রিশপ হয়ে লোলেগাঁও

লাভাতে দুদিন কাটিয়ে তারপরের যাত্রাপথ হতে পারে রিশপ। দুপাশে ঘন জঙ্গল, এই জঙ্গলে হিংস্র ভালুকও আছে। জঙ্গলের একটা বিশেষত্ব হল ঝুপ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে যাওয়া। চারপাশে তখন অদ্ভুত শুনশান, অদ্ভুত এক নিঃস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে অনেক অলৌকিক গল্পের সন্ধান পাওয়া যেতেই পারে। রিশপ এমন একটি পাহাড়িয়া গ্রাম, যে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় শোভা পায় রঙিন ফুল আর নানান অর্কিড। আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে আকাশে হিমালয়ের হিমকন্যাদের দর্শন মেলে। লাভা থেকে মাত্র ১২ কিমি দূরে এই গ্রাম। ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত এই পাহাড়ি গ্রামে প্রচুর পাখি আর আকাশের ক্যানভাসে একফ্রেমে কাঞ্চনজঙ্ঘা-সহ নানা অল্প চেনা শৃঙ্গের দেখা মেলে। সুন্দর সূর্যোদয় দেখতে হলে প্রায় ২ কিমি জঙ্গল ট্রেকে চলে আসতে হবে টিফিনদারা ভিউপয়েন্টে। এখান থেকে দেখা সূর্যোদয় অনেক দিন হৃদয়ে অতল গভীরে থেকে যাবে।

কালিম্পং অঞ্চলের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মানা হয় রিশপ-রিম্বিককে। এটি লাভা থেকে ১০ কি.মি. দূরে এবং কালিম্পং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে ৮২৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। লাভা থেকে পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করে পৌঁছনো যায় রিশপে। রিশপ এমন একটি শব্দ যার অর্থ পাহাড়ের মাথায় একলা গাছে। অবশ্য লাভা থেকে রিশপ পর্যন্ত জিপ চলার পথও আছে। রিশপের রাস্তা এখনও কাঁচা। বিদ্যুৎ এখনও না পৌঁছনোয়, এখানে থাকার মধ্যে একটা মধ্যযুগীয় অনুভূতির মজা আছে। অপার সৌন্দর্যের আধার রিশপ। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন হাতের কাছে। স্থানীয় শেরপা ও লেপচারা কটেজের মতো বেশ কিছু পর্যটকদের থাকার জায়গা বানিয়েছেন। নাথুলা পাস, তিন সীমানা, গ্যাংটক, তিব্বতের পাহাড়গুলি সহ এখান থেকে হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্য চোখ পড়ে।

রিশপের পথটা অন্ধকারের বুক চিরে চিরে, সামনে শুধু গাড়ির হেড লাইট। এখানকার হোম স্টে কাঠের। সন্ধ্যা হতেই কনকনে ঠান্ডা। ঘরের বাইরে আকাশে পূর্নিমার চাঁদ। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত দিগন্ত বিস্তৃত সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কি অপরুপ দৃশ্য। মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় পরিবেশ। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোর বিচ্ছুরণে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ সৌন্দর্য কল্পনা করা যায়না। এই অনুভুতি বর্ণনাতীত। কিছু জ্বালানি কাঠ দিয়ে “বন ফায়ারের” ব্যবস্থা মনকে কেমন উদাস করে দেয়। একদিকে আকাশে পূর্নিমার চাঁদ, অন্যদিকে চাঁদের আলোয় প্রজ্জ্বলিত কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর সবাই গোল হয়ে বসে কনকনে ঠান্ডায় আগুন পোহানো যেন প্রাচীন যুগের কোনও এক দৃশ্য। রাতে ঘরের ভেতর থেকে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্য এক কথায় অসাধারণ। রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হবেই বরফের চাদরে শুয়ে আছি। কিম্বা এমনও উপলব্ধি হবে বিছানায় কে যেন বরফ জল ঢেলে দিয়েছে। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

