।।চার।।
যে-নিম গাছের তলায় আমি আছি, সেই নিমগাছটি থেকে কিছু শুকনো পাতা মাটিতে ঝরে পড়ল। গাছ থেকে গাছের পাতা-ঝরা দেখে আমার মনে পড়ল কবির কবিতার লাইন- ‘খসে খসে পড়ে পাতা/মনে পড়ে কত কথা।’ আমার মনে পড়ল পুরনো দিনের কথা। আজ থেকে সতেরো বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ বছর। অবিবাহিত ছিলাম। আমি একজন জীবন্ত-স্ট্যাচু ছিলাম। টাকার বিনিময়ে প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জীবন্ত-স্ট্যাচু সাঁজতাম। এটা করেই খুবই কষ্টে আমাদের সংসার চলত। বাড়িতে আমি এবং আমার অসুস্থ বাবা। আমার মা ছিল না। মারা গিয়েছিলেন। আমার বাড়ি ছিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বংশীহারী ব্লকের বদলপুর গ্রামে। সেবার জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি শহরের ‘অগ্রগতি সংঘ’-এ দুর্গাপুজোয় গিয়েছিলাম জীবন্ত-স্ট্যাচু হিসেবে। ভীষণ ভালো ছিল আলোকসজ্জা। খুবই সুন্দর ছিল আয়োজন। নানা রঙের আলোর সংমিশ্রণে রাতের বেলা প্যান্ডেলের ভেতরে ও বাইরে মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়ে ছিল। রাত তখন দশটা। আমি প্যান্ডেলের সামনে আপাদমস্তক সাদা রঙের একটি জীবন্ত নারী-স্ট্যাচু সেঁজে নৃত্যের ভঙ্গিমায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আবির ও তার বন্ধু তুহিন বাইক নিয়ে অগ্রগতি সংঘের দুর্গাপুজো দেখতে এসেছিল। বাইক কিছুটা দূরে রেখে আবির ও তুহিন হেঁটে-হেঁটে প্যান্ডেলের সামনে এসেছিল। সেই মুহূর্তে প্যান্ডেলে তেমন লোকজন ছিল না। আমার নারী-স্ট্যাচুটিকে দেখে চমকে উঠেছিল আবির। আবিরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল,”বাহ,খুবই সুন্দর তো শ্বেতপাথরের স্ট্যাচুটি!”আমার স্ট্যাচুটির রূপে,আমার স্ট্যাচুটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল আবির। আবির বলে উঠেছিল, “সাবাশ শিল্পী! সাবাস ভাস্কর!” আমার সামনে দাঁড়িয়ে আবির তুহিনকে বলেছিল, “জানিস তুহিন,তানজানিয়া নামে একটি দেশে নেট্রন- হ্রদ নামে একটি হ্রদ আছে। নেট্রন-হ্রদ একটি লবণাক্ত জলের হ্রদ। নেট্রন- হ্রদের জলে কোনওভাবে পাখি-পশু-মানুষ পড়লে সঙ্গে-সঙ্গে সেখানেই জীবন্ত অবস্থায় স্ট্যাচু হয়ে যায়। লাভা মিশ্রিত ঘন হ্রদের জলে সূর্যের রশ্মি পড়ে সেই রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আকাশের দিকে ফিরে যায়। আকাশ পথে পাখিরা যাওয়ার সময় পাখিদের চোখে সেই রশ্মি পড়লে পাখিদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পাখিরা দিকভ্রান্ত হয়ে হ্রদের জলে পড়লে হ্রদের জলে থাকা লবণ ও সোডার প্রভাবে সাথে-সাথে পাখিগুলো জীবন্ত অবস্থায় স্ট্যাচু হয়ে যায়। যদি কিছু পাখি হ্রদের ধারে কোনওরকমে ওঠে, তাদের গায়ে লেগে থাকা লবণ-সোডার প্রভাবে তারাও স্ট্যাচু হয়ে যায়। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ড দক্ষিণ আফ্রিকার তানজানিয়ায় গিয়েছিল ‘ওল ডইনই লেঙ্গাই’ পাহাড়ের ছবি তুলতে। পাহাড়ের ওপরে উঠে সে লক্ষ্য করেছিল, নিচের দিকে একটি হ্রদ রয়েছে। সে ক্যামেরা নিয়ে হ্রদের কাছে এসেছিল। দেখেছিল, হ্রদের জল লাল। হ্রদের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অনেক পাখির-স্ট্যাচু। একটি পাখির-স্ট্যাচু হাতে নিয়ে সে চমকে গিয়েছিল। সে দেখেছিল,পাখিগুলো পাথরের তৈরি স্ট্যাচু নয়। জীবন্ত অবস্থায় পাখিগুলো পাথরের স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছিল। নিক ব্রান্ড পাখির স্ট্যাচুগুলোকে ক্ষণিকের জন্য,অল্প সময়ের জন্য প্রাণ দিতে চেয়েছিল। নিক ব্রান্ড পাখির স্ট্যাচুগুলোকে একটি একটি করে গাছের ডালে বসিয়েছিল। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলোকে জীবন্ত-পাখি মনে হচ্ছিল, জীবিত-পাখি মনে হচ্ছিল। ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ড সামান্য সময়ের জন্য পাখির স্ট্যাচুগুলোকে বাঁচিয়ে তুলেছিল। নিক ব্রান্ড তার ক্যামেরা দিয়ে পাখিগুলোর ছবি তুলেছিল। গাছের ডালে-বসা-পাখির স্ট্যাচুগুলোকে ক্যামেরার ছবিতেও জীবন্ত-পাখি মনে হচ্ছিল। নিক ব্রান্ড ছবিগুলোর নাম দিয়েছিল–‘অ্যালাইভ ইন ডেথ’। সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল ছবিগুলো।”
