ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ১)

রবিবার সকাল হলেই চাকুরেদারদের জীবনে নতুন উৎসাহ তৈরি হয়। সপ্তাহে ওই তো মাত্র একটাই দিন, বাড়িতে বসে ছুটির আমেজ বেশ উপভোগ করা যায়। পিছনে কোনো তাড়া থাকে না। ছ’টা দিনের ক্লান্তি মুছে ফেলার এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণ। বোধ হয় সেই কারণেই চাকুরেজীবীরা রবিবার এলে মনে মনে এত বেশি খুশি হতে পারেন।
ডুরানি অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত কেরানি, তবুও রবিবার এলে আগের অভ্যেসমতো মনের আনন্দে ভাসেন। বাজারে যাওয়ার তাড়া থাকে না। অলস মনোভাব নিয়ে খবরের কাগজ পড়া আর অতীত জীবনের স্মৃতি হাতড়ে সারাটা দিন বেশ কেটে যায়। স্মৃতির দোলা এত গভীর হয় বলেই সেলিম ডুরানির জীবন থেকে সময়ের পলক তরতর করে পার হয়ে যায়। মন চায় আরেকটু মজে থাকতে কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই সুযোগ থাকে না। সময় অনুক্ষণের দাস নয়, তাই কারুর প্রয়োজনে থমকে থাকতে শেখে নি। ডুরানির জীবনে স্মৃতিই একমাত্র সেতু যা তাঁর অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে দিতে পারে। এমনি মালা গাঁথার পালা রবিবার এলে বেশ এগিয়ে চলে। সেদিন সকাল না হতেই ডুরানি ঢুকে পড়লেন হারিয়ে যাওয়া অতীত স্মৃতির মধ্যে।
সকালের মিঠে রোদ সবেমাত্র বারান্দার উপরে খেলা শুরু করেছে। ডুরানি চেয়ারে শরীর মেলে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন আর ভাবছেন। হালফিল সময়ের মূল্যবোধ তাঁর পছন্দের সঙ্গে আর ঠিকমতো মিলছে না। চারদিকে কেমন যেন ছন্নছাড়া পরিবেশ। কেউ কারুর কথা শুনতে চায় না। যে যার মতো এগিয়ে চলেছে। যেন অনুশাসন বলে কিছু নেই। তারা জানতে চায় না, মূল্যবোধহীন জীবন শুধু শূন্য কলসির মতো বাজতে জানে। তাতে না মেটে নিজের তৃষ্ণা, না মেটানো যায় অন্যের তৃষ্ণা।
সাম্প্রতিক সময়ে সকাল হলেই মনোযোগ দিয়ে দু’তিনটে খবরের কাগজ মিল করে পড়াই ডুরানির মূল কাজ হয়ে উঠেছে। রবিবার এলে সেই ইচ্ছে আরও প্রবলতর হয়ে ওঠে। সাহিত্যের পাতা থাকে সব খবরের কাগজে। সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। রকমারি বিজ্ঞাপনও থাকে। সেগুলোর উপর চোখ বোলাতে বোলাতে কম পুলকিত হন না। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। পুরনো অভ্যেস নিয়ে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে চলেছেন। বলা চলে, ডুরানির দু’চোখ শব্দের মেলায় বন্দী হয়ে পড়েছে। একমাত্র নাতী আরিফ এসে বলল, এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ দাদু?
ডুরানি শুধুমাত্র উঁ বলে আগের মতো খবরের কাগজে মুখ গুঁজে থাকলেন। একটা অভিনব সংবাদে তিনি ভীষণ আকর্ষণ বোধ না করে পারছেন না। অভিভাবকরা এসে একজন শিক্ষককে প্রচণ্ড হেনস্থা করেছেন। সেই সূত্র ধরে ঘোরালো সংবাদের ডালি। স্যার নিজের মতো যা ভেবেছেন, তা অভিভাবকরা আদৌ মেনে নিতে পারে নি অথচ ব্যাপারটা এমন কিছু ছিল না। এক অমনোযোগী ছাত্রকে পড়ার ভিতরে টেনে আনার জন্যে আলতো করে দুটো চড় মেরেছেন মাত্র। তাতেই ছেলের বাপ ক্ষেপে লাল হয়ে উঠেছেন। লোকটা পুলিশে চাকরি করেন, সব সময় কাঁধে বন্দুক থাকে। কাউকে অকারণে ভয় দেখানোই তাঁর মূল কাজ। এতে একটু বাড়তি রোজগারও হয়ে থাকে। তাঁর আদুরে ছেলের গালে চড় মারার মতো স্পর্ধা কারুর থাকা উচিত নয়। ভাবনা এমনিই। কত না যত্নেই ছেলেটাকে বড়ো করে তুলছেন। শেষ হতে না হতেই বাড়িতে হরলিক্স-বোনভিটা চলে আসে। জন্মের পর থেকে এ নিয়ে কোনো ব্যতিক্রম হয় নি। সেই ছেলেকে নিয়ে টাকার বিনিময়ে চাকরি করা মাস্টার এভাবে ছেলেখেলা করতে পারলেন? ভাবলেন, একটা প্রতিকার না করলে নয়। এমন দৃষ্টান্ত বার বার হতে দেওয়া যায় না। তাই গ্রামের কিছু লোককে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে ঢুকে সেই শিক্ষককে এভাবে হিসেব বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আরিফের ডাক নাম পাপান। তার ভাবনা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর পড়ছে বলেই কী দাদু এভাবে শুধু উঁ বলে থেমে থাকলেন? নাকি কানে কম শোনে বলেই তার কথা শুনতে পায় নি? শেষ পর্যন্ত পাপান ভাবতে পারল যে শুনতে না পাওয়ার কারণে এভাবে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। তাই আরেকটু জোরে ডাকল, ও দাদু….।
ডুরানি শুধুমাত্র উঁ বলে চুপ করে থাকলেন। দুচোখ খবরের কাগজে আটকে গিয়েছে। একটা বিশেষ মূল্যবোধ তাকে ভীষণ তাড়া করছে। শিক্ষকদের উপর এভাবে হামলা চলতে থাকলে পঠনপাঠনের স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়ে যাবে না তো? এ ঘটনার পিছনে সুদূরপ্রসারী ফলাফলও রয়েছে। বাবার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আগামি দিনে ওই ছেলের আচরণ সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চরম অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে পারে। এদের সংখ্যা বাড়লে সমাজে শৃঙ্খলার ভারসাম্য ধরে রাখা দুষ্কর হয়ে উঠবে।
পাপানের অনুযোগ ততক্ষণে রাগে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দাদু দুবার শুধু উঁ বলে থেমে থাকল? ডুরানির কাঁধে আলতো ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তুমি কী গো দাদু, ডাকলেই শুধু উঁ বলছ? শুনতে পাওনি না কী?
