‘বিনম্র সনেটগুচ্ছ’—এক প্রকৃষ্ট প্রচ্যুত সময়ের ব্যবচ্ছেদ। এখানে বাস্তব সচেতন কবি অমলেন্দু বিশ্বাস তাঁর মনের গহনরাজ্যের অনুভূতিরাশি ও মননশীলতাকে হৃদ্যতার সঙ্গে প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর কাব্য ‘বিনম্র সনেটগুচ্ছ’-তে। এই কাব্যগ্রন্থটিতে সর্বমোট অষ্টআশিটি কবিতা আছে। রচনাকাল ১০.০২.২০০৯ থেকে ০৬.০৮.২০০৯; অর্থাৎ মাত্র আট মাসের মধ্যে তিনি একটি প্রবহমান স্রোতের মানসিকস্তরের বিশেষ প্রকাশ ৮৮টি সনেটের মধ্য দিয়ে ঘটিয়েছেন। প্রথমেই আমরা পরাবাস্তবতাবাদের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, এবং আরো কয়েকটি অপূর্ব চিত্রকল্প দেখতে পাই প্রথম সনেটটিতে। কবি উদাত্ত কন্ঠে বলে ওঠেন:
বোধের পাখিরা ওড়ে তোমার আকাশে
সে কী খোঁজে বিম্ব, বনানীর শাদা ভোর!
বোধের পাখিরা ওড়ে, পরিযায়ী নয়।
বোধিডানা খুলে সুগোপন পংক্তিমালা
নীলরৌদ্রস্নানে ডোবে নির্মেঘ পুলকে। ১
কবিতাটি রচিত ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারি। সমসাময়িককালে কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। দলে চরম বিসৃঙ্খলা, তার আগে দেশে ঘটে গেছে ২০০২ সালে গুজরাট নরমেধ যজ্ঞ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ঘটনা। এই অস্থির সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবির চেতনাস্তরে আঘাত করেছে নৃশংস নির্মম উত্তুঙ্গ নগ্ন কঠিন চরম বাস্তবতা। তাই স্বাভাবিকভাবেই কবির বোধের রাজ্যে ঝড় ওঠে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রামের নারকীয় ষড়যন্ত্রে গুলি চালানোর মতো নিন্দনীয় ঘটনা কবিকে এবং কবির মানসিক জগৎকে আঘাত করে তাই তিনি বাস্তবতার মধ্যে পরাবাস্তবতার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে আওড়ে ওঠেন—‘বোধের পাখিরা ওড়ে তোমার আকাশে’ আবার রিয়ালিস্টিক কবি ইট বালি পাথর দিয়ে নির্মিত নয়। তিনি রক্তমাংসে গঠিত। তাঁর মজ্জায় রয়েছে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, তাকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না; আবার ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয়তাকেও করেন না কখনো উপেক্ষা। তিনি প্রতীকের সাহায্যে বলেন ‘সে কী খোঁজে বিম্ব’, কবি কামনা বাসনা বর্জিত এক কংক্রিট মানব নয়। তিনি ফ্রয়ডিয় মনস্তত্ত্বের শৃংখলা ভাঙতে পারেন না। তাই তিনি ‘বিম্ব’ অর্থাৎ সাংসারিক জীবনে অমৃত সুধারাশির ভাণ্ড নারী স্তনবৃন্তের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেন না। কবির কল্পনালোকে তোমার আকাশ রয়েছে, রয়েছে ‘বনানীর শাদা ভোর!’—কবির কল্পনালোকে ভাসিত হয় অজস্র চিত্রকল্প। যেগুলি এক একটি স্থির মুহুর্তকে চলমান করে তুলেছে। কবিকেও করে তুলেছে একজন প্রকৃষ্ট জীবনবিজ্ঞানী। তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব মেনে সভ্যতার অগ্রগতির হাত ধরে এগিয়ে চলেছেন। কবির উপলব্ধির জগৎ স্থান থেকে স্থানান্তরিত সচলমান হয়ে উঠেছে।