খুব সকালে পাহাড়ের দৃশ্য আবার আলাদা। দরজা খুলে বাইরে বেরতেই চোখের সামনে দিগন্তবিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর সূর্যের প্রথম রক্তিম আলো। মনে হয় সোনাকে যেন গলিয়ে পর্বতের চূড়ামালায় ঢেলে দিয়েছে। অনন্য সুন্দর! অপার্থিব দৃশ্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হবে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী রূপেরও পরিবর্তন হতে থাকে। চারদিকে আলোতে আলো যেন হীরের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করছে, গাছে গাছে পাখির মিষ্টি কথোপকথন। সব মিলিয়ে এক নৈসর্গিক পরিবেশ। এরপরেই হোটেলের লনে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ শোভা দেখতে গরম চায়ের কাপে চুমুক। তারপর গরম জলে স্নান করে মোমো খেয়ে সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে মনের আনন্দে রওনা দেওয়া যেতে পারে লোলেগাঁওর উদ্দেশ্যে। রিসপ থেকে লোলেগাঁও প্রায় পঞ্চাশ কিমি , উচ্চতা ৭২০০ ফুট। আকাশে নানা মেঘের অবয়ব আর রঙের কোলাজ। পাহাড়ি পথে ওক, পাইন এবং আরো নানা অচেনা অজানা গাছ, বিভিন্ন পাখি, প্রজাপতি, কীটপতঙ্গ ও জীবজন্তু। পথের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হঠাৎ সামনে এসে দুহাতে অভ্যর্থনা জানাতে তৈরি লোলেগাঁও।

আসলে এসব জায়গার বিশেষত্ব হল নির্জনতাকে অনুভব করা এবং নিসর্গ প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করা। কালিম্পংয়ের বিশেষত্ব হল, এখানকার ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম তার নিজস্ব সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। কালিম্পংয়ের এমনই একটি ছোট্ট শান্ত গ্রাম হল লোলেগাঁও। অপূর্ব সুন্দর এই গ্রামটি। ঘন সবুজ অরণ্য এবং শান্ত উপত্যকার লোলেগাঁওকে প্রকৃতি অকৃপণ হাতে দান করেছে। ভোরের কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কালিম্পং ও লাভা থেকে পাইনের জঙ্গলে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ ধরে লোলেগাঁও যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। বাংলোর বারান্দায় বসে মন আর চোখ চলে যায় কোন সে সূদুরে। সন্ধ্যে নামলে এর এক অপরূপ দৃশ্য। মনে হয় অগুনতি জোনাকি দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে পাহাড়চুড়োয়। এখানে বসে বসেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।

আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পাইন, ফার, জুনিপার আর ক্রিপ্টোম্যানিয়ার বনের ছায়ায় আরও এক পাহাড়ি গ্রাম লোলেগাঁও। ভোরের সূর্যোদয় আর রাতে লক্ষ তারায় ভরা আকাশে, নীচের বিস্তৃত উপত্যকায় জ্বলছে আলোকমালা, ঠিক যেন হীরকদ্যুতির আভায় মন ভরিয়ে দেয়। লোলেগাঁও আসলে একটি ছোট ল্যাপচা গ্রাম যার জনসংখ্যা ৫০০০ এর কাছাকাছি। লোলেগাঁও, কালিম্পং থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার, শিলিগুড়ি থেকে ১২৪ কিলোমিটার এবং লাভা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। যারা প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করেন তাদের জন্যে মেঘে ঢাকা পাইন বনে ঘেরা এই গ্রামটি অনেক লোভনীয় একটি স্থান। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার জন্যে এটি একটি আদর্শ জায়গা। লোলেগাঁও শব্দের লোকাল অর্থ সুখী গ্রাম। এই গ্রামের সব থেকে বড় আকর্ষন হলো ক্যানপি ওয়াক। মেঘাচ্ছন্ন পাইন বনের মধ্য দিয়ে ৭৫ মিটার লম্বা এই ক্যানপটি ভ্রমণকারীদের মনকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়। এছাড়া মনেস্ট্রী, সানরাইজ পয়েন্ট, সানসেট পয়েন্ট ছাড়াও বেশ কিছু দর্শনীয়স্থান আছে।

আরও পড়ুন: লাভা 

(১) ক্যানোপি ওয়াক : লোলেগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই স্থান পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি টানে। পাইন, ফার, ওক গাছের ঘন বনে ১৮০ মিটার লম্বা কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে মুগ্ধ হতে হয়। দুটি গাছের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই ব্রিজটি যেন কোনও এক রহস্যকে গোপন করছে।
(২) ইকো পার্ক : গাছ-গাছালি, জলাশয় এবং বন্যপ্রাণে ভরা এই পার্ক লোলেগাঁওয়ের অন্যতম আকর্ষণ

কখন যাবেন:
আসলে বর্ষার সময়টা ছাড়া যেকোন সময় লোলেগাঁও (Lolegaon) ভ্রমণ করা যায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বরকে একটু সরিয়ে রেখে অন্য মাসে আসলেই ভাল। কারণ বর্ষায় ধ্বস পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে একথাও অস্বীকার করা যায়না বর্ষাকালে পাহাড় বা জঙ্গলের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য লক্ষ্য করার মতো।#

ছবিঋণ: মণিজিঞ্জির সান্যাল

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!