বিবর্তনের পথে ভাষা

ভাষা হল সংকেতময় চিহ্ন৷ আর তার সঙ্গে গণিতের নিবিড় সম্পর্ক৷ বাংলাভাষার উৎসের কাল থেকেই গণিতের সম্পর্ক বিরাজমান৷ এবং বাংলাভাষার সঙ্গে লোকগণিতেরও অতি নিকট সম্পর্ক৷ এ বিষয়ে দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের ঐক্যমত লক্ষ করা যায়৷ লোকগণিতের আলোচনা প্রসঙ্গে প্লেটোর বিশেষ মনোভাবের কথা স্মরণে রাখতে হয় প্লেটো গাণিতিক নিয়ম ও জ্যামিতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন৷ তিনি আরো বলতেন, বস্তু নয়, বস্তুর শাশ্বত সত্তা যা অবয়বহীন৷ অপরিবর্তনীয় ও অবাঙ্‌মানসগোচর তাকে জানাই হল প্লেটোর দর্শনের মূলতত্ত্ব৷ তিনি আরো জানিয়েছেন যে যদি লোকসমাজকে গুরুত্ব দিতে হয় তবে সেই লোকসমাজকে হতে হবে আদর্শ লোকসমাজ তবেই সমাজ ও রাষ্ট্র সুষ্ঠভাবে পরিচালিত করা সম্ভব৷ তিনি তাই রাষ্ট্র যন্ত্রের ক্ষমতা যাদের হাতে থাকবে অর্থাৎ শাসকদের ‘জ্ঞানীশাসক’ হওয়ার কথা বলেছেন৷ আর লোকসমাজেকেও জ্ঞানী হতে বলেছেন বা আদর্শবাদী হতে বলেছেন৷ যদি দাস হয়, তারা হবে আদর্শ দাস, যদি নাপিত হয় তারা হবে আদর্শ নাপিত, যদি ছুতোর হয় তারা হবে আদর্শ ছুতোর, যদি রাজমিস্ত্রি হয় তারা যেন হয় আদর্শ রাজমিস্ত্রি৷ তিনি ছিলেন সক্রেটিসের একনিষ্ঠ শিষ্য৷ সক্রেটিসের মৃত্যুকে তিনি ভালোভাবে মেনে নেননি৷ তিনি মনে করেন যদি আদর্শ জ্ঞানী শাসক হত তাহলে তারা সক্রেটিসকে প্রাণদণ্ড দিতেন না৷

ভাষার সঙ্গে গণিতের নিবিড় সম্পর্ক আদিম সভ্যতার একেবারে গোড়া থেকে৷ আদিমস্তরের মানুষ সংকেতময় ভাষাতে মনের ভাব প্রকাশ করত৷ তারা চিহ্ণ বা সংকেতের সাহায্যে একে অন্যের কাছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনাকে বর্ণনা করে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল৷ গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ বিপদে, আনন্দে, উল্লাসে মুখ দিয়ে বিচিত্র ধবনির সাহায্যে অন্যান্য সকল মানুষকে মনের ভাবকে বোঝাত৷ মানুষ অসংখ্য শব্দমালা জুড়ে বাক্য গঠন করার রীতি উদ্ভাবন করল৷ তারা ধীরে ধীরে সেই শব্দচয়নেও সৌন্দর্য, মাধুর্য আনার জন্য পরিমাণবোধকে প্রয়োগ করল৷ সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ ভাষাকে উন্নত ও মার্জিত রূপ দিতে লাগল৷ ভাষা নিয়ে এরপর চর্চা শুরু হল৷ শুরু হ’ল ভাষাকেন্দ্রিক বিজ্ঞান নির্ভর পড়াশোনা, ভাষা যেsymbolic তা কবিতা, সাহিত্য কাব্যিক শিল্প হিসাবেstylistics-এ হয়ে, সে যে গণিতের একটি দ্বিতীয় রূপ তা প্রমাণ করে৷ নোয়াম চমস্কি, সপির, মেলিনেস্কি লেভিস্ট্রাস, লেভব প্রভৃতি ভাষা বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে নানা মতামত ব্যক্ত করেছেন৷

বাংলা ভাষায় পাঁচটি উপভাষা৷ উপভাষাগুলি আঞ্চলিকভাষা, সামাজিক ভাষা, নিভাষা কেন্দ্রিক হয়ে থাকে৷ আবার Subaltern Community এবং লোকসমাজ যে ভাষাতে কথা বলে তাদের ভাষাকে লোকভাষা বলে৷ লোকভাষার সঙ্গে লোকগণিতের সম্পর্ক রয়েছে৷ নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে, বসবাসকারী বংশ পরম্পরায় কোনো জনজাতি বা কৌমসমাজ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে যারা কিনা বসবাস করে তারা যে ভাষাতে বা ভাষা ছাঁদে কথা বলে, সেই ভাষাই হয়ে ওঠে লোকভাষা৷ এই পর্বে ভাষার সঙ্গে লোকগণিতের সম্পর্ক উদাহরণ সহকারে আলোচনা করা হবে৷ লোকসমাজের অন্তর্ভুক্ত মানুষজন তারা মনের ভাবকে প্রকাশ করার সময় যে কাব্যময় ভাষা ব্যবহার করে তাতে অসংখ্য গাণিতিক চেতনার কথা প্রকাশ পায়৷ এবং তাদের কথাতেও প্রকাশ পায় মাত্রাবোধের পরিচয়৷
উপভাষা ভাষার সমীপে বা কাছাকাছি অবস্থান করে৷ ভাষা হল বিমূর্ত ব্যবস্থা৷ সমাজে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা৷ ভাষার ব্যবহৃত রূপ হল উপভাষা৷ এটা ভাষার থেকে কোনো অংশে বড়ো বা ছোটো নয়৷ ফল, মাছ কথাগুলি বিমূর্ত৷ কিন্তু আম, জাম, কলা বললে তবেই ফলের মূর্ত রূপ ধরা পড়ে৷ আবার মাগুর, শোল ইত্যাদিও মাছের নির্দিষ্ট মূর্তরূপ৷ লোকজীবনের সংশ্রব থাকলে তবেই তাদের ভাষাকে লোকভাষা বলা হবে৷

লোকভাষা থেকেই লোকসাহিত্য সৃষ্টি৷ আর লোকসাহিত্যকে ভিত্তি করে বিশ্বসাহিত্য সৃষ্টি হয়ে চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে৷ এখানে লোকমুখের লোকভাষা যে লোকসংগীতের রূপ নেয়— সেই সংগীতের চরণ নিয়ে তার মধ্যে সংখ্যা কীভাবে এসেছে তা দেখানো হল—তিন পাগলের হল দেখা নদে এসে। এখানে নদিয়া জেলাতে তিনজন পাগলের মিলনের কথা বলা হয়েছে৷ নদিয়া একসময়ে ছিল জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান৷ এখানে যেমন এসেছে বহু জ্ঞানীগুণী তেমনি এসে বহু ধার্মিক৷ তিনজন যে পাগলের আসার কথা এখানে বলা হয়েছে তারা হলেন চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈতাচার্য৷ এরা সকলেই ধর্ম, দর্শন, অলঙ্কার ও কাব্যজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ৷ তাই গানের অন্যত্র বলা হয়েছে—

চৈতে, নিমে অদৈই নাম ধরে সে …

আবার লোকসমাজে বিশেষত রাঢ়বঙ্গে একটি ছড়া বিশেষভাবে প্রচলিত তাতে গণিতের মাত্রাবোধ প্রকাশ পেয়েছে৷ এই ছড়াটি অবশ্য শুভঙ্করী আর্যা হিসাবে পরিচিত—

কুর্বা কুর্বা কুর্বা লিয্যে
কাঠায় কুর্বা কাঠায় লিয্যে
কাঠায় কাঠায় ধুল পরিমাণ
বিশ গণ্ডায় হয় কাঠার পরিমাণ
গণ্ডা বাকি থাকে যদি কাঠা নিলে পর
ষোল দিয়ে পুরে তারে সারা গণ্ডা ধার৷

এই লৌকিক ছড়াটার আবির্ভাব সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দী আসাম ও বাংলার বহুস্থানে ছড়াটি প্রচলিত৷ ছড়াটি জমির হিসাব কেন্দ্রিক তা বোঝা যায় এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য—
“Ethno cultural studies of mathematics is one term used to described the study of informed mathematics-historically the predominant form of mathematics at most times and in most cultures. Another term used is folk mathematics, which is ambiguous’ the folkmathematics articles is dedicated to another usage.”