তাই কবি বলছেন ‘বোধের পাখিরা ওড়ে , পরিযায়ী পাখি নয়।’ তাঁর কবিতায় জীবনানন্দ দাশের, শেলির এবং বিনয় মজুমদারের কিছুটা প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাই তিনি অবশেষে বলে ওঠেন:
বোধিডানা খুলে সুগোপন পংক্তিমালা
নীলরৌদ্রস্নানে ডোবে নির্মেঘ পুলকে। ২
নিষ্ঠাবান কবি সত্যের উপর, বিশ্বাসের উপর অগাধ আস্থা রাখেন। তিনি বাস্তবতাকে স্বীকার করেন, স্বীকার করেন মেরুদণ্ডহীন বুদ্ধিজীবীদের মননশীলতাকে, অপাংক্তেয় সমাজ ও সভ্যতাকে, এবং ভালোবাসার অগাধ অপার মহিমাকে অবশেষে স্বীকার করেন। কবিতার মধ্য দিয়ে কবি তার প্রত্যয়কে দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করে ভালোবাসার আরক্তিম পেলবতাকে উত্তুঙ্গ মনের বাসনাকে অপার্থিব সৌন্দর্য দিয়ে অলংকারের প্রলেপে ঢেকে দেন। কবির কবিতায় Imaginary, Magic Realism, Surrealism- এর মধ্য দিয়ে মনের ভাবকে ব্যক্ত করেন কবিতার পংক্তির উপভাষ্যে। তাই তিনি কবিতায় বলেন:
আশ্চর্য তোমার বোধ, মেধার জানালা—
ভোরের মতন স্বচ্ছ তৃতীয় নয়ন;
আসলে প্রজ্ঞার বিভা ফোটে অমলিন।
অবশ্য প্রণত—
রাখি সেই বিদূষীরে—আলোক অপার ৩
এই অস্থির সময়ে বিবেকবান বুদ্ধিজীবীর বোধশক্তিতে কবি আশ্চর্য হয়ে যান। আবার কবির কল্পনালতা বৃন্তহীন পুষ্পসম; কবিতাসুন্দরীর অপার সৌন্দর্যে কবি মোহিত হয়ে যান। কবি কল্পনাপ্রবণ হলেও তিনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন না; বরং অধিবাস্তব, পরাবাস্তবতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেন এই সময়ের মানুষের বিচ্ছিন্ন হৃদয়ের যন্ত্রণা। নাগরিক সভ্যতায় মানুষ কেবলই একাকীত্বে ভোগে; কবি সেই একাকীত্বকে অতিক্রম করে এক স্বপ্নের জগৎকে আবিষ্কার করেন। তিনি বলে ওঠেন:
ভোরের মতন স্বচ্ছ তৃতীয় নয়ন;
আসলে প্রজ্ঞার বিভা ফোটে অমলিন। ৪
ভাষার দিক থেকে এখানে কবির উপরে বিনয় মজুমদারের কিছুটা প্রভাব দেখা যায়। এটা হতে পারে যে তিনি দীর্ঘদিন ব্যাপী কবি বিনয় মজুমদারের সান্নিধ্য লাভ করেছেন তারজন্য এই প্রভাব আসাটা স্বভাবিক। তিনি বিনয় মজুমদারের প্রকৃষ্ট শিষ্য ছিলেন; বিনয় মজুমদারের জীবৎকাল পর্যন্ত। আবার ‘হৃৎকাতর’ শব্দের দ্যোতনায় অপূর্ব চিত্রকল্প তৈরি করে শব্দের ব্যঞ্জনায় পাঠককে উপহার দেন কতগুলি চলমান দৃশ্য যা অভাবনীয়, অকল্পনীয়।
কবির তিন নম্বর সনেটে ফ্রয়েডিয়তত্ত্ব ভীষণভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। ‘দরোজা কপাট বন্ধ, খুলবে আলগোছে।’ পংক্তিতে নারী বা প্রকৃতির যৌনাঙ্গের কুসুমিত দিকগুলিকে নির্দেশ করে। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুসারে দরোজার বন্ধ কপাট, আলগোছে খোলা, কিংবা সিন্দুক প্রভৃতি সবই নারীর যৌনাঙ্গের প৩তীক। প্রেম পৃথিবীর সৃষ্টি তত্ত্বকে ধরে রেখেছে। প্রেমের মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে সংসার, সমাজ, সভ্যতা বংশগতির সূত্র মেনে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে। তাই নরনারীর যৌন জীবন, প্রেমকে শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক হিসাবে ফ্রয়েড ঘোষণা করেছেন। প্রেমই বংশ বিস্তারের একমাত্র পথ। তাই কবি বলেন ‘তোমার স্পর্শ পেয়ে উড়বে কবুতর। ’ কবুতর শান্তির প্রতীক। তার উড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানবসমাজে শান্তি নেমে আসবে বলে কবির দৃঢ় বিশ্বাস। তাই কবি আগের পংক্তিতে নরনারীর জটিল প্রেমের সম্পর্কের কথা বললেও পরের পংক্তিতে শান্তির বার্তা ঘোষণা করেন।
এরপর কবি ভাবের গহীন প্রদেশে অবগাহন করতে নামেন। তাঁর কবিতা মানে শুধু শব্দের বুনুনি নয়। ভাবের, কল্পনার মানস অভিযাত্রা। সাত্ত্বিক কবি ধ্যানতন্ময়। কবিতার মধ্যে সংবাহিত হয় একই সাথে বাস্তব এবং অনির্দ্দ্যেশ্য আনন্দলোক। এই কারণে কবি অমলেন্দু বিশ্বাসের কবিতা স্বতন্ত্র। বিশেষত তাঁর ‘বিনম্র সনেটগুচ্ছ’ কাব্যের কবিতাগুলির মধ্যে এক বিশেষ জগৎ আবিষ্কার করে পাঠক। এই কাব্যের একটি কবিতায় তিনি বলেন:
উত্তাল ঢেউয়ের নিচে ভয়াল হাঙর
ধরে নাও নেই। নৌকো চড়ে যাবে তুমি!
ভাষার জাঙাল রচি। কাঙাল কবিটি।
মৃদু ভালোবাসা পেতে জানু পেতে রাখি।
অক্ষরবল্কল পেতে জ্যোৎস্না ভিখ্যে করি ৫
জীবনানন্দ দাশ কবিতা প্রসঙ্গে যা বলেছেন সেই কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে ‘কবিতা লিখতে হলে ইমাজিনেশনের দরকার; এর অনুশীলনের। এই ইমাজিনেশন শব্দটির বাংলা কি? কেউ হয়তো বলবেন কল্পনা কিংবা কবিকল্পনা অথবা ভাবনা। আমার মনে হয় ইমাজিনেশন মানে কল্পনাপ্রতিভা বা ভাবপ্রতিভা।’ ৬
কবি অমলেন্দু বিশ্বাসের কবিতায় এই কবিকল্পনা বা ভাবনারাশি প্রতিটি কবিতার চরণে চরণে ছড়িয়ে রয়েছে।
সাত নম্বর সনেটে প্রকাশ পেয়েছে কবির প্রজ্ঞা। কবির বোধ যা পাঠককে ভাবের জগতে টেনে নিয়ে যায়। রোমান্টিক মনের আবেগ—অনুভূতি কাব্যভাষ্যে ব্যক্ত হয়েছে সুন্দরভাবে। কবি তাঁর মনের ভাবরাশিকে সুসংহতভাবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন:
সম্পর্কের যোগসূত্র রয়েছে সঠিক—
বলে আমার ধারণা, জেনেছি অব্যর্থ।
পরস্পরে জানা গেলে, কিংবা ধরো তুমি
রাশি, লগ্ন মিল থাকলে প্রগাঢ় বন্ধুতা
গড়ে ওঠে কবিতায়, থাকে আজীবন।
নিজস্ব প্রত্যয় নিয়ে এক হলে দেখো
ভালোবাসা হর্মরাজি নির্মাণে অটুট
থেকে যায় চিরকাল—কালের প্রবাহে। ৭
তারপরের সনেটে কবির দার্শনিক প্রত্যয় প্রকাশ পায় সুন্দরভাবে। এই কবিতায় কবির মনের ও শরীরের ভাষা প্রাঞ্জলভাবে ব্যক্ত হয়েছে। সেখানে কবি বলেন:
শরীরী সম্বন্ধ ছাড়া সম্পর্ক থাকে না
এরূপ ধারণ আমি পোষণ করি না
হৃদয় ও প্রজ্ঞা দ্যাখো পাশাপাশি শুয়ে
নান্দনিক অভিধায় থকেছে সৃজনে
যেখানে শরীর যেন গৌণ হয়ে যায়
মন ও মনন এক ভিন্নতর মাত্রা,
নিয়ে বিচরণ করে মানুষের বোধে। ৮
