মূদ্রার এপিঠে কার্তিকের নয়া জার ওপিঠে কার্তিকের অভাব নিয়ে ছিল এই তল্লাটের মানুষের যাপন। কাল কার্তিকের যাপন।নানা বিশ্বাসের যাপন।যে কোন বিশ্বাসই সমাজের কার্যকারণ থেকে উদ্ভুত। বিকাশও পর্বে পর্বে।একেক তল্লাটে একেক ভাবে রূপায়িত হয় বিশ্বাসের আল্পনা।একাট্টা কোন রূপ নেই।লৌকিকতার নানা রূপ।নানা পার্বণ।
সেই পার্বণও সময়ের দাপটে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়।যেতে হয় সময়ের নিয়মে। সমাজ থেকে ওঠে আসা কার্যকারণও পাল্টে যায় সেই সাথে নানা বিশ্বাস। নানা রূপ।নানা কথকতা।কোন রূপই সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়। তবুও মানুষের স্মৃতিপুরাণের কথকতা চলতে থাকে।
প্রাণহীন সেই পুরাণের অপভ্রংশকে কেউ বলে কুসংস্কার। কেউ বলে বেহুদা। কেউ বলে বেদাত। আবার কেউবা ঘৃণার দলা ছুঁড়ে আঙুল দেখিয়ে বলে এগুলো শ্রাস্ত্রে নেই। পুরোহিত দর্পণে নেই কাজে কাজেই পরিত্যক্ত তাই বিধান।
আরও পড়ুন: গারো পাহাড়ের চিঠি: মনসা পুজা
ঝাঁকপ্রাণী মানুষ তবুও কোঠরে রাখা স্মৃতির রূপায়ণে কোন না কোন ভাবে লৌকিক পার্বণ পর্বে পর্বে পালন করে যায় ভূতপূর্ব সামাজিক যজ্ঞ। অভ্যাসের তাড়নায়।
নানা যজ্ঞই সারা বছর চলে। কথাই বলে না বার মাসে তের পার্বণ। তেমনি কার্তিকের পার্বণ নানা তল্লাটে নানা ভাবে পর্বে পর্বে আজো কোন না কোন রূপে আল্পনা আঁকতে দেখি। স্মৃতির বহমানতা দেখি।এই উত্তরাধিকার যৌথতার উত্তরাধিকার। একা একা যাপনে কোন সামাজিক স্মৃতি থাকে না। নিজেকে নিয়ে নিজে বাঁচার ভেতর যৌথসভার কোন স্মৃতি থাকে না। উলম্ব মানুষ কী আর আড়াআড়ির হাত বাড়ায়?
একবার বলেছিলাম তোমাকে কোন ছুটুছাটা এই উত্তর তল্লাটে বেড়িয়ে যাও। সময় তোমাকে সময় দিলো না– নাকি তোমার ইচ্ছার রূপায়ণ সময়ের ভেতরে এক্সকিশন করলে না সেটি এখনও বুঝি নি। মানুষের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা মনে ভেতর হঠাৎ ওড়ে আসার পেছনে থাকে নানা সম্পর্কের রসায়নের চাপ ও তাপ। হয় তো এই তল্লাটে আসার জন্য যে সম্পর্কের গণিতের সাথে যুক্ত হতে পারো নি। অথচ অবাক হয়ে ভাবি, এই উত্তর জনপদের গারো পাহাড়ের কথকতার জন্য তুমি উন্মুখ হয়ে থাকো।
যাক পুরাতন কাসুন্দি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। যতটুকু পারি এই তল্লাটের কথকতার স্মৃতি তোমারকে লিখে যেতে থাকি। তবু বলি সপ্রাণ উপস্থিতি যে কোন তল্লাটের স্মৃতিপুরাণ ও স্বপ্নের শাঁসটি অনুভব করার একমাত্র মাধ্যম।
