১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ তারিখ থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে চার-পাঁচমাস ব্যাপী তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলন দুর্বারগতিতে চলেছিল। স্বামী সচ্চিদানন্দ সেই আন্দোলনের সভাপতি ছিলেন। আন্দোলনটির পরিচালকদের মধ্যে স্বামী বিশ্বানন্দ— আসানসোলের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। আর আন্দোলনটির প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল তখন হুগলি শহরের মোগলপুরা লেনের বাড়িতে থাকতেন। অধুনা বিস্মৃত কিন্তু বৃটিশ আমলের বাংলার ইতিহাস বিখ্যাত এই আন্দোলনটির ইতিহাস জানতে হলে কিছু পুরোনো ঘটনার কথা না জানলে এটির তাৎপর্য যেমন বুঝতে পারা সম্ভব নয়, তেমনি নজরুলকেও বুঝতে পারা সম্ভব নয়। নজরুল ইসলাম এই আন্দোলনের সঙ্গে কেন যুক্ত হয়েছিলেন? নজরুল তখন যে ‘মোহ-অন্তের’ গানটি রচনা করেছিলেন, সেটি কতটা ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার ওপরে নির্ভর করে তিনি লিখেছিলেন, সেকথা এই আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে পরিচিত হলেই বুঝতে পারা সম্ভব। একইসাথে একথাও বোঝা যাবে যে, সেযুগের সাধারণ মানুষের কাছে নজরুলের লেখা এই গানটি কেন অতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাই বর্তমান সময়ের পাঠক-পাঠিকাদের জন্য প্রথমেই অল্পকথায় তারকেশ্বরের মোহন্তদের অপকীর্তির কিঞ্চিৎ ইতিহাস তুলে ধরবার চেষ্টা করা হল।
খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকের তৃতীয় দশকে—
“হুগলী জেলার অন্তর্গত হরিপালের রামনগর নামক স্থানের রাজা ভারামল্ল তারকেশ্বরের সেবার জন্য এক হাজার তেইশ বিঘা জমি অর্পণ করেন। … তারকেশ্বরের মোহন্তগণ দশনামা সন্ন্যাসী এবং ব্রহ্মচারীরূপে দেবসেবা করিবেন ইহাই ভারামল্ল নির্দেশ দিয়া যান। তাঁহারা বিবাহ করিয়া সংসার করিতে পারিবেন না এবং মোহন্ত গতায়ু হইলে তাঁহার প্রধান শিষ্য মোহন্তপদে অভিষিক্ত হইবেন। ইহাই চিরাচরিত প্রথা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় বহু মোহন্ত সন্ন্যাস ধর্মের মস্তকে পদাঘাত করিয়া স্ত্রী (বিবাহিত নয়) সংসর্গের কদাচারে নিযুক্ত হইয়া উক্ত পদের অমর্যাদা করেন। ধর্মের আবরণে মোহন্তগণ যে অধর্মের খেলা খেলিতেন, দরিদ্র প্রজাগণ সে অনাচারের প্রতিকারের চেষ্টা করিতে কোনদিন সাহসী হয় নাই। ১৩৩১ সালে স্বামী বিশ্বানন্দ নামক এক সন্ন্যাসী সর্বপ্রথমে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়া প্রহৃত হন। কিন্তু তিনি তাহাতে ভীত না হইয়া স্বামী সচ্চিদানন্দের সহযোগিতায় দ্বিগুণ উৎসাহে ইহা লইয়া আন্দোলন করেন। অতঃপর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয় তারকেশ্বরের যাবতীয় ব্যাপার নিজহস্তে গ্রহণ করিয়া নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সহযোগে সত্যাগ্রহ আরম্ভ করেন।” (হুগলী জেলার ইতিহাস, সুধীর মিত্র, পৃ: ৮২৩-৮২৪)
এরফলে তারকেশ্বর মঠ ও মন্দিরে প্রচলিত থাকা পুরোনো নিয়ম কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশবলে বিলুপ্ত হয়ে ট্রাস্টিদ্বারা পরিচালিত করবার জন্য হুকুম হয়েছিল।
