পিতৃতন্ত্রের পূর্বাপর ৪

।।চার।।

প্রজাতি হিসাবে মানুষের বিকাশ ও সামাজিক জীব হিসাবে যুূথ জীবনের সাংগঠনিক বিকাশের পাশাপাশি গোষ্ঠীগত-সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত-সম্পত্তি গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে সম্পত্তির মালিক, সম্পত্তির রক্ষাকর্তা, গড়ে উঠেছে বাজার, গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র।
মানুষের এই সামাজিক বিবর্তনের পাশাপাশি স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবাহের বিবর্তনও দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক রূপটি কীভাবে বদলেছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

মনুষ্য সদৃশ প্রজাতি এনথ্রোপয়েড থেকে মনুষ্য প্রজাতি সৃষ্টির পাশাপাশি যে গরিলা, শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটাং, গিবন সৃষ্টি হয়েছে তাদের পারিবারিক ধারাতে দেখা যায় গিবন একজোড়া স্বামী স্ত্রী আর বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। বাচ্চারা বড় হলেই সরে পড়ে। ওরাংওটাং আর একটু বড় পরিবার অর্থাৎ দুটি স্ত্রী-পুরুষ ও তাদের বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। গরিলারা একটি পুরুষ ও একাধিক স্ত্রী এবং বাচ্চাদের নিয়ে থাকে। পুরুষ স্বামী আসক্ত হয়ে পড়লে অন্য গরিলাদের সঙ্গে স্ত্রী গরিলাকে মিশতে দেখা যায়। কিন্তু মানুষের সব থেকে নিকটবর্তী প্রজাতি শিম্পাঞ্জী অল্প থেকে বেশী একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। তাদের ভিতর স্ত্রী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।

অনুমান করা হয়, মানুষের সুদূর অতীত এমনি স্ত্রী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা দিয়েই শুরু হয়েছিল। সেখানে যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীই পরস্পর মিলিত হতে পারত। স্বভাবতই নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ছিল অজ্ঞাত। সেদিন যদি স্ত্রী আধিপত্য বা পুরুষ-আধিপত্য ব্যক্তি স্ত্রী বা ব্যক্তি পুরুষের সঙ্গে পরম্পর উধা জাগ্রত করতে সাহায্য করত তা হলে মানুষ একত্র বাস করতে পারত না। সেক্ষত্রে সামাজিক জীবনের প্রভাব, মানুষের উন্নততর প্রাণী রূপে উত্তীর্ণ হবার পথ রচনায় ব্যর্থ হত।

অবাধ স্ত্রী-পুরুষের যৌন মেলামেশার স্তর থেকে মানুষের যাত্রা শুরু হল এক রক্ত সম্পর্কের পরিবারের একই বংশস্তরের, স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে বিবাহের প্রথায়। অর্থাৎ সমস্ত ঠাকুরদা-ঠাকুমারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী। বাবা-মা স্তরের সমস্ত পুরুষ-স্ত্রী এবং ভাইবোন স্তরের সমস্ত পুরুষ-স্ত্রী পরস্পর স্বামী-স্ত্রী। এই দুটি ধারাই প্রচলিত ছিল ব্য অবস্থার পর্বে।

এরপর বিয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল পুনলুয়া বিবাহ অর্থাৎ ভ্রাতা- ভগ্নীর পরস্পর বিবাহ রহিত হওয়া। নতুন বিয়ের প্রথায় সমস্ত ভ্রাতা ও তাদের স্ত্রীরা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী। আবার সমস্ত ভগ্নী ও তাদের স্বামীরা পরস্পর বৌ-বর। এরপর দেখা দিল জোড় বাধা বিবাহ। অনেক স্বামীর মধ্যে একজন প্রধান এবং অনেক স্ত্রীর মধ্যেও একজন প্রধান হয়ে পরস্পর জোড় বাঁধা। এই প্রবণতা ক্রমশঃ একজন স্ত্রী ও একজন পুরুষের পরস্পর স্বামী স্ত্রী হওয়ার প্রথাতে উপনীত হয়। তবে তখন পর্যন্ত তা ছিল অস্থায়ী। যে কোন একজনের ইচ্ছায় এই সম্পর্ক ভেঙ্গে নতুন সম্পর্কে রূপান্তরিত হতে পারত। এই দুটি বিবাহ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল বর্বর অবস্থার পর্বে।

