সেটাও জেনেছিলাম কায়দা করে। তুমি যে কোচিং থেকে ফিরতে সেটাও…
…তবে আজও আমি বুঝি, স্বীকারও করি মনেমনে, তুমিই উদ্যোগ নিয়ে অমন ব্যবস্থা করেছিলে বলেই আমরা পরস্পরকে পেয়েছিলাম। নয় তো কোথায় ছিটকে যেতাম দু’জনে…
আজ না পাওয়ার কথা একেবারেই হবে না। শুধু কতোটা পেয়েছি… কত মজা, আনন্দ, সেটা নিয়েই আলোচনা হবে আমাদের জীবনের এই গোধুলিতে।
আচ্ছা দামিনী‚ তোমার আর একটা মজার দিনের কথা মনে পড়ে?
পড়ে না আবার? তুমি পুলস্ত্যর ফুলশয্যার দিনের কথা বলছো তো?
সেদিন যা করেছিলে‚ যে কেউ শুনলেই হাসবে।
আমি তো কাউকে হাসাবার জন্যে করিনি… কি জানি সেদিন সকাল থেকে কেবলই‚ আমাদের ফুলশয্যার কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
তুমি পারোও বটে, অবশ্য বরাবরই তুমি বড্ড রোমান্টিক ‚ বলল দামিনী।
শান্তিময়ের সঙ্গেসঙ্গে উত্তর‚ ‘এই তো হেথায় কুঞ্জছায়ায়… এ জীবনে যে ক’টি দিন পাব ‚ তোমায় আমায় হেসে খেলে কাটিয়ে যাব দোহেঁ….’
আঃ থাম তো‚ এই বয়সেও এতো সুর আসে তোমার? দামিনী কপট রাগ দেখায়…
পুলস্ত্যর রিসেপশনটা ছিল বিয়ের দু’দিন পরে, রবিবার।
তাই আগের দিন… ভাত-কাপড়‚ নিমন্ত্রিতদের পাতে নতুন বৌএর ভাত দেওয়ার অনুষ্ঠানের জন্য, গুটিকতক আত্মীয়দেরই বলা হয়েছিল তাও তো দুপুরবেলা, মালিনী স্মৃতি সরণী বেয়ে চলে গেছে ফেলে আসা সেই দিনটাতে…
বেলা পাঁচটা নাগাদ অতিথিরা বিদায় নিলে‚ ফুলশয্যার ঘর সাজানোর লোকজন এসে গেলো।
তারা ছেলের ঘরে কাজ করছে ‚ তুমি যে তাদের সঙ্গে কি এতো গুজগুজ করছিলে‚ আমি তো তা জানিও না।
সন্ধ্যেবেলা চা-পর্ব মিটতে‚ তোমরা বসার ঘরে তিনজনে আড্ডা মারছিলে। আমি আর বাসন্তী মিলে উদ্বৃত্ত খাবার দাবারগুলো ফুটিয়ে রাখছিলাম‚ পরদিন যদি কেউ খায়।
বাসন্তীর বাড়ির জন্যেও বেশ খানিকটা দিয়ে বাইরের দরজা বন্ধ করে এসে বললাম‚ তোমরা সব কে কি খাবে খেয়ে নাও, রাত ন-টা তো বাজে।
কাল তো আবার ধকল আছে সারাদিন‚ আমিও এবার শোব।
পুলস্ত্যরা দুজনেই এক কাপ করে কফি খেয়ে চলে গেল ঘরে।
ওরা তো দিব্যি‚ আমাদের সামনে দিয়েই ফুলশয্যার ঘরে গিয়ে দরজা দিল।
না তো কি আজকের দিনেও তোমার মতো ‚ লজ্জাবতী লতা হয়ে‚ একগলা ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে থাকবে? বলল শান্তি।
আর তুমি কি করেছিলে, মুখ ঘুরিয়ে শান্তির দিকে তাকায় মালিনী…
তুমিও ঘরে চলে গেলে দেখে ,তোমার অভ্যাস মতো এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে‚ ঘরের দরজা ঠেলে দেখি…
ঘরের চারদিকে ফুল আর ফুল, খাটেও ফুল ছড়ানো।
তারমধ্যে তুমি দিব্যি পাঞ্জাবি পরে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছো।
নিজের মনেই হেসে বললাম‚ মরণ আর কি! বুড়ো বয়সে ভীমরতি…
গ্লাশটা টেবলে রেখে শুতে যেতেই‚ পটাং করে উঠে বসে বললে‚ কিরকম সারপ্রাইজ দিলাম‚ মালিনী?
আমি কপট রাগ দেখিয়ে বললাম ওহো‚ তাহলে তুমি মটকা মেরে পড়েছিলে?
না তো কি! বাসর সাজিয়ে রেখে বর বাবাজি ঘুমিয়ে পড়লো?
সত্যি তুমি ভাবলে কি করে?
তারপর তো সারারাত… কোথায় ঘুম, কোথায় কি?
বক-বকম করে, নিজেদের ফুলশয্যার স্মৃতি রোমন্থন।
সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি দেখে, পুলস্ত্য ঘরে ঢুকেছিল ডাকতে…
আমি ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি‚ সে হাঁ করে ঘরের চারদিকে দেখছে… আমার তো লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।
তবে ছেলেটাও তোমারই মত হয়েছে, বলে কিনা… মা দেখেছো‚ বাবা এখনো কত রোমান্টিক…
সত্যি‚ বাবাকে কনগ্র্যাটস করে আসি‚ বলে ঘর থেকে বেরোতে‚ আমি স্বস্তি পেলাম।
হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল , শান্তিময়…
…শোনো না অনেক তো স্মৃতি রোমন্থন হলো এবার মালাটা দাও‚ আমি কখন পরাবো গো? বললো মালিনী।
মালাটা হাতে নিয়ে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে‚ শান্তির গলায় পরিয়েই ঢিপ করে প্রণাম করলো।
শান্তি এবার সপ্রেমে মালিনীর হাতখানা ধরে‚ ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো‚ দিনটা ফুরিয়ে গেলো…
আমাদের দিনও তো এবার ফুরোবার সময় হয়ে এসেছে‚ সেজন্যেই আজ সব স্মৃতি আওড়ালাম।
যদি আর বলার সময় না পাই‚ কার প্রাণ সুর্য আগে অস্তাচলে ঢলে পড়ে… কে জানে…