অতীত থেকেই নিজেদের কদর্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারকেশ্বরের মোহন্তরা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, তাঁদের মধ্যে মোহের কোন অন্তঃ ঘটেনি। ১৮২৪ সালে হত্যার অভিযোগে তারকেশ্বরের মোহন্ত শ্রীমন্তগিরির ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছিল। সেই ঘটনা সম্পর্কে ১২৩০ বঙ্গাব্দের ১৬ই চৈত্র তারিখের সমাচার দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদে লেখা হয়েছিল—
“তারকেশ্বরের মোহন্তর পূণ্য প্রকাশ শোনা গেল যে তারকেশ্বর নিবাসী শ্রীমন্তগিরি সন্ন্যাসী স্বীয় ধর্মকর্ম সংস্থাপনার্থ এক বেশ্যা রাখিয়াছিলেন। তাহাতে জগন্নাথপুর নিবাসী রামসুন্দর নামক এক ব্যক্তি ঐ বেশ্যার সহিত কি প্রকারে প্রসক্তি করিয়া ছদ্মভাবে গমনাগমন করিত। পরে সন্ন্যাসী জানিতে পারিয়া ২রা চৈত্র (১২৩০) শনিবার রাত্রিযোগে সন্ধানপূর্বক হঠাৎ যাইয়া বেশ্যাকে কহিল যে একটু পানীয় জল আন, … তাহাতে বেশ্যা জল আনিতে গেলে সময় পাইয়া ঐ ব্রাহ্মণের বক্ষস্থলের উপর উঠিয়া তাঁহার উদরে এমত এক ছুরিকাঘাত করিল যে তাহাতে তাঁহার মঙ্গলবারে প্রাণবিয়োগ হইল পরে তথাকার দারোগা ঐ সমাচার শুনিয়া ঐ সন্ন্যাসীকে গ্রেফতার করেন।” এরপরে সেই ঘটনার জন্য ঐ মোহন্তের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। (হুগলী জেলার ইতিহাস, সুধীর মিত্র, পৃ- ৮২৫)
এরপরে— “মোহন্ত মাধবগিরি এলোকেশী নামক এক মহিলার সতীত্বনাশের অপরাধে কারাদণ্ড ভোগ করেন।” (হুগলী জেলার ইতিহাস, সুধীর মিত্র, পৃ- ৮২৭) উক্ত এলোকেশী— অতীতের হুগলি জেলার কুরুমঙ্গল নামক একটি গ্রামের নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের সুন্দরী কন্যা ছিলেন। নবীন নামক একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। নবীনের সেই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মোহন্ত এলোকেশীর পিতা নীলকমলকে হাত করে নিজের কুকর্মটি সমাধা করেছিলেন। এরপরে নবীন তাঁর স্ত্রীকে ক্ষমা করে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মোহন্তের নিয়োজিত লাঠিয়ালবাহিনীর জন্য পালিয়ে যেতে পারেননি। অবশেষে তিনি আঁশবটি দিয়ে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে থানায় আত্মসমর্পণ করে প্রশাসনের কাছে সব ঘটনা জানিয়েছিলেন। ওই ঘটনার বিচারে নবীনের যাবজ্জীবন দীপান্তর এবং পরস্ত্রীর সতীত্বনাশের অপরাধের জন্য মাধবগিরির কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। পরে দেশের বহু গন্যমান্যদের চেষ্টায় নবীন কারামুক্ত হয়েছিলেন।
তারকেশ্বরের মোহন্তদের সেইসব ধারাবাহিক অপকীর্তির জন্য তখনকার বিভিন্ন নাট্যালয়ে, সংবাদপত্রে ও সমাজের নানাস্তরে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠলেও সরাসরি কেউই সেইসব ঘটনার প্রতিবাদে এগিয়ে এসে কিছু করতে সাহস পাননি। কারণ— মোহন্তের সঙ্গে রাজা ভারামল্লের দান করা তৎকালের দেড়লক্ষ টাকা আয়ের দাপট এবং তাঁদের নিজস্ব গুণ্ডা ও লাঠিয়ালবাহিনীর প্রতাপ ছিল। ফলে একটা সময়ে সাধারণের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল যে, তারকেশ্বরের মোহন্তদের সেই নীরন্ধ্র প্রতাপ ভেদ করে কোন জোয়ান সমাজকে মুক্ত করবার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবেন? অবশেষে সেই