বাংলাদেশ বিমানের নতুন বিমানের নাম: ‘ধ্রুবতারা’। কবি অভিজিৎ দাস বরিশাল শহর থেকে যে কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, তার নামও ছিল: ‘ধ্রুবতারা’। অভিজিৎ ২০১৪ সালে ঢাকায় তার বাসা থেকে বেরিয়ে, তারপর কেন ফিরলেন না ঘরে? তিনি সত্যি যদি হারিয়ে যান অন্তহীন সময়ের অন্ধকারে চিরতরে, তাহলে কে তাকে দিয়েছিল ওয়াটার ক্যানন স্যালুট, যেভাবে এয়ারক্রাফট ‘ধ্রুবতারা’কে দেয়া হয়েছে ঢাকার বিমানবন্দরে। সত্যি কি ঘটেছিল তার সঙ্গে? অভিজিৎ আশির দশকের কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতাকে গান করে তার কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন:”শুধু মৃতদের গল্প কত আর কাঁধে ঝুলে যাবে/ এবার নিষ্কৃতি পেলে, শান্তি অন্বেষণে মহাকাশে/গিয়ে, দু’টুকরো লোহা ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দেব/ অসহ অসীম শব পুড়ে হোক ছাই পুড়ে ছাই।” বিষ্ণু বিশ্বাস ১৯৯৩ থেকে ২০১০ এ সময়কাল ভারতে একরকম অজ্ঞাতবাসে কাটিয়েছেন, বাংলাদেশের তার বন্ধুদের কাছে কোনও খোঁজ ছিল না। পরে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রামে তাকে পাওয়া যায়। তার বহু আগে থেকে অভিজিৎ বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতায় সুরারোপ করে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন। ভাবি, হয়তো একই রকমভাবে অভিজিৎকেও পাওয়া যাবে। তার সঙ্গে বরিশালের বগুড়া রোডে জীবনানন্দের বাড়ির সামনে কিংবা বিবির পুকুর পাড়ে কিংবা কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে আবার একদিন আমার তুমুল আড্ডা হবে।
মূলতঃ আমার কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার হাতেখড়ি তার হাতে। তখন আমাদের পরিবার বরিশাল শহরের ফকিরবাড়ি রোডে থাকতো। আমাদের বাসায় দৈনিক জনকণ্ঠ নিয়মিত রাখা হতো। সে পত্রিকায় ছোট কাগজ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশিত হতো প্রতি শুক্রবারের সাহিত্য পাতায়। সেখান থেকে জানলাম স্বাধীন সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ছোটকাগজের কথা। এমন একটি পত্রিকা আমিও প্রকাশ করবো এমন একটি ভাসা ভাসা ধারণা থেকে বইয়ের দোকানগুলোতে নিয়মিত ঘুরতাম, ক্লিপে ঝুলে থাকা পত্রিকা-বইগুলোর দিকে চোখ রাখতাম। হঠাৎ একদিন বিবির পুকুর পাড়ে বোবার দোকানে দেখতে পেলাম একটি শাদা প্রচ্ছদে লাল ড্রইংর করা অভিজিৎ দাস সম্পাদিত শীর্ণকায় একটি পত্রিকা ঝুলছে। নাম ‘ধ্রুবতারা’। সম্ভবত সেটি ছিল পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যা, যতদূরে মনে পড়ে প্রচ্ছদে পূর্ণেন্দু পত্রীর একটি ড্রইং দিয়ে করা হয়েছিল। পত্রিকা কিনে সেখান থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে চলে গেলাম সোজা সাগরদী সালাম চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থিত অভিজিৎদের ভাড়া বাসায়। এভাবেই পরিচয়। তারপর প্রকাশ করলাম আমার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা ‘আরণ্যক’। মাঝেমধ্যে আরও ছোট ছোট কিছু ভাঁজপত্র। যেমন: ‘প্রতিকৃতি’। আসলে সেময়ে তো আমরা ছাত্র। সুতরাং আমাদের পত্রিকাগুলো ক্ষীণ স্বাস্থ্যের হতো।
অভিজিৎ দাস মাঝে মাঝে বলতেন তার বন্ধু কবি সফি সরকারের কথা। কবি সফি সরকারও ঘরে ফেরেননি, কয়েক বছর আগে কবি সফি সরকারকে কে বা কারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল! একজন নাগরিক, একজন প্রতিভাবান তরুণ কবি হারিয়ে গিয়েছে কিংবা তাকে গুম করা হয়েছে—বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার রহস্য উদঘাটন করার জন্য কিছু করেনি!