“Mathematics, Folk body of traditional MATHEMATICS, originally transmitted orally. Folkmathematics may be regarded as an undercurrent to the main stream of mathematics; it nourishes the mainstream, and at the same time, is natured by it. Being extremely practical in nature it serves the daily need of the people of every walks of life. Common people with elementary education various problems arising out of everyday life, seek recreation in it, and are encouraged to devise new problems or puzzles orally, whether those are significant or trifling.

That several problems on folkmathematics had been current in ancient India is evident from traces that can still be found in the Bakhshali manuscript (300 AD), the Patana manuscript (775 AD), Mahavira’s Ganita Sara-Sanggraha (850 AD) and in other works of mathematics, a sort of mathematics contained in the Shubhankar were most probably cultivated by the Bangali since 300 BC. Shubhankar literally means a book on arithmetic, which can benefit mass education. It is uncertain whether the arithmatical system was introduced by Shubhankar during the reign of the Mallas in the first half of the 17th century. But there was certainly a mathematician, Shubhankar by name, in medieval Bengal, who had written several rules (aryas) pertaining to mathematics in the form of folk rhymas. The language in which the rules were composed is mainly the Bengali prevalent in medieval Bengal with lots of words taken from Prakit, Apabhrangsha, Abahalta and from Austro-Asiatic languages. There were many arya authors in Bengal and Assam in medieval time whose names were mentioned at the end of several aryas.”

ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক৷ তাই ভাষা ও সংস্কৃতির বৈশিট্যের মধ্য দিয়ে জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে৷ জাতি, সমাজ এবং দেশেরও পরিচয় হয়ে ওঠে ভাষা ও সংস্কৃতি৷ এশিয়া মহাদেশের সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিয়ে ভাষা আলোচনার ক্ষেত্রে ৬টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়ে থাকে৷ এশিয়ার এই ছয়টি বিভাজিত অঞ্চল হ’ল— (১) উত্তর-এশিয়া অঞ্চল, (২) মধ্য-এশিয়া অঞ্চল, (৩) দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল, (৪) দক্ষিণ-এশিয়া (ভারতীয় মহাদেশ) অঞ্চল, (৫) পূর্ব-এশিয়া, (৬) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল৷ এইসব অঞ্চলের মধ্যে চিনা-তিববতি ভাষা সমূহ (Sino-Tibetan Language Family) এশিয়ার পূর্ব অঞ্চলে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এবং এশিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত (Comric. 1990:970) গোটা পৃথিবীতে আটের দশকে জনসংখ্যা ছিল চারশ কোটি (Crystal. 1987:287) এই বৃহৎ জনসমটির বেশিরভাগ মানুষই কথা বলত ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের বিভিন্ন ভাষাতে৷ এই সময়ে পৃথিবীতে ভাষার ইতিহাসে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার দাপট বেশি৷ কর্ম জগতে, সাহিত্য, সংস্কৃতি সহ সমাজ বিজ্ঞানের সর্বস্তর ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ এদিক থেকে চিনা-তিববতি ভাষাতে যারা কথা বলে, তাদের সংখ্যা কম হলেও তুচ্ছ করার মতো নয়৷ জনসংখ্যার নিরিখে একটা বৃহৎ অংশের মানুষ কিন্তু এই চিনা-তিববতি ভাষাতে কথা বলে, এবং তাদের কাজ করে৷ কাজের ভাষা হিসাবেও এই ভাষা আটের দশকে যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে৷ ভাষিক সেন্সাসে আটের দশকে জানা যায় যে একশ চল্লিশ কোটি মানুষ এই চিনা-তিববতি ভাষা পরিবারের নানা শাখাভাষাতে কথা বলে৷ এই পরিসংখ্যানই জানায় যে ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাতে কথা বলা মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকে— চিনা-তিববতি ভাষাসমূহতে কথা বলা মানুষ৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে গড়ে এই পৃথিবীর তিনজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ চিনা-তিববতি পরিবারের ভাষাতে কথা বলে৷ কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা, সাহিত্য নিয়ে যত গবেষণা ও আলোচনা হয়েছে চিনা-তিববতি ভাষা, সাহিত্য নিয়ে ততটা আলোচিত হয়নি৷ এমনকি এদের সমাজ, সংস্কৃতিও থেকে গেছে উপেক্ষিত, অবহেলিত৷

কোনো ভাষা বড়ো নয়, কোনো ভাষা ছোটো নয়, একথা সত্য বলে প্রমাণিত ও স্বীকৃত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে পণ্ডিত মহলে৷ কিন্তু আজও অনেক শিক্ষিত মানুষও তিববতি ভাষা, চিনা ভাষা, লুশাই ভাষা সহ বিভিন্ন অঞ্চলিক ভাষা পড়া বা সেই ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করার কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে! ভাষা পাঠ ও আঞ্চলিক ভাষাকে গবেষণার বিষয় করলে তারা সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করে৷ তাদের গতানুগতিক ভাবনা চিন্তা আটকে যায় ইংরেজি বা অন্যান্য কোনো ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষার কাছে৷ তাই তারা গভীরভাবে উপদেশ দান করেন, ‘ইংরেজিটা মন দিয়ে শেখো!’

যাক কোনো ভাষার নিন্দা না করেই বলছি, ইংরেজি-সহ একাধিক ভাষা আজকের বাস্তবমুখী জগতে জানা দরকার তবে সেক্ষেত্রে কোনো মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা দেখানোর প্রয়োজন হয় না৷ সেদিক থেকে চিনা-তিববতি ভাষা পাঠ ও গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে৷ চিনা-তিববতি ভাষা বিষয়ক প্রথম আলোচনা ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়৷ ১৯২০ সালে আমেরিকান বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক এডুয়ার্ড স্যাপির (Edward Sapir) চিনা-তিববতি ভাষার সঙ্গে উত্তর-আমেরিকার না-দেে (Na-Dene) ভাষাগুলির এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলেন (Sapir. 1984:40)৷ তিনি জানান যে তিববতি ও লিনগি (Tlingit) ভাষাতে শব্দ ও রূপতত্ত্বগত সাদৃশ্য বর্তমান৷ পরে অবশ্য স্যাপিরের সেই মতবাদ সকলে মেনে নেননি৷ এবং দীর্ঘকাল পর, ভাষাতত্ত্বের বিজ্ঞান নির্ভর গবেষণা ও পঠন-পাঠন ব্যবস্থা ভাষাপাঠে পরিবর্তন আসে৷ এই শতাব্দীর আটের দশকের মাঝামাঝি (১৯৮৪) রুশ ভাষাতাত্ত্বিক স্তারোস্তিন চিনা-তিববতি ভাষাগুলিকে ইয়েনেশীয (Yenisean) ও উত্তর ককেশীয় ভাষাগুলির সঙ্গে সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করেন (Starostin; 1984)৷ এবং আশ্চর্যের বিষয় চ্যাং-এর এই ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রে নিহিত ছিল চিনা-তিববতি ভাষাগুলির সঙ্গে ইয়োরোপীয় ভাষার সাদৃশ্য৷ ফরাসি দেশেও এই সময়ে ভাষাতত্ত্বের বিজ্ঞাননির্ভর আলোচনাক্ষেত্র বিশিষ্টতা পেয়েছে৷ সেখানকার ভাষাতাত্ত্বিক সাগা (Sagart) ও চিনা-তিববতি ভাষা সমূহের সঙ্গে ইয়োরোপীয় ভাষার সাদৃশ্যের কথা মেনে নেন৷ এবং তিনিও এই বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক রচনা প্রকাশ করেন৷

