স্তনকর

কাজ ছেড়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে গুরুস্বামীর প্রশ্ন, তোমার কারণেই কি শেষ পর্যন্ত আমাকে এত বড় অপমান সয়ে নিতে হবে? পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখাবো কি করে?
গতকাল স্থানের ঘাটে আমিও এ গুজব শুনেছি।
রামস্বামীর রাসভ কন্ঠে কঠিন প্রশ্ন, তা আমাকে বলোনি কেন ? আবার গুজব বলছ?
নাঙ্গেলি নিরুত্তর।
রামস্বামী বিষয়টা নিয়ে খুব বিরক্ত, ভয়ানক শঙ্কিত। …এখন আর চুপ করে থাকা যায়না নাঙ্গেলি। টানা ১০ বছর তো অবাধ্য হয়ে দেখলে, কতজনকে পক্ষে পেয়েছ? শুরু করেছিলে একা, আজও একাকী পথ চলছ। তুমি ছাড়া এলাকার সব মেয়ে বিষয়টা মর্মে মর্মে বুঝে গেছে। তারা তো দিব্যি বুকে কাপড় না দিয়ে দিন পার করছে। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি? তারপরেও তুমি নিজের পথকে সামাজিক আন্দোলনের পথ হিসাবে ভাববে? রাজার নির্দেশ অমান্য করে এভাবে কিছু পাওয়া যায় না নাঙ্গেলি।
নাঙ্গেলি স্তম্ভিত মুখে রান্না ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে।
একবার ভাবো, ত্রিবাঙ্কুরের সাম্প্রতিক ঘোষণা আমাদের জীবনে কত বড় অপমানের হয়ে উঠতে পারে। তুমি তো শূদ্রঘরের একজন সাধারণ মেয়ে, তাহলে কেন এমন করে নারীর ভূষণ আর সমানাধিকার নিয়ে এভাবে ভাবতে যাবে? দশ বছরের স্তনকর দিতে রাজি না হলে প্রকাশ্য দিবালোকে ১০ জন তাজা পুরুষকে দিয়ে তোমাকে বলাৎকার করার আয়োজন করা হয়েছে। রাজা ত্রিবাঙ্কুরের সেটাই শেষ ঘোষণা। সারা মালাবার জুড়ে এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে টু শব্দটুকু শুনতে পাচ্ছ? সব মানুষের বিশ্বাস, ত্রিবাঙ্কুরের প্রতাপ আগুনের তেজকেও হার মানাতে পারে।
তাহলে তুমি কি ভাবছ?
যে করেই হোক পেয়াদাকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে ১০ বছরের স্তন কর পরিশোধ করে দেব বলে ভাবছি।
নাঙ্গেলির কঠিন প্রশ্ন, এতগুলো বছরের টাকা, অনেক বড় অংক, একসঙ্গে দিতে পারবে?
অন্য পথ আছে কি?
পাবে কোত্থেকে, তা নিয়ে ভাববে না?
রামস্বামীর বিরক্তি, খোলা বুকে চললে তোমার কি অসুবিধা হত শুনি? তুমি বিবাহিত। পাড়ার অন্য সকলে সেভাবেই তো চলে আসছে।
নাঙ্গেলি হতবাক, দুচোখ উগ্ৰ স্বামীর দিকে। দুজনের টানা দশ বছরের সংসারজীবন। লোকটাকে সে কোনদিন এত বেশি বিবাগী হয়ে কথা বলতে শোনে নি। আর প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না। পুরনো অনুভূতি বলেছে, এতগুলো বছর সে রামস্বামীর নিবিড় বন্ধনে রোজ রোজ নতুন করে গর্বিত হতে পেরেছে। কতবার তাকে শুনিয়ে বলেছে লোকটা, তোমার এ অবাধ্যতা…
নতুন এক সামাজিক আন্দোলনের নাম। আগামি দিনে ব্যক্তি জীবনের এ আরাধনাকে মানুষ কুর্নিশ জানাতে বাধ্য হবে। একটা সময় আসবে যখন এ দেশের নারী পুরুষ যৌথভাবে রাজা ত্রিবাঙ্কুরকে অস্বীকার করতে চাইবে। সেই সূত্রে তোমার এ আন্দোলন নতুন সামাজিক ইতিহাস হয়ে উঠবে।
আর এখন সেই লোকটা?
