মানব সভ্যতার বিকাশে মৃৎশিল্পের ভূমিকা: ঐতিহ্য, সংকট ও সম্ভাবনা

মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে মানুষের আবিষ্কার, অভিজ্ঞতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য নানা কৌশল উদ্ভাবন করেছে। আগুনের আবিষ্কার যেমন তাকে খাদ্য রান্না ও শিকার সংরক্ষণে সক্ষম করেছে, তেমনি কাদামাটি দিয়ে মৃৎপাত্র তৈরির কৌশল তার জীবনযাত্রায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। বলা হয়, মানব সভ্যতার প্রথম সোপান তৈরি হয়েছিল মাটির পাত্রের আবিষ্কারের মাধ্যমে। এটি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং একটি প্রয়োজনীয়তা থেকে জন্ম নেওয়া প্রযুক্তি, যা পরবর্তীকালে শিল্পকলার মর্যাদা পেয়েছে।

প্রাচীন মানুষ প্রথমে ঝাঁপি, গাছের ছাল কিংবা লতা দিয়ে পাত্র তৈরি করত। কিন্তু এসব পাত্র রান্নার জন্য উপযুক্ত ছিল না। তখন তারা কাদামাটির প্রলেপ ব্যবহার করে ঝাঁপিকে আগুনে টেকসই করার চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারে কাদামাটিই একটি স্বতন্ত্র উপাদান, যা দিয়ে পাত্র বানানো যায়। সেখান থেকেই মৃৎশিল্পের সূচনা। মানব সভ্যতা যখন যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতিতে প্রবেশ করে, তখন খাদ্য সংরক্ষণ ও রান্নার জন্য মাটির হাঁড়ি-পাতিল অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এটি শুধু প্রয়োজন মেটায়নি, বরং মানুষকে এক স্থানে স্থায়ী হতে, বসতি গড়তে এবং ধীরে ধীরে জটিল সমাজ ও সভ্যতা গড়তে সহায়তা করেছে।

ইতিহাসে চীনের থাংশান শহরকে মৃৎশিল্পের অন্যতম উৎপত্তিস্থল বলা হয়। মিং রাজবংশের সময় এই শহরে মৃৎপণ্যের বিকাশ ঘটে। সেলাডন নামের বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র এশিয়া ও ইউরোপে ব্যাপক জনপ্রিয় হয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশে পরিণত হয়। একইভাবে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর ও ভারতীয় উপমহাদেশে মৃৎশিল্পের নানা নিদর্শন পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায়, সভ্যতার অগ্রযাত্রায় মৃৎশিল্প একটি বৈশ্বিক ঐতিহ্য, যা ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে মানুষের অভিন্ন চাহিদা ও রুচির প্রকাশ ঘটিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৃৎশিল্পের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া নানা নিদর্শন প্রমাণ করে, এ অঞ্চলের মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই মাটির পাত্র ব্যবহার করত। বগুড়ার মহাস্থানগড়, দিনাজপুরে কান্তজীর মন্দির, কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার এবং বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে পাওয়া পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা এ শিল্পের নান্দনিকতা ও ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বরেও বহু প্রাচীন মাটির পাত্র ও অলংকরণের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো শুধু শিল্প নয়, বরং এ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য বহন করে।

বাংলাদেশের মৃৎশিল্প দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীমাতৃক দেশের ভূপ্রকৃতি মৃৎশিল্পের বিকাশে সহায়ক ছিল। সহজলভ্য এঁটেল মাটি, জ্বালানি কাঠ ও শুকনো ঘাস, পরিবহনের সুবিধা এবং সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক চাহিদা একত্রে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। গ্রামে প্রায় প্রতিটি ঘরেই একসময় মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কলসি ও অন্যান্য পাত্র ব্যবহৃত হতো। বৈশাখী মেলা ও বিভিন্ন উৎসবে কুমোরদের তৈরি মাটির খেলনা ও শোভাবর্ধক জিনিসপত্র শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় ছিল।

কুমোর সম্প্রদায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই শিল্প ধরে রেখেছে। তাদের পেশাজীবন ছিল মৌসুমি। বছরে ছয় মাস মৃৎপণ্য তৈরি এবং বাকি ছয় মাস বাজারে বিক্রি করাই ছিল তাদের জীবিকার প্রধান ভিত্তি। মাটির চাকা, পিতনী, বইলা, ফুল্যা ও পুইন নামের সরল যন্ত্রপাতিই ছিল তাদের প্রধান সহায়ক। মৃৎশিল্পে প্রযুক্তিগত উন্নতি খুব বেশি ঘটেনি, কারণ হাতের কাজের সূক্ষ্মতা ও দক্ষতা এই শিল্পের প্রাণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোথাও কোথাও বৈদ্যুতিক চাক ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও এখনো হাতে তৈরি পণ্যের চাহিদাই বেশি।

