পাপানের মতো বাচ্চা ছেলে ধাক্কা খেতে খেতে যে এভাবে পোক্ত হয়ে উঠতে পারে, তা ভেবে ডুরানি অবাক না হয়ে পারলেন না। মায়ের মার খাবার দৃশ্য দেখার পর থেকেই পাপানের ভিতরের অবস্থান দ্রুত পাল্টাতে শুরু করেছে। নতুন নতুন অনুভূতির সঙ্গে তার অনুশীলন গড়ে উঠছে দুবেলা। বড়ো বড়ো অভিজ্ঞতার ঢেউ তার মনের নদীতে এমনিই উথলে উঠছে যে মাঝে মাঝে চমকে উঠতে বাধ্য হচ্ছে। বাবা কেন মাকে মারল, সেই উত্তর খুঁজে পেতে পাপান যত বেশি করে আঁতিপাতি করে খুঁজছে তত বেশি করে সে নতুন নতুন অনুভূতির মুখোমুখি হতে বাধ্য হচ্ছে। দাদুর আক্ষেপ সকাল সন্ধেয় শুনতে হচ্ছে তাকে, একটা অদ্ভুত তুলনায় না ভেসে পারছে না। জীবনচর্চায় সারাজীবন যে দাদু একেবারে সাদাসিধে, সেই লোকটা বাপির বিরুদ্ধে এভাবে ভিতরের আতসবাজি প্রকাশ করে ফেলছে কেন? মা যে তার বাপিকে ভালো মনে আর মেনে নিতে পারছে না, তাও পাপানের জানা হয়ে গেছে।
রবিবার সকালে বাড়ির বারান্দায় বসে ডুরানি মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন, পাপান উঠোনে খেলা করছে। তখনও তার মনে চলছে দাদু-বাবার মতপার্থক্যের ঢেউ। বার বার প্রশ্ন জাগছে কিন্তু জানা নেই বলেই গুম হয়ে থাকতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে খেলা সাঙ্গ করে দাদুর পাশে এসে দাঁড়ালো। ডুরানির প্রশ্ন, হঠাৎ খেলা বন্ধ করলে কেন দাদুভাই? আজ সকালে পড়তে বসলে না কেন? নাকি পড়ায় মন বসানোর জন্যে একটু খেলে নিচ্ছ?
ভালো লাগছে না বলে খেলা বন্ধ করলুম।
কেন ভালো লাগছে না শুনি?
বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করলুম মাকে, মা কোনো উত্তর দিলে না। তাই তোমার কাছে উত্তরগুলো জানতে চাই, কিন্তু প্রশ্নগুলো বলতে কেমন যেন ভয় করছে।
আমার কাছে কোনো ভয়ের কারণ নেই।
তুমি কী এখনও চা খাও নি?
বুঝতে পারছি, তোমার মধ্যে বিস্কুট খাওয়ার ইচ্ছে জেগেছে কিন্তু তোমার মা এখনও যে চা করে দিয়ে যায় নি। বোধ হয় বিশেষ কারণে চা করা সম্ভব হয় নি। তোমার মা কী এখন রান্নাঘরে? ঘড়িতে বাজে কটা? ও, সবে তো সাতটা। তাহলে তো দাদুভাই আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে হবে। রোজ সাড়ে সাতটায় চা বিস্কুট দিয়ে যায়। এখনও উনত্রিশ মিনিট বাকি। দাঁড়াও দাঁড়াও, হেনাকে বলি যাতে এখনিই চা করে দিয়ে যেতে পারে। খেললে তো খিদে পাবেই।
তাহলে ততক্ষণ গল্প বলো দাদু। তোমার কাছে গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। একটা প্রশ্ন করব দাদু?
একটা বলছ কেন? যত খুশি প্রশ্ন করতে পারো। আমার হাতে এখন অফুরন্ত সময়। তোমাকে বড়ো করে তোলার জন্যে স্বপ্ন দেখাই আমার মূল কাজ। উত্তর দিয়ে সাহায্য করতে পারলে খুব ভালো লাগবে। বলো বলো, কী বলতে চাও।
অন্য কোথাও চলে যাই চলো না?
তাহলে কী অন্য ছেলেদের সঙ্গে দূরে কোথাও খেলতে যেতে চাচ্ছ?
দাদু, তুমি অন্য কী বলছ। আমি বলছি, তুমি, মা আর আমি— পাপান চুপ করে গেল।
এভাবে থামলে কেন?
এখানে আর থাকতে ভাল লাগছে না।
এসব কী বলছ দাদুভাই? তোমার বাবা বড়ো পুলিশ অফিসার। মাস গেলে মোটা টাকার মাহিনা। ইচ্ছে করলে আরও বেশি টাকা রোজগার করতে পারে। এত বড়ো বাড়িতে আমরা বসবাস করছি, এর চেয়ে ভালো জায়গা পাবে কোথায়?