ভাষার সাথে সাথে ভাষার আলোচনাও নিত্য নতুন ভাবে উপস্থিত হয়৷ বহুবিতর্ক নতুন করে যেমন জন্ম নেয়, তেমনি অবসান হয় দীর্ঘদিনের জমে থাকা ভাষা বিষয়ক সমস্যার৷ তবুও একথা বলতে কোনো বাঁধা নেই যে নয়-এর দশকের আগে পর্যন্ত কোনো সুদৃঢ় ভিত্তি বা প্রতিষ্ঠিত সত্য স্বীকৃত হয়নি৷ স্বভাবতই এই ভাষা নিয়ে মানুষের মনে থেকে গেছে অজস্র কৌতূহল, সংশয়৷ বর্তমান প্রজন্মের উদ্যমী ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক-গবেষিকাদের সেই সংশয়াবসানের প্রচেষ্টায় মেতে ওঠাতে পৃথিবীর ভাষাচর্চার আলোচনাক্ষেত্র সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে৷ এবং যথার্থ তথ্যানুসন্ধান ও উপাদান সংগ্রহের মধ্য দিয়ে গবেষণাকর্মে তাদের মনের ইতিবাচক দিকটিই ভাসিত হচ্ছে৷

বলা ভালো যে, চিনা(Sinitic) ও তিববতি-বর্মি(tibeto-Burman) ভাষাবর্গ নিয়ে চিনা-তিববতি ভাষা পরিবার গঠিত৷ এখানে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিনা-তিববতি ভাষা পরিবারের ভাষাগুলির সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস করা হল৷ একটি অঞ্চলে একাধিক ভাষা ও উপভাষা ছড়িয়ে থাকে এমন কি দূরত্ব পার্থক্যে ভাষা হয় স্বতন্ত্র৷ এই স্বাতন্ত্র্য আসে ভাষার শব্দ উচ্চারণে, বাকভঙ্গিমাতে ও ভাষাতে ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যগঠনে৷ এবং ভাষার এই সামগ্রিক পরিবর্তনের বৈচিত্র্য প্রকাশ হয় বৈজ্ঞানিক সূত্র মেনে৷ Arbutrary System নিয়ন্ত্রণ করে, ভাষার গঠন কেমন হবে? ভাষা কীভাবে বিবর্তিত হবে? এসবই বিজ্ঞান ভিত্তিক সূত্র মেনে সাধিত হয়ে থাকে৷ তাই সমস্ত ভাষার ইতিহাসেই ভাষাকে গতিশীল প্রাণপ্রবাহের মত বিবর্তিত অবস্থাতে পাওয়া যায়৷ যে ভাষা বিবর্তিত হয় না, সে ভাষা মরে যায়, সে ভাষা ধবংস হয়৷ এই চিনাবর্গের বিবর্তিত ভাষার মধ্যে চিনা একটি উল্লেখযোগ্য ভাষা তারই আলোচনা প্রথমে করা হল৷

চিনা বর্গের প্রধান ভাষা চিনা৷ চিনা ভাষার অন্তঃগঠনে ও উচ্চারণ বৈচিত্র্যে এই ভাষা স্বাতন্ত্রতা দাবি করে৷ এই ভাষা পরিবারের অন্তর্গত সমস্ত ভাষার মধ্যে চিনা ভাষাতেই বেশি মানুষ কথা বলে৷ চিনাভাষাতে কথা বলে এমন মানুষ তার স্বজাতীয় ভাষা উচ্চারণকারীর অনেক কথাই বুঝতে পারে না, ভাষা বৈচিত্র্য অত্যধিক হবার জন্য, বা ভাষার মধ্যে উপভাষা প্রাধান্য পাওয়াতে৷ এই ভাষাতে এমন অনেক শব্দ কথা উচ্চারণ আছে যা ওই ভাষাতে কথা বললেও সে বুঝতে পারে না, যদি না সে আঞ্চলিক শব্দমালা, বাক্‌রীতির সঙ্গে পরিচিত হয়৷ উপভাষাও ভাষার মতো বৌচিত্র্যময়৷ অভিন্ন ভাষা, অথচ বাক্‌রীতিও ব্যবহারের ভিন্নতা, সমভাষী মানুষের কাছেও এই ভাষার শব্দ, ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে৷ চিনা ভাষার এমন সব কারণে পিছনে ঐতিহাসিক ভৌগোলিক তাৎপর্য রয়েছে৷ খ্রিস্টপূর্ব একহাজার অব্দের আগেই এই ভাষা মূল বা প্রত্নভাষা থেকে আলাদা হয়ে গেছে৷ তাছাড়া চিনা ভাষার নামকরণের পিছনেও রয়েছে ঐতিহাসিক কারণ৷ চিনা(Sintic) ও সিনো(Sino) শব্দদুটির জন্ম হয়েছে কিন(Qin) সম্রাটদের শাসনকালে (Wang. 1994; 3952), খ্রিস্টপূর্ব ২২১-২৭০ অব্দে৷ চিনা ভাষা জন্ম নেবার অনেক পর চিনা লিপির সৃষ্টি হয়৷ চিনা লেখ্য ভাষা হান (Han) রাজবংশের সময়ে সৃষ্টি৷ সেই সময়ে হান্‌জি(Hanzi) ছিল তাদের লিখিত ভাষার নাম৷ আর সাধারণ মানুষের মুখে মুখে কথ্য প্রচলিত ভাষা ছিল হানয়উ (Hanyu)৷ এবং এটা নজর করার মতো যে চিনাদের ভাষার উৎসকালে যে দুটি প্রচলিত ভাষা ছিল (কথ্য, লিখিত) তার দুটির সঙ্গেই হান রাজাদের অনুষঙ্গ মিশে ছিল৷ এবং সেই ঐতিহ্যই রক্ষিত হয়েছে এই ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসেও৷

ভূ-খণ্ডের বিচ্ছিন্নতা ভাষার ভিন্নতাকে বেশি প্রকট করে তোলে৷ তাই অঞ্চলভেদে ভাষার রূপবৈচিত্র্যময়তা সৃষ্টি হয়৷ মানুষে মানুষের ভাষা ব্যবহারের পার্থক্য সূচিত হয় শব্দ, বাক্‌বিন্যাস অনুযায়ী নিভাষা বা বিভাষা আলাদা রকমের উপভাষা সৃষ্টিতে সহায়তা করে৷ এই কারণেই চিনা ভাষাতেও রয়েছে অজস্র উপভাষা বিভাগ৷ আঞ্চলিক রূপও তার মধ্যে সুরক্ষিত হয়েছে তাছাড়া ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতাকে অনুসরণ করে চিনা ভাষার উপভাষা দুটি প্রান্তীয় রেখা, বা সীমারেখা বা উপশাখায় বিভক্ত হয়েছে৷ এবং সেই সীমারেখা কেন্দ্রিক উপভাষার মধ্যে একটি পরিচিত হয়েছে উত্তর অঞ্চলের উপভাষা নামে, অপরটি পরিচিত হয়েছে দক্ষিণ অঞ্চলের উপভাষা নাম নিয়ে৷ ব্যাকরণের নিয়মনীতি, শব্দভাণ্ডারের দিক থেকে এই দুটি উপভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে তেমন কোনো ফারাক নেই৷ পার্থক্য আছে কেবল তাদের ধবনিগত উচ্চারণে৷