নিজের অবাধ্যতার মধ্যে নাঙ্গেলি তখনও ব্যক্তিগত সীমা ছাড়িয়ে
সমষ্টির প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চাচ্ছে। সেই অলৌকিক বোধের প্রেরণা তখনও তার জীবনে প্রতিদিন সকালে নতুন সূর্য ওঠার মতোই। মনে মনে সেই মুহূর্তে নাঙ্গলি কেমন যেন সব নারীর সমান স্বাধীনতার দাবিতে ভীষণ উদ্বেলিত।
মুখ নিচু করে রামস্বামীর প্রতি নাঙ্গেলির নরম প্রত্যুত্তর, নিয়ম সব নারীর ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। তা কেবল বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক হতে পারে কী? সেই প্রতিবাদেই তো… নারীত্ব রক্ষা নিয়ে এত ভাগাভাগি কেন?
তোমাকে বুঝতে হবে, এ আন্দোলন আমাদের সমাজের মানুষ আজও ঠিকমতো মেনে নিতে পারে নি। তাই নতুন করে ভাবার দিন এসেছে নাঙ্গেলি।
কিন্তু এতগুলো টাকা? সংগ্ৰহ করবে কি করে? কদিন সময় নেবে বলে ভাবছ?
অন্তত দিন সাতেক।
তোমার হাতে এখন সেভাবে কাজকম্ম নেই, তা কী ভেবে দেখেছ?
রুষ্ট রামস্বামীর প্রত্যুত্তর, এ নিয়ে তোমাকে এতটুকু ভাবতে হবে না।
নাঙ্গেলি আর কথা বাড়াতে সাহস পেল না। পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে চলল। ভাবল, লোকটা ঠান্ডা হলে পরে এ নিয়ে কথা বললে বাকিটুকু বুঝিয়ে বলা সম্ভব হবে।
পরের দিন সোমবার। এক পরিচিত পেয়াদা মারফত খবর পাঠিয়ে দিল রামস্বামী, সামনের রবিবার তার পক্ষে নাঙ্গেলির ১০ বছরের স্তনকর মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব।
রাজা ত্রিবাঙ্কুর নতুন করে আশ্বস্ত হলেন, অপরিসীম জয় দেখতে পাচ্ছেন রামস্বামীর পাঠানো খবরে। এইটুকুন একটা মেয়ে, তার পক্ষে এতটা স্পর্ধা দেখানো সম্ভব হল কি করে? তাঁর রাজ্যে কোনো শূদ্র তখনও এতটুকু কৌলিন্য দেখাতে সাহস পায়নি। প্রত্যেক শূদ্রের জানা উচিত, তাদের নিঃশর্ত সেবা বর্ণমানুষের জীবনে কত বেশি সুখভোগের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
খবর দিতে আসা পেয়াদাকে ডেকে ত্রিবাঙ্কুর বললেন, ওই দিন নাঙ্গেলির স্তনের পরিমাপ জানতে লোকও যাবে। পরে পরে নির্দিষ্ট স্তনকর পেতে হলে পরিমাপের অবস্থান জানা খুব জরুরী।
প্রণাম জানিয়ে পেয়াদা বলল, তাহলে আসছি মহারাজ।
আরে, পুরষ্কার না নিয়ে এভাবেই ফিরে যাবে? তোমার মাধ্যমেই তো একটা এত বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কেবল ভাবছি একটা সাধারণ মেয়ে এতদিন ধরে এভাবে সাহস দেখাতে পারল কি করে? টানা ১০টা বছর।একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজার বিরুদ্ধাচারণ করা কত বড় দূঃসাহসের কাজ তা একবার ভেবে দেখেছ? আজ থেকে মেয়েটাকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না আমাকে।
বিশেষ স্বস্তির ঝড়ে রাজা ত্রিবাঙ্কুর একুল সেকুল হতে লাগলেন।
পেয়াদা পরম বিনীত মস্তকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে নিল নিজের অতিরিক্ত পাওনা ।তারপর হনহন পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবল, চাকরি শুরুর দিন থেকে তার জীবনে এই প্রথম জুটল সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রাপ্তি। বেশ অভিভূত হল।
মাঝে মাত্র কটা দিন বাকী, নাঙ্গেলিকে নিয়ে আমমানুষের কৌতুহল বাড়ছে বাতাসের ঘোরে বাড়তি রূপ নেওয়া আগুনের হল্কার মতো। গ্রামের মেয়েদের মধ্যেও কম উদ্দীপনা ছিল না। স্থানের ঘাটে দেখা হতেই খোলা বুকের দেবকী বলল, এ্যই নাঙ্গেলি, সকলের সামনে ওই দিন বুকের কাপড়
খুলতে লজ্জা করবে না তোর?