ডুরানি কঠোর বাস্তবে না ফিরে পারলেন না, খবরের কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে মৃদু হেসে বললেন, বলো বলো দাদুভাই, তোমার কথা শুনতেই হবে।
তাহলে দু’বার শুধু উঁ বললে কেন?
না মানে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পড়তে গিয়ে—
কবিতাটা পড়ে কিছুই বুঝতে পারি নে। মানে বুঝতে না পারলে পরের দিন পড়া দেব কী করে? রতনবাবু খবু কড়া মাস্টার, আমাদের বাংলা পড়ান। পড়া না পারলে কান ধরে এত জোরে টানেন যে মাথার ভিতরটা টনটন করে ওঠে। হেডস্যারও রতনবাবুকে দেখে ভয় পান।
ডুরানির মুখে এক চিলতে হাসি। রতনবাবুর জয়লাভে নিজের জয়লাভ দেখতে পাচ্ছেন। শিক্ষক এমন হলে তবেই ছাত্রছাত্রীদের জীবনে শৃঙ্খলা ধরে রাখা সম্ভব। এমনও ভাবলেন, কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জীবনে শুরুতেই শৃঙ্খলার বীজ বপন করা খুব জরুরী? ডুরানির মনে দ্বিতীয় খুশির কারণ একান্তই ব্যক্তিগত। তাঁর নাতি পাপান রয়েছে রতনবাবুর কড়া তত্ত্বাবধানে। সেই অর্থে পাপানের বড়ো হওয়া নিয়ে মনে মনে কেমন যেন অনেকখানি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন। অভিভাবকদের উস্কানিতে আজকালকার ছেলেমেয়েরা যেভাবে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলছে, পাপান অন্তত বড়ো হয়ে সেপথে হাঁটতে পারবে না। রতনবাবুর দান করা অভ্যেসের অনুশীলন তার জীবনে বড়ো কাটআউট হয়ে উঠবে। কিছুতেই তাঁর নাতি নতুন করে ব্যতিক্রম হতে পারবে না। জোয়ারের স্রোত সব সময় সামনে চলে, কখনো পিছন ফিরতে জানে না।
আরেকটা নতুন স্মৃতিচারণ ডুরানির মধ্যে ক্রমে বড়ো হয়ে উঠছে। আলিম ডুরানি তাঁর ছেলে, সে এত কীর্তিমান হয়ে উঠতে পেরেছে কেবলমাত্র বন্ধুবর নীরজের তত্ত্বাবধানে বড়ো হয়ে উঠতে পেরেছে বলেই। বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধায় নত হতে হতে দিব্যি বুঝে গেলেন, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে কঠোর পরিশ্রমী হতেই হবে। সেই অনুসরণের যাদু এখন তার ছেলের জীবনে সোনা হয়ে উঠেছে। বাবা থানার শাঁসালো ওসি। তার ছেলে পাপান, সে ব্যতিক্রম হতেই পারে না। একেই বলে ট্রাডিশন। ভাবতে ভাবতে আবেগের কলকলানিতে ডুরানি ভেসে চলেছেন। ছেলে আলিমের ডাকনাম আকাশ। তাতেই ডুরানির মধ্যে গর্বের শেষ ছিল না। কেবল ভাবতে পারলেন যে তাঁকে অনুসরণ করে ছেলে আলিম সত্যি সত্যি আকাশ হয়ে উঠতে পেরেছে। ডাকনাম রাখা এ যুগে নতুন চল হয়ে উঠেছে যা ডুরানি বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছেন।
পাপান বিরক্ত হয়ে বলল, ও দাদু, আবার নতুন কিছু ভাবছ নাকি?
ডুরানি পাপানকে কোলে তুলে নিয়ে আদর দিতে দিতে বললেন, আগে কবিতাটা ভালো করে পড়ে শোনাও, তারপর তোমাকে মানে বোঝাচ্ছি।
পাপান জানে, বয়সজনিত কারণে দাদু কানে বেশ কম শোনে। তাই জোরে শব্দ করে পড়তে থাকল—
এ ওয়াইজ ওল্ড বার্ড
লিভড্ ইন দি ওক
দি মোর হি হার্ড
দি লেস হি স্পোক
শুনতে শুনতে ডুরানি আবার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভাবলেন, ছোটোদের ছড়া হলেও এর মধ্যে বড়োদের জীবনদর্শন রয়েছে। সামনের উঠোনে বড়ো গাছের আড়াল ঠেলে সূর্যের আলো তখনও সামনের চত্বরে ঠিকমতো ছড়িয়ে পড়তে পারে নি। ডুরানির দুচোখ সেদিকেই।
পাপান বিরক্ত হয়ে বলল, আবার শুধু শুধু কী সব ভাবছ?
ডুরানি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, এভাবে রাগতে নেই দাদু, তুমি কিছু বুঝতে চাইলে আমি কী চুপ করে থাকতে পারি?