অভিজিৎ এর সঙ্গে একসময়ে প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। আমি মূলত তাকে ডাকতাম ‘অভিদা’। সাগরদীতে তার বাসায়, বাসা সংলগ্ন সুখরঞ্জন রায় (বাদল) এর মেসে, কীর্তনখোলা নদীর পাড়ের বহু জায়গায়, নৌকায়, তার পৈতৃক বাড়ি কালিজিরা ব্রীজের কাছে বাজারে, সদর রোডে, বিবির পুকুর পাড়ে, হস্তশিল্প বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘কাঠবিড়ালী’তে, বরিশালের বিভিন্ন প্রেসে, চায়ের দোকানে, কদাচিৎ ঢাকায়, শাহবাগে বা আজিজ সুপার মার্কেটে, একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে অনেকবার বাড়ি ফিরেছি। কত কথা, কত সাহিত্য আলোচনা, সারা দেশের লিটলম্যাগের খবর, কখনো ঢাকা থেকে ফিরে এসে অন্য লেখকদের বইয়ের অতিরিক্ত কপি আমাকে দিয়েছেন, কিংবা তার নিজের কপিটাই পড়তে দিয়েছেন, কেউবা তার মাধ্যমে আমার কাছে পত্রিকা মানে আমার লেখক কপি পাঠিয়েছেন। তার মাধ্যমেই পরিচয় কিংবা দেখা হয়েছে আরও অনেক লেখক-শিল্পী-ছোটকাগজের সম্পাদকের সঙ্গে, তাদের মধ্যে বরিশালের ছোটকাগজের নব্বই দশকের আমার প্রিয় অগ্রজ লেখক ও কবিরা আছেন, যেমন: হেনরী স্বপন, কবি সাইদ র’মান, ছোটগল্পকার সৈয়দ ওমর হাসান, কবি র’মান র’মান—যাদের ভালোবাসা ও স্নেহ আমি পেয়েছিলাম। এছাড়া আমার সময়ের অর্থাৎ শূন্যের অনেক কবি-লেখক-সম্পাদকদের সঙ্গে অভিজিৎ এর মাধ্যমে পরিচয় ও দেখা হয়েছে।
আমি কম্পিউটার পরিচালনার কাজ শিখেছিলাম মূলত আমার সম্পাদিত পত্রিকার কাজের জন্য। সেসময়ে তিনি তার প্রথম গ্রন্থ ‘নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙ্গা কেমন সবুজ’ গ্রন্থের পাণ্ডূলিপি তৈরি করবেন। পরিকল্পনা মতো তিনি তার কাছে থাকা যেসব ছোটকাগজে তার কবিতা ছাপা হয়েছে সেসব একত্র করলেন, আমিও আমার কাছে থাকা সারা বাংলাদেশের যেসব ছোটকাগজে তার কবিতা ছাপা হয়েছে—আমার কাছে যা ছিল সেগুলো এক করে সদর রোডের বিবির পুকুর পাড়ে গিয়ে সেসব তুহিনের দোকানে একসঙ্গে ফটোকপি করলাম। সে ফটোকপি নিয়ে তিনি ঢাকা গেলেন। আমাদের দু’জনার একসঙ্গে করা তার এ কবিতার ফটোকপি থেকেই মূলত তিনি তার প্রথম দু’টি কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডূলিপি তৈরি করেন। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম আমার যতদূর মনে পড়ে তা হলো ‘মাটির চামচ মুখে’। ‘মাটির চামচ মুখে’র ওপর ড. সৌমিত্র শেখর ‘দৈনিক সমকাল’ এর সাহিত্য সাময়িকী ‘কালের খেয়া’ পত্রিকায় ‘মাটিতে বাস মাটিতে সুবাস’ শিরোনামে একটি সমালোচনা লিখেছিলেন। বাংলাদেশে কবিতার সমালোচনার সাহিত্যের বর্তমান যে দুর্ভিক্ষ চলছে সে সময়ে ড. সৌমিত্র শেখরের তরুণ এক অখ্যাত কবিকে নিয়ে লেখাটি আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। অভিজিৎ-এর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ’ মূলত ঢাকায় বসে নতুন কবিতাগুলোর সংকলন। ২০১২ কিংবা ২০১৩ সালের দিকে তিনি বেশ নতুন লেখা কবিতা নিয়ে সম্ভবত ঢাকা থেকে ফেরেন। সেসময়ে তিনি বরিশালে কিছুদিন ছিলেন। ঢাকা তার কাছে নানা ব্যক্তিগত কারণে দূর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। তিনি খুলনার দিকে কোথাও বন্ধুদের কাছে চলে যাবেন। আমাকে বললেন তার কাছে নতুন কিছু কবিতা আছে, মূলতঃ আলগা বা নানারকম সাইজের ছুটা কাগজের ওপর লেখা। সেসময় তিনি লেখার সঙ্গে ছবিও আঁকতেন, সেসব ছবি কবি সাইদ র’মান এর আঁকা দ্বারা প্রভাবিত। সে যাহোক, আমি সে কবিতা টাইপ করলাম। তারপর আমরা সেগুলো নিয়ে কবি অপূর্ব গৌতমের কাছে গেলাম। গৌতম দা, একটি ছোট সাইজের গ্রন্থের ফরমেটে এডোবি ইলাসস্ট্রেটরে তার ডিজাইন করে দিলেন। সে ফাইল নিয়ে অভিজিৎ চলে গেলেন খুলনার দিকে কোথাও। সেখান থেকে প্রকাশিত হয় তার আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘করপল্লবসঙ্গিনী’। আমি মনে করেছিলাম অভিজিৎ ওদিকে বেশ কিছুদিন থাকবেন। না, তিনি আবারও বরিশাল ফিরলেন। ‘ভাঙা আয়নার প্রতিবিম্বগণ’ ও ‘করপল্লবসঙ্গিনী’ প্রকাশের মাঝে তার অনেক কবিতা লেখা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল, তার কিছু কিছু আমার কাছে ছিল। বরিশাল ফিরে তিনি যেগুলো আমার কাছে যা ছিল সেগুলো আবারও সংগ্রহ করলেন, আবার তার কাছেও অনেক লেখার কপি ছিল। সব মিলিয়ে তিনি বললেন যে একটি নতুন কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডূলিপি দাঁড়িয়ে যাবে। আমি দ্রুত টাইপ করে দিলাম। তিনি সে পাণ্ডূলিপি নিয়ে বইমেলার আগে আগে ঢাকায় চলে গেলেন। কিন্তু যে প্রকাশনীর কথা আমাকে বলেছিলেন সেখানে বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের এক তরুণ গবেষক চাকরী করতেন, কিন্তু তারা কবিতার বই করবে না। নিখোঁজ হবার আগে আগে তিনি যেবার শেষ বরিশালে ফিরে এলেন তখন তিনি আক্ষেপ করে এসব আমায় জানিয়েছিলেন যে, কবিতার বই এসব বড় প্রকাশনীও করতে চায় না—তারা তাকে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে বলেছে, যা তিনি চান না, তিনি চান সৃজনশীল লেখাপত্র লিখতে, তিনি নন-ফিকশন লিখতে চান না। যারা তার কবিতার বই ছাপেনি, তাদের নাম আমি জানি, তাদের সঙ্গে পরে দেখা হয়েছে আমার, দেখা হলে তারা অভিজিৎকে নিয়ে মরা কান্না করতো। তার সঙ্গে টুকটাক মুঠোফোনেও কথা হতো। যদিও নানা পরিস্থিতির কারণে মুঠোফোন তার সবসময় থাকতো না। নাম্বারও পরিবর্তন হত। এ পাণ্ডূলিপির নাম দিয়েছিলেন ‘সারাটা আঁধার বেড়াবো