ধারাবাহিক উপন্যাস: এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৬)

কালবৈশাখী ঝড়ে প্রকৃতি যেমন আন্দোলিত হয়, আকাশের ভিতরের অবস্থা ঠিক সেইরকম। ক’দিন ধরে একটানা মানসিক কসরত করে চলেছে কিন্তু কিছুতেই বহমান ঝড়ের বাইরে আসতে পারছে না যদিও বিশেষ এক অকুতোভয় ভাবনায় দুলতে বেশ লাগছে। শুধু ভাবছে, তার পদমর্যাদার তুলনায় এ ঝড় কিছুই নয়। এতদিনের অভিজ্ঞতা বলছে, কালবৈশাখী সারা বছর চলে না। শরৎ, হেমন্ত কিংবা শীতে তার দেখা মেলে না। তাহলে কেন সে সামান্য বিরুদ্ধ তোলপাড়ে এত বেশি বিচলিত হতে যাবে? বড়ো পদে থাকলে এরকম একটু আধটু বিরূপ কথা খবরের কাগজে প্রকাশ পেয়েই থাকে, কিন্তু সেসব খুব বেশি দিন মনে রাখে না মানুষ। আরেকটা ভরসা বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়ার মতো মনের আকাশে দোল খাচ্ছে। উপরের পুলিশমহল তার সঙ্গে রয়েছে। বদনের মধ্যে একটু আধটু ভিন্ন চিন্তা থাকলেও বাইরে প্রকাশ করার মতো সাহস তার নেই। এরকম ঘটনা যে বদন আগে দেখে নি, তা নয়। তাই সে অভিজ্ঞতায় পোক্ত, কোনটা চেপে রাখতে হবে, কোনটা প্রকাশ করতে হবে, তাও বেশ জানে। অবশ্য এও ঠিক যে চলতি ঘটনা নিয়ে বদনের মধ্যে একটু উল্টো টানাপোড়েন চলছে। এ সমস্যা জটিল হয়ে উঠলে তাকে এড়িয়ে চলতেই হবে। একজন অধস্তন কন্সটেবল হিসেবে তখন আর কিছুই করার থাকবে না।
টলতে টলতে বারান্দা পার হয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে হেনাকে সামনে পেয়ে এক পলক ভেবে নিল। পাশের ঘরে বসে ডুরানি তখন ভিতরের যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। এতদিন তাঁর বাড়িতে মদ খেয়ে এভাবে কেউ প্রবেশ করতে পারে নি। আকাশ সেটাই করে দেখাতে পারল। সবই তাঁকে মুখ বুজে সহে নিতে হচ্ছে। একমাত্র ছেলে, উপায়ান্তর নেই। কিন্তু আকাশের বাড়াবাড়িতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না, পায়ে পায়ে আকাশের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে তখন চৌচির হয়ে গেছে।
আকাশের মুখে গভীর সংকোচের ছায়া। —কিছু বলবে নাকি?
সেজন্যেই এসেছি। সোজাসুজি উত্তর দাও, লক-আপের মধ্যে লোকটা মরল কী করে?
তো তো করে আকাশের উত্তর, সে জবাব তোমায় দিতে হবে কেন?
তোমাকে এখন বলতেই হবে, এভাবে একজন অসহায় মানুষ মরল কেন?
থানার ঘটনা সংসারের মধ্যে টেনে আনতে পারো না তুমি। যা ঘটেছে তার মিমাংসা থানাতেই হবে। এ নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করার কী আছে?
হেনা তখনও আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে। তার তীব্র প্রশ্ন— তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না। যে অবস্থায় বাড়ি ফিরেছ, তা নিয়ে একবারও ভেবে দেখেছ কী? এতদিন নিশ্চয় আমার জানার বাইরে এসব করছিলে, না হলে তো হঠাৎ করে এভাবে বাড়িতে ঢুকতে পারতে না। এর প্রভাব একটা শিশুকে কতখানি অবদমিত করতে পারে, তা একবার ভেবে দেখেছ কী? বাড়ির ভিতরটা ইচ্ছে করেই নষ্ট করে দিতে পারো কী তুমি? ভুলে যেও না, বেশ কয়েকজনকে নিয়ে এ সংসার। নিজের পিতা কতখানি ব্যথা পেতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে পারো নি কেন? পাপান তোমার ছেলে। তোমাকে মদ্যপ অবস্থায় দেখলে সে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, সেসব ভুলে যাচ্ছ কেন?