কবিতাটার মানে ভালো করে বুঝিয়ে দাও।
এখন তো মানে জানতে হয় না দাদুভাই। শুধু মুখস্ত করলেই চলে। এ ব্যাপারে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো একশভাগ এগিয়ে রয়েছে। কথা বলতে হবে ইংরেজিতে, ঘুমাতে হবে ইংরেজিতে, খেলতে হবে ইংরেজিতে, স্বপ্ন দেখতে হবে ইংরেজদের আদলে। দেশটা স্বাধীন হলেও আমাদের শিক্ষা জগতের উপরে ইংরেজদের প্রভাব এখনও অনেকখানি রয়ে গেছে। দেশকে ভুলে থাকার নতুন ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। বাঙালিত্ব ভুলে, দেশকে ভুলে চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো এখানে সেখানে গড়ে উঠছে। এতে ছাত্রছাত্রীদের যে মগজ ধোলাই ছাড়া কিছুই হচ্ছে না, তা নিয়ে ডুরানির মধ্যে কোনো সন্দেহ ছিল না।
পাপান উত্তর না পেয়ে মনে মনে গজগজ করতে থাকল। বুড়ো হয়ে গেছে বলেই দাদু কেবল বাজে বকে, কী প্রশ্নে কী উত্তর দিতে হবে, সেটুকুও জানে না। ডুরানির ডান হাত চেপে ধরে বলল, কী সব মাথামুণ্ডু ভাবছ তুমি? কাল স্কুলে রতনবাবুর হাতে আমাকে নির্ঘাৎ মার খেতে হবে। তা না ভেবে কেবল—, এজন্যে তোমার উপর ভীষণ রাগ হয়।
মুখ ঘুরিয়ে পাপান ভিতরের বিরক্তি প্রকাশ করে। ডুরানি নাতিকে পাশে বসিয়ে বললেন, তাহলে মানেটা মনোযোগ দিয়ে জেনে নাও দাদুভাই। এক জ্ঞানী বুড়ো পাখি। সে থাকত ওকগাছে, শুনত খুব বেশি, কথা বলত কম।
পাপানের ভিতরে কৌতূহলের পাহাড় জমে উঠল। দাদু এসব কী বলছে? এতদিন ধরে স্যারেদের নিয়ে তার মধ্যে যে বড়ো ধারণা গড়ে উঠেছে, দাদু তার বিরুদ্ধেই বলছে। পাপানের স্থির বিশ্বাস, স্যাররা বেশি জানেন বলেই এভাবে বকবক করে কথা বলতে পারেন, ছাত্রছাত্রীরাও তাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়। বেশি জ্ঞান আছে বলেই তো নানা বিষয়ে এভাবে স্যারেরা কথা বলতে পারেন।
আরেকটা নতুন সূত্র এসে পাপানের মাথায় দোল খাচ্ছে। ছড়াটা পাখিদের নিয়ে লেখা হতে পারে কিন্তু যিনি লিখেছেন, তিনি খুব জ্ঞানীমানুষ। কিছুতেই তিনি ভুল লিখতে পারেন না। বরং দাদু ভুল মানে করছে বলেই পাপানের বিশ্বাস হল। একটু মানসিক দ্বিধা নিয়ে বলল, মানেটা ঠিক মাথায় ঢুকল না দাদু।
কেন, নতুন কোনো প্রশ্ন জাগছে মনে?
কেবল মনে হচ্ছে, কবিতার মধ্যে অন্য কিছু লেখা আছে, তুমি আমাকে ভুল মানে শোনাচ্ছ।
এভাবে ভাবতে নেই দাদুভাই। বিদ্যালয়ে যে সব জ্ঞানী স্যাররা তোমাদের পড়ান, তাঁরা বক বক করতে বাধ্য হন বিষয়গুলো তোমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিতে। নতুন করে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানী করে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু অন্যান্য জ্ঞানীদের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁরা নানা বিষয় নিয়ে এত ভাবেন যে কথা বলার মতো যথেষ্ট সময় পান না।
তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করব দাদু?
নিশ্চয় করতে পারো।
কবিতায় যে বুড়ো পাখিটার কথা বলা হয়েছে, তার নাম কী?
তা নিয়ে তুমি কী ভাবছ বলো?
প্যাঁচা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
কবিতায় পাখিটার কোনো নাম নেই। তাহলে জানলে কী করে, এটাই প্যাঁচা?
কী যে বলো দাদু। কবিতার উপরে ওই তো একটা রঙিন ছবি। ওটাই দেখে তো নামটা বলতে পারলুম, চোখের সামনে ধরলে তুমিও ঠিক বুঝতে পারবে।
ডুরানি উৎসাহ দিয়ে বললেন, তোমাকে ঠিক ওই প্যাঁচার মতো হতে হবে দাদুভাই, না হলে যে জ্ঞানী হতে পারবে না।
পাপানের শরীর বিড়বিড় করে উঠল। প্যাঁচার বুদ্ধি থাকতে পারে কিন্তু শরীরটা কী বাজে দেখতে। চোখদুটো ভিতরে ঢুকে আছে। কর্কশ স্বরে ডাকে। পাপানের শরীরের বিড়্‌বিড়ানি আরও বেড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল, আমাকে প্যাচার সঙ্গে তুলনা করলে দাদু?
প্রাক্তন কেরানি ডুরানি হো হো শব্দ করে হেসে উঠলেন। বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন, প্যাঁচার বিশ্রী শরীর দেখে ভয় পাচ্ছ দাদুভাই? পাখিটার ভিতরে চিন্তা করার কত বড়ো শক্তি আছে, তা নিয়ে ভাববে না? গভীর ভাবনায় ডুবে যেতে পারে বলেই তো প্যাঁচার পক্ষে এত সব জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হয়েছে।
তাহলে তুমিও তো একধরনের প্যাঁচা।
একথা বলছ কেন?
সারাদিন চুপচাপ বসে থাকো। একমনে খবরের কাগজ পড়ো। বসে বসে কী সব ভাবো। জিজ্ঞেস করলে শুধু উঁ বলো। আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না, পাশে বসে আমি বক্‌বক করি, তুমি শুধু উঁ বলো।
আমাকে নিয়ে এত ভাবো দাদুভাই?
তাহলে ঠিক বলেছি তো?
ডুরানি আবার হেসে উঠলেন। বুঝলেন, বয়সে ছোটো বলেই পাপানের পক্ষে জীবনের গভীর দর্শন বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার সব হিসেব সোজাসুজি। পাপানকে জড়িয়ে ধরে আরেকটু আদর দিতে দিতে বললেন, আমি তো সারাদিন তোমার সঙ্গে বক্‌বক করে কথা বলি।
বাপি বাড়িতে থাকলে তো তুমি আমার সঙ্গে কোনো কথাই বলতে চাও না। কেবল ইশারা করে এটা ওটা বলো। এসব আমি বুঝতে পারি দাদু।
আবার ডুরানির অট্টহাসি, প্রাণখোলা মনোভাবের প্রকাশ। কেন চুপ করে থাকি জানো দাদুভাই? তোমার বাপি মস্ত বড়ো পুলিশ অফিসার। বেফাঁস কথা বলে তো তাকে ছোটো করতে পারি না।
মিথ্যে কথা বলছ দাদু।
এভাবে ভাবছ কেন?