মাতাল কুসুম বনে বনে’। আমি ২০১৬ সালে আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠানের স্পন্সরে করনেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে আসি। তারপরে স্বদেশে এখনও ফেরা হয়নি। দেশ থেকে আসার আগের বছর অভিজিৎ এর পরিবারের (বোনের) লিখিত অনুমতি নিয়ে পুরো গ্রন্থটি আমাদের ‘আরক’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করি, প্রকাশক ছিলেন নরওয়ে প্রবাসী ভায়লেট হালদার। আমার একটু ভয়ও ছিল কখন অভিজিৎ এসে ধমকে দেবে কিংবা হাসবে হো হো করে যে আমাকে গুম বানিয়ে দিয়ে লেখা ছেপে দিয়েছো এর মধ্যে? বিখ্যাত হবার সুযোগ নিচ্ছো নাকি? আর একটু অপেক্ষা করা যেতো না?
বাংলা কবিতার শূন্য দশক, ২০০০ সাল থেকে শুরু। পৃথিবী, দেশ, আমাদের সমকাল কতোটা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল সে সময়ে তা কেবল আমাদের তারুণ্য জানে। কে জানে, হয়তো প্রতিটি প্রজন্মের সামনে আসে এমন গ্রহণকাল যেসময়ে তারা কোথাও খড়কুটো ধরে একটু বাঁচার চেষ্টা করে, নিজের পায়ে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে। প্রতি বছর খবর আসতে লাগলো, পর পর জীবনের খাতা থেকে নাম কাটা গেল কবি রাকিবুল হক ইবন, কবি সুমন প্রবাহন ও কবি অনন্ত জাহিদের। অভিজিৎ মাঝেমাঝে ‘বুকটান’ পত্রিকার কথা বলতেন। এ ছোটকাগজটির একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে আজ থেকে দশ বারো বছরের আগের কোন এক পৃথিবীতে। সম্পাদক ছিলেন রাকিবুল হক ইবন, সুমন প্রবাহন, অভিজিৎ দাস। অভিজিৎ কখনো বিষাদাক্রান্ত হয়ে বলতেন:”এই দুই সম্পাদক প্রয়াত; এবার হয়তো আমার পালা।” শুনে রাগ করতাম। কিন্তু সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিতে পারতাম না। কিন্তু এ নিয়ে আলাপ করতে আমার ভালো লাগতো না, কারণ আমার নিজের জীবনেও বেকারত্বের হতাশা তখন ছিলো। অভিজিৎ ঢাকা থেকে অন্তত দু’টো আত্মহত্যার খবর ফোনে আমাকে দিয়েছিলেন। সুমন প্রবাহন ও অনন্ত জাহিদের স্বেচ্ছামৃত্যুর খবর। অনন্ত জাহিদের সঙ্গে আমার বরিশালে দেখা হয়েছিল। তখন তাকে বলেছিলাম আমাকে কিছু লেখা পাঠাতে। তিনি ভোলা ফিরে গিয়ে পাঠিয়েছিলেন একটি অপ্রকাশিত কাব্যনাটক। আমি সে পাণ্ডূলিপি পাঠাই রাজশাহী থেকে প্রকাশিত শহীদ ইকবাল সম্পাদিত ‘চিহ্ন’ ছোটকাগজে। ‘চিহ্ন’ সে কাব্যনাটক ছাপে তাদের পত্রিকায়। আমার কাছে লেখক কপি আসে। কিন্তু আমার আর সে কপি পাঠানো হয় না অনন্তকে। অনন্ত হঠাৎ পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। ইবন আর অভিজিৎ ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইবন যখন সময় পেতেন বরিশাল ছুটে আসতেন অভিজিৎ এর কাছে। সেখান থেকে তারা হয়তো