কার্তিকের জার ও অভাবের ভেতরও মানুষের চোখ ছিল ভরা আমনের জমির দিকে। জমিতে ধানের ভারে ঝুকে পড়েছে ধানবতীর ছড়া। শীতের উষের প্রলেপ জমেছে ঘাসের ডগায়। ফ্যাকাশে চোখে ফুটে তখন উল্লসিত চোখ। বিস্ফারিত চোখই স্বপ্ন গড়ে মনে বনে কোনে। অভাব পালায় তখন।কাজের পরিসর ক্রমেই বাড়তে থাকে জমিতে জমিতে। পড়ে থাকা অলস শরীর নড়েচড়ে ওঠে। সূর্য ওঠার আগে সেই অন্ধকার বিহান বেলা নাকেমুখে পান্তাটুকু পেঁয়াজ মরিচ দাঁতে টুকে দে-ছুট জমির দিকে কাজের দিকে।
জার তখন অনেক দূরে কুঁড়েদের গায়ে গিলাব জড়িয়ে নাড়ার আগুনে গা উত্তাপ নেয়। কার্তিকের শেষই হাসিখুশি উল্লসিত দিন। উঠানভরা নয়াধানের গোছা। গরুর খাবারের জন্য সাংবাৎসরিক খড়ের বড় বড় পালা। কী সুন্দর গুম্বুজঅলা হলদে হয়ে যাওয়া খড়ের পালা!কৃষকের বাড়ির সৌন্দর্য এই পালা। তার ঐশ্বর্যের প্রতীকও বটে। খড়ের গুম্বুজ নির্মাণ এককটি আর্ট। একটি ক্রাপসমেন্টশিপ। সব কৃষকই পারে না। কেউ কেউ পাড়ে।
উঠানের কোণে ডেকচিতে ফোটে আমন। ধানের গন্ধ জানো তো একেক সময় একেক রকম। ধানের ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ নেবার নাক সবার থাকে না। কেউ কেউ বুক ভরে নিতে পারে নয়া ধানের নানা সৌরভ। আমি পারি না। জমি লগ্না কৃষক পারে। কৃষনী পারে।
একবার বীজতলায় দাঁড়িয়ে বুকভরে সৌরভ নিয়েছিলাম তুলশীমালার কিশলয় চারার। দারুণ সুবাস। দিন যত বাড়ে ততই সুবাস বাড়ে।
ধান পাকার গন্ধ তো বাতাসেই খবর ছড়িয়ে দেয়। সেটি পথ হারানো পথিকের মতো যে কেউ টের পায়। ধানা কাটে যখন আঁটি বাঁধে তখন আবার আরেক গন্ধ। আঁটির গোড়ায় ধরে যখন আছাড়িপিছাড়ি করে ধান মাড়ায় করে তখন ধুলার সাথে গন্ধবেলায়। এখন অবশ্য ধানমাড়াই মেশিন জমির আলে ঢুকে গেছে। মেশিনের শব্দে গন্ধ পালায় যেমন তেমন আঁটি বাঁধা খড়ও জড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যে কোন খড়কুটোর মতো এখানে সেখানে। সে খড়ে খড়ের ছাওনি দেয়া ঘর হয় না। অবশ্য খড়ের ঘর নির্মাণ এখন খুব একটা দেখা যায় না। সবই দুচলা চৌচালা টিনের ঘর। হাফবিল্ডিং।
করছিলাম গন্ধের আলাপ। রোদের তাপে আতপ চাল আর জলআগুন ভাপে হয়ে ওঠে সিদ্ধচাল। কোেনটা মোটা কোনটা চিকন। ঝাড়াই বাছাই আর নাড়ার আগুনে বড় বড় ডেকচিতে ভরা নয়া ধানের বলক যখন ওঠে তখন তো মাতাল করা গন্ধ।।ভাপ ওঠা ভেজা ধানের গন্ধ। লেপাপোছা উঠানে ধান ছড়ানো মেলানোর গন্ধ রোদের তাপে বাড়িময় ছড়ায়। আগুনের পাড়ে বসা নাড়া দিতে দিতে ঘর্মাক্ত গিন্নি শরীরের গন্ধের কথা নাই বা বলি। তার অমানুষিক পরিশ্রমেই সাংবাৎসরিক ঘরের চাল। ভাঁড়ারে রাখা নিত্য সিদ্ধচাল।