আকাশ হেনার কথাগুলো আর গিলতে পারছিল না। সরোষে চেঁচিয়ে উঠল, স্টপ, স্টপ ইট, হাউ ননসেন্স ইউ আর। ভুলে যেও না, পুলিশ প্রশাসন নিয়ে বাড়িতে এভাবে আলোচনা করা চলে না, তাহলে তো সংসার আর থানার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। সারা পৃথিবী জুড়ে রোজ রোজ এমনি কত মানুষ মরছে, তা নিয়ে নিজেদের সংসারে অশান্তি বাড়ানো যায় কী? কোথাকার কে শ্রমিক, তার মৃত্যু নিয়ে নিজেদের মধ্যে এভাবে বিতণ্ডা করার কোনো মানে আছে কী?
নীরজ মল্লিক এসেই আকাশকে টলতে টলতে ভিতরে ঢুকতে দেখেছেন। একসময় আকাশ ছিল তার প্রিয় ছাত্র। এতটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে সে? নিজেকে কেমন যেন হতভম্ব লাগছিল। শিক্ষক ছিলেন বলেই বোধ হয় নিজেকে দ্রুত সামলে নিতে পারলেন, ধীর পায়ে আকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কোনো নির্দেশ নয়, বিনীত অনুরোধে শুধু বললেন, এভাবে কথা বলতে নেই আকাশ, অন্তত বাবার সামনে এভাবে কথা বলে ঠিক করছ না।
ঘরের মেঝেয় দাঁড়িয়ে আকাশ টলছে। নীরজ মল্লিকের দিকে ডান হাত উঁচু করে বলল, ভদ্রতার ডিক্সনারিটা কী আপনার কাছ থেকে শিখতেই হবে? আপনি কে? একজন থানার ওসিকে এভাবে জ্ঞান দিতে কে বলেছে আপনাকে? এটা স্কুল নয়, এখনও আমাকে ছাত্র ভাবছেন নাকি? আমি এতগুলো অঞ্চল চালাই, আপনি কী চালান শুনি? চাকরি নেই বলেই কী জ্ঞানদানের শিক্ষক হয়ে গেছেন?
নীজর খুব সহজে বুঝে গেলে, আকাশ সামনা-সামনি ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে অস্বীকার করতে চাচ্ছে। নিজেকে দ্রুত গুটিয়ে না নিয়ে পারলেন না। ভাবলেন, অন্য কিছু বলতে গেলে আরও অপমানিত হতে হবে। আগের আকাশ পরিবর্তিত হয়ে যা হয়ে উঠেছে, তাকে ঠিকমতো বিশ্বাস করা যায় না।
ডুরানি তখন মনে মনে মরিয়া। একটা কঠোর প্রতিজ্ঞা মনের সাম্রাজ্যে পাহাড় হয়ে উঠেছে। আরেকটু সামনে সরে এসে বলতে শুরু করলেন, আমি নীরজ মল্লিক নই রে, তোর জন্মদাতা পিতা, শিক্ষকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেটুকুও শিখিস নে? কেন তুই আমার বন্ধু নীরজের সঙ্গে এভাবে কথা বললি? নীরজ তোর শিক্ষক ছিল রে, সেটুকুও ভুলে গিয়েছিস? নিজের শিক্ষকের সঙ্গে এভাবে আচরণ করা যায়?
আকাশ সরোষে চেঁচিয়ে উঠল, তোমার কোনো কথার জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। তুমি কে? আমার উপরওয়ালা নাকি? তুমি কী সংসারের মধ্যে আরেকটা থানা তৈরি করে ফেলেছ, যেখানে তুমি ওসির দায়িত্বে রয়েছ?
ডুরানি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। রাগে কাঁপতে লাগলেন। প্রতিবাদের চরম পর্যায়ে থেমে থাকা যায় না। একটাই ভাবনা, চরম প্রতিবাদ করতে না পারলে হয়তো আকাশ পুরনো পথে ফিরে আসতে পারবে না। তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস, কেউ খুব বেশি দিন রক্তের সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে না। বিশ্ব সংসারের সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম। ভাবনার খরস্রোতে কেমন যেন আরেকটু বেশি সাহস পেয়ে গেলেন। কণ্ঠস্বর আরও কর্কশ করে বললেন, বাবু বোসের কাছ থেকে এত টাকা অন্যায়ভাবে নিতে গেলি কেন রে শুয়োর?
