বাংলার নবজাগরণ ও মাইকেল মধুসূদন

কোন কোন মানুষের জীবনের ঘটনা এতই অভাবিতপূর্ব ও চমকপ্রদ যে তার কাছে হার মেনে যায় দ্বন্দ্ব সংঘাতপূর্ণ নানাবিধ জটিলতা যুক্ত নাটকের কাহিনী। নাট্য ঘটনার ক্ষেত্রে শান্তনা থাকে যে সে গল্প বানিয়ে গল্প, কিন্ত কোন ব্যক্তির যাপিত জীবনের গল্প সত্য বলে সেখানের শান্তনা ও ভরসার আর কোন জায়গা থাকে না। উনিশ শতকের জাতক মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছরের জীবন ও তার শোচনীয় পরিণতি আমাদের টেনে নিয়ে যায় এমনই এক নিরাশার উপকূলে। কিন্তু এমন নির্মম ভবিতব্যের শিকার হওয়া তো তার শৈশবের ভাগ্যলিখন ছিল না। তিনি আদৌ দরিদ্রের সন্তান নন, এমনকি মধ্যবিত্তের ঘরেও জন্মাননি। তার পিতা রাজনারায়ন দত্ত পূর্ববঙ্গের সাগরদাঁড়ির অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত মানুষ ছিলেন। তার পৈত্রিক জমিদারীও ছিল। কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন রাজনারায়ন। মধুসূদন তার একমাত্র পুত্র। পুত্রকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তাকে দশ বছর বয়সেই কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন। ভর্তি করেছিলেন খিদিরপুর গ্রামার স্কুলে। পরে সেখান থেকে মধুসূদন ভর্তি হন সেকালের কলকাতায় ইউরোপীয় শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজে। এখানে মেধাবী ছাত্র হিসাবে মধুসূদনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশী দেরী হয়নি। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে অসম্ভব অধ্যাবসায়ী ছিলেন তিনি। তাই অল্প সময়ের মধ্যে ৭/৮টি ইউরোপিও ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন মধুসূদন। এবং গ্রীক, ল্যাটিন, ইতালীয়, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় লেখা সাহিত্য সরাসরি সে ভাষায় পড়তে সক্ষম হন। এ পাঠের প্রভাব পড়েছিল তার লেখা কাব্য ও নাটকে। তার সৃজন প্রতিভার স্ফূর্তি ঘটেছিল অনেকটা ধুমকেতুর মতো- ক্ষণিক কিন্তু অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল। মাত্র চার বছর সাতমাসের মধ্যে লিখে ফেলেছিলেন একটি আখ্যানকাব্য, একটি সাহিত্যিক মহাকাব্য, তিনটি নাটক, দুটি প্রহসন, একটি পত্রকাব্য (যাতে মোট ১১টি পূর্ণ পত্র কাব্যকারে আছে) ও একটি গীতিকাব্য। এছাড়া ছন্দের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে বাংলায় প্রবর্তন করেছিলেন কবি মিলটনের ব্লাঙ্ক ভার্স (Blank verse) অনুসরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ। আরও কিছু পরে ইতালীয় কবি পেত্রার্কা’র (Francesco Petrarca) সনেট অনুসরণে সৃষ্টি করেছিলেন বাংলায় প্রথম চতুর্দশপদী কবিতা, যার আয়তন চোদ্দ চরণে সীমাবদ্ধ এবং প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যাও চোদ্দ।