নাঙ্গেলির মুখে স্মিত হাসি।
একটা রেকর্ড করে দিতে পারলি রে তুই।
কেবলমাত্র রাজার বিরোধিতায় নারীর নিজস্ব সম্ভ্রম কি ত্যাগ করা যায়?
এখনও তেজ দেখাচ্ছিস?
নারীর সম্ভ্রমরক্ষার চেষ্টাকে অপরাধ ভাবছিস?
তোর সোয়ামি তো উল্টোদিকে নুয়ে পড়েছে।
নতুন করে নাঙ্গেলির মনে পড়ল রামস্বামীকে। সাম্প্রতিক সময়ে লোকটা তার জন্যে সত্যি সত্যি ভীষণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দিন পার করছে। তবুও আশ্বস্ত হল এই ভেবে যে কথা দিয়েছে যখন, রামস্বামী সাত দিনের মধ্যে স্তনকরের সমস্ত টাকা পরিশোধ করে দিতে পারবে। লোকটা নিজের কথা নিজেই রূপায়ণ করতে জানে।
আরও দুদিন পার হতেই নানা টানাপোড়েনে জেরবার হতে থাকল নাঙ্গেলি। একটাই হুল ফোটানো প্রশ্নে বারবার ধস্ত হতে হচ্ছে তাকে। বুকে কাপড় থাকল কি থাকল না তা একজন নারীর নিজস্ব সম্ভ্রম রক্ষার ব্যাপার। সেটাকে সে নিজের কৌলিন্য হিসাবেও ভাবতে পারে। তা নিয়ে ত্রিবাঙ্কুরকে চিন্তা করতে হবে কেন? সেই রহস্যপ্রশ্নে আরেকটা দূরের প্রসঙ্গ উঁকি মারছে নাঙ্গেলির মধ্যে। একটা মনগড়া প্রথা কি জোর করে বিশেষ শ্রেণির উপর চাপিয়ে দেওয়া যায়? তাতে কি ব্যক্তি জীবনে গণতন্ত্রবোধ রক্ষা পেতে পারে? বুকে কাপড় রেখে কৌলিন্য রক্ষার তাগিদ এতদিনে সব নারীর নিজস্ব অধিকার হয়ে উঠতে পারল না কেন? তাহলে কি তলে তলে চলছে, দলিত বনাম…
নাঙ্গেলি থমকে থাকল বেশ কিছু সময়। ত্রিবাঙ্গুরের ভাঙাচোরা একপেশে মনোভাব দুচোখের সামনে ছবি হয়ে ভাসছে। আজও লোকটা কঠোর বাস্তবতাকে মূল্য দিতে শিখল না। কিন্তু কোন্ শক্তি বলে? প্রশ্নটা পর্বতপ্রমাণ হয়ে নাঙ্গেলির মধ্যে দোল খাচ্ছে। অস্ফুটে শুধু বলল, এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
রামস্বামী নির্দিষ্ট দিনে টাকা পরিশোধ করতে পারবে কিনা, কিংবা না পারলে নাঙ্গেলির কপালে কি দুর্যোগ অপেক্ষা করছে, সেই বিচিত্র আলোচনা বাড়িতে বাড়িতে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে।
প্রমিলা প্রবীরকে শুনিয়ে বলল, হ্যাঁগো, আমরা তো খোলা বুকে ঘুরছি ফিরছি, নাঙ্গেলির পক্ষে তা মেনে চলতে অসুবিধা হলো কেন? যত সব আদিখ্যেতা।
বামুন হয়ে হাতের মুঠোয় চাঁদ ধরতে চাচ্ছে।
আমারও তাই মনে হয়।
প্রবীর খুব তেজি মদ্দ, তার তির্যক মন্তব্য, পাড়ার মধ্যে মাগীটা খুব বেড়ে গিয়েছিল।
ঠিক বলেছ তুমি , দলিতকে দলিত এর মতো চলতে হবে।
অন্য বাড়িতেও একই আলোচনার ধূম। প্রকাশ মান্ডি, মধ্যম বয়সি, রুপশ্রীকে বলল, মনে হচ্ছে টাকার অভাবে শেষ পর্যন্ত নাঙ্গেলিকে সত্যি সত্যি হারতে হবে।
রূপশ্রীর গুমোট মন্তব্য, তাই তো মনে হচ্ছে। রাজশক্তির কাছে কি পারা সম্ভব?
