দোলের স্মৃতি
পি. শাশ্বতী
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সলজ্জ নববধূবেশে সুসজ্জিতা। গাছে গাছে কচিপাতার সমারোহ, আম্রমুকুলের সৌগন্ধে আমোদিত বিহ্বলিত বাতাস। চারিপাশে পলাশ,কৃষ্ণচূড়ার রং বাহারী। প্রাণের সাড়া জাগানো গানে আকাশ,বাতাস মুখরিত। দিকচক্রবাল আন্দোলিত মাঝিমাল্লার ভোজপুরী,বিহারী হোলির সুরে। দিগন্ত জুড়ে আজ ফুলের আগুন। এসবের মধ্য দিয়েই ফাগুনী পূর্ণিমায় আসে রঙের উৎসব।
আগের দিন চাঁচর বা নেড়া পোড়ানোর মাধ্যমে হয় অশুভ শক্তির বিনাশ বা হোলিকা দহন। পরদিন নারায়ণ ও রাধাকৃষ্ণের পূজার মধ্য দিয়ে হয় দোলযাত্রার সূচনা। রঙের উৎসব পূর্ণতা পায় প্রাণের উৎসবে। নারীপুরুষ ছোট বড় নির্বিশেষে আবীর মাখার রীতি আছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম ও ছোটদের মাথায় দিয়ে আশীর্বাদ। সমবয়সীদের মধ্যে চলে রঙ বিনিময়। সেই রঙ হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মন গেয়ে ওঠে ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের এই বাতাসটুকুর মত।’
হলুদ জামাকাপড়, মাথায় পলাশফুলের মালা, মুখে বসন্তের গান জোড়াসাঁকো ছাপিয়ে সোনাঝুরির হাট, খোয়াইয়ের মাঠ ভাসিয়ে নিয়ে যায় আনন্দে, উচ্ছ্বাসে ও আবেগে। ব্যস্ততম কংক্রিট নগরীর দূষণ ছাপিয়ে বেজে ওঠে বসন্তের সুর। রাস্তাঘাটে রংবেলুনের ছোঁড়াছুঁড়ি আজও অনুরণন তোলে ছেলেবেলার স্মৃতিতে। সরস্বতীপুজোর দিনের মতো এইদিনেও হয় কত প্রেমের সূচনা। ‘রঙ না হয় দিয়েই গেলে, সে রঙ কখন লাগল গিয়ে মনে, গেল জীবন মরণ ধন্য করে।’
আপন মনে কত কথা বুদ্বুদের মত ভেসে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে অনন্তের বুকে। তার দুচারটি ধরে রাখার বিফল প্রয়াস। মনে পড়ে, আমাদের ছোটবেলায় অমিত কাকু যুগিয়ে দিতেন সব উৎসবের উপকরণগুলো। ব্যতিক্রম হত না দোলেও। এরপর অমিত কাকু বলতেন তাঁর ছেলেবেলার গল্প। একবার আমাদের অনুরোধে অমিত কাকু বলেছিলেন- ‘১৯৫৬/৫৮ সাল। মাসখানেক আগে থেকেই আমরা তোড়জোড় শুরু করতাম। আমরা মানে আমরা ১৩/১৪ জন, সবাই বয়সে ৮/১০ এর ঘরে। আমাদের অবস্থা তখন কাকেদের মতন। যে যেখান থেকে পারছে প্রত্যেকেই ভাঙা ঝুড়ি, ফেলে দেওয়া ফলের কাঠের পেটি, ছেঁড়া কার্টুন, চালানি মাছের ঝুড়ি, গাছের শুকনো ডালপালা, বিচালি ভর্তি গরুর গাড়ীর পেছন থেকে খড়ের আঁটি টেনে বার করে দে দৌড়। রাস্তাঘাটে ফেলে দেওয়া খবরের কাগজ সব জড়ো করা