আবির বন্ধুকে বলেছিল, “তুহিন,আমি এই শ্বেতপাথরের নারী-স্ট্যাচুটিকে প্রাণ-দান করতে চাই, জীবন-দান করতে চাই।” আবির কিছু সময়ের জন্য বাইরে চলে গিয়েছিল। আবির ফিরে আসলে তুহিন জিজ্ঞেস করেছিল, “কোথায় গিয়েছিলি?” আবির উত্তর দিয়েছিল, “পাশে এক স্টেশনারি দোকানে।” এরপর আবির দ্রুত আমার কাছে এসে মুহূর্তের মধ্যে তার জামার পকেট থেকে একটি লাল-টিপের পাতা বের করে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার নারী-স্ট্যাচুর কপালের মাঝখানে পরিয়ে দিয়েছিল একটি লাল-টিপ। এরপর তুহিনের কাছে এসে বলেছিল, “তুহিন দেখ, কপালের মাঝখানে লাল-টিপে শ্বেত-পাথরের নারী-স্ট্যাচুটিকে জীবন্ত মনে হচ্ছে।”
তুহিন বলেছিল, “আবির, তুই ঠিক বলেছিস। স্ট্যাচুটিকে জীবিত মনে হচ্ছে। একদম জীবিত।”
আরও পড়ুন: শ্রীমতি একটি মেয়ের নাম ৩
বিকেল চারটে বাজল। খোকনদা এসে বাবা ও কোয়েল বৌদিকে জানাল, “সময় হয়ে গেছে। এখন শ্রীমতিকে মর্গের ভেতর নিয়ে যাওয়া হবে।” আমার দেহ হাসপাতালের মধ্যে গাছের ছায়াতে স্ট্রেচারের ওপর। আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছি। আমার পা থেকে মাথা অবধি সমস্ত শরীর সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমার দেহকে মর্গের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতালের এক লোক এসে আমার স্ট্রেচারে হাত লাগাল। লোকটি আমার স্ট্রেচার স্পর্শ করতেই আমার ভেতরটা ঠুকরে কেঁদে উঠল। আমি তীব্র বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, “না। না। আমি মর্গে যাব না। আমি পোস্টমর্টেম করাব না।”
আমার কথায় কেউ কর্ণপাত করল না। আমাকে মর্গের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। আমার বাবা চুপচাপ। মুখে কোনও কথা নেই। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মন চাইছিল না, আমার দেহে ছুরি চলুক। আমার হৃদয় চাইছিল না, আমার শরীরের কাটাছেঁড়া চলুক। যে-শরীরকে প্রতিদিন দু’বেলা আদর-যত্ন করেছে, যে-দেহকে প্রতিদিন সুন্দর করে সাঁজিয়েছে, সেই যত্নের দেহের ওপর ছুরি চলুক, এটা বেশির ভাগ মানুষই চায় না। যদি মৃতদেহের আপত্তি জানানোর কোনও ব্যবস্থা থাকত, যদি মৃতদের সম্মতির দরকার হতো, তাহলে আমি নিশ্চিত, স্বেচ্ছায় দেহদানকারী বাদে সব মৃতদেহই তার দেহ পোস্টমর্টেম করাতে ‘না’ করে দিত। খোকনদা সকলকে বলল, “এখন শ্রীমতির শরীরকে মর্গের ভেতর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যদি কারও একবার দেখার ইচ্ছে হয়,তাহলে দেখে নিতে পার।” আমার বাবা কোনও রকম কথা বলল না। নিরব। নিশ্চুপ। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দেহের দিকে তাকাতে লাগল আর ফ্যালফ্যাল চোখে সকলকে দেখতে লাগল। কোয়েল বৌদি আমাকে খুব ভালোবাসত। কোয়েল বৌদির মুখেও কোনও কথা নেই। শুধু আমার অসুস্থ বাবাকে দু’হাত দিয়ে ভালো করে ধরে রইল। খোকনদা সকলের উদ্দেশ্যে বলল, “সকলকে একদিন চলে যেতেই হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। মৃত্যুর হাত থেকে কারও নিস্তার নেই,কারও ছাড় নেই। জন্ম থাকলে মৃত্যু হবেই। মানুষের দেহ থাকলে সর্দি-কাশি হবেই আর মানুষের কপাল থাকলে দুঃখ-কষ্ট হবেই। এটা সকলকে মানতেই হবে।”
স্ট্রেচার চলতে লাগল। খোকনদা আমার স্ট্রেচারের সাথে সাথে ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল। আমি দেখলাম, খোকনদার চোখে জল। অশ্রুতে ভিজে গেছে খোকনদার দু’চোখ। আমার দেহ মর্গের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। এ দৃশ্য আমি আর দেখতে পারলাম না। আমি দু’হাত দিয়ে আমার দু’চোখ ঢেকে নিলাম।
চলবে…