তোমার খারাপ লাগছে না?
খুব লাগছে।
কেন বলবে?
আমি তো আগে থেকেই হেরে বসে আছি। তাই খোলা বুকে চলতে কোন অসুবিধা হয় না। আজও। কিন্তু নাঙ্গেলি বুক ঢেকে টানা ১০ বছর ধরে নারী
জীবনে সমানাধিকারের দাবিকে সামনে আনতে পেরেছে, যদিও তা এখন…
জানো কি, ওর স্বামী মীমাংসার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
কেন বলো তো?
তুমি তো জানো, রাজা ত্রিবাঙ্কুর কি কঠোর তেজস্বী মানুষ। নাঙ্গেলিকে ঠান্ডা করতে প্রকাশ্যে অনেক পুরুষকে দিয়ে বলাৎকারের হুমকি দিয়েছেন। সেভাবেই নাকি তিনি প্রশাসনের কঠোরতা ধরে রাখতে চাচ্ছেন।
এ তো বড় লজ্জার বিষয়।
তা ভেবেই রামস্বামী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এতদিন সে নাঙ্গেলির সঙ্গেই ছিল। দেখতে চেয়েছিল একটা সামাজিক আন্দোলনের শেষ সোপান।
তা বলেছ ঠিক কিন্তু তিবাঙ্কুরের এ অন্যায় কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আইন হলে তা সবার জন্য হওয়া উচিত।
প্রকাশ গুম মুখে বসে থাকল বারান্দার উপর। ভাবতে পারল যে নারী জীবনের মুক্তি নিয়ে রূপশ্রী রয়েছে নাঙ্গেলির সঙ্গে কিন্তু রামস্বামী কি পারবে নির্দিষ্ট দিনে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে?
প্রকাশ বাধ্য হল আরও গম্ভীর হয়ে উঠতে। রামস্বামীও জানত, প্রকাশ্য দিবালোকে দ্বিতীয় অপমানের প্রসঙ্গ সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে অনেক বেশি যন্ত্রণার।
সেই প্রতীতী নাঙ্গেলি আর ফেলে দিতে পারল না। এমন হলে কোন মুখে তারা গ্রামে বাস করবে? কেউ যে সেই অসম্মানের ভাগীদার হবে না, তাও ভাবতে পারল নাঙ্গেলি। বরং টানা ১০ বছরের লড়াইয়ে মানুষের সামনে নারী স্বাধীনতার জন্য যে বিদ্রোহী সত্তা গড়ে তুলতে পেরেছিল সে, তা মুহূর্তে ধুলোয় মিশে যাবে।
পরের দিন শনিবার। তারপর আসবে রবিবারের সকাল। একটা ভাবনা নাঙ্গেলিকে বারবার তাড়া করছে, রামস্বামী কি পারবে রবিবার পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে? পারলে মধুর সমাপন, না পারলে শুধুমাত্র তাকে নয়, রামস্বামীকেও যারপরনাই হেনস্থা হতে হবে। রাজদরবারে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে কঠোর শাস্তি পর্যন্ত দিতে পারে। তা যে শারীরিক সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাবে, তা নিয়ে নাঙ্গেলির মধ্যে কোন সংশয় ছিল না। আশেপাশে তা নিয়ে কারোর মধ্যে সেভাবে হেলদোলও দেখতে পায়নি সে। যে যার সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। নাঙ্গেলির ইস্যুটা যে একান্তভাবে সামাজিক আন্দোলনের, সেই সত্যিটা যেন কেউ মাথায় নিতে পারেনি।
রবিবার। সকাল দশটা। তম্বি শুরু হল সামনাসামনি। রামস্বামী নির্বাক মুখে দাঁড়িয়ে। ত্রিবাঙ্কুরের এক তলপিবাহকের কড়া হুমকি, এখনিই পাওনা টাকা ফেলে দাও। রাজা ত্রিবাঙ্কুর নিজে এসেছেন, সঙ্গে এনেছেন ১০ জন তাজা যুবক। না বললেই তারা প্রকাশ্যে শুরু করে দেবে। নাঙ্গেলি কোথায়? রাজা ত্রিবাঙ্কুরকে অপমান করার শাস্তি কেবল এভাবেই হয়ে থাকে।
ভয়ে রামস্বামীর শরীরে কাঁপুনি শুরু হল। পাড়ার লোকজন ভিন ভিন করে জড়ো হতে শুরু করেছে। বুক খুলে না রাখার অভিনব কেত্তন প্রাণভরে উপভোগ করতে চায় তারা। সামাজিক সচেতন হয়ে ওঠা রামস্বামীর যত ভয় সেখানেই। টানা ১০ বছর বুকে কাপড় জড়িয়ে চলার চরম মাসুদ মিটে যাবে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে।
দেখতে আসার পথে মিলি তার স্বামীকে শুনিয়ে বলল, মাগীটা খুব বেড়ে গিয়েছিল গো।
জানেনা, জীবনে সহজে হেঁতাল গাছ হয়ে উঠতে নেই। ঝড় ঝাপটায় যে কোনো সময় তা ভেঙে পড়তে পারে।
নবীনের মন্তব্য, এভাবেই ভাবছ?