মান্দারিন হল বেজিং অঞ্চলের উপভাষা৷ এবং এইভাষা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশি প্রচলিত৷ এমন কি পশ্চিমি দেশেও মান্দারিন ভাষার প্রচলন আছে৷ চিন দেশের জাতীয় ভাষা হিসাবেও এই মান্দারিন স্বীকৃতি পেয়েছে৷ ১৯৫৫ সালে ‘চিনা-লেখ্য-ভাষা সংস্কার সম্মেলন’(Conference on Reform of the Chinese Written Language) হয়৷ সেই সম্মেলনে চিনের জাতীয় ভাষা হিসাবে মান্দারিন স্বীকৃতি পায়৷ চিন দেশে বসবাসকারী ৭৪ কোটি মানুষ মান্দারিন ভাষাতে কথা বলে৷ জনসংখ্যার এক বৃহৎ সমষ্টি এই ভাষাতে কথা বলে থাকে, সেজন্যই এই ভাষা জাতীয় ভাষা ও বাণিজ্যিক ভাষা হিসাবে গৃহীত হয়৷ তাই চিন দেশের মান্যভাষা(Standard) বললে সাধারণ এই ভাষাকেই বুঝিয়ে থাকে৷ চিনারা অবশ্য এ ভাষাকে ফুতোংহুয়া(Putoughua) বা সাধারণের ভাষা বলে থাকে৷ মান্দারিন ভাষার মধ্যেও চারটি অঞ্চলভেদ বা স্বতন্ত্রতা লক্ষিত হয়৷ এই চতুবর্গীয় মান্দারিন উপভাষা যথাক্রমে—

১৷ উত্তরাঞ্চলীয় মান্দারিন৷
২৷ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মান্দারিন৷
৩৷ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মান্দারিন৷
৪৷ পূর্বাঞ্চলীয় মান্দারিন৷

উত্তরাঞ্চলীয় মান্দারিন প্রাক্তন মাঞ্চুরিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চল, মঙ্গোলিয়া এবং চিনের হেবেই, হেনান, শানদং ও আনহুই অঞ্চলে প্রচলিত৷ উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় মান্দারিন চিনের শানশি, গানসু, কিংঘাই, নিংজিয়া এবং মাঙ্গোলিয়ার কিছু অঞ্চলে এই উপভাষা মানুষ ব্যবহার করে৷ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মান্দারিন সিচুয়ান, য়ুন্‌নান চুইজো(Guizhou), হুপেই ও উত্তর-পশ্চিম হুনান এলাকায় এই উপভাষাটি প্রচলিত৷ পূর্বাঞ্চলীয় মান্দারিন উপভাষা যে সকল অঞ্চলে ব্যবহার হয়ে থাকে তা হ’ল চিনের ইয়াংচি নদীর উত্তর অববাহিকা, মধ্য আংগুই, জিয়ানসু ও নানাচিং প্রদেশ ইত্যাদি৷

ড (Wu) একটি চিনাবর্গীয় উপভাষা৷ এই উপভাষা ব্যবহার করে অল্প সংখ্যক মানুষ৷ সংখ্যার দিক থেকে ৭ কোটি ৭১ লক্ষ ৭৫ হাজার জন উ উপভাষাতে কথা বলে (১৯৯০ সালের চিন দেশের লোকগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী)৷ ‘উ’ উপভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে প্রাধান্য দিয়ে এই উপভাষাকে দুটি আঞ্চলিক বৈচিত্র্যে বিভক্ত করা হয়েছে৷ তার মধ্যে একটি হল উত্তরাঞ্চলীয় উ উপভাষা যা কিনা ইয়াংচি নদীর দক্ষিণ অববাহিকা ও জিয়াংসু অঞ্চলে প্রচলিত৷ এই উপভাষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হ’ল যে ‘উ’ শব্দের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে৷ দক্ষিণাঞ্চলীয় উ রয়েছে অপর উপভাষাবর্গে৷ বেজিয়াং অঞ্চলে ‘উ’-এর দক্ষিণাঞ্চলীয় উপভাষাটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়৷ দক্ষিণাঞ্চলীয় উপভাষাতে ‘উ’ শব্দের ব্যবহার কম৷ তবে প্রতিবেশী মান্দারিন উপভাষার শব্দগুলি বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷

শিয়াং (Xiang) উপভাষা একটি সমৃদ্ধশালী চিন দেশীয় উপভাষা৷ হুনান অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজন শিয়াং উপভাষাতে কথা বলে৷ শিয়াং উপভাষাতে যারা কথা বলে থাকে তাদের সংখ্যা ৩ কোটি ৬ লক্ষ ১৫ হাজার৷ এবং এই উপভাষার শব্দভাণ্ডারও যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী৷

ইড (Yue) চিনা বর্গের অপর একটি উপভাষা৷ এই উপভাষাগুলিকে ক্যান্টনি উপভাষাও বলা হয়ে থাকে৷ চিনের বাইরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, এমনকি মহাদেশের বাইরেও ইউ উপভাষা ছড়িয়ে পরেছে৷ চিন দেশে ইউ উপভাষাতে কথা বলে ৪ কোটি ৬৩ লক্ষ ৫ হাজার জন৷ হংকং-এ এই উপভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ২৯ লক্ষ ২ হাজার জন৷ মালয়েশিয়াতে ৭৪ লক্ষ ৮ হাজার ১০ জন৷ আবার ভিয়েতনামে ৫০ লক্ষ মানুষ এই উপভাষাতে কথা বলে৷ ম্যাকাউতে ৪ লক্ষ ৯৮ হাজার৷ সিঙ্গাপুরে সেই সংখ্যা ৩১ লক্ষ ৪ হাজার৷ ইন্দোনেশিয়াতে ইউ উপভাষাতে কথা বলে ১ লক্ষ ৮০ হাজার জন মানুষ৷ থাইল্যাণ্ডে ২৯ হাজার ৪ শত জন এই ভাষা ব্যবহার করে৷ ফিলিপিন্সে ৬ হাজার মানুষ ইউ উপভাষাতে কথা বলে৷

হাক্কা (Hakka) চিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপভাষা৷ চিন দেশের মানুষের মধ্যে এই উপভাষাতে ২৭ কোটি ৩৬ লক্ষ ৫ হাজার মানুষ ব্যবহার করে৷

গান (Gan) অপর একটি উপভাষা৷ এই ভাষা ব্যবহার করে মূলত চিনের চিয়াংশি ও হুপেই প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষজন৷ গান উপভাষা ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ২ কোটি ৫ লক্ষ ৮০ হাজার৷

মিন (Min) একটি চিন বর্গীয় উপভাষা৷ এটি একটি পশ্চিমাঞ্চলীয় বা ফুচিয়েনের পশ্চিমাংশের জিয়ানইয়ান অঞ্চলের প্রচলিত উপভাষা৷ এই ভাষাতে কথা বলে প্রায় ১ কোটি ২ লক্ষ ৯০ হাজার মানুষ৷ এই উপভাষার দ্বিতীয় বিভাগে পূর্বাঞ্চলীয় উপভাষা বর্তমান৷ এদের আবার দুটি আঞ্চলিক রূপ বর্তমান৷ তা হলণ্ঠ (১) উত্তরাঞ্চলীয়, (২) দক্ষিণাঞ্চলীয়৷

মিন উপভাষা দ্বিখণ্ডিত রূপে অবস্থান করে আছে৷ তারমধ্যে উত্তরাঞ্চলীয়ের আঞ্চলিক বিভাগে আছে ফুজহোউ উপভাষা৷ এই উপভাষাতে বৃহত্তর চিনের ১০ কোটি মানুষ কথা বলে৷ এবং এই উপভাষাকেই মাতার মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে৷

অপরপ্রান্তে দক্ষিণাঞ্চলীয় উপভাষা৷ এই আঞ্চলিক বিভাজনের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য দুটি উপভাষা৷ হোক্‌কীয়(Hokkean) ও অময (Amoy) তাদের নাম৷ দক্ষিণাঞ্চলীয় মিন উপভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি ৩০ লক্ষ ৫ হাজার জন৷ চিন দেশ ছাড়াও অন্যান্য যে সমস্ত দেশে এই উপভাষা বর্তমান তা হ’ল মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যাণ্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনস্‌৷

