লোকগণিত পরিচয় (দ্বিতীয় পর্ব)

আজকের সভ্যতা বলতে যা বোঝায় তা গড়ে উঠেছে পৃথিবী সৃষ্টির পর কোটি কোটি বছরের ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে। যে পরিবর্তন কেবলমাত্র মনুষ্যজগৎ নয়, সমগ্র প্রাণী জগৎ এবং প্রকৃতি জগতের পরিবর্তনের ফলে। আবার সভ্যতার ছবি গোটা পৃথিবীতে একরকম নয়; কোনোকালে একরকম ছিল না।

বিজ্ঞানীদের অনুমান চারশত পঞ্চাশ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল। জন্মের পর থেকে অনেকবার ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এবং এর ফলে পৃথিবীর রূপ যেমন পাল্টেছে বারে বারে, তেমনি বারে বারে পাল্টেছে পৃথিবীর জলবায়ু এবং আবহাওয়া। এই পরিবর্তনের সূত্র ধরে প্রায় একশত কোটি বছর বা তার কিছু আগে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল। এজ্যেইক (Azoic) বা আরকিজ্যোইক (Archaezoic), প্রোটেরোজ্যাইক (Proterozoic), পোলিওজ্যাইক (Palaeozoic), মেসেজ্যাইক (Mesozoic), সিনোজ্যাইক (Cenozoic) যুগ ইত্যাদি বর্ণনা করে নৃবিজ্ঞানীরা বলেন, পোলিওজ্যোইক অধিকল্পের আগে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং সিনোজ্যোইক যুগে বা তার কিছু আগে প্রাণী জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় সাত কোটি বছর আগে স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে প্রকৃতির পরীক্ষার শেষ পরিণতি মানুষের আবির্ভাব, সিনোজ্যোইক অধিকল্পের শেষ অধিযুগে অর্থাৎ প্লাইসটোসিন অধিযুগে মানুষের জন্ম। বিজ্ঞানীদের অনুমান সময়টা দশ লক্ষ বছর বা তার কিছু বেশি আগে। বিষ্ণুপুরাণে আছে—

স্থাবরং বিংশতেলং জলজং নবলক্ষকম।
কুম্বাশ্চ নবলক্ষং চ দশলক্ষকং চ পক্ষিণঃ ।।
ত্রিশলক্ষংপশূণাঞ্চ চতুর্লক্ষং চ বানরাঃ।
ততো মনুষ্যতাং প্রাপ্য ততঃ কৰ্ম্মানি সাধয়েৎ।।

বিষ্ণুপুরাণের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে জীবাণু, জলচর, সরীসৃপ, বানর প্রভৃতি প্রাণীর জন্মের পর মনুষ্য জন্ম। অর্থাৎ শ্লোকটিতে ক্রমবিকাশের তত্ত্ব পরিস্কারভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

আদিতে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, আলো ছিল না, সর্বত্র অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। পৃথিবীর আদি পর্যায়ে অনন্ত জলরাশির উপর ঠাকুর ও ঠাকুরান বিরাজ করতেন। ঠাকুরের বার্তাবাহক ছিলেন লিটা। ঠাকুর ও ঠাকুরান প্রতিদিন স্বর্গপুরী থেকে ভোরে সুতো’ তে করে জলপুরীতে চান করতে নেমে আসত এবং ঠাকুর সে সময় কোনো না কোনো জলচর প্রাণী সৃষ্টি করতেন। এভাবে একে একে সৃষ্টি করল বোয়াড় হাকো (বোয়াল মাছ) ইর-অ (কূর্ম ), ধিরি কাটকম (পাথর কাঁকড়া), ল্যাণ্ডেৎ (কেঁচো), সলে ইচা: হাকো (চিংড়ি মাছ), তায়ান (কুম্ভীর), মাঙ্গার (মকর) প্রভৃতি জলচর প্রাণী। তারপর ঠাকুর জীউ মানুষ সৃষ্টি করলেন। সাঁওতাল সৃষ্টি তত্ত্বের বর্ণনা এরূপ।

