আমার শৈশব-কৈশোরের পহেলা বৈশাখ

এই তো সেদিনের কথা। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ। মনে পড়ে যায় সেসব দিন। বছরের শেষ মাস- চৈত্র মাস, ভয়াবহ সূর্যের খরতাপ। গাছে গাছে আমের কুড়ি বাতাসে দোলে- ভীষণ রকমের হালকা সুবাস নাকে লাগে। আশেপাশের বাড়িঘরের নিকানো উঠান। বেশীরভাগই টিনের চৌচালা বাড়ি ও মাটির মেঝে। বাড়ির আঙিনায় শীতদিনের ডালিয়া ও গাঁদা ফুলগাছ এবং লাউ, শিমের গাছগুলো শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। এমন খরার দিনে বাড়িঘরে পরিস্কার করার কাজে লেগে পড়ে সবাই। গোবর মাটি দিয়ে লেপাপোছা করে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রথম প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। ঘরের মেঝে ও ডোয়া লেপাপোছা করে আর তাতে আল্পনা আঁকে। চুন বা চাল বেটে জলে গুলিয়ে সাদা রঙের আল্পনা আঁকে। এই আল্পনা ঘরের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। চৈত্র মাসের গরমে আমরা হাঁসফাঁস করি। সেই দিনগুলিতে তালের হাতপাখাই আরামের ভরসা। তালপাখার পাশাপাশি কাপড়ের উপর সুতার কারুকাজ করা এক ধরণের পাখা দেখা যেত অনেক বাড়িতে। ইলেকট্রিক পাখার ঘরে ঘরে ছিল না। বরিশাল শহরে আমাদের ঘরের পাশে আতা গাছের ডালপালা টিনের চালের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে; লাল রঙ ধরা আতা পাকতে শুরু করেছে। ভরদুপরে খাবারের পর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বই পড়তে পড়তে ঘুমোনো একটা রোজকার অভ্যাস। মনে পড়ে চৈত্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষদিকে প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই ঝাড়পোছ শুরু হয়ে যেত। মহল্লার প্রতিটি বাড়ির আনাচে কানাচে জমে থাকা আবর্জনা পরিস্কার করা চাই। আসন্ন বাঙালির সার্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি নেয়া হত চৈত্রের শেষ দুই সপ্তাহ ধরে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। ঘরের কুপি বাতি, লবণের বাটি থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় সবকিছু ধুয়ে-মুছে পরিস্কার করা হত। বিগত দিনের সকল আবর্জনা জঞ্জাল পরিস্কার করে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে প্রায় সকল বাড়ির মানুষেরা প্রস্তুতি নিত। নতুন বছরের মঙ্গল কামনা করে বাড়িতে বাড়িতে ‘জাগ’ দিত। ‘জাগ’ মানে বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় জঙ্গল কেটে সাফ করে উঠানের পাশে ভুর করে রাখা; এরপরে সকাল ও সন্ধ্যাবেলায় নারিকেলের পাতা দিয়ে আগুন ধরানো হয়। জ্বলে উঠে ধোঁয়া বের হলে বাড়ির ছোট-বড় সকলে মিলে সেই ধোঁয়ার চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে ধোঁয়া মাখতো গায়ে আর ছড়া কাটতাম:

‘জাগ-জাগ-জাগ-জাগ, আমাদের বাড়িতে জাগ,
রাজার বাড়ি ধনদৌলত আমাদের আমাদের বাড়িতে জাগ।
বিপদ-আপদ, রোগ-বালাই দূর হয়ে যাক।‘

বর্ষ বরণের আগে তিনদিন ধরে শিশু-কিশোর-যুবা-বুড়া সকলেই ছন্দে ছন্দে সুর দিয়ে ছড়া কাটত আর ধোঁয়া শরীরে মাখতো। আমাদের বাড়িতে ও প্রতিবেশীদের বাড়িতেও চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অর্থাৎ চৈত্রের শেষদিনে ঘরে ঘরে তিতা করলা বেতের আগা, বিভিন্ন ধরনের তিতা শাক, ডুমুর সহ প্রায় সাত-আট রকমের সবজি মিশিয়ে একটি নিরামিষ পদ রান্না করা হত; এখনও বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জির শেষ দিনে তিতার ঝোলের তরকারী খেয়ে বছরকে বিদায় জানানো হয় বাংলা সংস্কৃতিতে।

পহেলা বৈশাখের দিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির নারীরা ;জাগ’ পোড়ানো ছাই ফেলে দিয়ে পান্তা ভাতের পানি ছিটাত সারা উঠোনে ও বাড়ির আশেপাশের খোলা জায়গায়। এরপরে স্নান করে সাদা জমিন লাল পাড়ের শাড়ী পরে ফুল তুলতো। একটি বেতপাতা, একটি জবাফুল বা অন্য কোন ফুল ও পাঁচপাতার আমপাতার সরা ঘরের প্রতিটি দরজায় লাগানো হত। এরপরে তারা সকালের জলখাবারের আয়োজন করতেন।