এখানে অঞ্চলভেদে চিন বর্গের উপভাষার পরিচয় প্রসঙ্গে সেই সকল উপভাষা ব্যবহারকারী মানুষের বসবাসের ভৌগোলিক পরিচয় দেওয়া হল৷ ক্যান্টনি উপভাষাতে চিন দেশের গুয়ানডং প্রদেশের মানুষ কথা বলে৷ আবার হাক্‌কা একটি জনপ্রিয় উপভাষা৷ এই উপভাষাতে গুয়ানজি প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও ম্যাকাও অঞ্চলের মানুষ কথা বলে থাকে৷ হুনান প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলগুলিতে হুনান উপভাষা মৌখিক ভাষা হিসাবে পরিচিত৷ কান হ’ল শানসি ও হুপেই প্রদেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা৷ মান্দারিন সাধারণভাবে চিনের উত্তারাংশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত৷ তবে মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলেও এই উপভাষাতে মানুষ কথা বলে থাকে৷ মিন ফুচিয়ান প্রদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষা৷ ঝোজিয়াং ও ফুচিয়ান প্রদেশ, হাইনান দ্বীপ ও থাইওয়ান অঞ্চলের মানুষ মিন উপভাষাতে কথা বলে৷ ওয়াই আনহুই অঞ্চলের মানুষের ভাষা৷ এই উপভাষা ঝোজিয়াং ও জিয়াংসু অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে৷ ‘উ’ জিয়াংসু, ঝেজিয়াং প্রদেশের মানুষের মৌখিক ভাষা৷

কুয়াংতং প্রদেশের ফুুচিয়েন অংশ, থাইওয়ান ও হাইনান প্রদেশের উত্তর উপকূলে মিন(Min) উপভাষা ব্যবহৃত হয়৷ এগুলির দুটি আঞ্চলিক উপবিভাগ রয়েছে৷ প্রথমত, পশ্চিমাঞ্চলীয় বা ফুচিয়েনের পশ্চিমাংশের মানুষ জিয়ানইয়ান অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষা ব্যবহার করে৷ প্রায় ১ কোটি ২ লক্ষ ৯০ হাজার মানুষ এ উপভাষাতে কথা বলে৷ দ্বিতীয়ত, পূর্বাঞ্চলীয় উপভাষা৷ এগুলির আবার বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈচিত্র্য রয়েছে৷ যেমন, উত্তর অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ফুজহোউ উপভাষা বর্তমান৷ এই উপভাষাকে চিনের প্রায় দশ কোটি মানুষ তাঁরা তাদের মাতৃভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছে৷

হোক্‌কীয়(Hokkean) অপর একটি উপভাষা এবং আরো একটি উপভাষা হল অময় যা মূলত দক্ষিণ অঞ্চলে প্রচলিত৷ এই দুটি উপভাষা মিন উপভাষারই দেহ থেকে বহির্ভূত ও এ ভাষাদুটি ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি ৩০ লক্ষ ৫ হাজার৷ চিন ছাড়া এই উপভাষাতে যে সব অঞ্চলের মানুষ কথা বলে তা হল মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যাণ্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনস প্রভৃতি দেশ৷

তিববতি বর্মি বর্গের ভাষা ৭টি ভাষায় বিভক্ত, সেগুলি হল (১) কামরুপি, (২) হিমালয়ী, (৩) কিয়ানজিক, (৪) কাচিন, (৫) লেলোবর্মি, (৬) বায়িক ও (৭) কারেনিক৷ কামরুপি ভাষা আবার চারটি উপশাখাতে বিভাজিত— ক) কুকি- চিন-নাগা, খ) আবোর-মিরি-দফলা, গ) বরো, ঘ) বোডো-গারো৷ কিকি-চিন-নাগা ভাষাগুলি ভারতবর্ষের আসাম সীমান্তে, মায়ানমার ও বাংলাদেশে প্রচলিত৷ এই উপশাখাতে আরো কিছু ভাষা আছে, তার সংখ্যা এখনও হিসাব করা হয়নি৷ ভাষাগুলির নামও প্রচলিত অঞ্চলের নাম দেওয়া হল৷ লুশাই ভারত, মায়ানমার ও বাংলাদেশে প্রচলিত৷ থাডো ভারত ও মায়ানমারে, আও নাগা ভারতের অসম রাজ্যে বর্তমান৷ সেমা প্রচলিত মধ্য ও দক্ষিণ নাগাল্যাণ্ডে, আসামে৷ আনগামি নাগা পশ্চিম নাগাল্যাণ্ডে, কোনায়ক নাগা উত্তর-পূর্ব নাগাল্যাণ্ডে প্রচলিত৷ তাংখুল নাগা মণিপুর, উখুল, নাগাল্যাণ্ডে প্রচলিত রয়েছে৷ লেপচা হু রোং ভাষা সিকিম, ভুটান ও নেপালে বর্তমান৷

হিমালয়ী শাখার প্রধান ভাষা তিববতি৷ তিববতি ছাড়াও উপশাখাভুক্ত ভাষাগুলি হল গনচিন, নেপাল, সিকিম, ভুটান ও ভারতের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় (সিকিম, দার্জিলিং) প্রচলিত৷ এই শাখাতে ৯টি উপভাষিক বৈচিত্র্য রয়েছে৷ ৯টি উপভাষা হল— মধ্য-অঞ্চলীয় উপভাষা, দক্ষিণ অঞ্চলীয় উপভাষা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপভাষা, পশ্চিমাঞ্চলীয় উপভাষা, উত্তরাঞ্চলীয় উপভাষা, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপভাষা, পূর্বাঞ্চলীয় উপভাষা, পশ্চিম প্রান্তীয় উপভাষা, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপভাষা৷

কিয়ানজিক শাখার প্রধান ভাষা কিয়াং আর তা চিনের সিচুয়ান প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত৷ কিয়াং-এর অনেকগুলি উপভাষা রয়েছে৷ অনেক ভাষাবিজ্ঞানী মনে করেন এগুলি উপভাষা নয় স্বতন্ত্র ভাষা বিশেষ৷ কাচিন শাখার একটি শক্তিশালী উপভাষা হল কাচিন বা জিংকোয়া, ভাষাটি চিন, ভারত ও মায়ানমারে প্রচলিত আছে৷ এখানে পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হবে৷

ছান্দোগ্য উপনিষদে সময়ের যে হিসাব রয়েছে, তা লৌকিক হলেও ধ্রুপদী সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে৷ লোকসমাজের মুখের ভাষাতে প্রাচীন কালের ভারতবর্ষে যে হিসাব পরিবাহিত হত, তা ছান্দোগ্য উপনিষদের পঞ্চমখণ্ডে কীভাবে বিবৃত হয়েছে সেই উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা হল৷ সেখানে কাল নির্দেশ করা হয়েছে যেভাবে তা হল, ‘‘পূর্বদিক ব্রহ্মের এক কলা, পশ্চিমদিক এক কলা, দক্ষিণদিক এক কলা এবং উত্তর দিক এক কলা৷ হে সৌম্য, ইহাই ব্রহ্মের চারি কলাবিশিষ্ট এক পাদ যার নাম প্রকাশবান্‌৷’’ তাহলে দেখা যাচ্ছে লোকসমাজের মুখের ভাষা যা লোকভাষা তা গাণিতিক চেতনায় সমৃদ্ধ এবং তা উচ্চমার্গের সাহিত্যে, ধর্মগ্রন্থে স্থান করে নিচ্ছে৷

হকার: প্রাত্যহিক জীবনে লোকসমাজ কথাবার্তাতে অসংখ্য গাণিতিক চেতনাসম্পৃক্ত, অসংখ্য পরিভাষা ব্যবহার করে৷ এই ব্যবহার লোকসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ৷ এবং এর প্রয়োগও বাস্তবজীবনানুসারী৷ নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রান্তেবাসী সমাজ যারা লোকসমাজ নামে লোকসংস্কৃতির আঙিনায় পরিচিত৷ তারা তাদের বাস্তব জীবন অতিবাহিত করতে গিয়ে এই সমস্ত গণিত সম্পৃক্ত পরিভাষা ব্যবহার করে যা লোকগণিতের অন্তর্গত৷ যেমন নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত যুবকেরা ট্রেনে হকারি করে৷ হকারি করার সময় তাদের মুখের ভাষাতে লৌকিক গণিতের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়৷ হকারেরা তাদের সামগ্রী বিক্রি করার জন্য চেঁচিয়ে বলে ‘বাঘের খাঁচা চাই, একটি নিলে ষাট টাকা, দুটো নিলে একশ টাকা৷’ সাধারণ মানুষের কৌতূহল জাগে বাঘের খাঁচা আবার কি জিনিস৷ তখন অধীর আগ্রহে যাত্রীরা অপেক্ষা করে৷ অবশেষে দেখা যায়, হকার তাঁর ঝুলি থেকে বের করছে ছেলেদের ব্যবহার করার জন্য জাঙ্গিয়া৷ সাধারণ যাত্রী হাসি চেপে রাখতে পারে না৷ তারা হকারের চাতুর্যে এবং গাণিতিকবোধে বিস্মিত হয়৷