ভোলার চরফ্যাশনে কবি ইমরান মাঝির কাছে চলে যেতেন। ২০০১ সালে আমার ‘আরণ্যক’ পত্রিকায় সুমনের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি অভিজিৎ আমাকে ছাপতে দিয়েছিলেন। সেসময়ে তার কাছে ঢাকার ‘কালনেত্র’ গ্রুপের লেখাপত্র থাকতো। সুমনের কবিতাটির নাম ছিল ‘একা’; কবিতাটি এমন:”একাকীত্ব বোধ তৈরীর অনেক আগে থেকেই/আমি একা/একা দিঘী একা ঘাট/একা নদী একা পথ।/একা রাতে একা পথে/একা এক একা রথে/পৌঁছে যাই ঈশ্বরের গৃহে/আর কথায় কথায় জেনে যাই/ঈশ্বরের অসীম একাকীত্বও/আমার একাকীত্বের কাছে একা।” সে সময়ে কবিতাটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিল আমাদের মাঝে। পশ্চিমবঙ্গের নব্বই দশকের কবি চিত্তরঞ্জন হীরা আমার পত্রিকা পড়ে তিনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তিনি লিখেছিলেন:”…সুমন প্রবাহন এর ‘একা’ আমাকে নাড়িয়ে দেয়।… আশ্চর্য ভাবনা থেকেই এই পঙক্তির জন্ম হতে পারে।” চিঠিটির অংশবিশেষ আমার পত্রিকার ‘দায়গ্রস্ত কয়েকজন’ কলামে জুন-জুলাই ২০০১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সুমনের প্রয়াণের পর চট্টগ্রামের মনিরুল মনিরের ‘খড়িমাটি’ পত্রিকায় আমি একটি গদ্য লিখেছিলাম, গদ্যের শিরোনাম ছিল ‘পেগাস্যাস’। তার ছোট ভাই তসলিম ‘সুমন প্রবাহন স্মরণ প্রয়াস’ থেকে ‘শূন্যমাতাল’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকার কিছু সংখ্যা করেছিলেন। তার প্রথম দিকের সংখ্যাগুলোর সঙ্গে অভিজিৎ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা সম্পাদনার দায়িত্ব আমার হাতে আসে, আমি তখন চট্টগ্রামের শহর থেকে ‘ব্রাক’ এর চাকরী ছেড়ে দিয়ে আবার বরিশাল ফিরে এসে মাস্টার্স এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তসলিম তার কিছুদিন আগে বরিশালে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীতে চাকরীর সূত্রে এসেছিলেন, তখন সংক্ষিপ্ত পরিচয় হয়েছিল, সে সূত্রে তিনি সে সংখ্যার কাজ আমাকে ঢাকা থেকে দিলে আমি এটিকে একটি কবিতার পাণ্ডূলিপি সংখ্যা হিসেবে সম্পাদনা করি, যা ১১ নভেম্বর ২০১০ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়, যাতে ছোটকাগজের লেখকদের মাঝে বরিশালের মাত্র আটজন কবির কবিতা নিয়ে মোট ১৬০ পৃষ্ঠার পত্রিকাটি বের হয়েছিল।