এখানে কবি কেবল জৈবিক প্রবৃত্তির তাড়নাকেই গুরুত্ব দেননি, মানবিক গুণাবলীকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষের যৌনচেতনা আছে সত্য কিন্তু তা বলে তাই সব নয়। কবি এই পৃথিবীর মানব সমাজের বাস্তব জীবনের মানবিক দিকগুলিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন, এই কারণেই তাঁর কবিতা এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।
অপর একটি সনেটে কবি অসংখ্য চিত্রকল্প রচনা করেছেন। এবং অপূর্ব সব শব্দমালার ব্যবহারে কবির স্বাতন্ত্র্য, বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে আলোকপাত করেছেন, যা এককথায় অনির্বচনীয় ভাবকে পাঠকের সামনে এনেছেন। কবিতায় কবি বলেছেন:
আদতে আমার কোনো গোপনতা নেই—
অন্তত তোমার কাছে। অকপট খুলে
তুলে রাখি স্বগতোক্তি সমূহ স্বভাবে
যেভাবে কবিতাপ্রাণ হৃদয়ে পুলিনে
শব্দস্রোত ঘুরে এসে ভেতরে আছড়ায়
তোমার ভেতর থেকে অন্য কূল এসে
মরমে রেখেছ হাত; হাসে দূরভাষ!
শুধু মৌন চলাচল থেকে যায় নদে।
গোপন করিনি কিছু। শুধু খোলা পট
নম্র নিচু স্বরতানে; আলো উচ্চারণ
প্রাণিত ভোরের কাছে প্রার্থিত ময়ূখ
বসে তাকে জানু পেতে। অক্ষর দয়িতা
কোন কূলে সুর তোলে অমালিন্য দিনে
বাউল সময় হাতে জ্যোৎস্না ভিক্ষা যাচে। ৯
কবি এখানে তাঁর হৃদয়ের পেলব, সান্দ্র মোহময়ী মৃন্ময়ীভাবকে সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। কবি বাস্তব জীবন থেকে অতিবাস্তব জীবনে নিমেষে পৌঁছে যান কল্পনার যানে চড়ে। তাঁর শব্দচয়ন কবিতাকে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। কবি অকপটে স্বীকার করেন যে তাঁর কোনো গোপনতা নেই কবিতাকল্পনা প্রেয়সীর কাছে, বাস্তবজীবনের ঘাত সংঘাতময় রূঢ়, কঠিন কঠোরতাকে কবি তোয়াক্কা করেন না; তাই ‘কবিতাপ্রাণ হৃদয়ে পুলিনে/ শব্দস্রোত ঘুরে এসে ভেতরে আছড়ায়’। এই কাব্যে কবি অপূর্ব সব চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। যেমন—‘আলো উচ্চারণ/ প্রাণিত ভোরের কাছে প্রার্থিত ময়ূখ/ বসে থাকে জানু পেতে। অক্ষর দয়িতা /কোন কূলে সুর তোলে অমালিন্য দিনে/ বাউল সময় হাতে জ্যোৎস্না ভিক্ষা যাচে।’ এখানে কবি অসাদারণ সকল শব্দমালা তৈরি করে কাব্যিক ভাষ্যে জীবন্ত চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন। কবি নিজেকেই দ্বিখণ্ডিত করে যেন নিজেকেই একটি সত্তা থেকে অপর সত্তার কাছে বক্তব্যকে পেশ করেছেন; এবং সেই বক্তব্য অরিমেয় ভাবকে দ্যুতিত করেছে; যা কিনা কবিতাটিকে আরো মোহময়ী আবহ সৃষ্টি করে তুলতে সাহায্য করেছে। কবিতাটিতে জীবনানন্দ দাশের প্রভাব লক্ষিক হলেও কবি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার আসরে স্থান করে নিয়েছেন, একথা জোর দিয়ে বলা যায়।
কবি অমলেন্দু বিশ্বাস জীবনানন্দ দাশ ও বিনয় মজুমদারের সার্থক উত্তরসূরী। তাঁর কবিতাতেও চিত্ররূপময়তা লক্ষিত হয়। তিনি যখন বলেন:
আরো বেশি কুয়াশায় রেখেছ আবৃত
যেকানে তোমাকে জানা থেকেছে দুর্জ্ঞেয়।
সম্পর্ক প্রত্যয় দৃঢ় থেকে গেলে বলো
সেখানে গোপন রাখা এতটা ভালো না
কিংবা সংগত কারণ আমি তো বলি না। ১০
