শক্তি চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩-১৯৯৫) আমার কাছে বাউণ্ডুলে ভবঘুরের মতো। তুড়ি মেরে জীবন ফুরিয়ে দিতে চেয়েছি বার বার তাঁর কাছে। বন্ধ ঘরের দ্বারে ডেকেছি নিজেকে। নীল ভালোবাসায় সোনার মাছি খুন করেছি। নিজেওতো খুন হয়েছি বাঁচার রসদ ফুরিয়ে গেলে। কিন্তু আবার জ্যোৎস্না রাতে একাই আমি স্বেচ্ছাচারী। বিষাদ যখন জমাট ঘন, মেঘ ডেকেছে, বজ্রসহ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে, তখনও প্রেমের হাত ধরেছি। প্রেমের হাতে নিঃশেষে নিজেকে দিয়েছি সঁপে। কেননা, আমি ও আমরা সবাই চলে যাচ্ছি দূরে। ভালোবাসা পাবো বলে, ভালোবাসার চিঠি পাবো বলে হেমন্তের অরণ্যে সবাই আমরা পোস্টম্যান—
‘আমরা ক্রমশই একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি
আমরা ক্রমশই চিঠি পাবার লোভে সরে যাচ্ছি দূরে
আমরা ক্রমশই দূর থেকে চিঠি পাচ্ছি অনেক’ এই চিঠি পেতে পেতে আমরা জীবনের অনুরাগে জড়িয়ে যাচ্ছি। আরশিনগরের মানুষ হয়েও দেখতে চেয়েছি কায়া। সন্তানের মুখ ধরে চুমু খেতে খেতে চাঁদ ও ভোরবেলার স্বপ্ন পাচ্ছি। অরণ্যের চেয়েও পুরনো অরণ্যের ভেতর প্রবেশ করছি। কেননা, হেমন্তের অরণ্যের পোস্টম্যান বলে পাথরের নীল ঠোঁটসহ পাতার ছাপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে হলুদ ঝুলি ভ’রে আবহমান কালের পথিক আত্মিক ভ্রমণের যোগে ভুবন জোড়া পরিক্রমা। এই তো তোমার ব্যাপ্তি, বস্তুতে বস্তুতে আনো জাগরণ, হিয়ার মাঝে জাগাও হিয়া। তোমার অনুভূতির পরাগ উড়ে আকাশ-পাতাল নড়ে ওঠে।
আত্মনিরীক্ষণ যখন এভাবে পর্যাপ্ত স্বয়ংক্রিয়তায় বিস্তৃতির অমোঘ বাতাবরণ খুলে দেয়, তখন কবিমানসের চৈতন্যের ঘোরে আদি ও অনন্তের ডাক দীর্ঘ অবস্থিতির ছায়াপাতে নিজস্ব অন্বয়টি জানান দেয়—
‘বয়স অনেক হ’লো নিরবধি তোমার দুয়ার
অনুকূল চন্দ্রালোক স্বপ্নে স্বপ্নে নিয়ে গেলো কোথা?
নাতি-উষ্ণ কামনার রশ্মি তবে লাক্ষারসে আর
ভ’রো না, কুড়াও হাতে সামুদ্রিক আঁচলের সীমা।’
‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ কাব্যের এই অমোঘ মুক্তি এক মোহময় আকর্ষণে আপতিক সুখের নিরালা হয়ে বিষাদের চরাচর সুগন্ধী বনফুলে ঢাকার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। শিল্প এখানে প্রাকৃতিক প্রেমিক পুরুষের আঁকা ছবি। সেখানে তো অভিমান ভরা আকাশ। যদিও বাগান, বাগানের ফল সবই মনুষ্যবেষ্টিত জীবনচর্চার সুখ-দুঃখ, অতিশয় প্রেম পথিকের। কবি বলেন—
‘অতগুলি বাগানের তীব্র ফল, আমি একা
অস্ত্রের গৌরবহীন
পড়ে আছি।’
অস্ত্র কেন গৌরববিহীন হবে? অস্ত্র যখন প্রেম তখন তো তার ‘স্তব্ধ লোভ’ থাকবেই। সুতরাং প্রেম গোপনের, প্রেম প্রকৃতির, প্রেম না-বলার এবং প্রেম অসুখের। তাকে বহন করে নিয়ে চলাই প্রেমিকের ধর্ম।
‘প্রেম’ কবিতাতেই কবি লিখলেন—
‘অবশ্য রোদ্দুরে তাকে রাখবো না আর ভিনদেশি গাছপালার ছায়ায় ঢাকবো না আর
তাকে বইবো বুকের গোপন ঝরে
তার পরিচয়? মনে পড়ে মনেই পড়ে।’
এই ‘মন’ নিয়েই বিরাট মনের অন্তঃস্থলে কবি পৌঁছে যান। আমরাও পৌঁছে যাই। চাঁদ, ব্রিজ, ট্রেন, ইস্টিশন সব প্রেমের জংশন অথবা লেবেল ক্রশিং পার হয়ে সমুদ্রে-পহাড়ে-আকাশে-নিসর্গে এই প্রেমের বাঁশি বেজে চলে আর বাউণ্ডুলে জীবনের অসংকোচ প্রেমচরিতনামা লিপিবদ্ধ হতে থাকে। ‘পৃথিবীতে আমরণ প্রেম আর শয়নঘর ছাড়া কিছু নেই’ তাই স্বপ্নের স্টিমারগুলো রুপোলি মাছে ভরে যায়। এই ইচ্ছাময়তা থেকেই সমূহ হাওয়া ওঠে। ধর্মেও জিরাফেও হৃদয়পুরের ডাক শোনা যায়। এই ইচ্ছাময়তা থেকেই কবি লেখেন—
‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’
মৃত্যুর সমদ্র পার হয়ে জীবনের গুঞ্জনের কাছে কবি পৌঁছাতে চান। বাঁচতে চান মৃত্যুর ওলোট পালোটের মধ্যেও। বাঁচা তো ভালোবাসারই ধর্ম।
আরশিনগর ঘুমিয়ে গেলেও জাগরণের পাড়া জেগে থাকে। তখন নিজেকে ডাক দেন, আত্মজাগরণের সেই ডাক যে মৃত্যুর দরজা খোলার এবং জীবনকে সেই ঘরের ভেতর থেকে বের করে আনার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজ সত্তাকে কবি এভাবেই জাগিয়ে তোলেন—
‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া
অবনী বাড়ি আছো?’
অবনী তো আমরা সবাই। মায়া-মৃত্যুর স্পর্ধায় ঘুমিয়ে পড়া অস্তিত্বকে টান মেরে তুলে ধরার বার্তা রহস্যময় জাগতিক প্রজ্ঞায় চিরন্তন এক Traveller-এরই কর্ম, যে Traveller-এর কথা Walter De La Mare তাঁর ‘The Listeners, কবিতায় বলছেন। আমরা সেই কড়া নাড়াই শুনি শক্তির কবিতায়। দরজার বাইরে মানবের এই কণ্ঠস্বর বেজেই চলে চিরন্তন কালের কড়া নেড়ে।#