সীমা ছাড়িয়ে যাবে না বলছি। বাড়ির সম্পর্কের মধ্যে থানার কর্মকাণ্ড টেনে আনছ কেন শুনি? মনে রেখো, অফিসের কাজে তুমি আমার বাবা নও, আমার উপরওয়ালা আমার বাবা। যা কিছু করতে হবে, স্রেফ উপরওয়ালার নির্দেশেই। এ সব ঘটনায় তুমি কে শুনি? প্রশ্ন করার কোনো অধিকার আছে কী তোমার? সারা জীবন কেরানিগিরি করে সেই পার্থক্যটুকু কী ভুলে গিয়েছ?
ততক্ষণে আকাশের বাড়ির সামনে হাজার দেড়েক মানুষ জড়ো হয়েছে বিক্ষোভ দেখাতে। চরম প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বিক্ষোভের ভাষায়। সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ উঠছে, জবাব চাই, জবাব দাও। ক্রিমিনাল ওসির কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
ডুরানি ভিতরের রাগে কাঁপছেন। একসঙ্গে দুটো প্রসঙ্গে ভীষণ কম্পিত হচ্ছেন। নিজের বাড়ির সামনে এতগুলো সমবেত মানুষ, তাদের ধিক্কারের ভাষা ডুরানির কাছে দ্রুত অসহনীয় হয়ে উঠল। ডুরানির একমাত্র দুর্ভাবনা, লোকগুলো নিশ্চয় ভাবছে, আকাশ তাঁর ছেলে, বাবা খারাপ মানুষ বলেই ছেলের পক্ষে এত বড়ো অপকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এত বড়ো কলঙ্কের জন্যে যে তিনি কম বেশি দায়ি, সেই বোধ বার বার ধাক্কা দিতে থাকল ডুরানিকে। মানুষের প্রতিবাদের ভাষা যেন সেটাই প্রকাশ করছে। তারা যেন নিশ্চিত হয়ে ভাবতে পেরেছে যে একজন নিরীহ শ্রমিককে লক-আপে পিটিয়ে মারার জন্যে ওসি আকাশ সত্যি সত্যি অপরাধী। ডুরানি চাপা স্বরে আকাশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, অসহায় বাবাকে জবাব দেবে না বলে তো এতক্ষণ আস্ফালন করছিলে, এখন কী জনতার দাবিকে উপেক্ষা করতে পারবে? সাহস থাকে তো মানুষগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াও। তাহলে অন্তত জানব, আমার আকাশ অন্যায় করেও আম-মানুষকে অস্বীকার করতে শিখেছে।
পাশের ঘরে ছবি আঁকায় ব্যস্ত পাপান এতক্ষণ বুঝতে পারে নি কখন তার বাপি বাড়ি ফিরেছে। চীৎকার শুনে মনোযোগ হারিয়ে ছবি আঁকা ফেলে রেখে বারান্দা পার হয়ে ঘরে ঢুকে দেখল, দাদু ত্রুদ্ধ মূর্তিতে তার বাপির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইরে দাঁড়ানো সমবেত মানুষের বিরুদ্ধ ধিক্কারধ্বনি কানে ভেসে আসছে। কিশোর পাপানের মনে নানা প্রশ্নের উঁকি। দাদু হঠাৎ করে বাপির উপরে এভাবে রেগে গেল কেন? বাইরে দাঁড়িয়ে এতগুলো মানুষ এভাবে যা তা বলছে কেন? নিজের ভাবনায় একটাই বিষয় উঠে আসছে। বাপি তো থানার ওসি, ফোন করলেই থানার লোকজন এসে লোকগুলোকে দিব্যি হটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাপি তা করছে না কেন?
ডুরানির রাগ তখনও এতটুকু কমে নি। রাসভ স্বরে প্রশ্ন করলেন, অমন চুপ করে থাকলি কেন রে? সাহস থাকলে লোকগুলোর সামনে গিয়ে বল্, নিরীহ শ্রমিকটাকে পিটিয়ে মারার জন্যে কত টাকা ঘুস নিয়েছিস?