সকালের জলখাবারে পাতে মিলতো লুচি, পায়েস, হালুয়া, চিড়া, মুড়ি, ছাতু, দই, খই, নারিকেল, কলা, গুড়, বাতাসা, মিষ্টান্ন… একেক বাড়িতে একেক রকম জলখাবার। সকালের জলখাবার গ্রহণ করার পরে বাড়ির গৃহিনীরা দুপুরের রান্নার আয়োজনে আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়ত। কেউ বা শিলপাটার বাটনা বাটত, কেউ শাকসবজি-মাছ-মাংস কুটে রান্না করত। সাধারণত পহেলা বৈশাখে বেগুন ভাজি, আলু ভাজি, মিষ্টি কুমড়া ভাজি, মাছের ঝোল, বুটের ডাল, মুড়িঘন্ট, মাংস- যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী রান্না করা হত বাড়িতে বাড়িতে। চৈত্র মাসে আমাদের কাঁচা আম খাওয়া বারণ ছিল, বাড়ির বড়রা বলত আম জলে না দিয়ে খাওয়া যায় না; সে কারণে নববর্ষের দিনে অনেকেই তাদের ছেলেমেয়ের জন্য আম গুড় দিয়ে এক ধরনের ঝোল রান্না করত, যাকে বলা হত ‘আমের টক’। এরপর থেকে আমরা কাঁচা আম খেতে পা্রতাম। আজকের দিনের মত তখন ইলিশ-পান্তা ও ভর্তা খেতে কাউকে দেখিনি। মহা সমারোহে উদযাপিত হত ‘হালখাতা’ দোকান ব্যবসায়ীরা তাদের পুরনো বছরের দেনা-পাওনার হিসেব সমন্বয় করে নতুন খাতা খুলত যা ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত। পহেলা বৈশাখের দিনে ব্যবসায়ীরা খদ্দের ও আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকেই মিষ্টিমুখ করাতেন। ব্যবসায়ীরা তাদের এই ‘হালখাতা’ সংস্কৃতি এখনও ধরে রেখেছেন। আমরা ছোটরাও দোকানে যেতাম এবং মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ফিরতাম হাসিমুখে।

চৈত্র মাসের শেষ তিনদিন বাড়িতে আসতো একদল মানুষ। মাথায় জটা, ছাই ও নীল রঙ মাখা শরীর, হাতে ত্রিশূল হাতে একজন শিব। শাড়ি পরা একজন নারী যিনি গৌরী সাজতেন। এদের দলে আরও ৪/৫জন থাকতেন যারা সং সেজে শিব ও গৌরির সাথে নাচগান করত। লোকেরা তাদেরকে গাজন সন্যাসী বলত। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে নাচগান করত- এই উৎসব নীলের গাজন নামেই পরিচিত। প্রতিটি বাড়ি থেকে তাদেরকে চাল ও টাকা দিত। খুব মজা পেতাম আমরা ছোটরা। তাদের পিছু পিছু নিতাম আর উপভোগ করতাম।

বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। মা ও দাদুর সঙ্গে মেলায় যেতাম। এলাকার অন্যান্য শিশুরাও মেলায় যেত। আমার প্রথম নজর পড়ত মাটির কোঁদা বা মাটি ঢেলা তৈরি পুতুলের প্রতি। মাটির খেলনাগুলোর মাঝে অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘বুড়ো দাদু’; তুলোর তৈরি শাদা দাড়ি, হোক্কা হাতে, একটু নাড়া লাগলে স্প্রিংয়ের কারণে বুড়োর মুখ কাঁপতো। হাতি, ঘোড়া, বাঘ, হরিণ, শিশুকোলে মা, কলসি কাঁখে গ্রাম্যবধূ ইত্যাদি শিশুদের চাইই চাই। এ ধরনের মাটির তৈরি নানা ধরনের খেলনা কিনে নিয়ে তারা বাড়ি ফিরত। মেলায় অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ ছিল নাগরদোলায় চড়া। মেলায় ঘোরাফেরার শেষে ফুট, তরমুজ, জিলাপি, আমিত্তি, বাতাসা, গুড়ের সন্দেশ, চিনির দিয়ে তৈরি হাতি-ঘোড়া-বাঘ-কুমির কিনে বাড়ি ফিরতাম। আমাদের মধ্যে চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া-কুমির… জমানোর প্রতিযোগিতা হত, কার কাছে কয়টি আছে। কিশোর ও যুবকেরা কিনতো বাঁশের বাঁশি, তালপাতার বাঁশি, ঢোল। সন্ধ্যা হলে বাড়ি ফেরার পরে চারপাশ নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের শব্দে ভরে যেত, রাত্রি না গড়ানো পর্যন্ত সে সুর ভেসে আসত দূর থেকে। নারীরা কিনতো রঙ-বেরঙের কাঁচের চুড়ি, ফিতা, তালপাখা, আয়না, গয়না.., পুরুষেরা কিনতো হুক্কা, পরিবারের জন্য বাসনকোসন, বাঁশের ও নারকেলের নানা তৈজসপত্র ও আসবাব। তারা বৈশাখী মেলায় যেত পাঞ্জাবি, ফতুয়া, লুঙ্গি, ধুতি, পাজামা পরে; কারো কারো কাঁধে থাকত গামছা। মেলার মাঠে হতো লাঠিখেলা, বাউল গান্‌ পুতুল নাচ- এসব ছিল ছোট বড় সকলের প্রিয়। কোথাও কোথাও হতো নৌকা বাইচ- নদীর পাড় ধরে সারি সারি মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে উপভোগ করত নৌকা বাইচ। গৃহস্থ বাড়ির বউয়েরা লাল পাড়ের শাড়ি ও কপালে লাল টিপ পরে পহেলা বৈশাখের মেলায় যেত, কেউ কেউ এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী-পাড়া-প্রতিবেশী-আত্নীয় স্বজনের বাড়ি ঘুরে ঘুরে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করত। একে অপরের মঙ্গল কামনা করে মিষ্টিমুখ করিয়ে তারা আনন্দ পেতেন।

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ, মেলা, লোকজ গান, লোকজ খেলা রকমারী দেশীয় খাবার একে অপরে ভাগ করে নিত— যা বাঙালীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ।

সবাইকে শুভ নববর্ষ।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Print
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!