আরো অন্য একজন হকার এসে কামরাতে হাঁকতে থাকে৷ দেবো নাকি দাদা, ‘ছাল ছাড়িয়ে, নুন লাগিয়ে, মাত্র পাঁচ টাকা, যে খাবে সে ভাগ্যবান, আর যে না খাবে সে শয়তান৷’ মাথায় ঝাঁকা তাতে অবশেষে দেখা যায় যে রয়েছে শসা ভর্তি৷ কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গিমাতে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ হয় এবং তখন সহজে, নিমেষে ক্রেতারা কিনতে, খেতে আগ্রহী হয়৷ শসা বিক্রেতা যে হকার তার শসাও নিমেষে তার বলার ভঙ্গিমায় মানুষ কিনতে বাধ্য হয়৷ তাঁর এই বিক্রির উপস্থাপন কৌশল আকর্ষক তাই খুব দ্রুত তাঁর শসা বিক্রি হয়ে যায়৷ এরা লোকসমাজ থেকে উঠে আসা হকার কিন্তু তাদের প্রাত্যহিক জীবনচর্যায়, জীবিকা নির্বাহে রয়েছে অজস্র গাণিতিক চেতনার প্রকাশ৷ এইভাবে লোকসমাজ থেকে উঠে আসা হকারদের মুখের ভাষাতে লৌকিক গণিতের চেতনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে৷ যা কিনা লোকগণিত নামে পরিচিত৷ এইভাবে হকারদের লোকভাষাতে সংখ্যারও কথা, অর্থের পরিমাণের কথা ব্যক্ত হয়৷ নিবিড়ভাবে একটু লক্ষ করলে এই বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷

মাছ বিক্রেতা: বাজারে মাছ বিক্রি করে মৎস্যজীবীরা৷ তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকা বা রুজিরোজগার করতে গিয়ে অজস্র গাণিতিক চেতনার প্রয়োগ ঘটায়৷ পরিমাপে, পরিমাণে, অর্থের হিসাবে এইসব মৎস্যজীবীরা লোকগণিতের প্রয়োগ ঘটায়৷ যা একান্তভাবেই লোকগণিত নামে পরিচিত৷ এরপর কিছু উদাহরণ দিয়ে বিে:ষণ করব, কীভাবে তারা এই গণিতের চর্চা করে থাকে৷ তারা মাছ বিক্রি করার সময় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খরিদ্দারদের ডাকে৷ ‘জলের মতো সস্তা দামে মাছ দিচ্ছি দাদা এদিকে আসুন’ বলে তাঁরা চেঁচায়৷ তারা নিজেদের অজান্তেই উপমা অলংকার ব্যবহার করে থাকে৷ উপমা বা তুলনা, দিক নির্দেশ, গভীরতা, সংকেত, পরিমাণ, পরিমাপ, সাদৃশ্য, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, সমানুপাতী, সংখ্যাতত্ত্ব গুণ, সুদকষা, কম্পাঙ্ক, অবস্থান, কাল, ক্ষণ, একক, সমতাবিধান, যুক্তি, পরিসংখ্যান, পাটিগণিত, বীজগণিত, ক্ষেত্রগণিত, জ্যামিতি, স্থানাঙ্ক প্রভৃতি গণিতের আলোচন্য বিষয়৷

নিরক্ষর মৎস্যজীবীরা মাছ সের হিসাবে বিক্রি করে৷ এই সের লোকসমাজের ব্যবহৃত পরিমাপের একক৷ গ্রামীণ জীবনে দীর্ঘকাল ধরে বংশ পরম্পরায় এই এককটির ব্যবহার চলে আসছে৷ আবার মাছওয়ালী মহিলারা নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও পাঁচমেশালি মাছ নির্দিষ্ট দামে কিনে ভিন্ন ভিন্ন দামে, ভিন্ন ভিন্ন খরিদ্দারের কাছে ওই মাছ বিক্রি করে৷ তারা নিমেষে অনুপাতের হিসেবের মতো জটিল গণিত মুখে মুখেই করে থাকে৷ তাদের ভাষাতে লৌকিক পরিমাপের একক ব্যবহৃত হয়, যা একান্তভাবেই লোকগণিতের আলোচ্য বিষয়৷ এছাড়া তারা যে দরে মাছ কেনে এবং সুনির্দিষ্ট ভাগানুসারে ভাগ ভাগ করে মাছ বিক্রি করে৷ এভাবেই তারা মাছ বিক্রি করে৷ আবার কোথাও কোথাও মৎস্যজীবী মহিলারা থালি থালি (মুম্বাই) মাছ একশ, দুশো টাকা দরে বিক্রি করে৷ সেখানে পরিমাপের একক থালা৷ যা কিনা একেবারেই লোকমানস সম্ভুত চিন্তাচেতনার ফসল৷

গোয়ালা: গোয়ালা দুধ বিক্রি করে৷ গোয়ালারা অধিকাংশই ঘোষ হয়৷ তারা গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্যকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের পেশার মাধ্যমে৷ তারা সের, পোয়া, আধাকেজি বা দুই পোয়া হিসাবে দুধ এই আজকের কম্পিউটার আবিষ্কারের যুগেও ব্যবহার করে চলেছে৷ তারা লৌকিক ভাষার সাহায্য লৌকিক পরিমাপের একককে বাঁচিয়ে রেখেছে৷

আবার বিহারের অজ পাড়াগাঁয়ে অসুস্থ রোগীর জ্বরের হিসাব দিতে তারা দুই কম্বলি, তিন কম্বলি, চার কম্বলি জ্বর বলে জ্বরের হিসাব রাখে৷ অর্থাৎ কম্বল যা গায়ে দিলে শীত নিবারণ হয়ে থাকে৷ তার সংখ্যার উপর নির্ভর করে জ্বরের হিসাব রাখে৷ যত বেশি কম্বল হবে জ্বর তত বেশি হবে বলে তারা সচেতন হয়ে রোগীর সেবা শুশ্রূষা করে থাকে৷ এইভাবে লোকভাষাতে লোকগণিতের চেতনা নিহিত থাকে যা আমরা নিত্যদিনের জীবনযাপনে ব্যবহার করে থাকি৷

রাজমিস্ত্রী: রাজমিস্ত্রিরা ইট বালি সিমেন্ট অথবা ইট আর মাটি দিয়ে পাকা বাড়ি নির্মাণ করে থাকে৷ তারা তাদের কাজের সময় ইটকে আধলা, কোয়ার্টার, টুকরা ইত্যাদি বলে থাকে৷ ছেনি, হাতুড়ি, কোদাল, বেলচা, গাইতি, শাবল, খুর্ণি প্রভৃতি রাজমিস্ত্রিদের প্রয়োজনীয় উপকরণ বা যন্ত্রপাতি লাগে৷ এছাড়া বাঁশের বা কাঠের লম্বা দণ্ড লাগে যা দিয়ে সিমেন্টবালির মিশ্রণ সমান করে৷ তারপর ঢালাই করা অঞ্চলে তারা মসৃণ করার জন্য কাঠের লম্বা আয়তকার মাপের মসৃণ কাষ্ঠ দণ্ড লাগে৷ এর সাহায্যে বিশাল-বিরাট হর্মরাজিকে করে তোলে দৃষ্টিনন্দনীয়৷ এবং এই সকল যন্ত্রপাতি দিয়ে তারা তাদের শিল্পী মনে নিহিত থাকা সৌন্দর্যবোধকে প্রকাশ করে রাজমিস্ত্রিরা ফুল, লতা, পাতা বরফি কলকা, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য, গাছ, মানুষ এবং প্রাকৃতিক ও জ্যামিতিক নানা দৃশ্যকে দৃশ্যায়িত করে তোলে৷ এই সুষম সৌন্দর্যবোধ গণিতের একটি বড়ো আলোচ্য বিষয়৷ এবং লোকসমাজের দ্বারা এই সৌন্দর্যবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বলে এই গাণিতিক চেতনাকে লোকগণিতের অন্তর্গত করা হয়৷ এছাড়া সাত কড়াই বালির সঙ্গে এক কড়াই সিমেন্ট পরিমাণ অনুসারে আনুপাতিক গণিতের প্রয়োগে কাজ করে থাকে৷ জলও ওই রাজমিস্ত্রি পরিমিতভাবে ব্যবহার করে থাকে৷ আবার কোয়ার্টার মাপের ইটকে তিন পোয়া পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার করে৷ ওলন হল উচ্চতা মাপার জন্য নাইলেনের দড়ি৷ যার উপরে একটি কাষ্ঠের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ঝোলানো থাকি দড়ি৷ আর নিচে একটি শঙ্কুর মতো আকৃতির লোহার দণ্ড থাকে৷ ফলে তাদের মুখের ভাষা লোকগাণিতিক, সাংকেতিক হয়ে থাকে৷