তুমি অন্য কথা বলছ দাদু।
তাহলে আমাকে বুঝিয়ে বলো।
এখানে থাকতে আর ভালো লাগছে না দাদু।
কী কারণে এমনি করে বলছ?
মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। তুমিও তো মাস্টারদাদুর কাছে বাপিকে নিয়ে কত দুঃখ করো। আমি বুঝতে পারি না বুঝি?
বুঝতে পারছি দাদুভাই, অন্য জায়গা দেখার জন্যে তোমার মধ্যে খুব ইচ্ছে জেগেছে। শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন এমনিই হয়। কেবল ভাবে, সারা পৃথিবীটা ঘুরে ঘুরে দেখি। ফুলের বাগান, গাছের ডালে পাকা আম ঝুলে থাকার দৃশ্য, বড়ো সমুদ্রের ঢেউ, উঁচু পাহাড়ের চূড়া— তোমাদের খুব পছন্দ। এসব নিয়ে তোমার মধ্যে প্রবল ইচ্ছে জেগেছে বলেই আমার খুব ভালো লাগছে। ছোট্ট বয়সে কল্পনায় ডানা মেলে রূপকথার জগতে হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে। কিন্তু এতে একটা বড়ো সমস্যা রয়েছে। কোনটা বেশি ভালো, তা জানার সুযোগ থাকে না রূপকথার জগতে। নতুন জায়গা দেখার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সময় বার বার মনে হতে থাকে, অতীতে যা ছিল, সবই মিথ্যে, ভবিষ্যৎ বলেও কিছু নেই। আমার কথা নতুন করে একটু ভেবে দেখবে দাদুভাই?
তাহলে বলো শুনি।
চাকরি করার সময় কত জায়গায় ঘুরেছি, সেসব জায়গার প্রকৃতি দেখেছি, কত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের জীবনযাত্রা জানতে পেরেছি। যেখানে গিয়েছি, মনে হয়েছে, এর চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। শেষে বুঝেছি, নিজের পরিবেশের মধ্যে থাকার মজাই আলাদা। তোমার বাপি কত টাকা খরচ করে এত বড়ো বাড়ি তৈরি করেছে জানো?
তুমি কেন সে কথা কোনোদিন বলো নি আমাকে?
লক্ষ লক্ষ টাকা। সামনে থেকে দেখলে রাজপ্রাসাদ বলে মনে হয়। বিকেলের মিঠে রোদে দাঁড়িয়ে ফুল আর পাতাবাহারের শোভা দেখতে দেখতে মন গলে যায়। এত মজা কোথাও পাবে না দাদুভাই। বিকেলে বসে খাতা পেনসিল নিয়ে এসবের ছবি আঁকতে পারো না? তাহলে ভালো লাগাটা জমে যেত। তোমার বাপির জন্যে কত গর্ব অনুভব করি জানো? তখন কম মাহিনে ছিল কিন্তু প্রায় সব ব্যয় করেছি তোমার বাপিকে বড়ো করে তোলার জন্যে। এখন তার ফল পাচ্ছি হাতে হাতে। খরচ করে দামি দামি মালপত্তর কিনলে যেমন মনে আনন্দ জাগে, তোমার বাপির জন্যে তার চেয়ে অনেক বেশি ভিতরের খুশিতে ভাসি। এসব তোমাকে খুব করে বুঝতে হবে দাদুভাই।
তুমি নিশ্চয় সেদিন মাকে মারার শব্দ শুনতে পেয়েছিলে। বের হলে না কেন? জ্ঞানী হলেই বুঝি এভাবে চুপ করে থাকতে হয়? জ্ঞানীদের কী কোনো প্রতিবাদ করতে নেই? আমার কিন্তু খুব কান্না পেয়েছিল।
এভাবে ভাবতে নেই দাদুভাই। একসাথে থাকতে গেলে এসব একটু আধটু হতেই পারে, এ এমন কিছু ব্যাপার নয়। বাংলার কবি কী বলেছেন জানো? ‘আবাদ করে বিবাদ করে, সুবাদ করে তারা।’ এভাবেই সংসারযাত্রা এগিয়ে চলে দাদুভাই। টুকিটাকি ঘটে না, তেমন বাড়ি খুঁজে পাবে না।
তুমি মিথ্যে কথা বলছ দাদু।
কী করে বুঝলে?
পাশের পাড়ার টিকলু আমাদের ক্লাসে পড়ে। ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, হ্যাঁরে, তোর বাবা তোর মাকে এভাবে মেরেছে কোনোদিন? টিকলু কী বলল জানো?