জোয়ানরূপে— বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার, সন্ন্যাসী ও ট্রেড ইউনিয়নিস্ট স্বামী বিশ্বানন্দের তারকেশ্বরের সিংহদ্বারে আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি নিজের চোখে তারকেশ্বরের মোহন্তদের নানা অপকীর্তি দেখে সেসবের তীব্র প্রতিবাদ করবার জন্য মোহন্তের লাঠিয়ালদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে তিনি সিংহগর্জনে তারকেশ্বরের মোহন্তদের ধ্বংস করবার কথা বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করে শেষে দেশবন্ধুর কাছে গিয়ে তারকেশ্বর মন্দির থেকে মোহন্ত অপসারণ করবার জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রস্তাব পেশ করবার পরে দেশবন্ধু তাঁর হাতেই সেই আন্দোলনটি পরিচালনা করবার ভার তুলে দিয়েছিলেন। সেই ভার হাতে পাওয়ার পরেই তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির মাধ্যমে তারকেশ্বরের জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটিতে— দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু, ডাঃ জে. এম. সেনগুপ্ত, অনিলবরণ রায়, পণ্ডিত ধরানাথ ভট্টাচার্য, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ঢাকা) এবং মৌলানা আক্রাম খাঁ সভ্য হিসাবে নির্বাচিত হন। (হুগলী জেলার ইতিহাস, সুধীর মিত্র, পৃ: ৮২৯-৮৩০)
তারকেশ্বর সত্যাগ্রহের সময়ে সতীশগিরি সেখানকার মোহন্ত ছিলেন। প্রথমে ধরানাথ ভট্টাচার্য ও স্বামী বিশ্বানন্দ সেই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। বিশ্বানন্দ মোহন্তর গুণ্ডাবাহিনীর হাতে প্রহৃত হওয়ার পরে ধরানাথ ভট্টাচার্য সেই ঘটনার প্রতিবাদ করবার জন্য তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ধরানাথ একজন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, যুগান্তর নামক বিপ্লবী দলের সশস্ত্র বিপ্লবী এবং সেযুগের হুগলি জেলার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত থাকবার ফলে তাঁর সাথে বহু তরুণ বিপ্লবীরা ছিলেন এবং সেইসময়ে তাঁদের দাপটও নেহাত কম কিছু ছিল না। নজরুল এই ধরানাথ ভট্টাচার্যের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। সেই আন্দোলনের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দেশবন্ধু ও ধরানাথ ভট্টাচার্য নজরুলকে চারণকবিরূপে আন্দোলনটির প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। কবি সানন্দে তাঁদের সেই অনুরোধকে আদেশ বলে মেনে নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন। প্রথমদিকে কবির লেখা সেই গানটি— বৃটিশ সরকার কর্তৃক তাঁর বাজেয়াপ্ত গ্রন্থ ‘ভাঙ্গার গানে’ নামক কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল; গানটির নাম ছিল— ‘মোহ-অন্তের গান’। সেইসময়ে নজরুল তাঁর বজ্রকণ্ঠে এই গানটি হুগলি জেলার বিভিন্ন গ্রামে, শহরে এবং সারা বাংলায় গেয়ে বেরিয়েছিলেন; যার ফলে হাজার হাজার তরুণ, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ স্বেচ্ছাসেবক তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পতাকার নিচে এসে শামিল হয়েছিলেন। উক্ত গানটির শুরু এরকমভাবে হয়েছিল—
“জাগো আজ দণ্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী।
ঐ ডুবালো পাপ চণ্ডাল তোদের বাংলা দেশের কাশী।