হিজড়ে: তৃতীয় লিঙ্গ যাদের বলা হয় তারা এখন শিক্ষা ও চাকুরি করতে পারে৷ কিন্তু সমাজে তাদের এখনও অন্য দৃষ্টিতে দেখে৷ যখনই শোনে হিজড়ে৷ তখন মানুষ একটু বাঁচা চোখে তাকায়৷ তাদের ভাষাতেই লোকগাণিতিক মাত্রাবোধ সুষমভাবে ব্যবহৃত হয়৷ পেশাগতভাবে এরা সদ্যজাত সন্তান একটু বড়ো হলে নাচিয়ে আশীর্বাদ করে৷ তারা যে সমস্ত ছড়া ও গান করে থাকে তার মধ্যে গাণিতিক চেতনা নিহিত থাকে৷ যেমন—

ওরে আমার সোনার বালি৷
নজর দেবে যে তোর তার মুখে চুনকালি৷৷
বাঁচবি বিটি আশি বছর৷
বাপমারে দেখবি জীবন ভর৷৷
ও আমার কালা সোনা৷
ও আমার আদরের মনা৷৷
স্বাস্থ্য হবে সুন্দর, বেটা করবি লেখাপড়া৷
সে নজর দিবে তুকে সে চুষবে আমার বাড়া৷৷

তাদের গানের সঙ্গে থাকে অসংখ্য গালিগালাজ৷ যার ফলে পুরুষরা সামনে থাকতে পারে না৷ থাকলে কথায় কথায় কাপড় তুলে বেশি টাকা দাবি করে৷ এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা তারা শিশুকে নাচিয়ে দাবি করে বসে৷ হিজড়েরা যে সমস্ত কথা বলে, যেমন— ‘সুন্দর মনা’ এখানে গুণের কথা ব্যক্ত হয়৷ যা কিনা গণিতের আলোচ্য বিষয়৷ এই গণিত লোকগণিত নামে পরিচিত৷ কেননা সামাজিক গাণিতিক প্রজ্ঞা তারা ব্যবহার করে থাকে আর এই সামাজিক গণিত লোকগণিতের অন্তর্গত৷ তাই হিজড়েদের ভাষা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বুলিতে যেমন ‘কতটা খাবার লিবি রে’, ‘তোর রূপের আগুন জ্বালা বিটি’ প্রভৃতি ভাষ্যে পরিমাণ, ক্রিয়া প্রভৃতিও আধুনিক কালের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞেরা গণিতের আওতায় এনে ফেলে৷ তাই হিজড়েদের ভাষাও লোকগণিতের সম্পৃক্ত৷ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়৷

লটারি বিক্রেতা: সরকারি লটারি যারা বিক্রি করে তাদেরও রয়েছে একটি নির্দিষ্ট ভাষা৷ সেই পরিভাষাগুলো অন্যান্য মানুষের কাছে অপরিচিত, অজ্ঞেয় মনে হতে পারে৷ যেমন এক লট, ঘর, তিন সিরিজ, পঞ্চাশের ঘর, খাওয়া বা খাবে হওয়া নীল (নীল মানে কোনো প্রাইজ না ওঠা)৷ সিকিমের ডিয়ার লটারি, পাঞ্জাবের মা লক্ষ্মী, পশ্চিমবঙ্গ নববর্ষ লটারি প্রভৃতি লটারির নাম করা যায়৷ এছাড়া অবিক্রিত টিকিটকে আনসোল্ড বলে৷ সেম একটি পরিভাষা অর্থাৎ একই নম্বরের যে কটি সিরিজ আছে সবকটি মিলিয়ে৷ আরো বিশ্লেষণ করে বলা যেতে পারে৷ ধরা যাক এক থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত লটারি টিকিট৷ আর সেম মানে যদি চারটি সিরিজ হয়, তবে মোট দুশোটি লটারি টিকিট হবে৷ এখন তো পঞ্চাশ সিরিজের খেলাও চালু আছে৷ অর্থাৎ একটি টিকিটের সেম কাটা মানে পঞ্চাশটি টিকিট কাটা৷ সিকিমের ডিয়ার কাটলে পঞ্চাশ সিরিজের তিনশ টাকা লাগবে৷ এই টিকিটের প্রথম পুরস্কার এক কোটি টাকা৷ এই সব লটারি টিকিট গরিবগুবের্বা লোক ও মা বোনেরা বিক্রি করে৷ কারো দোকান আছে৷ আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে হকারি করে৷ এরা নিজেদের অজান্তেই গণিত চর্চা করে চলেছে সদাসর্বদা নিজেদের মতো করে এও লোকগণিতের প্রয়োগের একটি দিক৷