যতবার আমার এ কথা শুনেছে, ততবার হেসে গড়িয়ে পড়েছে। একদিন আমাকে ধমকে দিয়ে বলল, তুই পাগলের মতো বকছিস কেন রে? আমার মা গরু-ছাগল নাকি যে বাবা তাকে লাঠি দিয়ে পেটাবে? সকালে বিকেলে সন্ধেয় চা খাওয়ার সময় বাবা মা আর আমি মিলে খুব মজা করি রে। বাবা হাসে তো মা হাসে। মা হাসে তো বাবা হাসে। আমিও খুব হাসি।
অনুভূতির টানাপোড়েনে পাপান যে কত বড়ো হয়ে উঠেছে, তা ভেবে মনে মনে চমকে উঠলেন ডুরানি কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। প্রকৃত জীবনবোধ কী হওয়া উচিত, তাও অন্যের মাধ্যমে জেনে নিতে পেরেছে সে। জীবনে অনুভূতির খেলা এভাবেই জমে ওঠে যা শুরু হয় বাল্য বয়সে, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তা বেড়ে বেড়ে পর্বতের মতো উঁচু হয়ে ওঠে। পাপানের সঙ্গে আর বাড়তি আলোচনায় না গিয়ে আবার খবরের কাগজে মুখ গুঁজে পাঁচ পৃষ্ঠার একটা ছোট্ট হেডিং পড়ে চমকে উঠলেন। হেনাকে ডাকতে শুরু করলেন, বৌমা, তুমি কী এখন রান্নাঘরে? এখানে একটু আসবে?
চা বিস্কুট দিতে দেরি হয়ে গেছে। একাজে সেকাজে বেশ বিলম্ব হয়ে গেল। আর মাত্র মিনিট পাঁচেক গেলেই….
চা বিস্কুট দেওয়ার জন্যে তোমাকে ডাকছিনে বৌমা। একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর বের হয়েছে। তুমি এসে পড়ে ভিতরের খবরটুকু আমাকে জানিয়ে যাও, আমি শুধু হেডিংটা পড়েছি।
হেনার বুকের ভিতরে অশনি হিল্লোল ঝড়ো হাওয়ার মতো বইতে শুরু করল। আকাশকে নিয়ে আবার কোনো অশুভ খবর বের হয় নি তো? রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সামনের বারান্দাটুকু পার হয়ে ডুরানির সামনে এসে দাঁড়ালো।
খবরের কাগজ হেনার হাতে তুলে দিয়ে ডুরানি বললেন, পাঁচ পৃষ্ঠার শেষ দিকে আছে বৌমা। হেডিং পড়ে কেমন যেন কৌতূহল জাগল, তুমি খবরটুকু পড়ে আমাকে শুনিয়ে দাও। তাহলে অন্তত কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারব।
অভিনব দোলাচল হেনাকে জোরে জোরে ধাক্কা মারছে। আগে কোনোদিন তাকে এভাবে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে বলেন নি। একবার আড়চোখে ত্রস্ত শ্বশুরকে দেখে নিল। সত্যের পূজারী ডুরানি কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। মনের ধাক্কা সামলে উঠতে পারছেন না বলেই কী?
আবার তাগিদ দিলেন ডুরানি, পড়ে কী জানলে আমাকে বলো বৌমা।
ছোট্ট খবরটুকু গিলতে হেনার খুব বেশি সময় লাগল না। থানার ওসির নির্দয় প্রহারে লক-আপের মধ্যে কারখানার এক শ্রমিক মারা গেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। রঙপুর থানার লকআপে অসহায় শ্রমিকের মৃত্যুতে রাজ্য প্রশাসন নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে ঘটনার মোড় উল্টোদিকে ঘুরে যেতে পারে বলেই অনেকের অনুমান। শ্রমিক সংগঠনগুলো একজোট হতে শুরু করেছে থানার সামনে বিক্ষোভ দেখানোর জন্যে। সারা ভারত মজদুর কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ওসিকে বরখাস্তের দাবিতে তারা রবিবার থেকে থানার সামনে অনশনে বসবে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকবে।
বৌমা, খবরটা পড়ে এভাবে চুপ করে গেলে যে?
হেনার মুখে দুর্যোগের ছবি ভাসছে। রঙপুর থানাতেই তার আকাশ ওসির দায়িত্বে রয়েছে। খবরের যা গতিমুখ, তাতে মনে হচ্ছে, বাবু বোসের পরামর্শে ধরে আনা শ্রমিকটা মারের চোটে মারা গেছে লক-আপের মধ্যে। আরও ভাবতে পারল যে একটা বাইরের ঝামেলা ঝড়ো বাতাসের মতো হঠাৎ করে তাদের সংসারে ঢুকে পড়ল। কী করে সামলাতে হবে তা হেনার জানা নেই কিন্তু ভাবতে পারল যে সংসারের উপর ঝড়ঝাপটা এলে তা সকলকে স্পর্শ না করে ছাড়বে না।
পাপান এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকল দাদুর মুখের দিকে। একটাই নাম বার বার দুজনের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। আর নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না, বলল, বাবু বোস কে দাদু? লোকটা কী করেছে? যে লোকটা মারা গেছে, সে বাবু বোসের কে হয়? তাহলে কী বাবু বোস মনে মনে খুব দুঃখ পেয়েছেন?
