নিজের পরিচয়টুকু দিতে গিয়ে ‘আমি বাঙালি’ শুধু এই দুটি শব্দই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। প্রশ্নকর্তা আরও একধাপ এগিয়ে যখন আরও গভীরে প্রবেশ করতে চান তখন মুশকিলে পড়ে যাই। স্তব্ধ হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্য। অবশেষে বলি, ‘হ্যাঁ, মুসলমান। নাম অমুক।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশ্নকর্তার মুখের ভূগোল পাল্টে যায়। হয় তিনি স্থান পরিবর্তন করেন, নয়তো জানালার বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে উদাস হয়ে যান। দ্বিতীয়বার তাঁর সঙ্গে আর কথা বলার সাহস হয় না।
এই ভয়টা আজীবন বয়ে চলেছি। পথেঘাটে, ট্রেনে-বাসে, অফিস রুমে এবং কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানেও। ছোটবেলায় একটা দূরত্ব বজায় রেখেই বেড়ে ওঠা। ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্ব। তারপর বড় হওয়ার পরও এই দূরত্ব যে কমেনি, তা প্রতিটি মুহূর্তে হাড়ে হাড়ে টের পাই।
সেদিন কর্মস্থলে যাওয়ার পথে ট্রেনে উঠে জানালার ধারে বসেছি। আমার উল্টোদিকে মুখোমুখি এক ব্যাঙ্ক কর্মচারী, অল্পবয়সি স্মার্ট যুবক। কাশ্মীরের বিস্ফোরণ নিয়ে বললেন, ‘মুসলিমদের বিশ্বাস করব কী করে, এরা সুযোগ পেলেই হামলা করে।’ এইসব কথার কী উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। বললাম না, না, সব মুসলমান কেন খারাপ হবে! ভালো তো আছেই। আর দেখুন…
কথাটা আমাকে শেষ করতেই দিলেন না। বললেন, ‘ভালো মানুষ সেজে থাকা তাদের অভিনয়। শুধু সুযোগের অপেক্ষা।’
—আপনার কথায় আমি সহমত নই।
—সে তো স্বাভাবিক। ধর্মের ভিত্তিতে আপনারা পাকিস্তান ভাগ করে নিয়েছেন। ভারত ‘হিন্দুরাষ্ট্র’। সংবিধান বাতিল করে আবার নতুন করে তা আমরা লিখতে চাই।’
—আপনারা তা পারবেন না। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এবং সরকারি কর্মচারী হয়েও কী করে এসব কথা বলছেন জানি না।
—এতদিন এসব কথা না বলেই তো আপনাদের মতো লোকদের এত বাড়বাড়ন্ত!
উগ্র কোনও রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য শুনে চুপ করে গেলাম। তর্ক-বিতর্ক কোন পর্যায়ে চলেছে তা টের পেলাম। এত বিদ্বেষ! প্রতি মুহূর্তে হৃদয়টা দগ্ধ হচ্ছে। দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিলেও সে পরীক্ষায় পাশ করা যায় না। মানুষকে যতই ভালোবাসার কথা বলা হোক তা যে নিছক প্রহসন, তা পদে পদে বুঝতে পারি। কর্মস্থলও যে খুব একটা সুখকর নয় এবং সেখানেও ‘মানবিকতা’ শব্দটির বহুদিন আগেই ধার কমেছে, তা সে-ই উপলব্ধি করতে পারবে যার মানবিকবোধ আছে। কাশ্মীরে বিস্ফোরণ হোক কিংবা আমেরিকায় সব বিস্ফোরণের দায় যে মুসলিমদের উপরই বর্তায় তা ঠারে ঠোরে জানিয়ে দেন কিছু সহকর্মীও। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলে দেন, ‘এসব তো আপনাদেরই লোকেরা ঘটিয়ে থাকে।’ পাকিস্তানের কোনও ‘খান’ আর আমি অমুক ‘খান’-কে একই বংশের ধরে নেন সেই সহকর্মীরা। অবাক হয়ে যাই। আমার চেতনা, আমার শিক্ষা-সংস্কৃতি, আমার জীবনযাপন একজন পাকিস্তানির মতো হতে যাবে কেন? আমি তো বাঙালি, আমি তো আপনাদের মতোই। এতদিন একসঙ্গে আছি, তবু কেন ভালো করে চিনলেন না আমাদের? একটা অস্থির সময় সৃষ্টি করে দেশের একটা রাজনৈতিক দল যেভাবে জাত-ধর্মের বিভেদ ও বিদ্বেষকে কাজে লাগাচ্ছে, তাতে তরুণ সমাজের এবং শিক্ষিত সমাজের একাংশ যে এই বিভেদ ও বিদ্বেষকে প্রশয় দিতে এগিয়ে আসছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্ম কি এই বিভেদেই? ধর্ম কি এই হিংস্রতাতেই? মানবিক শিক্ষা কি আজ প্রয়োজনহীন হয়ে পড়েছে? ‘মানুষ’ পরিচয়টি কি একটি রাজনৈতিক দল মুছে দিতে চায়? প্রশ্নগুলি ‘স্বাভাবিকভাবেই এসে যাচ্ছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে কি সভ্যতা বাঁচবে? পরস্পর সংঘাত আর বিভেদের বাতাবরণ তৈরি করে একটা সম্প্রদায়কে দূরে রাখলে যে নিজেদেরই সমূহ ক্ষতি, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আছে কারও? অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির যে ধারা নিয়ে ভারতীয় জীবনবোধ ও দর্শন সম্পৃক্ত হয়েছে, তাকে কী করে অস্বীকার করা যায়? স্থানের নাম পাল্টানোর মধ্যে দিয়ে, উপাস্য বিশ্বাসে বাধা দিয়ে, ভিন সম্প্রদায়কে উদ্বাস্তু হিসেবে দেখে কি ভারতবর্ষকে পরিবর্তন করা যাবে?
হয়তো যাবে না ঠিকই, কিন্তু মানুষকে বিভেদের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করে দীর্ঘদিন রাষ্ট্র দখল করা যাবে। ধর্মীয় পুরাণের অপব্যাখ্যা করে তাদের বোঝানো যাবে—আমরা তোমাদেরই লোক। মানুষও তা মেনে নেবে; কেননা, ধর্মোন্মাদ মানুষ এদের শাসন-ব্যবস্থায় ইহকাল ও পরকালেও লাভবান হতে চায়। আত্মরক্ষা ও ঈশ্বর প্রাপ্তির বহর অভিনব পথে চালিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মানববন্ধনের মাহাত্ম্য ভুলে যায়। বিবেকানন্দের আদর্শ, জীবন ও বাণী পালটে যায়। জাতির জনকের অপব্যাখ্যা করা হয়। কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত বলে তাকে অচ্ছুৎ করতে চাওয়া হয়। দেশপ্রেমের নিত্যনতুন বুলি শিখতে হয়। গোমাংস ভক্ষণ বন্ধ করে গো-মাংস রফতানি দ্বিগুণ করা হয়। হানাহানির পরিবেশ তৈরি করার জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করে নানা অপকর্মের প্রচার করা হয়। মিডিয়ার সামনে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে স্বপন্থী মানুষজনের আবেগকে উষ্ণ করা হয়।
এই পরিবেশে কী করে নিজের পরিচয় দেব? প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা আর কবে মানবিক হব?#