কেন ভাবব না শুনি? মাগীটার বাড়াবাড়ি দেখে শরীর জ্বলে যায়। এই তো আমরা খালি বুকে রয়েছি, কোনো অসুবিধা নেই কিন্তু ওই মাগীটা তা মেনে নিতে পারল না কেন?
নবীন তখন বিপরীত ভাবনায় ভাবছে। মিলির দুচোখে নাঙ্গেলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন আরও বড় হয়ে উঠছে। …মাগীটা জানে না, তার এ অপমান অন্য সব মেয়েকে কত বেশি ছুঁয়ে যেতে পারে।
রামস্বামীর বাড়ির সামনে তখন বিতন্ডার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সামুদ্রিক জোয়ারের মতো। নাঙ্গেলি ঘরের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। মাঠে-ঘাটে সেও কমবেশি কাজ করেছিল রামস্বামীর সঙ্গে। তাহলে কি মেয়েটা সেই জমানো টাকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে? তাই এত নিশ্চিন্ত?
সন্দেহের নতুন সোপান রামস্বামীর মধ্যে। দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকে দেখল, ভিতর থেকে তালা দিয়ে লাঙ্গেলি ঘরের মেঝেতে বসে রয়েছে। তারস্বরে জানালো, রাজা ত্রিবাঙ্কুর এসেছেন, দিতে না পারলে তো…
ওগো, জমানো টাকাগুলো গুনছি ।তুমি নির্ভাবনায় থাকো। সম্পূর্ণ মিল হয়েও কিছু বেশি থেকে যেতে পারে।
তাহলে তো আর কোনো চিন্তা নেই। চরম অপমান থেকে বেঁচে যেতে পারব, বিড় করে বলল রামস্বামী।
তুমি বরং ত্রিবাঙ্কুরের সামনে গিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলো, একটু পরে আমি যাচ্ছি।
আর এতটুকু দেরি করল না রামস্বামী, দ্রুত পায়ে সেই বিকৃত তল্পিবাহকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
…তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, নাঙ্গেলিকে নিয়ে আর কোনদিন এভাবে অপমানকর কিছু বলবে না।
হতবাক তল্পিবাহকের লাল দুচোখ রামস্বামীর দিকে। আরো মিনিট দুই গেল। গভীর ভাবনাতুর সন্ধিক্ষণ। জনে জনে ফিসফাস শব্দে ব্যস্ত। নাঙ্গেলি এসে দাঁড়ালো রাজা ত্রিবাঙ্কুরের সামনে। ডানহাতের তালুতে ধরা বড় কচু পাতা।
থেমে থেমে নাঙ্গেলির সদর্প উক্তি, যেজন্য দশ বছরের কর আমার উপর দাবি করেছেন, সেই দুটো কেটে এনেছি আপনাকে উপহার দেব বলে।
নাঙ্গেলির বুক ভেসে যাচ্ছে রক্তে। মিলি প্রথম ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর চরম আতঙ্কে সম্পূর্ণ চুপ করে গেল। তার বুকের গভীরে অভিনব অনুভূতিসচল কলকলে ছলছলে বেগবান সমুদ্রস্রোত। শুধু মালাবার নয়, ভারতের সব প্রদেশ, সমস্ত অঞ্চল, শত সহস্র গ্রামে তখন যুগান্তরের নতুন সকাল।#

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!