হেনার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কী সাংঘাতিক ঘটনা। বাচ্চা পাপানকে যে এসব বলা যায় না, তা নিয়ে মনের মধ্যে গভীর সংশয় তৈরি হল। শুধু ভাবছে, আকাশের কৃতকর্ম অদূর ভবিষ্যতে পাপানের উপর ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।
ডুরানির ভিতরের প্রতিক্রিয়াও মারাত্মক হয়ে উঠছে। লোকটা কেমন যেন মুসড়ে পড়েছেন। আকাশকে গড়ে তোলার সময় টাকার দায় থাকলেও কখনো তিনি উল্টো পথের কথা ভাবেন নি। এখন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ থাকা সত্ত্বেও আকাশ সেই পথে হেঁটে সকলের জন্যে একটা প্রত্যাশিত বিপদ টেনে আনতে পারল তাদের জন্যে। হেনাকে কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব, তা মাথায় আসছে না, শুধু ভাবতে পারলেন যে চোখের সামনে এতদিনের আলো কেমন যেন নিভে যেতে বসেছে। তাঁর জীবনের আলো নতুন করে ধরে রাখার মতো আর কেউ এ পৃথিবীতে নেই।
হেনার স্বগতোক্তি, এত দুঃখ করবেন না, করুণাময় নিশ্চয় একটা পথ দেখিয়ে দেবেন।
একবার ভেবে দেখ হেনা, আমরা কোন্ পরিবেশে বাস করছি। এত বিপন্ন অবস্থায় পড়ে গিয়েছি যে ঠিকমতো বুঝতে পারছি নে, আমরা বেঁচে আছি, না মরে গিয়েছি। অবসর জীবনে এসে এতদিনের জানা পৃথিবীকে দুচোখের সামনে কেমন যেন একান্ত অচেনা বলে মনে হচ্ছে।
ঠিক বলেছেন আপনি, সমগ্র পরিবেশটা হঠাৎ করে আমাদের কাছে একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বুঝতে পারছি নে, কোথায় গেলে দু’দন্ড শান্তি মিলতে পারে। আপনি কী অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন না?
পাপানের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, তোমার কী খুব অসুখ করেছে মা? তাহলে ডাক্তারের কাছে চলো না, দেখিয়ে দামি ওষুধ নিয়ে আসি। আমি আর দাদু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি।
ডুরানির বুকের গভীর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। তা দ্রুততালে মিশে যাচ্ছে হেনার অবরুদ্ধ কান্নার সঙ্গে। হেনাও অজানা অশনিতে দুলতে বাধ্য হচ্ছে।
ডুরানি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা সামনে গিয়ে গ্রিলে দু’হাত রেখে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুচোখ আকাশের দিকে। তাঁর নিবিড় স্বগতোক্তি, আর যে কিছুই ভাবতে পারছি নে বৌমা। বুঝতে পারছি, সামনে কী কঠিন দিন অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্যে। অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে। ভেবেও যে নতুন কোনো সমাধানসূত্র বের করে আনব, সেই সুযোগও নেই। জানো হেনা, রক্তের অনুসঙ্গ আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে চেপে বসা কঠিন সময়কে মেনে নেওয়া ছাড়া পথ থাকে না। এজন্যে মনকে শক্ত করে তুলতেই হবে। একবার ভেবে দ্যাখো, সময়ের কী সাংঘাতিক অভব্যতা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। মনকে শক্ত করে তোলার কথা ভাবছি, আবার নিজেরাই সেই বিষয়ে দুশ্চিন্তা করে কেমন যেন কাতর হয়ে পড়ছি। জীবনের কান্না এমনিই। তা থামাতে চাইলেও থামে না।
হেনা প্রশ্ন করে জানতে চাইল, লোকটাকে এভাবে খুন করার কোনো দরকার ছিল কী? অপরাধী হলে তাকে থানা থেকে কোর্টে চালান করলেই তো সব দায় মিটে যেত। পরে বিচার হলে জানা যেত, লোকটা সত্যি সত্যি অপরাধ করেছে কিনা। সেই সুযোগটুকুই পেল না। তার আগেই হতভাগ্যের জীবনের নাটক শেষ হয়ে গেল। এমন বহু দৃষ্টান্ত দেখা গেছে, অপরাধী হিসেবে যাকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে কোর্টের বিচারে সে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। এসব ঘটনা দিব্যি প্রমাণ করে, লোকটাকে অপরাধী হিসেবে এ্যারেস্ট করাই ছিল একটা মস্ত বড়ো ভুল। এই লোকটা সেই সুযোগ পেল না কেন? তাছাড়া বাবু বোস জড়িত থাকার ফলে সামগ্রিক ঘটনা নিয়ে একটা সন্দেহ তৈরি হতে পারত। তাতে বিচারের রায় লোকটার দিকে ঢলে পড়লে কারুর কিছু করার থাকত না।
অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে নীরজ মল্লিক নিজেই চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে হেনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বেশ বললে বৌমা। লোকটাকে ধরে কোর্টে পাঠালে আরও অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যেতে পারত। এও ঠিক যে সে হয়তো অপরাধী হিসেবে গণ্য হত। এর বাইরে আরেকটা যে কঠোর সত্যি রয়েছে তা সবার আগে তোমাকে জানতে হবে। কোর্টের বিচারে সবার আগে বাবু বোস জড়িয়ে পড়ত। কেবলমাত্র তাকে বাঁচাতে গিয়ে লাখ লাখ টাকার গোপন কারবারে একজন নিরাপরাধ শ্রমিককে যেভাবে প্রাণ দিতে হল, তাও প্রকাশ্যে চলে আসত। এখন তুমি যা ভাবতে পারছ না, আমার পক্ষেও তা সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে, অথচ আমাদের আকাশ সেটাই সম্ভব করে দেখাতে পারল। জানো হেনা, একেই বলে কপাল। এক সময় ভাবতাম, আকাশ আমার প্রিয় ছাত্র, চারদিকে কত সুনাম, প্রশংসা করতেও ভালো লাগত। এখন সেই আকাশের জন্যে মনে মনে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। আসলে অন্তরাত্মায় আমি একজন শিক্ষক। কৃতি ছাত্রের মধ্যে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে। সেই আশাটুকু আর পূরণ হল না।
হেনার প্রশ্ন, কী করলে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব তা কেউ বলতে পারছেন না কেন? সমস্যার গভীরে সমাধান লুকিয়ে থাকে, সেটুকু বাতলে দিতে পারলে তো একটা চেষ্টা নিয়ে দেখা যেতে পারে।
তুমি আকাশের স্ত্রী, সবার আগে তোমাকেই ভাবতে হবে আকাশের মুক্তির কথা। মনের স্বস্তি এভাবেই ফিরে আসে হেনা। কিন্তু সেই পথ কী খোলা আছে? আইনের জটিলতায় ক্রমে তা দীর্ঘতর হচ্ছে। আমাদের পক্ষে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া অন্য কিছু করার উপায় আছে কী? ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির অবস্থা। জানি তার মধ্যেও তোমার মন চাইছে অন্য কিছু।
আপনি বসুন, বন্ধুকে সাহস দিতে একটু কথা বলুন, আমি ততক্ষণ চা করে আনি। ক্রিমকেকার বিস্কুট খাবেন তো?
তখনও মাথা নীচু করে বসে বসে ভাবছেন ডুরানি। এত লজ্জিত হয়েছেন যে মাথা উঁচু করে কথা বলার শক্তিটুকু নেই। নীরজের আন্তরিক সান্ত্বনা, এভাবে ভেঙে পড়ো না ডুরানি। তুমি শক্ত হতে না পারলে হেনার পক্ষে সাধারণ জীবন নিয়ে চলা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এটাকে বিশেষ ঘটনা হিসেবে না ভেবে সাধারণ ঘটনা হিসেবে নিতে পারলে তো ভিতরের কষ্ট অনেকখানি দূর হয়ে যেতে পারে। চারদিকে ভাঙাভাঙির খেলা এখন সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। সেই অবস্থানের মধ্যে আকাশ যেটা ঘটিয়েছে, তাকে সম্পূর্ণ অসম্ভব ভাবলে ভয়ানক ভুল করা হবে।
ওই প্রসঙ্গ থাক নীরজ, কোনো বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে বিশেষ জানাশোনা থাকলে আমাকে এখনিই জানাতে পারো।
পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছ ডুরানি? যে কঠোর বাস্তবতা নিয়ে এতদিন খেলা করেছ, এখন সেটা দেখেই এত ভয় পাচ্ছ? পালিয়ে বাঁচা যায় না ডুরানি। সেটা কোনো জীবন নয়। আকাশ তোমার ছেলে, সেই সম্পর্ক কী কোথাও গিয়ে অস্বীকার করতে পারবে? পাপান তোমার নাতি, তা কী গোপন করে রাখা যায়? জীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রসঙ্গকে কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখা যায় না ডুরানি। বাঁচতে গেলে সব বাধাবিপত্তি দূর করে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বাঁচতে হবে।
তাতে কোনো ভয় পাচ্ছি নে নীরজ। সারা জীবন তো সেভাবেই চলে এসেছি। সমস্যা অন্য সূত্রে, অন্য অনুসঙ্গে। আসলে নতুন বিড়ম্বনা থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসার পথ পাচ্ছি নে। কেবল মনে হচ্ছে, চারদিকে এত আলো, এত বাতাস, কেবল আমি দম নিতে কষ্ট অনুভব করছি। কী অদ্ভুত সময়ের বন্ধনে আটকে পড়েছি, তা তোমাকে যুক্তি দিয়ে ঠিক বোঝাতে পারছি নে। জীবনের যে পথ নিজেই অনুসরণ করে এসেছি, তা আকাশের মধ্যে আরও বিস্তার লাভ করুক বলে ভেবেছি, সেই পথটা আজ মিলিয়ে যেতে বসেছে। কেমন যেন নতুন অন্ধকার এসে তা গ্রাস করে ফেলছে। একজন ব্যর্থ পিতা হিসেবে এ দৃশ্য দেখা কত কষ্টের, তা নিয়ে একবারও ভাববে না? তুমিও তো পিতা, এ যন্ত্রণা বুঝতে তোমার এতটুকু অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