বন্য অবস্থা থেকে বর্বর অবস্থার বিবাহ-পদ্ধতি সভা অবস্থায় এসে রূপ লাভ করে এক পতি-পত্নী প্রথায়। এক পতি-পত্নী প্রথার মধ্যেই রূপলাভ করতে থাকে পিতৃতন্ত্রের ভ্রণ। এক পতি-পত্নী বিবাহ কার্যতঃ স্ত্রীজাতিকে এক পতি বরণে বাধ্য করে। অন্যদিকে ক্রমশঃ পুরুষের ক্ষেত্রে, একাধিক স্ত্রী গ্রহণ এবং তা থাকা অবস্থায় ও বন্ধ হয়ে গেলে, হেটায়ারিজম ও বেশ্যা বৃত্তি প্রচলিত হওয়ায়, একাধিক রমণীর সঙ্গে যৌন মিলনের পুরুষ-অধিকার অব্যাহত থাকে। বিবাহের বিবর্তনের সাথে সাথে সম্পত্তির ধারণার ও মালিকানার ঘটেছে রূপান্তর। মানবগোষ্ঠীর একটা গোটা উপজাতি একসময় একটা অঞ্চলে বাস করত। সেই অঞ্চলের সম্পদ আহরণে উপজাতির অন্তভুক্ত ফ্রাত্রী কিংবা গোত্রের সকলের সমানাধিকার ছিল। কিন্তু অন্য কোন উপজাতির ছিল না সেখানে ঢোকার অধিকার। এটিই হল সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা।একদিকে ছিল প্রাচুর্যা। অন্যদিকে প্রয়োজন ছিল না সঞ্চয়ের। তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রশ্নটি শুরুতে দেখা দেয়নি। বন্য অবস্থায় গণ্য করবার মত কোন সম্পত্তিও দেখা দেয় নি।

বর্বর অবস্থায় সম্পত্তির শুরুর দিকে ঘরবাড়ি, বস্ত্র, শিকারের অস্ত্র, পশু, অতিরিক্ত খাদ্য প্রভৃতি ছিল গোত্রের সম্পত্তি। ক্রমশঃ স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে শ্রম-বিভাজনের ফলে গৃহস্থালীর জিনিষপত্র থাকত মহিলাদের অধিকারে, আর শিকার ও কৃষি উৎপাদনের জিনিষপত্র, খাদ্যবস্তু, পশু প্রভৃতি থাকত পুরুষ পাহারায় ও তাদের অধিকারে। এখান থেকেই ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তির গুরুত্বপূর্ণ জিনিষগুলি পুরুষের হস্তগত হয়। কিন্তু গোড়ার দিকে সমষ্টিগত বিবাহের কারণে, সম্পত্তি মাতৃধারা অনুসারে গোত্রের বংশধরদের হস্তগত হত। সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরুষ তার ক্ষমতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজস্ব অধিকারে বংশধারা সৃষ্টিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যুদ্ধবিগ্রহের ভিতর দিয়ে বন্দী করা দাসের অধিকারও পুরুষকে কর্তৃত্বের মানসিকতার দিকে নিয়ে যায়। পাশাপাশি বিবাহের প্রথা জোড়বাঁধা বিবাহের দিকে অগ্রসর হওয়ায় পুরুষের নিজস্ব বংশধারা সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হল। এক পতি-পত্নী বিবাহ বা এক পতি-বহুপত্নী বিবাহ সেই অবস্থাকে স্থায়িত্ব দিল।