জীবন অজ্ঞেয়, অজানা; তার গতিপথ যে কোনদিকে চলে যায় তাও আমরা জানি না অথবা বুঝতে পারি না। তাই কবি উচ্চারণ করেন ‘কুয়াশায় রেখেছ আবৃত’। এই জগৎ, এই জীবন রহস্যময় তাকে একমাত্র কবিরাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন এমনই মত পোষণ করেন পাশ্চাত্যের সহিত্য রসিকেরা। সাহিত্য পাঠে আনন্দ; অপার অপার্থিব আনন্দ অনুভূত হয়; আর তা পরিশ্রম বা শ্রমের দ্বারা অর্জন করা যায়। সে কায়িক শ্রমই হোক অথবা মানসিক শ্রম। তাই প্রাচ্যের অন্যতম বিদগ্ধ সাহিত্যিক ও রসজ্ঞ বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালের পুতুল’ গ্রন্থে বলেছেন:
শ্রমই তাঁর আনন্দ, এক হিসেবে সবচেয়ে বড়ো আনন্দ; এবং সে-পরিশ্রমের পুরস্কার ভালোভাবেই পাওয়া যায় ব’লে সেটা আরো বেশি সুখের হয়। পুরস্কার শুধু অর্থ নয়, যশও আছে; সে-যশও উঁচুদরের, যার সঙ্গে ফিল্মস্টার কি রাজমন্ত্রীর দু-চারদিনের নামডাকের কোনো তুলনা হয় না। ১১
বুদ্ধদেব বসুর উক্তিটি কবি অমলেন্দু বিশ্বাসের কবিতা চর্চা প্রসঙ্গে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। কবির কাব্যে এই দর্শন চিন্তা-ভাবনা প্রবহমান অন্তঃশীলার মতো।
জীবনবোধে ঋদ্ধ, বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত কবি কঠিন জ্বরায় আক্রান্ত। এই অস্থির, নির্ঘুম সময়ে দাঁড়িয়ে কবি জীবনবেদের নির্যাসে সম্পৃক্ত হন। আর মানসিক অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর কবি বলতে থাকেন:
ঈষৎ ধ্যানের চেয়ে আরো বেশি গাঢ়—
গাঢ়তর আমাদের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক;
যেভাবে গড়েছি ঠিক কবি ও কবিতা
দুর্মর সংযোগ বহমান চিরসত্য।
জেনেছি আজন্মকাল প্রণয় সুভাষা ১২
অন্তর্ভেদ্য মানসিক চেতনাবোধে কবি যন্ত্রণকাতর হয়ে পড়েন। এবং আমাদের আজকের কৃত্রিম সম্পর্কের কথা প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করেন তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে। কবির সঙ্গে কবিতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই চিরসত্যও কবি জ্ঞাপন করেছেন অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে। তাই কবির ভাষ্যে ব্যক্ত হয় অভিনব ভাষিকতথ্য ‘জেনেছি আজন্মকাল প্রণয় সুভাষা’। সৃজনশীল মানুষেরাই কবি-শিল্পী হয়ে থাকে। থাকে তাদের চেতনে অবচেতনে সৃষ্টির উন্মাদনা। কবি অমলেন্দু বিশ্বাসও তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর সনেটের বুনোটে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার কৃত্রিম শরিকি ভালোবাসা, মেকি সম্পর্কের কথাই প্রকাশ পায়। কবির আশৈশব অর্জিত জীবন অভিজ্ঞতাকে, এবং রূঢ় সমাজের চিত্রকে স্পষ্ট মুকুরে সযত্নে এঁকেছেন অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে। এবং তাঁর কাব্যভাষা, শৈলি ভিন্ন ধরনের, আলাদা ঘরানার। তিনি জীবনসংগ্রামে বিজয়ী রাজপুরুষ। কাব্যরাজ্যে অবগাহন করে তাই তিনি অনায়াসে বলে ওঠেন:
তেমনি বিরহ পর্ব থেকে অবিরত—
পর্বান্তর ঠিকঠাক থেকেছে অবিন্যস্ত।
আসলে বিন্যস্ত রূপ ছাড়া কোনো কিছু