কালের বিবর্তনে মৃৎশিল্প নানা সংকটে পড়েছে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন ও সিরামিক সামগ্রী ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো টেকসই ও সস্তা হওয়ায় মানুষ দ্রুত মাটির পণ্যের বিকল্প হিসেবে এগুলো বেছে নেয়। একই সঙ্গে এঁটেল মাটির দাম বৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট, আয়ের তুলনায় ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কুমোররা বিপাকে পড়ে। অনেক পরিবার ঋণ নিয়ে পেশা চালিয়ে যেতে চাইলেও ক্রমাগত লোকসানের মুখে তারা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। ফলে গ্রামীণ কুমোরপাড়া যেগুলো একসময় মাটির সুবাসে মুখর থাকত, আজ সেগুলো নিস্তব্ধ।

তবে আশার কথা হলো, আধুনিক বিশ্বে পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। সবুজ বিশ্বায়নের যুগে মাটির পণ্য আবার গুরুত্ব পাচ্ছে। শহুরে জীবনে মাটির ফুলের টব, গার্ডেন আইটেম, শোভাবর্ধক সামগ্রী, আলোকসজ্জার সামগ্রী ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে তৈরি মৃৎপণ্য এখন ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রপ্তানি হচ্ছে। এতে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই নয়, বরং বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছে।

সরকার ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগেও এ শিল্প নতুন করে প্রাণ পাচ্ছে। ১৯৮২ সালে বিসিকের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম মৃৎশিল্প মেলার আয়োজন হয়, যা ব্যাপক সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে বরিশালে মৃৎশিল্পী সম্মেলন আয়োজন শুরু হয়, যেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিল্পীরা অংশ নেন। চারুকলা অনুষদের তরুণ শিল্পীরা মৃৎপণ্যে নতুন ডিজাইন, রঙের ব্যবহার ও নান্দনিক বৈচিত্র্য এনেছেন, যা শহুরে গ্রাহকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ঢাকাসহ বড় শহরে হাজার হাজার দোকানে মৃৎপণ্য বিক্রি হচ্ছে। ঘর সাজানোর সামগ্রী থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ ও অফিস সাজাতেও মাটির জিনিসপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে।

তবুও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। বাজারজাতকরণের অভাব, আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার সীমাবদ্ধতা, কুমোরদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ঘাটতি, ঋণ ও পুঁজির অভাব শিল্পটিকে এগিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে। অনেক সময় মৃৎশিল্পীরা শ্রম অনুযায়ী ন্যায্য মূল্য পান না। তারা ১০০টি মাটির পাত্র ৫০০ টাকা খরচে তৈরি করে মাত্র ৬০০ টাকায় বিক্রি করেন। এতে তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সরকার ও বিনিয়োগকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য।

মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে কিছু নীতি গ্রহণ প্রয়োজন। প্রথমত, পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে মৃৎপাত্রের ব্যবহার বাড়াতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেমন মিষ্টির হাঁড়ি বা দইয়ের পাত্রের জন্য মাটির পাত্র বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, কুমোরদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশা ও ডিজাইনে দক্ষ করতে হবে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং করে “বাংলাদেশ মৃৎশিল্প” পরিচিত করতে হবে। চতুর্থত, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত মৃৎশিল্প মেলা আয়োজন করতে হবে, যা শিল্পীদের উৎসাহ যোগাবে এবং বাজার বাড়াবে।

সবশেষে বলা যায়, মৃৎশিল্প মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। এটি কেবল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উৎস নয়, বরং মানুষের শিল্পবোধ, নান্দনিকতা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন। মা আর মাটির সঙ্গে এদেশের মানুষের যে নাড়ির টান, তা প্রতিফলিত হয় মৃৎশিল্পের প্রতিটি সৃষ্টিতে। সঠিক উদ্যোগ ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই শিল্প আবারো তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। মৃৎশিল্পকে টেকসই করা গেলে তা শুধু ঐতিহ্য রক্ষা করবে না, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে এবং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিসরে পরিবেশবান্ধব সাংস্কৃতিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!