হেনা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার মধ্যে একটাই আক্ষেপ প্রবলতর হয়ে উঠছে। সমাজের বুকে কোন্ মুখে সে মাথা উঁচু করে চলবে? পাপান কী পারবে বাপের পরিচয়ে বড়ো হয়ে উঠতে? আকাশের কারণে যেভাবে মনের শান্তি চলে গেছে, তা কী আর কোনোদিন ফিরে আসবে? কে ফিরিয়ে দেবে তার কাঙ্খিত জীবনকে? দুচোখের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না হেনা।
নীরজ গম্ভীর হয়ে বললেন, এসব কী ভাবছ হেনা? আমরা তো পাগলের মতো প্রলাপ বকতে পারি না। সারা পৃথিবী জুড়ে এসব চলছে। চারদিকে অস্থিরতার সমুদ্রে জল বাড়ছে। এটাই সামগ্রিক পরিস্থিতি। আকাশের ব্যক্তিজীবনকে সেই সমষ্টির সঙ্গে মিল করে ভাবলে দিব্যি নতুন পথ পেয়ে যেতে পারি।এক অর্থে তোমার কথাই ঠিক নীরজ। তারপর একটা বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে ডুরানির মন্তব্য, দারুণ ব্যাখা দিতে পারলে হে। সারা জীবন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় কত বেশি পোক্ত হয়ে উঠতে পেরেছ, আজ তা হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে গেলাম। এটাও ঠিক, মনের টানে আমরা সকলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি, সেই বন্ধন থেকে সহজে মুক্ত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এখন বেশ বুঝতে পারছি, হ্যামিলটনের বাঁশিওয়ালার সুর অন্য খাতে বইছে। সকলকে গুহার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
পাপান অন্য চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে থাকল। একবার দাদুর মুখের দিকে দুচোখ রেখে চাপাস্বরে বলল, তুমি ঠিক বলছ না দাদু। গতকাল বললে, হ্যামিলটনের বাঁশিওয়ালার সুর কেবল বাচ্চাদের টেনে নিয়ে যায় গুহার দিকে। আজ আবার অন্য কথা বলছ। তাহলে শুধু বাচ্চাদের নয়, বড়োদেরও সমানতালে টেনে নিয়ে যেতে পারে?
হেনার মাথায় এসব ঢুকছে না। বড়ো আশা করে সে আকাশকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে খাঁটি সত্যের পূজারী বলেই তার শ্বশুর জনমানসে সাধু ডুরানি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। নিজেই সখ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন আকাশ। ভেবেছিলেন, একমাত্র ছেলেকে গড়ে তুলে সত্যি সত্যি আকাশ করে তুলতে পারবেন। কেরানি হিসেবে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, আকাশকে দিয়ে সেই গন্ডি ভাঙতে পারবেন তিনি, কিন্তু সময়ের টানে তাঁকে কোন্ আকাশ দেখতে হচ্ছে? যে আকাশ দেখতে পাচ্ছেন দুচোখের সামনে, তা মেঘে ঢাকা বলেই সেখানে সত্যের এতটুকু আলো নেই। ঝড়ো বাতাসে বিচ্ছিন্ন মেঘের আনাগোনায় সেই আকাশের বাকি অংশ ঢেকে যাওয়ার উপক্রম। কঠোর বাস্তবে ডুরানির বার বার মনে হতে থাকল, তার ছেলে আকাশ বাস্তবিক অর্থে জীবনের আবর্জনা ছাড়া কিছুই নয়। বার বার ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, এ দুর্বিসহ জীবন নিয়ে তাঁর পক্ষে খুব বেশি দিন সুস্থ শরীরে চলাও সম্ভব নয়।
চাপা দীর্ঘশ্বাস হেনার বুকের গভীরে। নীরজকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি কোনো মিথ্যে কথা বলেন নি মেসোমশাই। কিন্তু এসবের পরেও তো অন্য নানা প্রশ্ন থেকে যায়। মানুষের জীবন তো একটাই, বাকি প্রশ্নের উটকো বোঝা টানবেন কী করে? টানতে গেলেই দুচোখের দেখা পৃথিবী নরক হয়ে উঠবে। এই যে এত টানাপোড়েন, এক জীবনে তা টেনে চলতে পারব তো? সংসারের ভিতরে থেকে এখন বেশ বুঝতে পারছি, রঙ বেরঙের কাঁচ দিয়ে সাজানো ঘরের জন্যে এত টাকা এসেছে কোন্ পথে।
নীরজের প্রশ্ন, শুধু একটা প্রসঙ্গ নিয়ে এত ভাবার দরকার আছে কী?