মা আমাকে অন্য কথা বলেছে। তুমি তো আজকাল বাপিকে একদম দেখতে পারো না। নিজেকে আড়াল করার জন্যেই এভাবে চুপচাপ থাকো।
ডুরানি আর হাসতে পারলেন না। বুঝতে পারলেন, নাতির কাছে ধরা পড়ে গিয়েছেন। কঠোর বাস্তবে পাপান বয়সে অনেক ছোটো, বুদ্ধির ঘরে সেভাবে পরিপক্কতা আসে নি কিন্তু তার অনুভূতিতে নতুন বোধ তৈরি হয়েছে। সেই শক্তি নিয়ে সে এত কথা বলতে পারছে। প্রসঙ্গ পাল্টে দিতে ডুরানি বললেন, একটা গল্প শুনবে দাদুভাই?
গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে দাদু, বলতে বলতে থেমে যাবে না তো? কতবার যে এভাবে থেমে গিয়েছ। ভারি রাগ হয় তোমার উপর। একটানা গল্প না শুনলে ভালো লাগে না আমার।
ডুরানির মুখে এক চিলতে হাসি, পাপানের ভাবনাকে এভাবে অন্য খাতে বইয়ে দিতে পেরেছেন বলেই একটু পুলকিত হলেন। তারপর নাতির দিকে চোখ রেখে বললেন, তাহলে শোনো দাদুভাই…
পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা বড়ো নদী চড়াই উৎরাই পার হতে হতে চলার পথে একটা শাখা নদীর জন্ম দিতে পারে নিজের শরীর থেকে কিন্তু জলের গুণগত মানে কত পার্থক্য জানো? বড়ো নদীর জল যেমন মিষ্টি, তেমনি স্বচ্ছ, কিন্তু ছোটো নদীর জল লোনা আর ঘোলা। বড়ো নদীর মনে এ নিয়ে দুঃখের শেষ ছিল না, কেবল ভাবত, নিজের শরীর থেকে জন্ম নেওয়া শাখা নদীটার ভাব প্রকৃতি এত ভিন্ন হল কী করে?
পাপান হেসেই চলছে। নিজেকে কিছুতেই থামাতে পারছে না। কেবল ভাবছে, দাদু তাকে গল্প শোনানোর নাম করে বানিয়ে বানিয়ে যা তা বলছে। মানুষের মতো নদীর মন থাকতে যাবে কেন? দাদু জোর করে নদীর জীবনে মানুষের মন ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাই ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, নদীর আবার মন আছে নাকি?
আছে দাদুভাই, আছে।
কী করে তা সম্ভব বলবে তো?
তুমি কী তোমার মনটা দেখতে পাও? নদীর মনটাও তেমনি। চোখে দেখা যায় না, তাই অনুভূতি দিয়ে নদীর কথা বুঝে নিতে হবে। নিজেই যখন নদী হয়ে উঠবে, তখন বুঝতে পারবে ভিতরের মন কীভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলছে।
পাপান অট্টহাসি শুরু করল, ডুরানির শরীরে একটু ঠ্যালা দিয়ে বলল, কী সব বাজে বকছ দাদু? আমি নদী হতে যাব কেন? এখন বাচ্চা হয়ে আছি, পরে বড়ো মানুষ হব। তুমি কী নদী হতে পেরেছ? তাহলে আমাকে নদী হতে বলছ কেন? মানুষ কী কখনো নদী হতে পারে? এজন্যে বাপি তোমাকে পাগল বলে।
তাই বলে নাকি? ডুরানির শরীরে হঠাৎ করে কেমন যেন বিদ্যুতের শক খেলে গেল। থমকে থাকলেন বেশ কিছু সময়, দুচোখ পাপানের দিকে স্থির করে রাখলেন। একটাই ভাবনা মাথার ভিতরে চক্কর মারছে। শিশুদের তো একটাই বৈশিষ্ট্য, কখনো মিথ্যে কথা বলতে পারে না, যা শোনে, অকপটে সেটাই প্রকাশ করে দেয়। এজন্যে পাপানের মধ্যে ডুরানি কোনো দোষ দেখতে পেলেন না বরং ছেলে আকাশকে নিয়ে নতুন ভাবনায় ডুবে যেতে বাধ্য হলেন। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে বড়ো করে তুলেছেন, কর্মজীবনে এখন সে শাঁসালো অফিসার ইন চার্জ, অনেক লোককে নিয়ে তাকে চলতে হয়, একটা বড়ো এলাকার শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তার মাথার উপর। সেই আকাশ কিশোর পাপানের সামনে এভাবে তাকে নিয়ে মন্তব্য করতে পারল? নিজের বাবাকে পাগল বলে সমাজের বুকে কী চল প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে? নিজের জীবনে বড়ো হওয়ার পর্বগুলো ভুলে এভাবে তাকে আঘাত করার পিছনে অন্য কোনো মতলব নেই তো? পাপান মিথ্যে করে এসব বলতে যাবে কেন? আবার জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, তোর বাপি কী সত্যি সত্যি আমাকে পাগল বলেছে?