জাগো বঙ্গবাসী।
মোহের যার নাইকো অন্ত
পুজারী সেই মোহন্ত
মা-বোনের সর্বস্বান্ত,
করছে বেদী মূলে।
তোদের পূজার প্রসাদ বলে খাওয়ায় পাপ-পুঁজ সে গুলে
তোরা তীর্থে গিয়ে দেখে আসিস পাপ ব্যাভিচার রাশিরাশি।
জাগো বঙ্গবাসী।”
তৎকালীন তারকেশ্বরের ধর্মধ্বজী ভণ্ডরা ধর্মকে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসায়ে পরিণত করে, সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে ঠকিয়ে টাকার পাহাড়ের ওপরে বসে, নিজেদের পোষা গুণ্ডা ও লাঠিয়ালবাহিনী দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষের মুখ বন্ধ করে রাখবার চেষ্টা করেছিলেন বলে কবি লিখেছিলেন—
“পূন্যের ব্যবসাদারী
চালায় সব এই ব্যাপারী;
জমাচ্ছে হাঁড়ি হাঁড়ি টাকার কাঁড়ি ঘরে।
হায় ছাই মেখে যে ভিখারী শিব বেড়ান ভিক্ষা করে।
ওরে তাঁর পূজারী দিনে দিনে ফুলে হচ্ছে খোদার খাসী।
জাগো বঙ্গবাসী।”
তখন এরকম ভণ্ড, দুশ্চরিত্র পূজার সেবাইত মোহন্তের সব সংবাদ জানা সত্ত্বেও তাঁরই কাছে আশীর্বাদ লাভের জন্য নিজেদের ঘরের মেয়ে, বৌ, বোন প্রভৃতিদের মানসন্মান বিকিয়ে দিতে যে দেশের মানুষেরা কসুর করতেন না, তাঁদের সাবধান করে দিয়ে কবি লিখেছিলেন—
“এই সব ধর্ম ঘাগী
দেবতায় করছে দাগী;
মুখে কয় সর্বত্যাগী ভোগ-নরকে বসে।
সে যে পাপের ঘণ্টা বাজায় পাপী দেব দেউলে পশে
আর ভক্ত তোরা পূজিস তারেই? যোগাস খোরাক সেবাদাসী।
জাগো বঙ্গবাসী।”
সেইসময়ে এরকমভাবে যেসব ভণ্ড মোহন্তরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের মান-মর্যাদা, ইজ্জৎ-ঈমান সবকিছুকে হরণ করে নিয়ে সমাজকে বে-ইজ্জৎ করছিলেন— তারকেশ্বরে আগত তীর্থযাত্রীরা সেসব দেখেও দেখছিলেন না এবং বুঝেও বুঝছিলেন না; দুর্ভোগে ভুগেও তাঁরা সেসবের প্রতিকার করবার কোন চেষ্টা করেননি। তাই তাঁদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে নজরুল গেয়ে উঠেছিলেন—
“দিয়ে নিজ রক্ত বিন্দু
ভরালি পাপের সিন্ধু—
ডুবলি তায় ডুবলি হিন্দু, ডুবালি দেবতারে?
দ্যাখ ভোগের বিষ্ঠা পুড়ছে তোদের বেদীর ধূপাধারে।
পূজারীর কমণ্ডলুর গঙ্গা জলে মদের ফেনা উঠছে ভাসি।
জাগো বঙ্গবাসী।”
তখন শুধু পূজার দক্ষিণা— সোনা রূপা হীরে জহরত পেয়েই কি সেইসব মোহন্তরা খুশি হতেন? নারী মাংস— বিশেষ করে সেযুগের ভদ্র ঘরের মেয়ে বৌদের সর্বনাশ কি তাঁদের ধর্মের গরম টাকার গরম শীতল হত? তাঁরা ভোগের চরম স্তরে উঠতে চেয়েছিলেন। তাই কবি বলেছিলেন—
“দিতে যায় পূজা আরতি
সতীত্ব হারায় সতী
পুণ্য খাতায় ক্ষতি লেখায় ভক্তি দিয়ে।”
উপরোক্ত লাইন ক’টির অর্থ হল যে— তারকেশ্বরের যে মোহন্তরা সেযুগের অসংখ্য নারীদের সর্বনাশ করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের আবার দেবসেবার টাকায় নিজেদের রক্ষিতারূপেও রেখে দিয়েছিলেন। তখনকার তারকেশ্বর মন্দিরের একটা চত্বর সেইসব রক্ষিতাদের বসবাসের জন্যই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। মোহন্তর প্রসাদী-জীবন বলে তাঁরা মাসোহারা পেতেন এবং মোহন্তের দুরাচারী মুসাহিবদের ভোগ্যপাত্রীস্বরূপ সেখানে বাস করতেন। এরপরে কবি আবার লিখেছিলেন—
“তার ভোগ মহলে জ্বলছে প্রদীপ তোদের পুণ্য ঘিরে।
তোদের ফাঁকা ভক্তির ভণ্ডামীতে মহাদেব আজ ঘোড়ার ঘাসী।
জাগো বঙ্গবাসী।”