লোকমুখে লোকভাষা এবং তাতে কীভাবে গাণিতিক চেতনা নিহিত রয়েছে নিম্নে বিধৃত প্রবাদগুলি তার যথার্থ দৃষ্টান্ত৷ যেমন— ‘উই ইন্দুর কুজন৷ ডাল ভাঙ্গে তিন জন’৷ অর্থাৎ সমাজের বুকে যারা যারা খারাপ মানুষ এবং প্রতীকি উই ও ইঁদুরের মতো মানুষেরা ভালো কাজ হতে দিতে চায় না৷ তারা নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে৷ ‘তোমারো পিরিতি বালির বাঁধ, ক্ষণেক হাতে দড়ি ক্ষণেক চাঁদ’ এই প্রবাদটি দীর্ঘকাল ধরে লোকসমাজে মুখে মুখে প্রবাহিত হয়ে আসছে৷ সমাজে কিছু মানসিকভাবে ধূর্ত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দুষ্কর৷ এরা কখনো মানুষের কল্যাণে আসে না৷ বরং মানুষের জীবনকে করে তোলে অতিষ্ট৷ সময় সুযোগ পেলে এরা হাতে চাঁদ পেয়ে যায়৷ এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা মুস্কিল৷ এরা সুবিধাবাদী৷ লোকসমাজে এদের সাংকেতিকভাবে সুচিহ্ণিত করা হয়েছে৷ আবার যার খাবার খায়, তার বদনাম গায়৷ যার ভরনপোষণে মানুষ তার গুণগান না করে অপর কোনো অবৈধ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তখন লোকসমাজ তাদের বলে, একেবারে লৌকিকভাষাতে ‘ভাত খাও ভাতারের, গুণ গাও নাঙ্গের’৷ লোকসমাজে একশ্রেণির অসচেতন মানুষ আছে৷ যারা কখনোই নিজের খেয়ালে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চায় না৷ এদের লোকসমাজের সদস্যরা কটাক্ষ করে বলেছে‘ ‘অন্ধ জাগো না কিবা রাত্রি কিবা দিন’৷ সময় চেতনা গণিত তথা লোকগণিতের বিশাল একটি অধ্যায়৷ এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব অতি অনায়াসে লোকসমাজ প্রাত্যহিক জীবনযাপনে মুখে মুখে বংশ পরম্পরায় করে চলেচে৷ তারই প্রকাশ ঘটেছে একটি প্রবাদে ‘যে দেশে কাক নাই সে দেশে কি রাত্রি পোয়াবে না’৷ রাত্রি একটি নির্দিষ্ট কালব্যাপী সময়৷ এবং এইটি সময়চেতনার বা হিসাব, গণনার একটি এককমাত্র৷ কাক না থাকলে সে দেশে কি রাত্রি পোয়াবে না৷ এই প্রবাদের মধ্য দিয়ে লোকসমাজের সময় চেতনা ব্যক্ত হয়েছে৷ সময়ের হিসাব রাখা একটি গাণিতিক প্রজ্ঞা৷ লোকসমাজে তা বহুল প্রচলিত৷ এবং এটা তারা করে আসছে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে৷ অপর একটি সময়ের নির্ঘণ্টবাচক প্রবাদে বলা হয়েছে ‘কাহারো সর্বনাশ কাহারো ভাদ্রমাস’৷ অর্থের হিসাব করাও একটি সূক্ষ্ম গাণিতিক চেতনার অভিব্যক্তি বলা যেতে পারে৷ লোকসমাজ তাই মুখে মুখে অনুশীলন করে দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত প্রবাদ বাক্য বা শব্দগুচ্ছ তাতেও গাণিতিক চেতনা প্রকাশ পায়৷ তারা বলে ‘চেটায় শুইয়া লক্ষ টাকার স্বপন দেখে’৷ অপর একটি প্রবাদে লোকসমাজ তাদের অর্থনৈতিক চেতনার কথা সংখ্যামাণে ব্যক্ত হয়েছে৷ প্রবাদটি তারা কথায় কথায় রোজকার দিনে ব্যবহার করে৷ তারা বলে ‘লাক টাকা লাক টাকা দুই কুড়ি দশ টাকা’৷ লোকসমাজ বাস্তব জীবনের কঠিন কঠোর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাই তারা অনায়াসেই বলতে পারে ‘দশের লাঠি একের বোঝা’৷ আবার লোকসমাজে নারীদের কাপড়ের দৈর্ঘ্যের হিসাবও প্রবাদের মাধ্যমে তাদের গাণিতিক সূক্ষ্মবোধ প্রকাশ পায়৷ তাদের ব্যবহৃত প্রবাদে তাই উঠে আসে ‘বার হাত কাপড়ের তের হাত দশা’-র কথা৷ সামাজিক ভাষা উপভাষার অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত৷ আবার একটা গ্রামের সঙ্গে আর একটা গ্রামের ভাষার মধ্যেও তারতম্য দেখা যায়৷ তেমনি এক অঞ্চলের লোকভাষার সঙ্গে অন্য অন্য অঞ্চলের লোকভাষার তারতম্য পরিলক্ষিত হয়৷ এছাড়া নিভাষাতেও ব্যক্তিভেদ ভাষার মাত্রাবোধ পরিবর্তিত হয়ে থাকে৷ এখানে তাই লোকসমাজে ব্যবহৃত মুখের ভাষাতে যে গাণিতিক প্রজ্ঞা প্রকাশ পায় তারই দৃষ্টান্ত দেওয়ার প্রয়াস পাওয়া গেল৷ লোকসমাজে প্রচলিত ‘খোঁড়ার পা খানায় পড়ে’৷ এই প্রবাদে সামাজিক গণিতের কথা ব্যক্ত হয়েছে৷ সমাজে সমস্যাসংকুল মানুষেরাই যেন আরো বেশি সমস্যাতে জড়িয়ে পড়ে৷ আবার অপর একটি লৌকিক প্রবাদে বলা হচ্ছে ‘মারি তো গণ্ডার লুঠি তো ভাণ্ডার’৷ এখানে পরিমাণবোধের কথা প্রকাশ করা হয়েছে৷ লোকসমাজের নিত্যদিনের কথোপকথনে গাণিতিক প্রজ্ঞা যে নিহিত রয়েছে তা একটু নজর দিলেই বোঝা যাবে৷

নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী কৌমজনসমাজ দীর্ঘদিন ধরে একই সংস্কৃতি লালন পালন করে আচার-আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার চর্চা করে যূথবদ্ধভাবে তবে তাদের সংস্কৃতিকে লোকসংস্কৃতি বলে৷ আর এই লোকসমাজের মুখের ভাষাই লোকভাষা নামে পরিচিত৷ অঞ্চলভেদে আলাদা আলাদা সংস্কৃতির মতোই ভাষার তারতম্য লক্ষ করা যায়৷ তাই অঞ্চলভেদে ভাষা যায় বদলে, বুলি যায় আলাদা হয়ে৷ লোকভাষার মধ্যে পড়ে পেশাগত ভাষা, সামাজিক ভাষা, নিভাষা বা বিভাষা, সাংকেতিকভাষা বাcodification এমন কী গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষের ভাষা আলাদা হয়৷

আবার প্রতিটা মানুষের বাক্‌যন্ত্র ভিন্ন হওয়াতে বাক্‌রীতি আলাদা আলাদা হয় আলাদা হয়ে যায় বাক্‌ভঙ্গিমা৷ জিহ্বা, কণ্ঠনালি মুখগহ্বরের গঠনানুসারে মানুষের বলা লোকসমাজের ভাষা হয়ে থাকে আলাদা৷ এখানে পেশাগত ভাষায় লোকগণিত কীভাবে লোকসমাজ প্রয়োগ করে থাকে তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হল৷

সমস্ত পেশার সঙ্গেই লোকগণিতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ এখানে কয়েকটি পেশার উল্লেখ করা হল৷ পরে আবার আরো বিস্তৃত আলোচনা করা যাবে৷ আমাদের মধ্য-পূর্ব এশিয়ার ভাষাভাষি মানুষধের লোকভাষা গাণিতিক প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ৷ পরবর্তী সময়ে এই বিষয় নিয়ে আরো গভীরভাবে আলোচনা করা হবে৷ এবং বাক্‌যন্ত্র অনুযায়ী ভাষাতে যে কত বৈচিত্র্য তাও দেখিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও ক্ষেত্র সমীক্ষা করে আলোচনার প্রয়াস দেখানো যাবে৷

ক্ষেত্র সমীক্ষা:
১. মনুমিস্ত্রি৷ বয়স ৪৮৷ স্থান: বোলপুর৷ তারিখ: ১৮.০৫.২০১৮৷ সময়: সকাল ১১.৩০৷ জাতি: সাঁওতাল৷
২. ছেনি বিবি৷ বয়স ২৩৷ স্থান: ফুল্লরা তলা৷ তারিখ: ০৫.০২.২০১৮৷ লাভপুর, বীরভূম৷ জাতি: তৃতীয় লিঙ্গ৷ পেশা: হিজড়ে৷
৩. গোবিন্দ দাস৷ বয়স ৩৫৷ স্থান: কুন্তিঘাট৷ তারিখ: ১৭.০৮.২০১৩৷ জেলা: হুগলি৷ সময়: সকাল ৯.৩০ (টেলিফোনে সাক্ষাৎকার)৷ পেশা: লটারি বিক্রেতা৷

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
১. Chatterjei, S. K., The Origin and Development of The Bengali Language, Rupa Publications India Pvt. Ltd., Kolkata, 2017
২. Bloomfield, L (Ed. Hoijer, H) Language History from Language, Holl, Rinehart and Winston, Inc. New York, 1965.
৩. নাথ মৃণাল, ভাষা ও সমাজ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ৷
৪. শ, রামেশ্বর, সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলাভাষা, কলকাতা, পুস্তকবিপণি, ২০১২৷
৫. বিশ্বাস, তপনকুমার, লোকভাষার নানামাত্রা, বনসাই প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ৷
৬. মোরশেদ, আবুল কালাম, আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান, ঢাকা, বাংলাদেশ৷
৭. সার্ভে রিপোর্ট ইউনেস্কো, ২০১১

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!