বলেছে বলেই তো তোমাকে বলতে পারলুম। রাতে খেতে বসে মাকে বোঝাচ্ছিল, ওই সব নীতিকথা কানে তুলবে না, বুড়ো হলে মানুষ এভাবেই পাগল হয়ে যায়। নিজের স্বার্থটুকুও বুঝতে পারে না। জন্ম দেওয়া ছেলের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবতেও ভুলে যায়। রাতদিন কেবল নিজের ফাঁকা আদর্শের পাগলামিতে মজে থাকে।
ডুরানি আরও গম্ভীর না হয়ে পারলেন না। একমাত্র ছেলে আকাশকে গড়ে তোলার পর্বগুলো পর পর ভেসে উঠছে। সারা জীবন যত রোজগার করেছেন তার বারো আনা অংশ ব্যয় করেছেন আকাশকে গড়ে তোলার জন্যে। ছোটোবেলায় ছেলেকে মেধাবী জানতে পেরে তাঁর মধ্যে একটা স্বপ্ন ক্রমে আকাশমুখি হয়ে উঠেছিল। পিছনে লেগে থাকতে পারলে ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। দেশের মানুষের কাছে মাথা উঁচু করে চলার নতুন পথ পাবেন তিনি। পাপানের মুখে মূল্যায়ন শুনে তাই এত বেশি করে চমকে উঠতে বাধ্য হলেন, দুধে পাপানকে শুনিয়ে নিজের বাবাকে নিয়ে এসব বলা যে কত বড়ো অন্যায়, তা নিয়ে আকাশ একবারও ভাবতে পারল না? পাশে বসে থাকা পাপানের গায়ে কোমল হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার বাপি তো ঠিক কথাই বলেছে। বুড়ো হয়ে গেলে মানুষ কী ভাবতে কী ভেবে ফেলে।
নীরজ মল্লিক, ডুরানির বাল্যবয়সের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কয়েক বছর আগে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ডুরানির কথাগুলো শুনে চমকে না উঠে পারলেন না। বাবাকে নিয়ে ছেলের মন্তব্য এত নিম্নমুখি হতে পারে? নীরজের মনের তলানিতে একটা দুঃখভার দুরন্ত গতিতে ছুটছে ঘূর্ণিঝড়ের মতো। দিনকাল পাল্টে যাওয়ার সংকেত তাঁকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। পরিবর্তনের নতুন নতুন ধাপ বাপ ছেলের সম্পর্কের নিগূঢ়তায় এত জোরে থাবা বসাতে পারল? নিজের হাতে চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন, এটা শুধু তোমার ব্যক্তিজীবনের পরাজয় নয় ডুরানি, এর ভিতরে রয়েছে এ যুগের গভীর যন্ত্রণা। আকাশের মুখ থেকে যা বের হয়েছে, তা যুগযন্ত্রণার একটা প্রকাশ মাত্র।
ডুরানি বন্ধু নীরজকে সাদর আপ্যায়ণ জানাতে এতটুকু ত্রুটি রাখলেন না। দু’জনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। স্কুল জীবনে তার সূত্রপাত। এতদিন পাশাপাশি চলার সূত্রে দুজনের চাকরি জীবন শেষ হয়ে গেলেও দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে এতটুকু ভাটা পড়ে নি। সেই সূত্র ধরে ডুরানি বললেন, চলতি জীবনের স্রোতে প্রকৃত সম্পর্ক-চেতনা যে এত তাড়াতাড়ি পাল্টে যাবে, তা ভাবতে পারি নি নীরজ।
তা বলেছ ঠিক।
ডুরানি নীরব চোখে চেয়ে থাকলেন আবাল্য বন্ধুর দিকে। নীরজ যে খাঁটি ভদ্রলোক, তা নিয়ে তাঁর মধ্যে একবিন্দু সন্দেহ নেই। খুব মিশুকে। গ্রামীণ জীবনের দরদ বোঝে বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এত বেশি জনপ্রিয়।
নীরজ পাপানকে কাছে ডেকে নিয়ে মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করলেন। নিজের শরীরটা পাপানের শরীরের সঙ্গে সেঁটে দিয়ে বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। তারপর পাপানকে উদ্দেশ্য করে তাঁর ছোট্ট প্রশ্ন, বলো, কেমন আছ দাদুভাই?
মাস্টারদাদু, তোমাকে আজ একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। দাদু ঠিকমতো বলতে পারে নি। তুমি আমার মাস্টারদাদু, তাই মনে হচ্ছে তুমিই ঠিকমতো উত্তর দিতে পারবে।
নীরজ দু’চোখ স্থির করে চেয়ে থাকলেন পাপানের দিকে।
বড়ো বড়ো জ্ঞানীরা যদি চুপ করে থাকেন, তাহলে দেশের মানুষ জ্ঞানলাভ করবে কী করে? কোনো কাজে না আসলে এভাবে জ্ঞানলাভ করে লাভ কী? অন্যদেরকে দেওয়ার জন্যে কী জ্ঞানলাভ করেন নি?
পাপানের প্রশ্নের গভীরতা মাপতে মাপতে নীরজ খুশি না হয়ে পারলেন না। ডান হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে পাপানের চুলের ভিতরে আবার বিলি কাটতে কাটতে একটা ছোটো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, দারুণ কথা বলেছ দাদুভাই। পণ্ডিতরা তর্কযুদ্ধ করতে চান না বলেই এভাবে চুপ করে থাকেন।
পাপানের জন্যে একটা অচেনা গর্ব ডুরানির মধ্যে ক্রমে উতলে উঠছে। নীরজকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখলে নীরজ, আমার দাদুভাই জীবন জানার জন্যে কত বেশি উদগ্রিব হয়ে উঠেছে। সকালে বিকেলে এমনি নানা প্রশ্ন করে আমাকে তটস্থ করে রাখে। ওর মধ্যে প্রশ্নের শেষ নেই। এটা হবে কেন, ওটা হল কেন, এতদিন এসব হয় নি কেন, এমনি বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরছে মাথার ভিতরে। আমার উপর একটাই দাবি, আমি যেন ওর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিই। শোনার পরে এমন করে ভাবতে থাকে যে নিজেই অবাক না হয়ে পারি না।
একটু থমকে থাকার পরে নীরজ বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, কার নাতি ভাবতে হবে তো।
ডুরানি হো হো করে হেসে উঠলেন। নীরজও সেই হাসিতে যোগ দিলেন। পাপান মাস্টারদাদুর বাহুডোর ছাড়িয়ে মাকে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
রান্নাঘর থেকে রেহেনার প্রশ্ন, এভাবে গলা ফাটাচ্ছিস কেন রে?