আকাশ গলা চড়িয়ে বলল, অমন ননসেন্সের মতো কথা বলছ কেন? বয়সের ভারে পাগল হয়ে যাও নি তো? আমিই থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি, কী করব, না করব, সেই সাজেশন তুমি দিতে চাচ্ছ আমাকে? একটা প্রসঙ্গ স্পষ্ট করে জেনে রাখো, কেরানিগিরির সঙ্গে বড়ো দারোগাবাবুর কাজের কোনো মিল খুঁজে পেতে চেও না।
রাগে ডুরানির শরীরের কাঁপুনি কিছুতেই কমছে না। শুধু ভাবছেন, জীবনের মূল নীতিগুলো আকাশ এভাবে ভুলে যেতে পারল? বড়ো পদ পেয়েছে কিন্তু বড়ো আদর্শ রক্ষার চাপ নিতে শেখে নি। এভাবে ভুল বকে তো ও জয়ী হতে পারবে না। ভিতরের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন।
আকাশ তখন বিছানার উপর জাঁকিয়ে বসে এস.ডি.ও., এস.ডি.পি.ও. এবং এস.পি.-কে ফোন করতে ব্যস্ত। পাবলিকের এ উন্মত্ততা তার পক্ষে কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ওরা জানে না, সময় বিবেচনা করে একজন ওসিকে কত বড়ো দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখনও ভেসে আসছে বাইরে দাঁড়ানো মানুষজনের উন্মত্ত কণ্ঠস্বর। —একবার বের হলে উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব রে। গরিব মেরে আর কাছারি গরম করতে দেব না। এমনি নানা টুকরো মন্তব্য।
ডুরানির বুঝতে অসুবিধা হল না যে আকাশ নিজের বিপদ নিয়ে ভীষণ বিড়ম্বিত হয়ে উঠেছে। নিজেকে বাঁচাতে উচ্চ পদস্থ অফিসারদের কাছে ফোন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাতেও যে বিপদ কাটবে, সেই বিশ্বাস তাঁর মধ্যে ছিল না। বরং ভাবছিলেন, এমন সুবর্ণ সুযোগে আকাশকে আরও ধারালো আক্রমণ করে পুরনো পথে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। ডান হাত সামনে তুলে ধরে পাঁচ আঙুল নাচাতে নাচাতে বললেন, অফিসের বাবাদের ফোন করে কিছু হবে না রে। নিজের পথ নিজেকেই বেছে নিতে হয়, নতুবা বাবাদের আশ্রয়ে পরাধীন জীবন কাটানো বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে। তুই একটা আস্ত খুনে, অন্যায় করেও গলাবাজি করতে এতটুকু বিবেকে বাধছে না। এসব ভাবতে ভীষণ ঘেন্না করে রে আমার।
মুখ সামলে কথা বলো, নাহলে কিন্তু….।
তুই কী করবি শুনি?
চরম রাগে আকাশের শরীর কাঁপছে।
ডুরানি তখনও বলে চলেছেন, এমনিই পাষণ্ড যে তোকে ঘৃণা করতে ভীষণ লজ্জাবোধ করি। আমার দুর্ভাগ্য, এমন ছেলেকে পৃথিবীর আলো দেখানোর আগে গলা টিপে খুন করাই উচিত ছিল আমার। কিন্তু তা যে কেন সম্ভব হল না, সেই খেসারত আমাকে সারাজীবন দিয়ে যেতে হবে।
বাঘের মতো লাল চোখ নিয়ে একবার ডুরানির দিকে তাকালো আকাশ।
তাতেও এতটুকু ভ্রূক্ষেপ নেই ডুরানির। বলে চলেছেন, তুই নরকের এমনিই জঘন্য কীট যে মুখ দেখতে ঘৃণা করে আমার। এ বাড়িতে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলেছিস রে।
ভুলে যেও না, এ বাড়ি আমার টাকায় তৈরি হয়েছে।
কার কেনা প্লট, তা একবার ভেবে দেখেছিস? তোর নামে কোনো ডকুমেণ্ট নেই, এ জায়গার দলিল সস্তাবেজ আমার নামেই।
আকাশ দাম্ভিক ওসি। মেজাজে এক আনা নীচে নামতেও তার ভীষণ কষ্ট হয়। বিশেষ গণ্ডির মধ্যে আটকে পড়েছে তার জীবন। তাই নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে সজোরে ডুরানির গালে চড় বসিয়ে দিল। ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ডুরানি।
হেনা ছুটে এসে শ্বশুরকে দাঁড় করাতে করাতে বলল, মানুষের মতো দেখতে হলেও পশুর মতো আচরণ করতে শিখেছো তো বেশ। নিজের পিতার গায়ে হাত তুলতে এতটুকু বিবেকে বাধল না তোমার? মানুষের হাত যে এভাবে পশুর হাত হয়ে যেতে পারে, তা আগে জানা ছিল না আমার।