ডুরানিকে উদ্দেশ্য করে হেনা বলতে শুরু করল, আপনার বন্ধু আমাকে থামানোর জন্যে একটা মহৎ প্রচেষ্টা নিয়েছেন বলতে হবে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বৌমা, আমাকে সেভ করার জন্যে তাঁকে চেষ্টা নিতেই হবে। মেসোর জন্যে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই, তবে কোনো আলোও দেখছিনে। আপনিও আমাকে ভুল বোঝাতে শুরু করেছেন? পাপান সব কিছু জানার পরে এ রাজপ্রাসাদ থেকে কোনো সুখের সন্ধান খুঁজে পাবে কী? ভুল বোঝানোর জন্যে আপনি তার চোখে অপরাধী হয়ে যাবেন না তো? পরবর্তী সময়ে সে আপনাকে কীভাবে নিতে পারে, তা এখন থেকে ভাববেন না? যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কেবল তার কথা ভেবে আপনি পাপানের চোখে আসামি হতে যাচ্ছেন কেন? এ যমপুরিতে দাঁড়িয়ে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, দৈত্যের মতো সমগ্র বাড়িটা যেন আমাকে, আমাদেরকে গিলে খেতে চাচ্ছে। ভিতর থেকে শুধু শোষণের চীৎকার শুনছি। সব কিছু জানার পরে আপনি কেন যে এভাবে চুপ করে আছেন, তা মাথায় ঢুকছে না।
ডুরানির পাশে চেয়ারে বসে নীরজ মল্লিক পুরনো স্মৃতি হাতড়ে চলেছেন। অতীতের কত কথা মনে পড়ছে তাঁর। আকাশ শুধু তাঁর বন্ধুর ছেলে নয়, নিজের একান্ত প্রিয় ছাত্র। একটা বিশেষ দুর্বলতা লুকিয়ে ছিল হৃদয়ের গভীরে। সেই আকাশকে নিয়ে এখন তাঁকে বিরুদ্ধ পথে ভাবতে হচ্ছে। হেনাকে বললেন, তোমাকে একটা স্মৃতির কথা শোনাই বৌমা। তাহলে বুঝবে মানুষ নিজের দুর্বলতার জন্যে কীভাবে নিরস্ত্র হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। যতদিন আকাশ আমার স্কুলে ছাত্র হিসেবে ছিল, কোনোদিন চেষ্টা নিই নি ওর ভিতরের পশুটাকে খুঁজে বের করার। একটা অপত্য স্নেহের দুর্বলতা আকাশকে কেন্দ্র করে আমার ভিতরটা কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে হয়ে ছিল। নিজের চোখে দেখেছি, আকাশকে বড়ো করে তোলার জন্যে তোমার শাশুড়ি ফিজার কী একান্ত নিবেদিত প্রাণ। তাতেই আমার দুর্বলতা আরও বেড়ে গিয়েছিল। বৌদি আমার সঙ্গে যে কোনো প্রসঙ্গে কথা বলতে এলে মূল প্রসঙ্গ ভুলে আকাশকে নিয়ে বারো আনা সময় ব্যয় করে দিত। তুমিই বলো, বন্ধু পত্নীর এত কথা শুনে আমি দুর্বল হয়ে পড়তে পারি কিনা। অভিন্নহৃদয় বন্ধুর ছেলেকে নিজের ছেলে হিসেবে ভেবে আমি কী কোনো ভুল করেছিলুম? এখন কিন্তু সেই বেড়ে ওঠা ধারণা হুড়মুড় করে গুঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। আমার কী মনে হচ্ছে জানো হেনা, মায়ের স্নেহদুর্বলতায় বেড়ে ওঠা আকাশ মানুষ না হয়ে আস্ত দানব হয়ে উঠেছে। আমার একান্ত স্নেহের আকাশ—একথা ভাবতে কত যে কষ্ট পাচ্ছি মনে মনে।
ডুরানি আরও আবেগে দুলছেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নীরজের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলেন। —জানো নীরজ, তুমি যে মেয়েটির কথা উল্লেখ করলে, সে আজ আর এ পৃথিবীতে নেই। কেবল তুমি আর আমি আছি। যেভাবে তুমি আকাশের জন্যে নিজের অপরাধ স্বীকার করে হাল্কা হতে চাইলে, তাতে আমার মনে হয়েছে, পিতা হিসেবে আমিও কম অপরাধ করি নি। আকাশ আমার ছেলে, আমার উচিত ছিল ওর ভিতরের পশুটাকে খুঁজে বের করে প্রচণ্ড শাসন করে বুঝিয়ে দেওয়া, অমানবিক হতে চাইলে এভাবেই শাস্তি পেতে হয়। আমি তা পারি নি নীরজ। এ অক্ষমতার জন্যে আমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে পারবে? তাহলে অন্তত নিজের অপরাধের জন্যে সামনাসামনি শাস্তি পেয়ে মনে মনে একটু খুশি হতে পারি। কেন আমি আকাশকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারলুম না, সেই বিচার প্রথমে তোমার হাতে শুরু হোক। আসামির কাঠগোড়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পেলে অন্তত আমি সকলকে জানাতে পারব যে আমিই অপরাধী আকাশের অযোগ্য পিতা। নিজের কর্তব্য পালন করতে পারি নি বলেই এভাবে আমাকে বিচারকের সামনে উপস্থিত হতে হয়েছে।