এই শিখরস্পর্শী সাফল্যের পাশে বাংলার অন্যান্য অনেক সাহিত্যিককে ম্লান মনে হয়। অথচ এতখানি বিজয় গৌরব থাকা সত্ত্বেও মধুসূদনের জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কেটেছিল ভীষণ দারিদ্র ও অনাহারে; তার অসহায় মৃত্যু ঘটেছিল আলিপুরের সরকারী দাতব্য হাসপাতালে ক্লিন্ন শয্যায়। তার ভৌমজীবনের এই করুণ ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বারবার মনে হয়, তার প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ভীষণ অমিতব্যয়ীতা ও ভোগবিলাসের সুগভীর ইচ্ছার সঙ্গে তাল রক্ষা করতে পারেনি তার সল্পায়তন অর্থ উপার্জন। গৌরব লাভের সমস্ত সম্ভাবনা ও শক্তির উজ্জ্বল উপস্থিতি সত্ত্বেও ভাগ্যের কাছে তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। তার অমিত শক্তি ও বিপুল পরাভব লক্ষ্য করে একজন সমালোচক লিখেছেন- ‘বিয়োগান্ত নাটকের মতোই কবির জীবন ছিল দুরন্ত দুঃসাহসে প্রমত্ত, বীর্যে সংকল্পে প্রতিভায় দুঃসাহসী। কিন্তু ভাগ্য বিধাতার অদৃশ্য গোপন হস্তক্ষেপে সে জীবন বারবার সংকল্প চ্যুত হয়েছে। অভ্রভেদী শিখর বজ্রাঘাতে ভেঙ্গে পড়েছে।, দুর্জ্ঞেয় নিয়তির ইচ্ছাশক্তির কাছে অমিত পুরুষকার মাথা নত করেছে। অভিনব তার যাত্রা, পদে পদে বৈজয়ন্তী উড়িয়ে নব নব উপকূলে তিনি অবতরণ করেছেন। তবু তার অক্ষয়কীর্তির তরণী সাফল্যের শেষ ঘাটে উত্তরণ করতে পারেনি।’ এই অসাফল্যের বেদনা নিয়েই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন, অনেক পরে পেয়েছেন মহাকবির যোগ্য সম্মান।

বস্তুত উনিশ শতকে পশ্চিমি শিক্ষাদীক্ষার হাত ধরে বাংলায় যে নবজাগরণের আবির্ভাব ঘটেছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদনের মানসক্ষেত্র ও তার সৃষ্টিসম্ভার পর্যালোচনা করার অবতরণিকা স্বরূপ এই সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরার কারণ এই যে ইউরোপীও রেনেসাঁসের প্রবাদপ্রতিম পুরুষদেরও জীবনে এমন দুর্ভাগ্যের ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটতে দেখা গিয়েছিল। তারাও দন্ড দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। নতুন মূল্যবোধ ও জীবন-প্রতীতীকে বরণ করে নেবার মাশুল হিসেবে। মধুসূদনের সৃষ্টিতে এদেশীয় নবজাগরণের প্রভাব অন্বেষণ করতে গেলে তার উৎস ও পূর্ব প্রেক্ষাপট হিসেবে ইতালীয় তথা ইউরোপীও রেনেসাঁসের স্বরূপটি বুঝে নেওয়া আবশ্যক