নীরজ মল্লিক দ্রুত পায়ে ডুরানির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তখনও ডুরানির শরীরের কম্পন এতটুকু কমে নি। নীরজের নিবিড় সান্ত্বনা, ভেঙে পড়ো না বন্ধু। সময়ের টানে হয়তো দিনকাল আমূল পাল্টে গেছে কিন্তু জীবনের সত্যরূপ কখনো পাল্টে যেতে পারে না। তুমি সেই সত্যের সাগর হয়ে বেঁচে রয়েছ, এ মূল্যায়ন আগামি দিনে অনেকের কাছে ধরা পড়বেই।
ডুরানির গোঁঙানো স্বরে চাপা মন্তব্য, এভাবে ভাবতে নেই নীরজ। বরং মনে করতে পারো যে বৃদ্ধ বয়সে আমার কিছু দেনা ছিল আকাশের কাছে, সেটাই আজ ও সুদে আসলে আদায় করে দিতে পারল।
পাপান প্রিয় দাদুর পাশে মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে। আকস্মিক ঘটনায় এতই বিড়ম্বিত যে কী বলতে হবে তা তার মাথায় আসছে না। দাদুর কাছ থেকে শোনা নানা গল্প পর পর ভেসে উঠছে মনের পটে। ডুরানির ডান হাত চেপে ধরে বলল, তোমার একটা পুরনো গল্পের কথা এখন খুব করে মনে পড়ছে দাদু।
ডুরানির দুচোখ পাপানের দিকে, তাতে নতুন কৌতূহলের বন্যা। কিন্তু সেসব কথায় ব্যক্ত করল না। বরং ভাবলেশহীন চোখ নিয়ে চেয়ে থাকল প্রিয় নাতীর দিকে। তাহলে পাপান কী বড়ো হয়ে? আর ভাবতে পারলেন না নীরজ। হেনা চরম বিরক্ত হয়ে পাপানকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই আবার এ সময় গল্প ফাঁদতে এলি কেন?
জানো মা, এখন দেখছি, দাদুর বানিয়ে বানিয়ে বলা গল্প বেশ সত্যি হয়ে উঠেছে।
নীরজের প্রশ্ন, কোন্ সত্যি গল্পটা নতুন করে মনে পড়ল তোর?
শাখা নদীর ঘোলা জল দেখলেই বড়ো নদী মনে মনে ভীষণ দুঃখ পায়। দাদু কতবার এ গল্প আমার কাছে বলেছে।
নীরজ একটু হেসে বললেন, তাহলে কী পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা বড়ো নদী মনের দুঃখে আবার পাহাড়ে উঠে যাবে?
বড়ো নদীর বুকে এখন সেই শক্তি আছে কী?
কী রকম? এট্টু বুঝিয়ে বলবি?
আমার দাদু বড়ো নদী কিন্তু অনেক বয়েস হয়ে গেছে। বাপি তো শাখা নদী, ঘোলা জলের। তা দেখে দাদুর মনে দুঃখ থাকলেও কিছুতেই আর পাহাড়ের দিকে ফিরে যেতে পারবে না।
নীরজ মল্লিক মানসিকতায় শিক্ষক, সমাজবোধের সূক্ষ্ম কারিগর। কিশোর পাপানের গভীর জীবনবোধ দেখে আপ্লুত না হয়ে পারলেন না। তবুও একটা নতুন প্রশ্নে কয়েকবার দুলে উঠলেন। পাপানের মতো বাচ্চা ছেলে জীবনের অনুভূতি নিয়ে এভাবে কথা বলতে পারল, আকাশ থানার ওসি হয়েও নিজের সমাজ সচেতনাতায় তা নিতে পারল না কেন? আরেকটা বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হতে না পারলেও একটা অচেনা বিশ্বাসে ভর করতে বেশ ভরসা পেলেন। বড়ো হয়ে অন্তত পাপান তার বাপের মতো হবে না। তাৎক্ষণিক ঘটনার জেরে তেমন এক প্রতীতীতে হারিয়ে যেতে নীরজ মনে মনে বেশ সুখ অনুভব করতে লাগলেন। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া আকাশ নামক তাৎক্ষণিক বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যতের ধূসর ছায়ায় নীরজের অভিনব প্রত্যাশা দুলে উঠছে। হতাশার কন্দরে দাঁড়িয়ে আশার আলো দেখা যে কত বেশি সুখের, সেই গল্পে মজে থাকলেন নীরজ এবং ডুরানি। হেনা এসে বলল, একটু পরে চা দিয়ে যাচ্ছি। জীবনের চরম বেহিসেবের মধ্যে একেবারে খারাপ লাগবে না। আসলে কপালের মার, দুনিয়ার বার। আমার কপালটা আজ ভেঙে চৌচুর হয়ে গেল যে। হেনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।#

চলবে…

এ এক অন্য আঁধার (পর্ব- ৫)

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!