ওঠে না সেভাবে গড়ে যেভাবে তোমাকে
কৃৎকৌশলে রেখে আমি নান্দনিক সত্তা
আরো বেশি অভ্যন্তরে চেয়েছি সাজাতে
যেভাবে সাজায় শিল্পী মাটির প্রতিমা। ১৩
কবির মানসভ্রমণ পার্থিব ও অপার্থিব জগতে, সর্বত্র। সৌন্দর্যচেতনা কবির মানসিক জগতকে আপ্লুত করে। জগৎ ও জীবনকে ভালোবেসে মাটির কাছাকাছি কবি রোমান্টিক হয়ে সুদৃঢ় প্রত্যয়ে উত্তরসূরীর মধ্যে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা, ধ্যান ধারণা সঞ্চারিত করে দিতে চান। তিনি কঠিন কঠোর দুর্বিষহ বাস্তব জীবনকে উপেক্ষা করেন না। বরং তাকে মেনে নেন।
বাংলা সাহিত্যের উষালগ্নে আমরা চর্যাপদ পাই। সেখানে মোট একান্নটি পদ ছিল। তারমধ্যে ছাব্বিশটি পদ কেবলমাত্র শূন্যতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পদকর্তারা রচিত করেছিলেন। অর্থাৎ সাহিত্যবিজ্ঞানের ধারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চাতে জন্মক্ষণ থেকেই ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই প্রবাহধারাটি অক্ষুণ্ণ থাকেনি। সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞান ও গণিতের যে ওতপ্রোত সম্পর্ক তা ধীরে ধীরে ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে। বিজ্ঞান ও গণিতের সাহিত্য তথা কাব্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক। প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতো বিচতক্ষণ দার্শনিক ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্বেরা এই মত মেনে নিয়েছিলেন। বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে বিনয় মজুমদারের কাব্যে এই বিজ্ঞান ও গণিতের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। তিনি একটি স্বতন্ত্র কাব্যই রচনা করেছেন ‘আমি গণিতের শূন্য’- নামে। কিন্তু অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে এ বিষয়ে অনুসরণ বা সচেতন হবার লক্ষণ তেমনভাবে দেখা যায় না। কথাসাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার ‘অঙ্ক ভাবনা’ নামে একটি পত্রিকা চালাতেন। তিনি এই মত পোষণ করতেন যে সাহিত্য রচনা করতে গেলে সুনির্দিষ্ট পরিমিতি ও পরিমাণবোধ থাকতে হবে। সাহিত্য, শিল্পকলা, কাব্য কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সুষমবোধ থাকা অত্যন্ত আবশ্যক। তাই তিনি জানিয়েছেন, যে সাহিত্য সৃষ্টি করতে গেলে যথেষ্ট গাণিতিকবোধ ও বিজ্ঞানচেতনা থাকা দরকার।
বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে কবির কাব্যেও সেই বিজ্ঞান চেতনা, পরিমিতিবোধ ও গাণিতিক প্রজ্ঞা কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। কবির ‘বিনম্র সনেটগুচ্ছ’ নিবিড় পাঠে সেই বৈজ্ঞানিক চেতনা ও গাণিতিক প্রজ্ঞার বিশেষ প্রয়োগ দেখা যায়। কবি অমলেন্দু বিশ্বাসের একটি সনেটে বাস্তব জীবনের বিবৃত সত্য ঘটনার বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞার বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি একটি সনেটে বলেছেন:
সম্ভাব্য ঘটনাসূত্র বোঝো তুমি আগে
কেননা তোমার দেখা তৃতীয় নয়ন
আলোর অধিক তীব্র হয়ে ধেয়ে যায়;
ফলত কবিতাবোধ, বোধের আকাঙ্ক্ষা
এত সুগোপনে থাকে সুতীব্র সংস্রবে
যেখানে তোমার মাত্রা—পরিমিত বোধ
নির্ণীত সরলরেখা ছুঁয়ে থাকে ভোর। ১৪
বিজ্ঞান-সাহিত্যধারার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন কবি অমলেন্দু বিশ্বাস উপরে বর্ণিত কবিতাটিতে। এই সময়ের সামাজিক চেতনাসম্পন্ন দূরদর্শী কবি তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে অনন্য জগতের সৃষ্টিতে পারঙ্গম হয়েছেন। এবং এই সূত্র ধরে দার্শনিক, চিন্তাবিদ, চিত্রকর, শল্যচিকিৎসক বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-র মতামতের সাযুজ্য দেখতে পাওয়া যায় কবির কবিতায়।
লিওনার্দো তাঁর নোট বই-এ লিখেছেন, প্রকৃত বিজ্ঞান মানুষের তথা কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত হয়। যে বিজ্ঞান ও সাহিত্যবিজ্ঞান এই অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত নয় তা অসার ও ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ—
To me it seems that all sciences are vain and full of errors that are not born of experience, mother of all certainty, and that are not tested by experience. That is to say, that do not at their origin, or end, pass through any of the five sense. ১৫
এইভাবে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষের যেসব অভিজ্ঞতা জন্ম নেয়, বুদ্ধি ও মননশীলতার দ্বারা সেইসব অভিজ্ঞতার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের অথবা তাদের ভিতরকার সাধারণ নিয়ম ও নীতি আবিষ্কারের উদ্দেশে তখন চেষ্টা করা যেতে পারে। তারপর বুদ্ধি ও মননশীলতার সাহায্যে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সে ব্যাখ্যা প্রদান করা যায়; প্রকৃত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেই ব্যাখ্যার গাণিতিক প্রয়োগ সম্ভব। ১৬
এই বিষয়টির উপরে লিওনার্দোকে বিশেষ জোর দিতে দেখা যায়। তিনি বলতেন, নির্ভুল গাণিতিক অথবা জ্যামিতিক পদ্ধতিতে যে বিষয়ের ব্যাখ্যা ও আলোচনা সম্ভব নয়, এবং তা কোনোক্রমেই বিজ্ঞানের সাহিত্য বা সাহিত্যবিজ্ঞান বলে পদবাচ্য হতে পারে না।
No human investigation can be called true science without passing through mathematical tests; and if you say that cannot be concended and must be denied for many reasons. ১৭
এছাড়া ইতালির প্রখ্যাত নন্দনতত্ত্ববিদ ক্রোচেও সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানের সঙ্গে ভাষা ও সৌন্দর্যবিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক—সেকথা তিনি অনেক আগেই পরিষ্কার ধারণা নিয়ে সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক মতামত প্রতিস্থাপন করে গেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে তাই আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর কবিতা প্রসঙ্গে ক্রোচের বক্তব্যকে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচনা করে, তাঁর মতকে নিচে ব্যক্ত করা হল। তিনি বলেছেন:
The relation between intuitive knowledge or expression, and intellectual knowledge or concept, between art and science, poetry and prose, cannot be otherwise defined than by saying that it is one of double degree. The first degree is the expression, the second the concept; the first can exist without the second, but the second cannot exist without the first. There exists poetry without prose, but not prose without poetry. Expression, indeed, is the first affirmation of human activity. Poetry is “the maternal language of the human race”. ১৮
তাই উপসংহারে বলতে হয় বিজ্ঞাননির্ভর কবিতাকে বিশেষত কবি প্রবর অমলেন্দু বিশ্বাসের কবিতাগুলি যথার্থ অর্থে মাতৃভাষায় উন্নীত হয়েছে নিজস্ব মহিমায়। সেদিক থেকে এই কবির কাব্য ‘বিনম্র সনেটগুচ্ছ’ একটি সার্থক কাব্যপ্রবাহ যাকে অতিক্রম করা সাধারণ পাঠকের পক্ষে যথেষ্ট দুষ্কর।#
তথ্যসূত্র:
১. অমলেন্দু বিশ্বাস : বিনম্র সনেটগুচ্ছ, নৌকো প্রকাশনী, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ, প্রথম প্রকাশ ২৪ নভেম্বর, ২০০৯; পৃ. ৯
২. তদেব; পৃ. ৯
৩.তদেব; পৃ. ১০
৪. তদেব; পৃ. ১০
৫. তদেব; পৃ. ১৪
৬. জীবনানন্দ দাশ : কবিতার কথা, কবিতা প্রসঙ্গে, সিগনেট প্রেস, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ, ২০১৮ ; পৃ. ৩৯
৭. অমলেন্দু বিশ্বাস : বিনম্র সনেটগুচ্ছ, নৌকো প্রকাশনী, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ, প্রথম প্রকাশ ২৪ নভেম্বর, ২০০৯; পৃ. ১৫
৮. তদেব; পৃ. ১৬
৯. তদেব; পৃ. ৮০
১০. তদেব; পৃ. ৮২
১১. বুদ্ধদেব বসু : কালের পুতুল, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ, তৃতীয় সংস্করণ, মে ১৯৯৭; পৃ. ১
১২. অমলেন্দু বিশ্বাস : বিনম্র সনেটগুচ্ছ, নৌকো প্রকাশনী, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ, প্রথম প্রকাশ ২৪ নভেম্বর, ২০০৯; পৃ. ৮৩
১৩. তদেব; পৃ. ৮৪
১৪. তদেব; পৃ. ৮৫
১৫. Irma A. Richter(Editor): Selections from the Notebooks of Leonardo da Vinci, Oxford, London, 1962; pp. 5-9
১৬. সমরেন্দ্রনাথ সেন : বিজ্ঞানের ইতিহাস, শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ, কোলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ, চতুর্থ মুদ্রণ : আগস্ট ২০০২; পুনর্মুদ্রণ : ডিসেম্বর ২০০৫ ; দ্বিতীয় খণ্ড ; পৃ. ২৯৭
১৭. Irma A. Richter(Editor): Selections from the Notebooks of Leonardo da Vinci, Oxford, London, 1962; pp. 5-9
১৮. Benedetto Croce: Aesthetic as science of Expression and General Linguistic, The Echo Library, USA, 2007; pp.33