বিবাহের বিবর্তনের প্রতিটি ধাপের সঙ্গে সম্পত্তির অধিকারবোধের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক জানা যায় না। আবার নির্বিচার যৌন সম্পর্ক থেকে এক বংশধারার ভিতর বিবাহ, তা থেকে পুনলুয়া ও জোড় বাঁধা বিবাহের বিবর্তনের সঙ্গে পাশা-পাশি সম্পত্তির ধারণার বিবর্তনের প্রত্যক্ষ কোন যোগসূত্র নেই। একে অন্যের বিবর্তনের ফলও নয়। কিন্তু সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মাতৃধারা থেকে পিতৃধারায় আসাটা ঐতিহাসিক সত্য। কবে কী ভাবে এবং কেনই বা বিবাহের এই বিবর্তন ঘটল, ঠিক ঠিক এভাবে ঘটাটা কতদূর সত্য, সম্পত্তির অধিকারে পিতৃধারা- কী ভাবেই বা প্রতিষ্ঠিত হল তা সুস্পষ্টভাবে জানা দুষ্কর।

বিয়ের ক্ষেত্রে এই স্তরগুলি যে সুস্পষ্টভাবে সর্বত্র সার্বজনীন ভাবে ঘটেছিল তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এক পতি-পত্নী প্রথা ও একই সাথে একটি পুরুষের একাধিক স্ত্রী, কিংবা একটি মেয়ের একাধিক স্বামী অনেক দেশে একই সময়ে প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ মিশরে ঐতিহাসিক কালেও প্রচলিত ছিল। মুসলমানদের ভিতর সহোদর ভাই-বোন ছাড়া অন্য ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহ আজও চলছে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মামা-ভাগনী বিয়ে এখনো দেখা যায়। এইসব দিক থেকে দেখলে জীবাশ্মবিদ্যা যেমন-ভাবে প্রাকৃতিক যুগস্তরকে তুলে ধরে, বিবাহের ইতিহাস তেমন-ভাবে সামাজিক স্তরকে প্রতিফলিত করতে পারে না। দেবদাসী বা বেস্তার অস্তিত্ব যেমন নির্ভুল ভাবে পুরুষ প্রাধান্যের দৃষ্টান্ত হতে পারে, বিবাহের ইতিহাস তেমন নিশ্চিতভাবে মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের বস্তুসম্মত ব্যাখ্যা হতে পাবে না।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভবের পরেও বহু সমাজে নানাভাবে নারীর গুরুত্ব ও প্রাধান্য বহমান ছিল। মাতৃধারায় বংশগতির প্রচলন মাতৃতন্ত্রের ফল হিসাবে না দেখে বংশধারা নির্ণয়ের তৎকালীন স্বাভাবিক উপায় হিসাবে দেখা যেতে পারে। পুরুষতন্ত্র পরবর্তী সময়ে যে নারীকে ঘৃণিত কক্ষে নিক্ষেপ করেছে তার উদ্ভবের পিছনে পিতৃবংশধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিলেও অন্যান্য আরো অনেক কারণ থাকাটাই স্বাভাবিক।

পিতৃধারায় ব্যক্তিগত উত্তরাধিকারের প্রচলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার সাথে সাথেই উদ্ভব হয়েছে পুরুষকর্তৃত্বের। সামাজিক অর্থনৈতিক এই পুরুষ কর্তৃত্বই হল পিতৃতন্ত্র। পিতৃতন্ত্রকে এই ভাবে দেখা আর এর পূর্বে মাতৃধারায় গোষ্ঠীগত উত্তরাধিকারের প্রথার মধ্যে মাতৃতন্ত্রের ধারণাকে চিহ্নিত করা সম্ভবতঃ এক নয়। পিতৃতন্ত্র হল পুরুষ কর্তৃত্ব ও আধিপত্য যা নারীর উপর শোষণ- নির্যাতন ও অবদমনের কারণ। কিন্তু মাতৃধারায় উত্তরাধিকার থাকা কিংবা ঐতিহাসিক কারণে সেই সময় নারীর প্রাধান্য থাকার অর্থ আদৌ পুরুষের উপর নারীর শোবণ নির্যাতন অবদমন চালনাকে বোঝায় না। অর্থাৎ মাতৃতন্ত্র পিতৃতন্ত্রের বিপরীত রূপ হিসাবে অস্তিত্বহীন।

ক্রমশ… 

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!