হচ্ছে আমাদের গোয়ালঘরের পেছনের সরু গলিতে। গঙ্গার ধারে বাঁশের গোলা থেকে পচা বাঁশ, পানের ঝুড়ি বাঁধবার ঘাসের দড়ি এইসব দলবেঁধে দিনে দিনে সংগ্ৰহ করা হচ্ছে। যেটা কিনতে হবে, সেটা হচ্ছে বাক্সবোম। মহাবীর ফায়ার ওয়ার্কসের বাক্সবোম – ২ বাক্স, মোট ৪ টাকা দাম, ২৪ টা মোট থাকে। প্রত্যেকের চাঁদা – ১৫ পয়সা। এসব হচ্ছে নেড়াপোড়ার আয়োজন।
এরপর দোল খেলার উপকরণ।
ডালুর কাকা হচ্ছেন সন্ন্যাসীকাকা, পাড়ার লেদমেসিন কারখানায় কাজ করেন। বিকেলবেলা ডিউটির শেষে আমরা আমাদের পিচকিরিগুলো নিয়ে কাকার ঘাড়ে পড়তুম। কারোর পেতলের, কারোর টিনের পিচকিরি। পেতলের পিচকিরির পুরোন ওয়াশার পাল্টে নতুন ওয়াশার লাগিয়ে, তার ওপর মোটা করে গ্ৰীজ লাগিয়ে, নাট টাইট দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিতেন কাকা, বলে দিতেন, পিচকিরিটা সারা রাত যেন জলভর্তি বালতিতে রাখা হয়। টিনের পিচকিরিগুলোর মরচে তুলে, কেরোসিন দিয়ে আগাপাস্তালা ধুয়ে, ওয়াশার পাল্টে গ্ৰীজ লাগিয়ে দিতেন। মোট মজুরী ২ টাকা। বাবা সন্ন্যাসীকাকাকে মূল্য দিয়ে দিতেন। দোলের দিন সন্ন্যাসীকাকা কারখানা থেকে বোতল ভর্তি মেসিন ধোয়ার কালো কেরাসিন তেল ডালুকে দিত। আর, পশু, ওদের ড্রাইভারের পেছনে, এক বোতল পোড়া মবিলের জন্যে। দোলের আগের দিন। রাত্তিরে জ্যেঠু, বড়বাজার থেকে রং, আবীর, গুলাল। টিনের কৌটার গায়ে লেখা- প্রতাপমল গোবিন্দরাম, খোংরাপট্টী, বড়বাজার।
দোলের আগের দিন। মাস্টারমশাইকে বলে বিকেলের ভেতর পড়াশুনা শেষ করে সবাই হাত লাগাতাম নেড়াপোড়ার সরঞ্জাম তৈরির কাজে। জিনিষটা দাঁড় করাতেই রাত্তির আটটা। এতদিন ধরে জোগাড় করা জিনিষগুলো ঠিকঠাক ভাবে লাগিয়ে, বড় একটা নারকোল গাছের পাতা দিয়ে মুড়ে দড়ি দিয়ে বাঁধা হত, আর বাক্সবোমগুলো সারা গায়ের বিভিন্ন জায়গায় গুঁজে দেওয়া হতো। রাত্তির ৯ টার পর। বেশ ভীড় । ৪/৫ টা রংমশালে আগুন লাগিয়ে ছুঁড়ে মারতুম ঐ কাঠামোটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলে উঠতো কাঠামোটা- চার দিকটা অন্ধকারের মধ্যে গনগনে লাল। আমাদের আহ্লাদ দেখে কে? নাচতে নাচতে “আজ আমাদের নেড়াপোড়া কাল আমাদের দোল”…বলে সবাই চেঁচাতুম। আস্তে আস্তে আগুন নিভে আসত, অন্ধকারের মধ্যে গোল থালার মত চাঁদের আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠত। উত্তেজনায় ভাল করে ঘুম হত না।