স্তন্যপায়ীদের ক্রমবিকাশের স্তরে এক ধরনের ছুঁচো (tree shrew) কে মনুষ্য প্রজাতির আদি বলে প্রাণী বিজ্ঞানীগণ মনে করেন। এই ধরনের প্রাণী থেকেই লেমুনের উদ্ভব হয়েছে। টারসিয়ারকে লেমুনের পরবর্তী বংশধর বলে অনুমান করা হয়। টারসিয়ারের পরে বানর। বানরের সঙ্গে মানুষের সাদৃশ্য অনেক। তবে বানর মানুষের পূর্বপুরুষ নয়: বানরদের পরবর্তী বংশধর বনমানুষ হল মানুষের নিকটতম প্রজাতি। বনমানুষের চারটি শ্রেণী হল— গেরিলা, শিম্পাঞ্জি, গিবন এবং ওরাংওটাং। মানুষের পূর্বপুরুষ হিসাবে আর একটি প্রাণীর নাম পাওয়া যায়— সেটি হচ্ছে— প্রোকনসাল। প্রোকনসাল -এর পরিবর্তিত রূপ অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষের খুবই নিকটতম প্রাণী। এ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রাণীর নাম করতে হয়, জিনজানথ্রপাস যারা অস্ত্র বানাতে পারতো, এবং এরা গুহাতে আশ্রয়ও নিত। এদের ব্যবহৃত গুহায় পাওয়া গেছে কয়েক রকমের পাথরের হাতিয়ার। পণ্ডিতদের অনুমান নেয়ানডারটাল মানব লজ্জা নিবারণের ব্যবস্থা করেছিল। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে এটি অন্যতম প্রধান পদক্ষেপ। এরা মৃতদেহ কবর দিতো। উল্লেখ্য কবর দেওয়ার প্রচলন আজও আছে। নেয়ানডারটালদের পরেই হোমোসোপিয়েন্স বা খাঁটি মানুষের আবির্ভাব। এরপর একে একে পরিগর (Perigord) ওরিনিয়াক (Aurignae) সুলত্রে (Solutre) এবং লা মাদালেন (La Madeleine) গোষ্ঠীর মানুষের আবির্ভাব। বর্তমান কালের প্রধান মানব জাতিগুলির উদ্ভব হয়েছে পুরাপ্রস্তরযুগে এবং নব্যপ্রস্তরযুগে মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি নতুন পথে বাঁক নেয় ও সূচনা হয় এক নব অধ্যায়ের।

প্রথম মানুষের জন্ম কোথায় হয়েছিল এই নিয়ে নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়নি। প্রোকনসাল, যাকে মানুষের সম্ভাব্য পূর্বপুরুষ ধরা হয়, তার আদি নিবাস আফ্রিকায় এবং অস্ট্রালোপিথেকাস নামে যে প্রাণীটি মানুষের অনেকটা কাছাকাছি তারও বাসস্থান আফ্রিকা। প্যারানথ্রপাস, জিনজানথ্রপাসও আফ্রিকা অধিবাসী। যাদের ঠিক মানুষ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে তাদের মধ্যে প্রথম হ’ল পিথেকানথ্রপাস এর বাসস্থান যবদ্বীপ বা জাভা এবং অপর প্রজাতি সিনানথ্রপাস-এর বাসস্থান ছিল চিন। সোলোমানব এবং অ্যাজ্রাক মানবেরও জন্মভূমি জাভা। আফ্রিকার প্রাচীন মানব হ’ল রোডসীয় মানব। এমনও হতে পারে এশিয়া থেকেই মানুষের স্রোত ইউরোপে ঢুকেছিল এবং মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছিল এশিয়াতে।

পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি নিয়েও মানুষের আবির্ভাব নিয়ে বিভিন্ন দেশের পুরাণে অনেক গল্প আছে। নতুন প্রজাতির উদ্ভব কিভাবে সম্ভব হল সে সম্পর্কে লামার্ক এবং ডারউইনের মতবাদ বিখ্যাত লামার্কের মতে’ প্রকরণ (Variation) বা পরিবর্তন এর মধ্যদিয়ে নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এই প্রকরণ বা পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে পরিবেশে এবং জীবনযাত্রার পদ্ধতির প্রভাবের ফলে।

ডারউইন বলেছেন প্রজাতির পরিবর্তন মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঘটে। তাঁর মতে জীবন সংগ্রামে এবং বিশেষ প্রাকৃতিক অবস্থায় কোনো কোনো প্রকরণবিশিষ্ট জীব জয়লাভ করে বা খাপ খাইয়ে নিতে পারে, যারা খাপ খাইয়ে নিতে পারে তারাই জয়লাভ করে। মানুষের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসও ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস।

জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা বা যাওয়া জীবন সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে মানুষ। মানুষই সৃষ্টি করেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতি। অন্য জীবের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য হ’ল (১) উন্নত মস্তিষ্কের গঠন, (২) উন্নত বুদ্ধি, (৩) গঠনগত প্রকৃতির দিক থেকে অন্য জীবের তুলনায় উন্নত বলে নিজের হাত দুটিকে কাজে লাগাবার ক্ষমতা, (৪) প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা, (৫) প্রতিকূল পরিবেশকে আয়ত্তে আনার ক্ষমতা, (৬) জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে নানা কৌশল ও বুদ্ধির আশ্রয় নেওয়া, (৭) সৃষ্টি ক্ষমতার পরিচয় দেওয়া, (৮) জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য যন্ত্র আবিষ্কার, (৯) কথা বলা এবং পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের ক্ষমতা, (১০) ভাষাবোধ, (১১) লিপি আবিষ্কার, (১২) শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষমতা। মানুষের ক্রমবিকাশ এবং মনুষ্যসৃষ্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতি ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে মানুষের কাছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে

নিজের সৃষ্টিকর্মের মানসিকতা থেকেই মানুষ সৃষ্টির আগে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড কেমন ছিল তা নিয়ে ভেবেছে। মায়া সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, আইসল্যাণ্ড এবং ভারতীয় সভ্যতা নিয়ে সবাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির নানা মত ব্যক্ত করেছে।

ভারতের আদি সাহিত্য ঋগ্‌গ্বেদের নাসদীয় সূত্র সৃষ্টির আগের অবস্থার বর্ণনা করতে বলা হয়েছে প্রারম্ভে সৎ-অসৎ, আকাশ-অন্তরীক্ষ, রাত্রি-দিন, মৃত্যু-আমৃত্যু এসব কিছুই ছিল না। ছিল কেবল বিশৃঙ্খলা, মন তমসার আড়ালে ছিল তাপজাত অদেহী শূন্যতা এবং অনির্দিষ্ট বিশৃঙ্খলা। বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবত পুরাণ, বৈহ্ম-বৈবর্ত পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ প্রভৃতিতে সৃষ্টিক্রম বর্ণনা করা হয়েছে। সৃষ্টিক্রিয়া যে একদিনে সম্পন্ন হয়নি তা এসব গ্রন্থে বলা হয়েছে। মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, শ্রীরাম, শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি থেকে স্পষ্ট জলজ জীব থেকে ক্রমবিকাশের পথ ধরে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনিগুলি একদিনে গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে এগুলো একটা রূপ পেয়েছে। এগুলি আবার অনেক পরে লিখিত রূপ লাভ করেছে। পৌরাণিক কাহিনিগুলির সঙ্গে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গী। বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনীতে সর্বগ্রাসী মহাপ্লাবনের কথা আছে। দেশ আলাদা আলাদা অথচ মহাপ্লাবন সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনিগুলির মধ্যে সাদৃশ্য দেখে অনুমান করা হয় তুষার যুগের পর সম্ভবত পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে কোনো এক সময়ে মহাপ্লাবন ঘটেছিল। প্রতিটি দেশের কাহিনির মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বর্ণনার সাদৃশ্য লক্ষণীয়। চিন্তা ও মননের উপর মানুষের গুরুত্ব আরোপ করায় দিনে দিনে এই সাদৃশ্য বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। এভাবেই দেশে দেশে গড়ে উঠেছে তত্ত্ববিদ্যা— বিষয়ক যুক্তি (Ontological Argument), বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ক যুক্তি (Cosmological Argument),উদ্দেশ্যবাদ বিষয়ক যুক্তি (Technological Arugment) ও নৈতিকযুক্তি (Moral Argument)। ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টি মানুষের এই কাল্পনিক সৃষ্টি ক্ষমতা সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমোন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। মানুষকে সংঘটিত করতে, সাংস্কৃতিক চেতনাবৃদ্ধির কাজে, সামাজিক শৃঙ্খলা আনয়নে এই কাল্পনিক সৃষ্টি কি অসাধারণ ভূমিকা নিয়েছিল ভাবলে অবাক হতে হয়।