সকলেই জানেন পশ্চিমি রেনেসাঁসের মাতৃভূমি ছিল ইতালি ও পিতৃভূমি গোটা ইউরোপ। মোটামুটিভাবে চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত এই রেনেসাঁসের বিকাশ ও বিস্তার। রেনেসাঁসের প্রকৃতি বিচার করে কেউ কেউ এই সময়পর্বকে অভিহিত করেছেন ‘মানব সভ্যতার প্রথম বসন্তকাল’ হিসেবে। বসন্ত যেমন জরাধর্মী শীতের অবসানে প্রকৃতিতে নিয়ে আসে প্রাণের নবীন হিল্লোল, গাছেদের শাখায় শাখায় নতুন পাতা গজায়, ফুটে ওঠে হাজারও রঙিন ফুল, তেমনি সামন্তবাদী গোষ্ঠীতান্ত্রিক সাবেকী ভাবনার গড্ডালিকা-প্রবাহী মধ্যযুগের অবসানে ও অধুনিকতার আগমনে বিদায় নেয় অনেক পুরোনো রীতিনীতি, মূল্যবোধ, অন্ধ কুসংস্কার সাহিত্যের গতানুগতিক ভাব-ভাষা-ছন্দ; তার পরিবর্তে দেখা দেয় সমাজে-সংসারে-সাহিত্যে- সংস্কৃতিতে নতুন চিন্তা, নব দর্শন, নবীন জীবনপ্রত্যয় ও নব নব আঙ্গিকসহ সাহিত্যবস্তুর নবীন ভাষ্য। একে এক বলা যায় আমাদের সার্বিক অস্তিত্বের নবজন্ম। ‘রেনেসাঁ’ বা রেনেসাঁস শব্দটি আদতে ফার্সি ভাষার শব্দ, যার ইংরেজী পরিভাষা হল ‘Re-birth’, বাংলায় পুনর্জন্ম। ‘Renaissance’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ফরাসী ঐতিহাসিক মিশেল তার ‘History of France’ বইয়ের সপ্তম খণ্ডে। তার আগে ভাসারি-ও একই অর্থে Rinascita’ শব্দের প্রয়োগ করেন, যা থেকে Renaissance শব্দটির সৃষ্টি বলে অনেকে মনে করেন। শব্দটি যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, তা যে নবীন চিন্তার উদ্দীপন ও নতুন মানব প্রত্যয় গড়ে উঠবার উল্লাসকে বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইউরোপে মধ্যযুগে ছিল চার্চের আধিপত্য ও বিভিন্ন গিল্ডের কঠিন শৃঙ্খল। তখন ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার কোন স্বীকৃতি ছিল না। সেই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে ব্যক্তির মুক্তি ঘোষণা, ভক্তি থেকে যুক্তি ও ধর্ম থেকে মানুষের পথে যাত্রা ছিল রেনেসাঁসের লক্ষণ। পুরোনো প্রথাগুলির গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে সর্বত্রই সংশয়ী মন সজাগ থেকেছে, আর দেখা গেছে সবকিছুকে মানব-মূল্যে বিচার করার প্রবনতা। একদিন যে ইউরোপ মনে করতো গ্রেকো-রোমান সাহিত্যে আদ্যিকালের পুরোনো মূল্যবোধ ঢুকে রয়েছে, তাকে সরিয়ে দিয়ে মধ্যযুগে সূচিত হয়েছিল চার্চের আধিপত্য, জোয়ার বয়ে গিয়েছিল ফিউডালিজম (Feudalism) আর ফাঁপানো এরিস্টোক্রাসির (Aristocracy)। কিন্তু রেনেসাঁসের আলো জ্বলে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার শুরু হয় প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্যের পাঠ, প্যাগান সংস্কৃতির চর্চা। রেনেসাঁসের কালে দেখা দেন ইতালিতে একদল মুক্তবুদ্ধির মানুষ- পেত্রার্কা (Petrarca), ওভিদ (Publius Ovidius Naso), বোক্কাসিও (Giovanni Boccaccio), ব্রুনি (Leonardo Bruni), সালুতাতি (Coluccio Salutati), ভাল্লা (Lorenzo Valla), গুয়ারিনো (Camillo Guarino Guarini), লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (Leonardo da Vinci), রাফায়েল (Raffaello Sanzio da Urbin), মাইকেল এঞ্জেলো Michael Angelo), মানেত্তি (Giannozzo Manetti), এরামুজ (Desiderius Erasmus), ফিকিনো (Marsilio Ficino), আলবের্তি (Leon Battista Alberti), পোগগিয় (Gian Francesco Poggio), পিকো (Giovanni Pico della Mirandola) প্রমুখ সাহিত্য-চিত্রকলা-বিজ্ঞান-সঙ্গীত ও অন্যান্য শাখার কৃতবিদ্য স্রষ্টা পুরুষের দল। এদেরকে সামরিক অভিধায় ‘হিউম্যানিস্ট’ (Humanist) বলে অভিহিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কাজ করেছে সর্বগ্রাসী অনুসন্ধিৎসা ও তর্কময় মানসিকতা। কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, এইসব রেনেসাঁস-জাত হিউম্যানিস্ট ও শিল্পীরা মূলত ছিলেন জনবিছিন্ন ও শ্রেনিচ্যুত মানুষ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইতালি এক সুবর্ণময় অর্থনৈতিক যুগের বাসিন্দা ছিলেন এরা, যা ছিল ওই রেনেসাঁসের ভিত্তি। এই রেনেসাঁস গড়ে ওঠার পেছনে বাণিজ্যিক ধনতন্ত্রের ভূমিকাও কম ছিল না। বার্ডি, পেরুজ্জি, মেদিচি পরিবারের বাংকিং ব্যবসা ও তাদের বাণিজ্যলব্ধ মূলধন রেনেসাঁসকে গতি যুগিয়েছিল। এইসব ধনী বণিক পরিবারের হাত ধরেই ইতালিতে দেখা দিয়েছিল ‘Money Economy’, যা বুর্জোয়া শ্রেনির বিকাশে প্রভূত সাহায্য করেছিল।