ক’দিন পরই নবান্ন।মুখরিত আমনের উঠান। সেই কবে ” সীতাসংহিতা” সিরিজে এমন এক উঠান নিয়ে লিখেছিলাম ‘ মলন’ কবিতাটি।১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় বইটি।এসো টুক করে কবিতাটি পড়ি কবির বরাতে।
মলন
“কে গো তুমি দু’হাত উড়িয়ে নাচাও কাচারিঘর
উঠান আমার বীরপুত্র
তোমার উত্তরীয়ের সখা
মলনে কী সুন্দর বিচ্ছেদে বাড়ে
বিষ্ণুপ্রিয়ার চালের ঘড়া
আর আমার উদলা ঘরের ছানি
নবান্ন এবার হবে গো সুজন
সকলে নাও আমার নিমন্ত্রণ”
নয়া চালের বলক ওঠা ভাতের নিমন্ত্রণ তোমাকে। যদিও তোমরা যে নবান্ন উৎসব চেন তা জমি থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের এক বিচিত্রা অনুষ্ঠান মাত্র। কর্পোরেটের আঁচড়ে আজকাল খুব চাউড় হয়েছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিজস্ব স্টোডিও থেকে লাইভ সম্প্রচারও করছে। তোমাদের শহরের নবান্ন উৎসব উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন জমির বাইরে গেরস্থের ঘরের বাইরে উৎসব। সেখানে হল্লা আছে সপ্রাণতা নেই।
এই সময়েই উঠে রব। বলা ভালো উঠত। কিংবা আরো সঠিক করে এখনো কোথাও কোথাও রব ওঠে। অভাব আর জারকে পরাজিত করে নবান্নের আহ্বান না। রব ওঠে ঋতুর পালাক্রমে যে দুর্ভোগ যন্ত্রণার নানা রোগ শোক নিয়ে আসে তা যৌথতার ভেতর থেকে নানা লৌকিক পালা আয়োজন করে। ঋতুর ভালোত্বের সাথে যে মন্দত্ব জড়িয়ে থাকে তার হাত থেকে মুক্তি পাবার হল্লা ওঠে।
কান ফাটানো হল্লা। যৌথতার হল্লা।চারদিকে আগুনের ফুলকি। নয়া নাড়ায় দপদপ করে আগুন জ্বলে জ্বলে ওঠছে।ভাঙা কেরোসিন টিনের ঝংঙ্কার।কাল কার্তিকের বিদায়;বেজে গেছে ঘন্টা।
“হৈ হৈ রৈ রৈ……
কার্তিক গেলে আগুন আইল।
পুৃটিমাছ দুয়ারে পড়ল।”
কোথাও আবার এই ভাবেও বলে–
” ভারা গেলো
ভুরা গেলো ।
বোঁচার কান
মশায় খাইলো। “
আবার কোথাও
“কার্তি গেল আগূন আইলো
কড়াকড়ির মাও দুয়ারো বইলো
মশা মাছির মুক পুরা গেল হই – হই – হ”
অথবা
“আকশো হা হা হা
পোকা মাকড় দূরত যা।
সগারে ধান টনেয়া মনেয়া,
হামার ধান কাঞ্চা সোনা।
ছোট নাঙলের বড়ো ঈশ
হামার ধানের বড়ো বড়ো শিষ”
অথবা
“ভালা আয়ে বুড়া যায়,
মশা মাছির মুখ পোড়া যায়।
আগুন আাইল
ওরে আগুন আইল”
কোথাও আড়া বোড়া নামেও ডাকে এই কার্তিকের সংক্রান্তির সন্ধ্যায় বেলার উৎসবকে। ঘরের দুয়ারে একটু আড়া বোড়া ছুয়ে গেলেই মঙ্গল। বালাই ষাট। কার্তিক গেছে।গেছে অভাব।
এবার নয়া ধানের নয়া মুখে হল্লা হৈ হৈ রৈ রৈ।যদিও যাপনে বাংলা মাস নেই –আছে জানুআরি ফেব্রুআরি… তবুও কার্তিক ও তার স্মৃতিপুরাণ আছে মানুষের শ্রুতিতে স্মৃতিতে।
“হৈ হৈ রৈ রৈ
কার্তিক গেল আগুন আইল
মরা দুয়ারে পুৃটিমাছ পড়ল।