মানুষের স্বভাব হ’ল আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা। আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা বা বাসনা থেকেই সংস্কৃতির তথা মানব সম্পদের উদ্ভব হয়েছে। তাই সংস্কৃতি হ’ল মানুষের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, নানা সংস্কার, চিন্তা, ধর্ম, সাহিত্য-শিল্প প্রভৃতি। মৌলিক ক্রিয়াকলাপ (Basic Technology) ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ (Social Technology)-র উপর নির্ভর করে মানব সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। সভ্যতার একটি গতি আছে এবং গতি আছে বলেই তার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। আবার এটাও স্পষ্ট সভ্যতার দ্রুত গতির মত সংস্কৃতির গতি অত দ্রুত নয়—যদিও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সভ্যতার অগ্রগতির একটি অন্যতম শর্ত। অগ্রগতির এই ফারাক যুগে যুগে সমাজে পড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। যে অঞ্চলে হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা আজ ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বা সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে অশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলেও বর্তমান সভ্যতার অঙ্গ নয়। ফলে বর্তমান সভ্যতার সংস্কৃতিকে মার্জিত সংস্কৃতি বলা হলে তুলনাসাপেক্ষে প্রাচীন সেই সংস্কৃতিকে লোকসংস্কৃতি বলা যেতে পারে, একদা বঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থান গৌড় আজ গণ্ডগ্রাম। নবাবী আমলের মুর্শিদাবাদ আজ আর উন্নত নগরী নয়। বন্দর নগরী সপ্তগ্রামে দেখে ভাবাই যায় না একদা দেশি বিদেশি বণিকের পদচারণায় কল্লোলিত ছিল আজকের মজে যাওয়া সরস্বতী তীরবর্তী জনপদ। বিদ্যাচর্চার অন্যতম কেন্দ্র নবদ্বীপ যেভাবে একদা বঙ্গসংস্কৃতি চেতনাকে নিয়ন্ত্রিত করতো আজ তা ইতিহাস। Micro-Scale-এ বর্তমান সমাজের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলেও অনুরূপ সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। অর্থাৎ লোকসংস্কৃতি ও মার্জিত সংস্কৃতির এই স্থানাঙ্ক পরিবর্তন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। আবার আজ যা মার্জিত সংস্কৃতি কালের নিয়মেই তা লোকসংস্কৃতি হয়ে যেতে পারে। লোকসংস্কৃতি ভাবনা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রয়াসে মার্জিত সংস্কৃতিতে বিবর্তিত হবার ঘটনাও একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই সামাজিক গতি বা Social dynamism বোঝা লোকগণিত চর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত।

সামাজিক গতি মানুষের জীবনযাত্রাকে সার্বিকভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের জ্ঞান, ভাষা, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে এই গতিশীলতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। দেখা বা শোনার মধ্য দিয়ে মানুষের যে বিশ্বাস গড়ে ওঠে সেই বিশ্বাসের যুক্তি পরম্পরা যদি জ্ঞান হয় তবে সে জ্ঞান একটি সুসংবদ্ধ গাণিতিক প্রক্রিয়া ছাড়া আর কি? এবং একথা বলার অপেক্ষা রাখে না দেখা শোনা ও অনুধাবনের দ্বারা নিত্যলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিষ্ঠিত প্রান্তেবাসী মানুষের সংস্কার ভিন্ন ভিন্ন হলেও, নিজ নিজ জীবনে একটি স্বতঃস্ফূর্ত যুক্তি পরম্পরার জন্ম দেয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই তার গাণিতিক প্রক্রিয়া চলতে থাকে আপন সত্তায়।

অর্থাৎ Knowledge যদি হয় casual relation তাহলে সেই সুসংবদ্ধ সম্পর্ক কি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই নেই? আছে, তবে একই form এ নয়। এবং তাই গাণিতিকবোধও সর্বক্ষেত্রে এক নয়; বিশেষ করে গাণিতিকবোধের প্রকাশ সবার সমধারায় নয়। A.J. Ayer একেই বলেছেন The Problem of Knowledge বিষয়টি খুব সহজে বোঝা যায় ভাষার ক্ষেত্রে। ‘Referential’, ‘Ideational’, ‘Behavioral’ Theory of Knowledge নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে William P. Alston বিষয়টি সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন তার Philosophy of Language গ্রন্থে। মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য সর্বস্তরের মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করে নিজ নিজ পদ্ধতিতে তাতে সে গাণিতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। এই গাণিতিক প্রক্রিয়ার জন্য তাকে আলাদা করে গণিত শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হয়নি—এটি জীবনছন্দে রঞ্জিত একটি মানস প্রক্রিয়া। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই মানুষের গাণিতিক চেতনাকে পরিশীলিত করতে সাহায্য করেছে এবং প্রকৃতি, মানব সমাজ, মানুষের জানার উৎসাহ। মানুষের মস্তিষ্ক পরিশীলিত গাণিতিক চেতনাকে আজ এমন এক স্তরে উন্নীত করেছে যে তা দেখে মানুষ নিজেই অবাক হয়। দেখে মনে হয় Social Dynamism যেন কখনও কখনও চেতনার গতিকে অতিক্রম করে যায়। অবশ্য অন্য একটি দিকও আছে, গণিত কখনও কখনও কেবলমাত্র বৌদ্ধিক চর্চার বিষয় বলে চিহ্নিত হয়। সম্ভবত সামাজিক গতিশীলতা এবং মনস্তাত্ত্বিক গতিশীলতার ফারাক এই ধরনের বিভাজনের মূল ভিত্তি।

চলবে…

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!