ইতালির এই জাগরণ পরে গোটা ইউরোপ ভূখণ্ডে ‘রিফর্মেশন’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে সমাজচিন্তায়, বিদ্যাচর্চায়, শিল্পসাহিত্যে গতিশীল এক জীবনধারার আবির্ভাব ঘটতে থাকে। নিজের দেশকালের বাইরে কোনো দূরাগত আদর্শকে আত্মস্থ করে নিজের সামাজিক ও মানসিক বিবর্তনকে সেই ধারার সঙ্গে একাত্ম করাই হয়ে ওঠে ইউরোপীয় নবজাগরণের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এই সময় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের আবির্ভাব ঘটে, যে ধর্ম অর্থের বিনিময়ে পাপাচারকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ ছিল। গৌরবকে অতীতে অন্বেষণ করতে গিয়ে ইউরোপের জ্ঞানোদীপ্ত মানুষেরা শুরু করলেন প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাহিত্যের নিবিড় চর্চা। এদের মধ্যে একদল মধ্যযুগীয় চার্চকেন্দ্রিক খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্যকে অন্ধকারের সঙ্গে ও পুনরাবিস্কৃত গ্রেকো-রোমান ঐতিহ্যকে তুলনা করতে থাকেন আলোর সঙ্গে। পুরোনো ধ্রুপদী সাহিত্যের ওপর পড়তে শুরু করল নতুন চিন্তা-চেতনার ছাপ।

ফলে মানবতা ও আত্মবোধের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে লাগল। ইংল্যান্ডে একই সময়ে আবির্ভূত হলেন ক্রিস্টোফার মার্লো ও উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। এদের লেখা নাটকে ধরা পড়ল ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পূর্ণ বিকশিত রূপ। এরা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, সাদা-কলোয় মেশা রক্তমাংসের মানুষকেই করে তুললেন তাদের রচনার মুখ উপজীব্য। রেনেসাঁসের চিন্তালীল পর্যবেক্ষকরা খুব সঙ্গতভাবেই এই কালটিকে চিহ্নিত করেছেন আশা ও আত্মপ্রত্য্যের যুগ হিসেবে। একই সঙ্গে এই সময়পর্বটিকে তারা বিবেচনা করছেন ‘Revival of Classical learning’ – এর কাল বলেও। সমস্ত দিক মিলিয়ে বলা যায়, যুক্তিনির্ভর মানবতাবাদী আধুনিক জীবনবোধের সূচনা করল ইউরোপীয় রেনেসাঁস।

বাংলায় নবজাগরণ এই পশ্চিমি রেনেসাঁসের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত এবং এই জাগৃতির তরঙ্গ গোটা উনিশ শতক জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের অন্যত্র। এই কালপর্ব থেকেই সূচিত হল বাংলা তথা ভারতের সাহিত্য ও সংহতির আধুনিক পর্যায়, ব্যক্তিমানুষের জীবনাচরণেও দেখা গেল তুমুল পরিবর্তন। বাংলার মধ্যযুগ ছিল ধর্মশাসিত, গোষ্ঠীচালিত ও গতানুগতিক ধ্যান-ধারণা-পোষিত। সাহিত্যে দেবভক্তির ছড়াছড়ি। ব্যক্তি-মানুষের, কোথাও কোনো স্বাধীন প্রকাশ নেই। ভাব ও ভাব ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে পুচ্ছানুসারিতার চূড়ান্ত। শাস্ত্র আর লোকাচারের বেড়ি প্রতি পদে পদে। পুরুষতন্ত্রের দাপটে নারীরা অবরুদ্ধ, অভিমতহীন, ভোগীর কামবস্তুতে পরিণত। দাসীত্বের দর্শনে তাদেরকে দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে শৈশব থেকে। বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথায় তাদের জীবন বিড়ম্বিত ও নৃশংসভাবে বলিপ্রদত্ত। কুলীন কন্যারা সপত্নী দ্বন্দ্বে জর্জরিত। অন্যদিকে কৃষিনির্ভর সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির দ্বারা সামাজিক সচলতাও স্তব্ধ। জাতপাতের ছোঁয়াছুঁয়ি বজায় রেখে বাংলার অনক্ষর গ্রামসমাজ অনন্ত ঢিমে তালে চলেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের হাত ধরে। কিন্তু যে মুহূর্তে ঔপনিবেশিক ধনতল প্রবেশ করল বনিক ইংরেজদের বদৌলতে এবং ইস্ট ইওিয়া কোম্পানি দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসল ও তাদের সাম্রাজ্য পরিচালনার প্রয়োজন নতুন শিক্ষাদীক্ষার আয়োজন করল, তখন থেকে শুরু হল নতুন একটি পর্যায়।