দেখতে পাচ্ছ না, মাস্টারদাদু এসেছেন, এখনও তো চা-বিস্কুট খেতে দিলে না।
ডুরানি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, আমার নাতির কেমন সামাজিক জ্ঞান দেখো নীরজ। তোমাকে যে চা-বিস্কুট দিতে হবে, তাও পাপান জানে।
বেলা বেড়ে বেড়ে কয়েক বাঁশ উপরে উঠে গেছে। বাড়ির সামনে বড়ো নিমগাছতলায় ছায়ারোদের লুকোচুরি খেলা চলছে। নীরজ সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মনে মনে পাপানকে নিয়ে ভাবছেন। ছেলেটা বেশ। কত সহজে তাকে আপন করে নিতে পেরেছে। আরেকটু পরে রেহেনা ওরফে হেনা চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। আকাশই প্রথম রেহেনাকে হেনা নামে ডাকতে শুরু করেছিল। অদ্ভুত ব্যাখ্যাও দিয়েছিল। হেনা ফুলে খুব গন্ধ, তোমাকে ডাকলে সেই সুগন্ধ পাই তাই—।
নীরজ জানেন, পাপানের বিস্কুটের ভাগ রয়েছে তার প্লেটে। গলার স্বর উঁচু করে ডাকলেন, গেলে কোথায় দাদুভাই?
পাপান ঘাড় নীচু করে ঘরের ভিতরে এসে নীরজের কোলের উপর চেপে বসল। নীরজ তার হাতে দুটো বিস্কুট গুঁজে দিয়ে বললেন, ধরো দাদুভাই, খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ো, তোমাকে ঠিক দাদুর মতো হতে হবে।
পাপানের মধ্যে নতুন ধন্দ দোল খাচ্ছে তালে তালে। মাস্টারদাদু এত ভুল বলতে পারলেন? দাদু সারাজীবন কেরানি হয়ে কর্মজীবন শেষ করেছেন, কাউকে হুকুম করার সুযোগটুকুও পান নি। তুলনায় তার বাপি মস্ত বড়ো পুলিশ অফিসার। কত অপরাধীকে জোর করে বাড়ি থেকে ধরে আনতে পেরেছে। বাপির ভয়ে বাড়িতে দাদুকে সিঁটিয়ে থাকতে হয়। মাস্টারদাদু তাকে বাপির মতো হতে বলল না কেন? পাপানের মনে কৌতূহলের পারদ চড়ছে ধীরে ধীরে। নীরজকে উদ্দেশ্য করে বলল, এভাবে ভুল বলতে পারলে মাস্টারদাদু?
নীরজ পাপানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আমাকে বাপির মতো হতে বললে না কেন? এজন্যেই বাপি মাকে শুনিয়ে অনেকবার বলেছে, বেশি বয়স হয়ে গেলে মানুষ কী বলতে কী বলে বসে, ঠিক পাগলের মতো অবস্থা।
হেঁসেল থেকে হেনার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আঁকার মাস্টার এসে গেছে রে খোকা।
যাই, বলে পাপান ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আসলে নীরজ এসেছিলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর ডুরানিকে শোনানোর জন্যে। পাপানের উপস্থিতির কারণে তা বলা এতক্ষণ সম্ভব হয় নি। ভেবেছেন, পাপানের সামনে খবরটা প্রকাশ করলে তার শিশুমনে ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ফাঁকা সময় বুঝে নীরজ ডুরানির পাশে এসে বসলেন, কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরটা পড়ে ফেলতে পেরেছ তো?
কী খবর বলো তো?
ওই তো তোমার পাশে খবরের কাগজ রয়েছে, চারের পাতা খুললে দেখতে পাবে।
আগে বলো, কী নিয়ে এই খবর বের হয়েছে?
বাবু বোসের ফ্যাক্টরিতে একজন কর্মী খুন হয়েছে, পিছনে রয়েছে খুব জটিল রহস্য। রাজনীতির দলগুলো এ নিয়ে তোলপাড় করতে শুরু করেছে। ঘটনা ঘটলে সব দল ঘোলা জলে তাদের লাভ ঘরে তুলতে চায়। এ দেশের রাজনীতিতে ঘোলা জলে মাছ ধরার দৃষ্টান্ত ক্রমে প্রকট হয়ে উঠছে।
এসব জেনে আমাদের লাভ কী? দুবেলা এমন ঘটনা যেখানে সেখানে ঘটছে। খবরের কাগজ পড়ে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কী?
খবরটা ভালো করে পড়লে তুমি অন্য জিনিস জানতে পারবে। খুনের অভিযোগে পুলিশ অফিসার একজন লেবারকে গ্রেপ্তার করেছে।
কী বলছ নীরজ? এ তো খুনের চেয়ে আরও বড়ো খবর। এর মানে হল তো একজন লেবারের হাতে আরেকজন লেবার খুন হয়েছে। ভিতরে যে রহস্য রয়েছে, তা নিশ্চয় অনেক বেশি গভীর!
ঠিক ধরেছ ডুরানি, পিছনের তথ্য ফাঁস হলে আরও বড়ো কঠোর বাস্তবতা বের হয়ে আসবে।
চা-বিস্কুট দিতে হেনা এসে ঘরে ঢুকল। নীরজ বললেন, ভালো আছ মা, আবার চা আনলে কেন? বাড়ি থেকে খেয়েই বের হয়েছি।
শুধু আপনার জন্যে নয়, পাপানের বাড়তি বিস্কুট খাওয়ার ইচ্ছা মেটাতে চা-বিস্কুট দিতেই হবে।
ওর মুখে মাস্টারদাদু সম্বোধন শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।
হেনা পাপানকে উদ্দেশ্য করে ডাকতে শুরু করল, ওরে, আর লজ্জা করিস নে। তোর মাস্টারদাদু ডাকছেন রে, এলে তবে তো বিস্কুট খেতে পাবি।
নীরজ মল্লিকের প্লেট থেকে বিস্কুট তুলে খাওয়া পাপানের অনেক পুরনো অভ্যেস। দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকে মাস্টারদাদুর প্লেট থেকে দুটো বিস্কুট নিয়ে আবার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নীরজ বাড়িতে এলেই পাপানের কপালে এই সহজ সুযোগটুকু জুটে থাকে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হল না।
নিরিবিলি খেতে খেতে দুই বন্ধুর আলাপচারিতা নতুন করে শুরু হল। নীরজ বললেন, খুন হয়ে যাওয়া লেবার তার শেষ বিবৃতিতে কী বলে গেছে জানো?
ডুরানি অবাক বিস্ময়ে নীরজ মল্লিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বাবু বোস লোক দিয়ে খুন করালেও সেই দায় তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডুরানি অবাক বিস্ময়ে নীরজের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবছেন আপন মনে। এ তো দেখছি ভীষণ জটিল ব্যাপার। আজকাল কী এমনি করে সত্যের অপলাপ ঘটে চলেছে?