অভিজিৎ হারিয়ে যাবার আগে বরিশাল শেষবার এসেছিলেন, রতন মামার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম:”বরিশালে স্থায়ী চলে আসেন।” প্রতুত্তর করেছিলেন,”ফেরার রাস্তাগুলো বড় ঢালময়।” অভিজিৎ এর একটি গিটার ছিলো। তিনি তা বাজিয়ে নিজের লেখা গান করতেন:”গোঁসাইয়ের কপাল এমন ফলে সাড়ে তিন মণ/দুই মনের বিক্রি শেষে/আধ মণ যায় খাজনা দিতে/এক মণ যায় পশুপক্ষির পেটে/লো ভোলা মন।/রূপের রসিক জন্মাবধি/ফসল ফলাই পাওনা সুধি/মনমোহিনীর উপোস নিরবধি,/লো ভোলা মন।/দিন ফুরাইলে রাত্রি আহে/আমার ঘরে চাঁদ না বহে/অমাবস্যার ঘোর তো দিবানিশি/লো ভোলা মন।” এ লেখাটি তিনি গান হিসেবে লিখেছিলেন। এ গানটির বেশ সুন্দর একটি নতুন সংস্করণ গেয়েছেন শিল্পী ইন্দ্রনীল মজুমদার। এছাড়া কবি জীবনানন্দের দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় সুরারোপ ও তা গেয়েছিলেন তিনি, যার একাংশ শূন্য দশকের বরিশালের আরেক কবি সাঈফ ইবনে রফিক পরিচালিত ডকুমেন্টারি ‘মানুষ জীবনানন্দ’তে সংযুক্ত করা হয়েছিল। অভিজিৎ কবি সুমন প্রবাহনের কবিতা ‘পতন’ এর সুরারোপ করেছিলেন ও গেয়েছিলেন। ঘোরলাগা এ কবিতাটি এমন:”ভূতগ্রস্থ মহাশূন্যে ঝাঁপিয়ে মেলেদি’ দু’হাত/শুনশান পতন নামে অস্তিত্বের চরাচরে/পতন ডানার এ ঝাঁপে হারিয়ে ফেলি সময়/বুকের ভিতর ওৎ পাতে সময়হীন মহাকাল/স্থানিকতা শূন্য এ যাত্রায়,/যা দেখি সেখানে চোখ নয়/যেখানে চোখ সেখানে দৃষ্টি নয়।/সমাধিস্থ আত্মার পর্দা ছিঁড়ে তাকালে,/পৃথিবী নামে/ঘরে কবরের দাগ/ঝোড়ো কাকের মড়ক সংসারে/কোথায় আমি!/জানি না, জানার নেই।/অন্ধকার রাতে নিজস্ব নক্ষত্রের পাহারায়/অনেক চেনা কবরের অচেনা অন্ধকারে/কংকালের গলা জড়িয়ে ধরি/মা, আমার গায়ে খুব জ্বর।”
অভিজিৎ দাসের নাম কতো পত্রিকায় যে ভুল এসেছে তার ইয়ত্তা নেই, এ নিয়ে তাকে মজা করতে দেখেছি, জীবনানন্দের শেষে নামে ‘দাশ’ দেখে আমাদের সম্পাদকরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন! সে কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় অভিজিৎ ও আমার দু’জনার নামে অনেকবার ‘দাশ’ ছাপা হয়েছে, আসলে হবে ‘দাস’। আমি এর মাঝে প্রভাতকুমার দাসের লেখা জীবনী ‘জীবনানন্দ দাশ’ প্রামাণ্য গ্রন্থটির পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমি কর্তৃক আগস্ট ২০১৩ এ প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণের ‘বিশেষ সংখ্যা পত্রপত্রিকার বর্ণানুক্রমিক তালিকা’য় একই ব্যাপার লক্ষ্য করলাম [পৃষ্ঠা: ৩৬৪]।
অভিজিৎ একাধারে যেমন বিমূর্ত কবিতা লিখেছে, তেমনি সে প্রতিবাদী হয়েছে তার গানে ও কবিতায়, যেমন: পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে তার রচিত এক কবিতা ‘পোশাক’। তাতে লিখেছিলেন: “সেলাই মেশিনে ছুটছে তুমুল গতি/লজ্জারা যত লুকোচ্ছে এসে/পোশাকের আবডালে/তোমার কণ্ঠে এনে দিতে পরিমিতি/রাষ্ট্র নেমেছে; আধপেটে বাঁচো/কোনোমতে চালে-ডালে/সকালে এসেছ, রাত হলে হবে ছুটি/ক্যারিয়ার ভরা টিফিন ছিল যা সাথে/তাই ভাগ করে কোনোমতে ডাল-রুটি/’কাজে হাত লাগা…চুপ যা! হাড়হাভাতে’…/তবুও এমন কারখানাতেই তুমি/দিন আনো-রাতে খেতে পাও না তো রোজ/শিশুর কপালে পোড়াচাঁদ যায় চুমি/সাহেবের ঘরে পার্টি, পানীয়, ভোজ!” ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠির সমালোচনা করেছেন তিনি যারা দুর্বলের দুঃখ-দুর্দশার ওপর দাঁড়িয়ে মুনাফা লোটে, অথচ তারা ভান করে যে তারা দুর্বলকে সাহায্য করছে, কিন্তু তাদের দুর্দশাও দেখতে চায়। বঞ্চিত মানুষের পাশে কলম নিয়ে দাঁড়ানো ছিল অভিজিৎ এর চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ধর্মীয় অন্ধত্ব ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ২০১৩ সালে বরিশাল শহরের টাউন হলের সামনে স্থাপিত গণজাগরণ মঞ্চে তাকে উদাত্ত কণ্ঠে গান গেতে দেখেছি। এমন জলজ্যান্ত মানুষটি তার পরের বছর হঠাৎ হারিয়ে যাবেন তা মেনে নেয়া যায় না। মাঝেমাঝে তার শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধুদের দেখা যায় তাকে নিয়ে নস্টালজিয়া প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখতে, যেমন: মনজুরুল হক ওলী লিখেছেন:”কাল স্বপ্নে দেখছি অভিজিৎ ফিরে আসছে।” কবি হেনরী স্বপন লিখেছেন:”কবি অভিজিৎ এর এই কাব্যিক অন্তর্ধান, হয়তো সাময়িক…”। ছোটগল্পকার কুলদা রায় লিখেছেন:”…কবির জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।” ঈয়ন প্রশ্ন করেছেন,”অভিজিৎ দাস নিরুদ্দেশ, না গুম?” কবি সিদ্ধার্থ টিপু লিখেছেন:”ছবির হাটে সন্ধ্যা নামে। নতুন পুরোনো কতো শত চেনা-অচেনা মুখের ভিড়ে মুখরিত হওয়া সেই সন্ধ্যাগুলো। আলো-আঁধারিতে একজন অভিজিৎ গিটার হাতে ছয়টি তারের মিহি সুরে মিলিয়ে যায় গাঢ় অন্ধকারে।” শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘উঠান’ পত্রিকায় অভিজিৎ নিয়ে কবি সোমেশ্বর অলি একটি কবিতা লিখেছেন, কবিতার নাম ‘অভিজিৎ দাস’, সে কবিতাটির উল্লেখ করে আমার এ লেখাটি শেষ করছি:”এখনো থামেনি শ্লোগান, ধমনিতে টের পাও উপহাস!/যে কবিতা ধাবমান, তার বুকে ছুরি, কালো ইতিহাস–/নিখোঁজ মানুষ এক, ভাবা যাচ্ছে না প্রয়াত,/এভাবে অমর সে–/মিছে তোমাদের শোকসভা, জমায়েতও।/বেকার গানের সুর, কাঁটাতারে এখনো বন্দি বাতাস,/ঘরে ঘরে তোমাদের সকলের অজ্ঞাতবাস।” রাষ্ট্রীয় ঘেরাটোপের মধ্যে কবে মানুষের এ অজ্ঞাতবাস শেষ হবে? কবে রাষ্ট্র জবাবদিহিতা করবে কেন একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক নিখোঁজ হলো? মানুষটার কি হয়েছিল? কেউ কি ছিল তার হারিয়ে যাবার নেপথ্যে? এ সত্য আমাদের সামনে কবে আসবে? এর জবাব কে দেবে? উত্তর মেলে না। শুধু মুচকি হাসে অন্ধকার। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস সত্য চেপে রাখা যায় না। সত্য একদিন উদঘাটিত হবে।#