গ্রাম সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ২

রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির এক টুকরো ছবি ধরা পড়ে, পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের সেলিমাবাদে। হিন্দুদের পাশাপাশি এ গাঁয়ের মুসলিম সমাজের অনেকেই রথের রশিতে টান দেন। দশকের পর দশক ধরে এভাবেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসবের আনন্দে গা ভাসাচ্ছেন এ গাঁয়ের আট থেকে আশি। তবে অন্য জায়গার মতো রথের দিনে নয়, সেলিমাবাদে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয় প্রকৃত উৎসবের পরের দিন, অর্থাৎ আগামিকাল। এটাই এ গ্রামের রীতি।

পূর্ব বর্ধমানের জামালপুর এক নম্বর পঞ্চায়েতে একটি প্রাচীন এলাকা সেলিমাবাদ। কথিত আছে, সম্রাট সেলিম খান এই গ্রামে নাকি আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামটি সেলিমাবাদ নামে পরিচিতি পায়। হিন্দু ও মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বাস এই গ্রামে। গ্রামের মাঝামাঝি একটি জায়গায় রয়েছে ‘বাল গোপাল জিউ’-এর প্রাচীন মন্দির। সেই মন্দিরেই রথযাত্রা-সহ হিন্দুদের অন্য দেবদেবীর পুজোপাঠ হয়। জানা যায়, সম্রাট সেলিম খান আরামবাগ থেকে বর্ধমানের দিকে যাচ্ছিলেন। দামোদরের বাঁধ ধরে যাওয়ার সময়ে পথে তাঁদের গ্রামের ‘বাল গোপাল জিউ’-এর মন্দির সংলগ্ন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে তিনি আশ্রয় নেন। পরে পাকাপাকিভাবে তিনি সেখানেই তাঁর ‘আস্তানা’ গড়ে তোলেন। সেলিম খানের নাম অনুসারে পরবর্তী কালে গ্রামটি ‘সেলিমাবাদ’ গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

জামালপুর থানা এলাকার বাসিন্দা তথা ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব গবেষক পূরবী ঘোষ জানিয়েছেন, কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে সেলিমাবাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রবাদ রয়েছে, এই গ্রামের সম্রাট সেলিম খান খালি হাতে বাঘ নাকি মেরেছিলেন। পূরবী ঘোষ আরও জানান, ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা গিয়েছে শের আফগানকে হত্যা করার পর তাঁর পত্নী মেহেরুন্নিসাকে সেলিমাবাদ গ্রামের দুর্গে এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেলিম খান। পরবর্তীকালে এই মেহেরুন্নিসাই নুরজাহান নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

একইভাবে সম্রাট হওয়ার পর সেলিম খান পরিচিত হয়েছিলেন ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর’ নামে। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে পূরবী ঘোষ আরও বলেন, ‘আগে সেলিমাবাদ গ্রামে হিন্দু ও জৈন এই দুই ধর্মের যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল। সেই থেকে সেলিমাবাদ গ্রামটি বহু সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে।’

এই সেলিমাবাদ গ্রামে ‘বাল গোপাল জিউ’-এর মন্দির তৈরির পিছনেও রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস।কথিত আছে, সেলিমাবাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য ও তার স্ত্রী দয়ালময়ী দাসী। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক শক্তিপদ সাঁতরা বলেন, ‘১৯১৮ সালের আগে কোনও এক সময়ে সেলিমাবাদ গ্রামে এসে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য। বৈষ্ণব সাধক দ্বীজবরদাস বৈরাগ্য এই গ্রামে নিজের বাড়ির সামনেই মন্দির গড়ে তোলেন। সেই মন্দিরেই তিনি রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল ঠাকুরের বিগ্রহের পুজোপাঠ শুরু করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তিথি অনুযায়ী গোটা দেশ জুড়ে হওয়া রথ উৎসবের পরের দিন সেলিমাবাদ গ্রামের রথযাত্রা উৎসবের সূচনা দ্বীজবরদাস বৈরাগ্যই করেছিলেন। সেই প্রথা মেনে আজও রথের পরের দিন রথের পুজোপাঠ সম্পন্ন করে আসছে সেলিমাবাদের বাল গোপাল জিউ সেবা সমিতি।’