ভেতরে আরও খবর আছে ডুরানি।
আরও জটিল খবর?
ঠিক তাই। তোমার আকাশের নাম একেবারে সামনে চলে এসেছে। ও নাকি বাবু বোসের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়েছে দুটো পৃথক কারণে। খুনের সঙ্গে যাতে বাবু বোসের নাম জড়িয়ে যেতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে আকাশকে। দ্বিতীয়ত, একজন আনকোরা লোক ধরে এনে তাকে খুনি সাজাতে হবে।
হেনা আবার ঘরে ঢুকে খুব শান্ত স্বরে নীরজকে উদ্দেশ্য করে বলল, সব কিছু জেনে এসব বলছেন তো? আকাশ পুলিশে চাকরি করে। বিরুদ্ধে বলার জন্যে লোকজনের অভাব থাকার কথা নয়। তাদের কথা শুনে এসব বলছেন নাতো? আপনি আমার গুরুজন স্থানীয়, অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করি আপনাকে, তাই আশা করতেই পারি, আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কিছু বলবেন না। আমার শ্বশুর আপনার ঘনিষ্ট বন্ধুপ্রতিম, তাঁর একটা নিজস্ব ভাবমূর্তি রয়েছে। আকাশ কী পারবে জোর করে সেই স্রোতের বাইরে যেতে? আমার তা মনে হয় না। আপনি কেন যে এত বেশি নাসূচক ভাবনায় জড়িয়ে পড়েছেন, তা মাথায় আসছে না।
হেনা, তুমি যা বললে, এর বাইরে একজন সতী সাধ্বী স্ত্রীর নিজস্ব ভাবনা থাকতেই পারে না। প্রথম শুনে তুমি যেভাবে প্রতিবাদ করলে, আমিও সেভাবেই প্রতিবাদ করেছি। আকাশ তোমার স্বামী, আমার প্রিয়তম ছাত্র। তার চেয়ে বড়ো কথা, সে আমার বাল্যবন্ধু ডুরানির ছেলে। তাই প্রথম শুনে বার বার মনে হয়েছিল, এ কাজ আকাশ করতেই পারে না। বাবার আদর্শে লালিত পালিত হয়ে সে বড়ো হয়ে উঠেছে। সেই অর্থে তার পক্ষে তুচ্ছ কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তারপর যত বেশি ঘটনার ভিতরে ঢুকে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি, তত বেশি নতুন নতুন সূত্র বের হয়ে এসেছে। তাতেই আকাশকে সন্দেহ না করে পারি নি। যে লোকটাকে জোর করে খুনি হিসেবে সাজানো হয়েছে, তার বয়স কত জানো হেনা? মাত্র পঞ্চাশ। টানা পঁচিশ বছর সে এই কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। তাতেই তার সংসার চলে। বাড়িতে ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের পড়াশোনা নিয়ে ভাবতে হয়। এত সব বাস্তববোধ বাদ দিয়ে সে অন্য আরেকজন লেবারকে খুন করতে যাবে কেন? তুমি বাবু বোসকে ঠিকমতো চেনো না। লোকটা পারে না, এমন কাজ নেই। লেবার খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়া লোকটার কোনো স্বার্থ না থাকলেও এ খুনের পিছনে বাবু বোসের স্বার্থ পূরণের অনেক কারণ লুকিয়ে রয়েছে। সে সব নিয়ে ভাববে না হেনা? স্বামীর জন্যে স্ত্রী হয়ে যে আবেগ বিহ্বলতা প্রকাশ করলে তা অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিচ্ছি কিন্তু কঠোর বাস্তব কী অন্য কথা বলছে না? তোমাকেও শক্ত মন নিয়ে এসব ভাবতে হবে হেনা।
স্বামীই নারীর জীবনে আরাধ্য দেবতা। তাকে নিয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা না সূচক মন্তব্য শুনতে হচ্ছে হেনাকে। মন থেকে মেনে নেওয়া কঠিন কিন্তু মেনে না নিয়ে উপায় কী? যে লোকটাকে রোজ দেবতা হিসেবে বরণ করে নিতে হয়, বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে হয়, তার বিরুদ্ধে এভাবে কথা উঠলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে আটকে পড়ে থাকতে হচ্ছে তাকে। মনের গভীরে একটা নতুন প্রশ্ন বার বার উঁকি মারছে। নীরজ মেসো ইচ্ছে করেই আকাশের বিরুদ্ধে এত কথা বলতে যাবেন কেন? আকাশের জন্যে আগে অনেক বার তাঁকে প্রাণ ঢেলে প্রশংসা করতে শুনেছি। তিনি কেন আজ আকাশের বিরুদ্ধে এভাবে সোচ্চার হতে চাচ্ছেন, তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। এমন তো হতে পারে, তাকে লুকিয়ে আকাশ বিশেষ অঘটনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, যা আজও তার পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি। ভাবনার ঝড়ে বিধ্বস্ত হেনা বিমূঢ় মুখে পায়ে পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ডুরানি ছেলের জন্যে খুব বেশি অশান্ত হতে পারলেন না বরং একটা আক্ষেপ তাঁর সমগ্র হৃদয় জুড়ে ধিকি ধিকি জ্বলছে ছাইচাপা আগুনের মতো। একটিমাত্র ছেলে, অনেক কষ্টে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তা নিয়ে তাঁর মধ্যে একটা বিশেষ স্বপ্নও ছিল। তাঁর মতো সত্যের পথে চলতে পারলে লোকসমাজে বিশেষ সম্মান প্রাপ্তি সুলভ হয়ে উঠবে বলেও ভেবেছিলেন। ছেলের জন্যে একজন পিতা কতটা গর্বিত হতে পারে, তা ডেকে ডেকে অনেককে শোনাতে পারবেন। সেই ছেলে এভাবে এত বড়ো অপকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারল? একটা কঠিন আক্ষেপ ঝমঝম বৃষ্টির মতো ডুরানির মনের দু’কুল ছাপিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে মুখ করে আবার বলতে শুরু করলেন, জীবনের শেষ বেলায় এভাবে যে নতুন করে শুরু করতে হবে, তা ভাবতে পারি নি নীরজ। বলো তো, সব কিছু ঢেলে সাজানোর সময় কী আমাদের জীবনে আছে? আকাশ আমাদের বাধ্য করছে সেই পথে ছুটতে। না সূচক অভিজ্ঞতার জ্বালা কত বেশি যন্ত্রণাদায়ক, এখন বেশ বুঝতে পারছি কিন্তু এত ভার সহে নিতে পারব তো নীরজ?