নজরুল তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন তারকেশ্বরের মোহন্তদের অত্যাচারের ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার ফিরিস্তি দেওয়ার পরে দেশবাসীর কাছে সেই পাপী মোহন্ত-গোষ্ঠীর অপসারণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন—
“তোরা সব ভক্তিশালি
বুকে নয়, মুখে খালি।
বেড়ালকে বাছতে দিলি মাছের কাঁটা যেরে।”
বাস্তবে সেযুগের ধর্মধ্বজী মোহন্ত মার্জারের হাতেই ভক্ত ও তীর্থযাত্রীরা মাছের নিরাপত্তার ভার তুলে দিয়েছিলেন! তাই কবি গেয়ে উঠেছিলেন—
“তোরা পূজারীকে করিস পূজা পূজার ঠাকুর ছেড়ে।
মার অসুর শোধরা সে ভুল আদেশ দেন মা সর্বনাশী।
‘জয় তারকেশ্বর’ বলে পড়বিরে নয় গলায় ফাঁসী।
জাগো বঙ্গবাসী।”
বর্তমানে বিভিন্ন গ্রন্থে হুগলি জেলার প্রসঙ্গে তারকেশ্বর আন্দোলনের কথা পাওয়া গেলেও সেই আন্দোলন নিয়ে নজরুলের লেখা এই গানটির কথা কিন্তু বিশেষ পাওয়া যায় না। এযুগে অতীতের তারকেশ্বরের অত্যাচারী মোহন্তদের দাপট যে বিলুপ্ত হয়েছে, তাতে নজরুলের কি যবরদস্ত হাত ছিল— সেই ইতিহাস নবযুগের নবীনদের কাছে তুলে ধরবার জন্য এই গানটির গুরুত্ব অপরিসীম। ওই আন্দোলন চলবার সময়ে নজরুলের এই অমিত শক্তি সম্পন্ন অগ্নিময়ী বাণীর মাধ্যমে শিবের ত্রিশূলচ্ছটা যেন শ্রোতাদের মধ্যে বিচ্ছুরিত হয়েছিল। ফলে শ্রোতারা নিজেদের শিরদাঁড়া খাড়া করে মোহন্ত অপসারণের শপথ নিয়েছিলেন।
তারকেশ্বরের মোহন্তের অধীনে তখন বেতনভুক সহস্রাধিক লাঠিয়াল ছিলেন। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের সর্দার ছিলেন। তিনি যেমন দুর্বার চরিত্রের মানুষ ছিলেন, তেমনি অত্যন্ত নিষ্ঠুরও ছিলেন। একটাসময়ে মোহন্তের জন্য তিনি করেননি এমন কোন কাজ ছিল না। কিন্তু দেশবন্ধু ও নজরুল এহেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে এতটাই প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন যে, তিনিও পরে মোহন্তের পরম শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। একটাসময়ে যাঁর হাতের লাঠি মোহন্তদের নির্দেশে কাউকে খুন করতে পর্যন্ত দ্বিধা ও গুম করে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করত না, সেই সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ই শেষপর্যন্ত মোহন্ত সতীশগিরির আতঙ্কের কারণ উঠেছিলেন। তারকেশ্বর আন্দোলন চলবার সময়ে একদিন তারকেশ্বর মন্দির সংলগ্ন বিরাট মাঠে সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি সভা চলছিল। সেদিন সেখানে স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে— দেশবন্ধু, সুভাষচন্দ্র, স্বামী বিশ্বানন্দ, স্বামী সচ্চিদানন্দ, নজরুল প্রমুখরাও উপস্থিত ছিলেন। সেদিনকার সভায় দেশবন্ধু প্রথমেই নজরুলকে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওদিকে সহস্রাধিক লাঠিয়ালসহ সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় তখন সেই সভাকে ঘিরে ফেলেছিলেন। সেইসব লাঠিয়ালরা সভায় উপস্থিত মানুষদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য মোহন্তের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। সভাস্থ সকলেই তখন সঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন যে, লাঠিয়ালরা কখন তাঁদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সভাকে তছনছ করে দেবেন। এর আগেও কেউ সেইসব লাঠিয়ালদের জন্যই সেখানে ওই আন্দোলন সংক্রান্ত সভা করতে পারেননি। কিন্তু সব ভয়কে তুচ্ছ করে দিয়ে নজরুল সেদিন নিজের দৃপ্ত ভঙ্গিমায় কেশর ফুলিয়ে, চুলভর্তি মাথা ঝাঁকিয়ে— ‘জাগো আজ দণ্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী’ —বলে গানটি ধরেছিলেন। এরপরে তিনি যতই লাইনের পর লাইন গানটি গেয়ে গিয়েছিলেন, সভাস্থ মানুষদের চোখেমুখে ততই দুঃসাহসিকতার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় তখন মঞ্চের এককোণে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশবন্ধু মাঝে মাঝেই তাঁর দিকে তাকালেও তিনি একটা কাঠের পুতুলের মতোই একজায়গায় দাঁড়িয়ে গানটি শুনছিলেন। এরপরে গানটি শেষ হলে তিনি নজরুলকে অশ্রুসজল কণ্ঠে বলেছিলেন— “কাজী গানটা আবার গাও।” তাঁর অনুরোধে নজরুল আবার গানটি গেয়েছিলেন। এরফলে উদ্দীপনাময় সেই সভায় উৎসাহের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল, নজরুলের কণ্ঠের দৃঢ়তায় গানটির সুর দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিল, এবং লাঠিয়ালরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন গানটি শেষ হওয়ার পরে তারকেশ্বরের মোহন্তের বেতনভুক লাঠিয়ালদের সর্দার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নজরুল ও দেশবন্ধুর পায়ের কাছে তাঁর নিজের হাতের লাঠিটি রেখে দিয়ে সেই সভাতেই মোহন্তের সর্বনাশ করবার শপথ নিয়েছিলেন। ফলে মুহূর্তের মধ্যে তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল এবং বেশিরভাগ লাঠিয়ালই সত্য বন্দোপাধ্যায়ের সাথে সেই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
ওই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিয়ে নজরুলের কবি বন্ধু, সেকালের হুগলির প্রখ্যাত ছাত্রনেতা গীস্পতি ভট্টাচার্য, দেশবন্ধু পুত্র চিররঞ্জন দাশ, স্বামী বিশ্বানন্দ ও আরও অনেকে কারাবরণ করেছিলেন। এরপরে সতীশগিরির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেই মামলার রায়ে মোহন্তর হাত থেকে সমস্ত দেবত্তর সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিয়ে দশনামী সম্প্রদায়ের আরেকজন সন্ন্যাসীকে তারকেশ্বরের মোহন্ত পদে নিযুক্ত করে তাঁকে গদি থেকে অপসারিত করা হয়েছিল, এবং একজন প্রথমশ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তারকেশ্বর মঠ ও মন্দিরের তদারকির ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল। শুধু সেটাই নয়, ওই মামলার বিচারকেরা এই রায়ও দিয়েছিলেন যে— কোন কারণে ম্যাজিস্ট্রেট যদি মনে করেন যে, নতুন মোহন্তও সেই পদের উপযুক্ত নন এবং তিনি নিজের ক্ষমতার ও সম্পত্তির অপব্যবহার করছেন, তাহলে তিনি যে কোন সময়ে সেই মোহন্তকে তাঁর পদ থেকে অপসারিত করে অন্য কাউকে নতুন মোহন্ত নিযুক্ত করতে পারেন। এভাবেই কয়েকশো বছরের অত্যাচারী পাপিষ্ঠদের দ্বারা কলঙ্কিত তারকেশ্বর কলঙ্কমুক্ত হয়ে মুক্তিলাভ করেছিল। আর তারকেশ্বরের সেই মুক্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামও যে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন, সেকথা এযুগের মানুষেরও জানবার প্রয়োজন রয়েছে।#