শক্তিপদ সাঁতরা বলেন, ‘পুরীর রথে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রাদেবীর বিগ্রহের পুজোপাঠ হয়। রথের দিন এই তিন দেবতার বিগ্রহ রথে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের মাসির বাড়িতে। কিন্তু সেলিমাবাদ গ্রামের রথে রাধাকৃষ্ণের পাথরের মূর্তি এবং অষ্টধাতুর গোপাল মূর্তির পুজো হয়। তিথি মেনে দেশজুড়ে হওয়া রথযাত্রা উৎসবের পরের দিন সকাল থেকে সেলিমাবাদ গ্রামের ’বাল গোপাল জীউ’ মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ ও গোপালে পুজোপাঠ শুরু হয়। ভক্তদের প্রসাদ ও ভোগ বিতরণ শেষে বিকালে কাঠের তৈরি প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার রথে রাধাকৃষ্ণ মূর্তি ও গোপাল মূর্তি চাপিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরে নিয়ে যাওয়া হয় দামোদরের ধারের মাসির বাড়িতে। মাসির বাড়িতে যাওয়ার পথে এই গ্রামের রথে রশিতে টান দেন সব ধর্মের মানুষজন।’

আরও পড়ুন: গ্রাম সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ১

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মায়া সাঁতরা জানান, শুধুমাত্র রথযাত্রার পুজোপাঠই নয়। দোল, শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী এমনকী রাস উৎসবও তিথির নির্দিষ্ট দিনে সেলিমাবাদ গ্রামে পালিত হয় না। হয় তার পরের দিন।পুরাকাল থেকেই সেলিমাবাদ গ্রামে এমন রীতি-রেওয়াজ মেনে যাবতীয় পূজা-অর্চনা হয়ে আসছে বলে মায়াদেবী জানিয়েছেন। গ্রামে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা কম বলে কখনওই ভাটা পড়েনি।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের কালীপুজোও সেই একই সুরে গাঁথা। গ্রামের নাম হাঁড়িপুকুর। হিলি থানা এলাকায় মুসলিম অধ্যুষিত এই গ্রামে দেশভাগের পর থেকেই সাড়ম্বরে পূজিতা মা কালী। গ্রামে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা কম বলে কখনওই ভাটা পড়েনি দেবীর আরাধনায়। প্রথাগত ভাবে সারা বছর হিন্দু পুরোহিত পুজো করলেও এই সংক্রান্ত বাকি সব দায়িত্ব সোৎসাহে পালন করেন স্থানীয় মুসলিম পরিবারের সদস্যরাই।

এমনকি, বছরভর মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের ভারও সামলান তাঁরাই।কাঁটাতারের বেড়া কিংবা ধর্মের ভেদাভেদ ছায়া ফেলতে পারেনি তাঁদের এই একসূত্রে গেঁথে থাকায়। দেশভাগের পরেও এতটুকু খামতি হয়নি পুজোর কোনও সাজসজ্জায়। ম্লান হয়নি উৎসবের আনন্দ বা ঐতিহ্য। দীপাবলির আলোয় তাই এখনও সেজে ওঠে পুরো গ্রাম। দুই বাংলার সীমান্ত রক্ষীরা থাকেন পুজোর আয়োজন করেন।

এই মন্দিরে মূর্তিপুজো হয় না। হয় শুধু ঘট পুজো। ভারত সীমান্তরক্ষী (বিএসএফ) ও বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী(বিজিবি)-দুই বাহিনীই এই উৎসবে সমান ভাবে।

গ্রাম বিশেষ্য পদ। নগর থেকে দূরে জনবসতিকেই সাধারণত গ্রাম বলে।এই গ্রামের লোকেরা প্রধানত কৃষিজীবী। বিনয় ঘোষ বলেছেন, সম্পন্ন গ্রামের কথা- যারা যে কোনও জিনিসের জন্য নিজের গ্রামের উপর নির্ভরশীল।অন্যদিকে সমৃদ্ধ গ্রামে অর্থনৈতিক অবস্থান বরাবর ভাল।
গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম সুসম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!