এভাবে ভেঙে পড়তে নেই ডুরানি। চারদিকে মেকি ক্লেদাক্ত জাগতিক সভ্যতার কুফল শুরু হয়ে গেছে। আমরা এতদিন যে সব সদর্থক সুফল দেখে আসছি, তাৎক্ষণিক ভাটার স্রোতে সেগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। পরিবর্তে নানা অঘটন দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। কেবল ভাবছি, জীবনে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু তার জন্যে এত নীচে নামতে হবে কেন? আকাশ বাড়িতে ফিরলে ওকে একটু বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। হয়তো দেখবে, আবেগের বশে একটা কাজ করে ফেললেও যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিতে পারবে। আমার কী মনে হয় জানো, তোমার বৃত্ত থেকে যার উত্থান, তার পক্ষে খুব বেশি দিন চিত্তহারা হয়ে থাকা সম্ভব হবে না। শুধু সচেতন করে দিতে পারলেই বোধ হয় আকাশ পূর্ব অবস্থানে ফিরে আসতে পারবে। এ ঘটনার জন্যে একা আকাশকে শুধু শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই। চলতি সমাজের বুকে নেতিভাবের যে ঝড় বয়ে চলেছে, তা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে আকাশ হয়তো নিজেকে রক্ষা করতে পারে নি কিন্তু ওর নাম আকাশ, তোমার জীবনের জোয়ার ওর জীবনে সবচেয়ে বড়ো সত্যি। তা ভুলে ও খুব বেশিদিন থাকতে পারবে না। যেভাবে ওর জন্যে তিলে তিলে ত্যাগ করেছ, আমি আজও প্রত্যাশা করি, ত্যাগের সেই জোয়ারে আকাশকে ফিরে আসতেই হবে। নিজের হাতে গড়া আকাশ তোমার একমাত্র ভবিষ্যৎ, সে কখনো ফলকা কাঁচের মতো ভেঙে যেতে পারে না।
বড়ো দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল ডুরানির বুক থেকে। —জানো নীরজ, বিভিন্ন তীর্থস্থানে বেশ কয়েকবার ঘুরেছি, কিন্তু তার সুফল ছেলের উপর তেমনভাবে পড়ল না কেন? আমার তো একটাই প্রার্থনা ছিল, আকাশকে আমার মতো গড়ে দাও প্রভু। এখন দেখছি, সেই আবেদন কোনো কাজে আসে নি। আকাশের জীবনে তার কোনো প্রভাব দেখতে পেলুম না। মুখোশের আড়ালে থেকে বিফলতা দেখতে দেখতে কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। দিনকাল যে এত দ্রুত পাল্টে যাবে, তা কোনোদিন ভেবেও দেখি নি। এখন ভাবছি ক’দিন পরে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও পাব না।
সেই ভয় আমার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। মনে হচ্ছে, চলতি অবস্থান থেকে আমরা দ্রুত পিছিয়ে পড়ছি। যে যুবকরা আমাদেরকে বোকা ভাবছে, তাদেরকে বড়ো করে তোলার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। এখন যেন সেসবের কোনো মূল্য নেই। তোমার মতো আমিও মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ঘুরেফিরে তোমার কাছে আসি কেন জানো? এত যে গভীর দুর্ভাবনা তা থেকে পরস্পর আলোচনা করে একটু রিলিফ না পেলে তো জীবন স্ট্যান্ডস্টিল হয়ে যাবে।
ডুরানির চাপা স্বগতোক্তি, এত ভেবে আর লাভ নেই নীরজ। জীবনের আয়ু কমতে কমতে সন্ধের আগে এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সামনে শুধু রাতের হাতছানি। আর কী নতুন করে হিসেব মেলাতে পারব? অঙ্কে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ মিলে গেলে প্রাপ্তির ঝুলি সহজে ভারী হয়ে ওঠে কিন্তু আমাদের পাওনার ঝোলাটা শুধু শূন্যই থেকে গেল। চারদিকে চলছে গরমিলের হট্টমেলা, যা চলছে, আমরা তাকেই মূল স্রোত হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। রোজ রোজ এভাবে কী আমরা নিজেদের সঙ্গে ছলনা করছি না? লাভ একটাই, ছলনা করার বিদ্যেটুকু বাধ্য হয়ে বেশ আত্মস্থ করে ফেলেছি। এখন ভেবেই নিয়েছি, পুত্র আর মূত্রের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। শরীর থেকে বের হয়ে গেলে আর কোনো যোগ থাকে না। পুত্রও তাই, বয়স পেলে নিজের স্বাধীনতায় চলে, শরীর আর বুদ্ধির কৌশলে দিব্যি মূত্রের বৈশিষ্ট্য লাভ করে। আকাশ সেই সত্যি প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নীরজ বললেন, তোমার কথাই ঠিক। দুঃখ একটাই, আমরা কেউ মনের মতো উত্তরসূরী রেখে যেতে পারলুম না। একা এসেছি যেভাবে, সেভাবেই চলে যেতে হবে। এত সব ভাবতে আর ভালো লাগে না ডুরানি।
ডুরানি আবেগে দুলছেন কিন্তু কী উত্তর দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। পাপান এসে বলল, মাস্টারদাদু, আবার কবে আসবে আমাদের বাড়িতে?
মন চাইলে যে কোনোদিন চলে আসব।
পাপান জানে, মাস্টারদাদু এলে তার বাড়তি বিস্কুট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন মনে এল না। নীরজ মল্লিক সামনে হাঁটছেন দিগন্তহীন স্রোতে ভাসতে ভাসতে। দুই বন্ধুর মিলিত হৃদয় যে একটিমাত্র কাঁটার আঘাতে বার বার যন্ত্রণাকাতর হয়ে উঠছে, তা বেশ বুঝতে পারছিলেন নীরজ।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!