তবে বিদেশি সিভিলিয়ানদের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য গঠিত ফোর্ড উইলিয়াম কলেজ নয়, বরং মধ্যবিত্ত হিন্দু ঘরের সন্তানদের শিক্ষার জন্য নির্মিত হিন্দু কলেজ ছিল বাংলার নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র। এদেশে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিল এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়োজিত পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা। এখানকার শিক্ষক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ও তার বিপ্লব-সাধক শিষ্যরাই প্রথম এনেছিলেন আধুনিকতার ঝরো হাওয়া, যার দমকা বাতাসে উড়ে গিয়েছিল পুরোনো প্রথা ও সংস্কার, খুলে গিয়েছিল এদেশের মানুষের বদ্ধ মনের দরজা ও জানালা। ডিরোজিয়ানদের কার্যকলাপের মধ্যে কিছু উগ্রতা ছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু তাদের অনেকের চিন্তা ভাবনাতেই মানুষের ইহলৌকিক জীবন বিশেষ মূল্য পেতে থাকে; ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নারীশিক্ষার স্বরূপ ও মুল্য বুঝতে শুরু করে এদেশের মানুষ। গোষ্ঠী-সমাজ-ধর্ম-প্রথাকে বিদায় জানিয়ে সে ফিরে চলে আপন নিভৃত অন্তরের গোপন কুঠুরীতে। মানুষের এই নিজস্ব প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকেই ধরা হয়ে থাকে আধুনিক যুগের প্রারম্ভ।

‘আধুনিক’ শব্দটি যদিও আপেক্ষিক, তবুও ভিন্ন কাল ভিন্ন মানসিকতা থেকে কোনো নির্দিষ্ট যুগ বা জীবনবোধের পার্থক্য সূচিত করার ক্ষেত্রে এ শব্দের ব্যবহার অনিবার্য। সাপেক্ষ দৃষ্টিতে অগ্রবর্তীকাল সবকিছুতেই পিছিয়ে ফেলে তার পূর্ববর্তীকালকে। কালের প্রভাব সঞ্চারিত হয় মানবমনে। যুগের ধর্ম, স্বভাব ও প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতি রেখে যাবতীয় সৃষ্টি চলে এগিয়ে। সময়ের এই চলমানতা হঠাৎ কখনো কখনো স্তব্ধ হয়। তখন তার চারপাশে জমে উঠতে থাকে ‘আচারের মরু বালুরাশি’; একই কক্ষপথের আবর্তনে ক্লান্তি জমে। এমন অবস্থায় বাইরের কিংবা ভিতরের অভিঘাতে জেগে ওঠে চিরচলিষ্ণু প্রাণ, সুপ্তির মগ্নতা থেকে উত্থান ঘটে চিরকালীন মানবমনের। সংস্কৃতিবিদরা একেই বলেছেন ‘নবজাগরণ’। পাশ্চাত্যের রেনেসাঁস শব্দে যে পুনর্জন্মের আভাস আছে, ‘নবজাগরণ’ শব্দটি তার সঙ্গে পুরোপুরু সর্বসম না হলেও মানসিক নিদ্রা থেকে নতুন করে উত্থানের ইঙ্গিত থাকায় এই অভ্যুদয় নবাবির্ভাবের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তবুও সংস্কৃতি পর্যবেক্ষকরা ইতালীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের তফাৎ লক্ষ্য করেছেন বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে।