হেনা অবাক হচ্ছিল শ্বশুর ডুরানিকে এত বেশি বিচলিত হতে দেখে। শুনতে শুনতে নিজের দুচোখ ভিজে উঠছিল। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে হাজার কথা মনে এলেও কোনো কিছুই প্রকাশ করতে পারল না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বলল, এভাবে নিজেকে অভিশপ্ত হিসেবে ভাববেন না। সমাজে প্রত্যেক মানুষ পৃথকভাবে গড়ে ওঠে। আকাশের মধ্যে যদি কোনো ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত থাকে, তার দায়িত্ব আকাশকে নিতে হবে। ছেলে অপরাধ করলে তার জন্যে পিতাকে শাস্তি পেতে হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত সারা পৃথিবীতে একটাও নেই। তাহলে আকাশের জন্যে এভাবে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে যাবেন কেন? এভাবে ভাবলে আর যাই হোক মায়ের আত্মা ঠিকমতো শান্তি পাবে না। একটা প্রসঙ্গ আমরা সকলে জেনে ফেলেছি, গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা কিংবা আপনার মধ্যে কোনো ফাঁকি ছিল না। সেটাই তো জীবনের পূর্ণতা, সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার যা আপনি ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন।
নীরজ মল্লিক শুনতে শুনতে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন। জানালার ফাঁক গলে তার দুচোখ নীল আকাশের দিকে। ভালোমতোই বুঝে ফেলেছেন, এ বাড়ির সকলে আকাশকে নিয়ে আরও শক্ত হতে চাচ্ছে। এমন কী পাপানও। দ্বিতীয় পথ না থাকলে জীবন সময় সময় বড়ো বেশি একরোখা হয়ে ওঠে। সকলের অবস্থা তেমনিই। আরেকটু পরে হেনা সকলের জন্যে চা করে নিয়ে এল। খেতে খেতে সবাই দেখল, আকাশ টলতে টলতে বাড়িতে ঢুকছে। এ দৃশ্য বাড়ির কেউ আগে কখনো দেখে নি। সবচেয়ে বেশি অবাক হলেন নীরজ মল্লিক। তাঁর প্রিয় ছাত্রের এ কী দশা হয়েছে! ডুরানি ভীষণ বিমূঢ়, কথা বলার অবস্থানে নেই বলেই তাঁর জীবনের বিমূঢ়তা নিজের মানসিকতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারছে না। শুধু বুঝলেন, বাড়ির বাইরে আকাশ যেভাবে তৈরি হয়েছে আজ তার প্রথম প্রকাশ নিজের বাড়িতে বয়ে আনতে পারল।
নীরজ মল্লিক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজকের মতো আসছি ডুরানি, পারলে কাল বিকেলে আবার একবার আসব। আকাশকে নিয়ে নানা ভাবনা মাথার ভিতরে জট পাকিয়ে আছে, কাল বিকেলে বেড়ানোর সময় তা নিয়ে তোমার সঙ্গে শেয়ার করব। আজ তাড়াতাড়ি উঠলুম এই কারণে যে ভিতরে কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছে। সত্যি বলতে কী, অস্থির ভাবনার খাদে দ্রুত ডুবে যাচ্ছি পুরনো স্রোতগুলো উল্টোপথে লুকিয়ে যেতে বসেছে বলে। শিক্ষক হিসেবে যে উৎকর্ষতা নিয়ে সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছি, তা যেন হঠাৎ করে আজ মিলিয়ে গেল। আমাদের সামনে আর কোনো নতুন পথ খোলা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ডুরানির মর্মান্তিক আক্ষেপ, আর যে ভাবতে পারছি নে নীরজ, চলতে চলতে এখন শুধু ফুরিয়ে যাবার দিন নিয়ে ভাবতে বেশ লাগছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হেনাকে বললেন, এভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না হেনা, আকাশ বাড়িতে ফিরেছে। ওর সঙ্গ দেওয়া তোমার প্রধানতম কাজ। ওকে যদি আমাদের চেনা পথে টেনে আনতে পারো, তাহলে আরেকটা নতুন ইতিহাস লেখা হয়ে যাবে তোমার প্রচেষ্টার মধ্যে।#
চলবে…