দোলের দিন সকালে জলখাবার খেয়ে আমরা ১৩/১৪ জন জড়ো হয়ে, ৩টে দলে ভাগ হয়ে যেতুম। গায়ে সরষে তেল মেখে পুরোনো ছেঁড়া জামা প্যান্ট পরে ৩ টে দল ৩ জায়গায় পোজিশন নিয়ে আ্যকশান শুরু হত। চলত বেলা ১টা পর্যন্ত। ততক্ষনে নিজেদের-ই চিনতে পারছি না- এমন-ই অবস্থা। এরপর দলবেঁধে সাবান ছোবড়া নিয়ে গঙ্গায় গিয়ে প্রচুর ধ্বস্তাধ্বস্তি করে গায়ের রং কতকটা উঠিয়ে বাড়ী এসে মাংস ভাত, আঃ, কি যে মজা! বোঝানো যাবে না। বিকেল হতেই জ্যাঠিমা, মা বেগুনী, আলুবড়া, ডালবড়া, সিঙ্গাড়া ভেজে বড় গামলায় মুড়ি, তেল, নারকেল, লঙ্কা, কড়াইশুঁটি, ধনেপাতা মেখে বাইরের ঘরে। বাড়ির কাজের পিসিকে দিয়ে পাঠিয়ে যাচ্ছে। যে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, এক দু গাল মুড়ি আর তেলেভাজা খেয়ে যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নামলো। বাজারের বিহারী মুটিয়ারা ঢোল বাজিয়ে হাওয়ায় আবির উড়িয়ে নাচতে নাচতে পাড়া পরিক্রমা করতে লাগল। ওরা হাতে হাতে মালপোয়ার টুকরো দিতে দিতে এগোতে লাগলো। এছাড়াও ছিল ফুটকড়াই, সাদামুড়কি ও রঙবেরঙের মঠ।
মাঝ পঞ্চাশের কলকাতা, অনেকটাই ফাঁকা। রাত্তির নটার পর আমরা নেতিয়ে পড়তুম। পিচকিরি, রঙের বালতি মায়েদের জন্যে ফেলে রেখে আমরা চলতাম ঘুমের দেশে।’
ছোটবেলায় দোলের অনেক গল্প আছে। সবার যেমন থাকে। সেইরকম এক পিসতুতো দাদার মুখে …’আবীর থেকে বাঁদুরে রঙ। বাড়িতে কেউ চিনতে পারতো না। সেই রঙ থাকতো সাত দশদিন। আগের দিন নেড়াপোড়া। আলু বেগুন পোড়া খাওয়া হত। আগানে বাগানে ঘুরে নারকেল পাতা, তাল পাতা, ঝোপঝাড় জোগাড় করা হত সাতদিন ধরে। বিরাট ব্যাপার। মনে হত কী ভীষণ কাজ করছি আমরা!
দোলের দিন বেলা বারোটার পর রঙ শেষ হয়ে যেত। তারপর শুরু হত বাঁদরামি। প্রায় সব জামাকাপড় ছেড়ে বাড়ি ঢুকতাম। বাবা গেটের বাইরে দু বালতি জল আর সার্ফ দিতেন। আর হোগলা। চান করেই বিরাট ঘুম পেয়ে যেত। অনেকের বাড়িতে পুজো হত। ফুটকড়াই, মঠ খেয়ে নেচে বেড়াতাম। মা খাসির মাংস আর ভাত করে রাখতেন। বুভুক্ষুর মতন খেয়ে নিপাট ঘুমিয়ে পড়তাম।
বিকেলে কিছু দুষ্টু বন্ধু আবীরের মধ্যে গুঁড়ো রঙ মিশিয়ে মাথায় ঘষে দিত। ব্যাস, বাড়িতে ফিরেই তুমুল…
এখন পলাশ, পাহাড়, আর মহুয়ার বাস খুব ভালো লাগে। আর ভাললাগে চুপচাপ একটা গাছতলায় বসে দূর থেকে উৎসব দেখতে। সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকা… কখন উঠবে সেই পাহাড়ের মাথাভর্তি করে অপার ভালোবাসা… সঙ্গে অফুরান মন ডোবানো আদর।’#