যেমন: ইতালিতে যখন রেনেসাঁস ঘটে, তখন সে দেশ ছিল স্বাধীন এবং তা অন্য কোনো দেশের দ্বারা প্রভাবিত ছিল না; কিন্তু বাংলায় যে নবজাগৃতি দেখা দিয়েছিল সে সময় ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটেনের পদানত এবং ইউরোপীয় প্রভাবের ফলেই শিক্ষিত বাঙালির চিত্তজাগরণ ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত, যে গতিবেগ এদেশে রেনেসাঁসে লক্ষ্য করা গিয়েছিল, সেটা বাংলার ক্ষেত্রে অলব্ধ ছিল। তৃতীয়ত, বাংলার নবজাগরণে পরস্পরবিরোধী প্রবনতা দেখা গিয়েছিল। যেটা বাঙালির রেনেসাঁসে সেভাবে ফুটে ওঠেনি। চতুর্থ পশ্চিমি রেনেসাঁস পৌঁছেছিল সমাজের গভীরে, কিন্তু বাংলায় ইউরোপীয় বিদ্যার আলো কেবল উদ্ভাসিত করে তুলেছিল নগর কলকাতার শিক্ষিত সম্প্রদায়কে। তাই অনেকেই উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নাগরিকের জ্ঞানদীপ্তিকে আদৌ নবজাগরণ বলে মানতে চাননি, কারণ এর গভীর ও দূরসঞ্চারী প্রভাব থেকে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছিল সাধারণ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। শেষত উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল স্ববিরোধীতায় ভরা।

কিন্তু তবুও বাংলার নবজাগরণে বহুকালাগত অভ্যস্ত চিন্তা-চেতনার জগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল, এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। স্বনামধন্য যদুনাথ সরকার, সুশোভন সরকার, অমলেশ ত্রিপাঠী প্রমুখ ঐতিহাসিকরা, বিনয় ঘোষ, অন্নদাশঙ্কর রায়, শিবনারায়ন রায় প্রমুখ সংস্কৃতি পর্যবেক্ষকরা উনিশ শতকের এই ভাবান্দোলনকে এক নতুন জীবনপ্রত্যয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটি বাঙালি সমাজের সর্বস্তরে সমানভাবে ছড়িয়ে না গেলেও চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী মানুষদের যে আমূল নাড়া দিয়েছিল এবং সেই নবজাগ্রতদের বহুমুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে তার কিছু অংশ বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সন্দেহাতীতভাবে সত্য।

যে নিম্নবর্গের মানুষেরা এতদিন শিক্ষা বঞ্চিত ছিল, যে সমস্ত নারীরা বহুকাল পুরুষতন্ত্রের চোখ রাঙানিতে নত ন্যুব্জ হয়ে অন্তপুরে মুখ লুকিয়ে ছিল, তাদের সামনে উন্মুক্ত হল এবার শিক্ষা সংস্কৃতির সিং-দরজা। এরা শিক্ষিত হয়ে বৃত্তি বদল করল, আর্থিক দিক থেকে সম্পন্ন হয়ে উঠল, আর এর ফলেই দেখা দিল সামাজিক গতিশীলতা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘটল অভাবনীয় পরিবর্তন। দেবতার একাধিপত্য সরে গিয়ে প্রধান স্থান দখল করল মানুষ। ভক্তি নয়, যুক্তিই হল মুক্তবুদ্ধি মানুষের অবলম্বন। কেবল আর পয়ার-ত্রিপদীর ছন্দে বাধা কাব্যতেই তৃপ্ত নয় ইউরোপীয় সাহিত্যে দীক্ষিত বাঙালি পাঠক। তার মানস তৃপ্তির জন্য গড়ে উঠল বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন সংরূপ। দেখা দিল গদ্য, গদ্যসাহিত্য, সৃষ্টি হল সাহিত্যিক গদ্যের। এই ধারাপথেই নেমে এল নকশা, রম্যরচনা, উপন্যাস, ছোটগল্প, রকমারী নাটক, গুরুগম্ভীর ও হালকাচালের প্রবন্ধ, তুখোড় সাহিত্য সমালোচনা এবং আরো কত কী। নব্যশিক্ষিত বাঙালির মানস পরিভ্রমণের উপযুক্ত উদার একবিচরণ ক্ষেত্রের সৃষ্টি হল। মানতেই হবে আজকের উত্তর-আধুনিকতা উনিশ শতকীয় আধুনিকতার যথার্থ উত্তরসূরি। সুতরাং বাংলার নবজাগরণ, শত বিতর্ক সত্ত্বেও একটি জ্বলন্ত বাস্তব। আর আমাদের আলোচ্য সেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই বঙ্গীয় নবজাগরণের এক অন্যতম প্রাণপুরুষ।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!